মুক্ত গদ্যঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়













মুক্ত গদ্যঃ


শিকড়ে মাটির গন্ধ
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়



……… তারপর সত্যিই হরিচরণ কাকা একদিন গাছ হয়ে গেল । মাটির সাথে সংলগ্ন হয়ে থাকল তার পা দুটো । আস্ত শরীরটা রূপান্তরিত হল ডাল পালা ফুল ফলে । কাদা আর মাটির গন্ধে এক বনভূমি । একদম অচেনা অজানা জগত । তখন হরিকাকার কাছে যেতে ভয় পেতাম । আমার ছোটবোন শম্পা বলত –অসম্ভব । সাহস দিতাম শম্পাকে ।

- আমার ভীষণ ভয় করে দাদা ।

- ভয় কি , আমি তো আছি ।

- ভয় তো তোকে নিয়েই । তুই গাছ হয়ে গেলে কে আর আমার সাথে খেলবে বল ।

আমি মানতাম না সেসব কথা । সবাই কি গাছ হতে পারে ? মাটিতে মিশে যেতে পারে আমূল ? বাতাস থেকে বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ে বিনিময়ে ফিরিয়ে দিতে পারে প্রাণদায়ী অক্সিজেন ? সবাই নীলকণ্ঠ নয় ।

ভয় ও বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম শিমূল গাছটার দিকে । যখন ফুল ফলে ভরে উঠত মাঠ । যখন সৃজনের গন্ধে মশগুল হয়ে যেত মাটি । আমরা তাকিয়ে থাকতাম আকাশের দিকে – বোধ হয় বৃষ্টি শুরু হবে এবার । ছাতা খুঁজতে শুরু করতাম । আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ছাতা ছিলনা । দাদুর ছিঁড়ে যাওয়া হরিদাস পাল নিয়ে আমি আর শম্পা বেরিয়ে পড়তাম মাঠে । হৃৎস্পন্দনের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত পাতার মর্মর ধ্বনি । তোলপাড় করতে শুরু করতাম পুকুর ক্ষেত আর নদী । মাছ ধরতাম বিলে । নানা সাইজের নানা গন্ধের বিচিত্র সