বিশেষ রচনাঃ ইন্দ্রানী ঘোষ















বিশেষ রচনাঃ


নতুন দেখা
ইন্দ্রানী ঘোষ


আরেকটা বছর ঝরে পড়ল কালের সমুদ্রে। চৈত্রের শুরুতেই Macbeth এর tomorrow and tomorrow speech টা বড্ড মনে পড়ে, যা বলে Macbeth এর চরম উপলব্ধির কথা, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।একটা করে দিন চলে যায় কালের গর্ভে। ম্যাকবেথ কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল তাঁর আকাঙ্খা। তাঁর প্রচণ্ড ambition এর, পলতেয় আগুন ধরিয়েছিলেন স্বয়ং “লেডি ম্যাকবেথ’। শতাব্দী ধরে যাকে বলা হয় খলনায়িকা। আমাদের জন্য ভাগ করা নিজস্ব দুনিয়া। জয়ের সাথে পুরুষের যোগাযোগ। নারী প্রেরণার রূপ। জয়ের সাথে আছে আগ্রাসন, আছে পুরুষের অলঙ্কার অহং। ম্যাকবেথ নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুদ্ধে রত হন। যদিও তাঁর অন্তর তখন ক্ষতবিক্ষত। ওদিকে পাগলিনী লেডী ম্যাকবেথ প্রলাপ বকেন। বলেন, নেপচুনের সমুদ্রের সমস্ত জল তার হাতের রক্ত মুছতে পারবে না। ম্যাকবেথ পড়েন বিজয়টিকা। লেডী ম্যাকবেথের জন্য কিন্তু বিজয়শ্রী নেই, তাঁর জন্য আছে বিস্মৃতির অতল কালো নেপচুনের সমুদ্র । 

দিন গেছে রেনেসাঁর বয়েস হয়ে গেল প্রায় চার শতক। চারশোটা “নববর্ষ” পেরিয়ে গেল। দেখাটা একটু হলেও বদলেছে বৈ কি। আমরা অন্তরীক্ষে যাই, প্লেন চালাই,গবেষণা করি, ছবি আঁকি, সিনেমা বানাই, লিখি, সৃষ্টির আদি কাজও করি। খলনায়িকা একটু আধটু হই আজও, তবে সমঝে চলে মানসিক শিক্ষায় উজ্জ্বল পুরুষেরা। বাকীদের মানুষ বলেই গন্য করি না আমরা। কিছুদিন আগে একটা মনস্তাত্ত্বিক কর্মশালায় গিয়েছিলাম কর্মসূত্রে। আজকের পুরুষদের দাঁত নখ এভাবে বেড়িয়ে পড়ার কারণ খতিয়ে দেখালেন Dr Manjula Padmanabhan. বললেন Gender sensitization বা লিঙ্গ ভিত্তিক সচেতনতা বাড়ান বেশি দরকার। Dr padmanabhan একটি সুন্দর নাটক পড়লেন। নাটকের বিষয় অবশ্যই মেয়েদের যৌনতা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মনে করে মেয়েদের যৌনতা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার দরকার নেই। Rapist রা মনে করে মেয়েদের “না” বলা মানেই “হ্যাঁ” বলা। তারা মনে করে যে “লজ্জা” মেয়েদের অলঙ্কার। সেই লজ্জাকে সজোরে সরিয়ে দেবার অধিকার তারাই রাখে। নাটকের শেষে গানের একটি কলি শেষ কথা বলে গেল,”I’m more than my lady parts”. নারী চিহ্ন ছাড়াও আমাদের কিছু অস্তিত্ব আছে।একেবারে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গোঁড়ায় আঘাত হেনেছেন তিনি। এই সাহসী পদক্ষেপের সমর্থন দেখলাম অনেক পুরুষরা করলেন। দেখে বেশ ভালো লাগলো। 

এ প্রসঙ্গে আমাদের স্কুলের ছেলে বন্ধুদের কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। আমরা ছেলেদের সাথে সেই অবুঝ বয়েস থেকেই পড়াশোনা করেছি, খেলেছি। প্রকৃতিগত কিছু ‘ফারাক’ সেদিনও ছিল আজও আছে। রাগ, অনুরাগ, হেলাশ্রদ্ধা, স্পর্শকাতরতা সব মিলিয়ে এক অম্লমধুর সম্পর্ক আমাদের। কোন বান্ধবী হয়ত ফুটবল বা ক্রিকেট বিষয় কোন মন্তব্য করে ফেলেছে ,অমনি মন্তব্য উড়ে এসেছে “আঃ কি হয়েছে? তোরা আবার কি বলছিস?” মনে হত যেন তাঁর পেটে কামড় পরেছে। আমাদের একজন বান্ধবীর ক্রিকেট খেলার খুব সখ হয়েছিল ছেলে বন্ধুদের সাথে,তা তারা নেবে কেন? সেই সে বোঝে নি যে “We are from Venus ,they are from Mars”. football, cricket এসব ওদের কাজ। আমাদের কাজ দেখে যাওয়া। তবে হ্যাঁ, একটা কথা না বলে পারছি না আগের প্রজন্মের পুরুষদের সাথে আমাদের ছেলেদের অনেক তফাৎ তো নিশ্চয়ই আছে। আমাদের ছেলে বন্ধুরা টুনটুনি পাখীর

মতো তাদের ছানাদের খাইয়ে দেয়। মায়েরা আসতে পারেন না সবসময় ,বিদেশ থেকেও কেমন সুন্দর বাচ্চাদের ডানার নীচে নিয়ে উড়ে আসে বাবারা। প্রয়োজনে রান্না করে, চা ত করেই। বউ এর প্রশংসা করতে দ্বিধা করে না। এক বন্ধুর তিন বছরের মেয়ে তাঁর মায়ের গলা ধরে বায়না করলে আমাদের বন্ধু বলে “আমি ত আর সবার সামনে পারব না বায়না করতে”। সবার আড়ালে তাঁর বায়নাক্কার কি যে সামাল দিতে হয় তা না আলোচনা করাই ভালো। দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী আমাদের এক ডাক্তার বন্ধু বলে “আমি দুই খাণ্ডারনীর সঙ্গে থাকি, এক আমার ব্‌ দুই আমার মেয়ে” এই বন্ধুকে আমাদের আনটিরা পর্যন্ত কম নম্বর দিতে ভয় পেতেন। দুই নারী শক্তি এঁকে যে কি বাঁধনে বেধেছে, দেখে বড় আনন্দ পাই। এক বন্ধুর বউ আমাদের সাথে বেশ মিশে যায়, তাতে আমাদের বন্ধু বলে “আরে আমার বান্ধবীদের সাথে আমি স্পেস না পেলে আমি যাই কথায়?” বেশির ভাগ বন্ধু দেখি বউ এর রূপমুগ্ধ। অনেকে সঙ্গে করে আনে আড্ডাতে, অনেকে নয়, পাছে নজর লাগে। আবার যারা আনে তাঁরা একটা চোখের মনি এক কোণায় ঠেলে দিয়ে দেখে, কতজন তাঁর আদরের বউটিকে মাপছে। আরেকটি চোখের কোণ থাকে সুন্দরী বান্ধবীর দিকে। আর একজন বান্ধবী যে তাঁর দুটো চোখেরই খবর রাখছে তা সে বুঝতে পারে না । ‘men will be men after all’. আমরা বোকা থাকার অভিনয় শতাব্দী ধরে করে চলেছি আর মজা পাচ্ছি। আমাদের বন্ধুরা আমাদের কৈশোর কালের দুই বান্ধবীকে নিয়ে প্রায়ই আলোচনা করে থাকে বৌদের সামনেই। তাদের ছোট স্কার্ট,চুলে ঢেকে যাওয়া চোখ ,গোলাপি ঠোঁট, মসৃণ ত্বক ইত্যাদি নিয়ে। অন্য বান্ধবীদের মন রাখতে তারা বলে “আমরা তোদেরও দেখি”। ওরা না দেখলে যেন আমরা দুঃখে আকুল হচ্ছি। আমাদের বরেরা আমাদের আড্ডাতে আসে না তারা আমাদের ছেড়ে দেয়। এটাও একটা নতুন পাওয়া বটে। আমাদের স্বাধীনতা বেশ উপভোগ করি আমরা। তবে আমরা আমাদের স্কুলের এই বন্ধুদের কাছে সবচেয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করি। ছোট বেলায় বেশ ফিরতে পারি। এমন বন্ধু যেন আফগানিস্তান,পাকিস্তান,উত্তর ভারতে মেয়েরাও পায়। 

আমাদের শৈশব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় ওদের থেকে যায়। আমরা খলনায়িকা হয়ে থাকি বেশির ভাগ সময়, ওরা নিষ্পাপ শিশু। তবে দেখছি এতে ওরা একটু লজ্জা পাচ্ছে আজকাল। এই লজ্জাবোধ থাকলে আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত। আগামী নববর্ষের দিনগুলিতে যদিও জীবনের মোমবাতি একটু একটু করে গলবে। তবুও খানিকটা ভালবাসার আলো জ্বলবে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাস এর মত। লেডি ম্যাকবেথদের এর মাথাতেও একটু ভালবাসার ছোঁয়া লাগবে আশা করি।


3 মতামত: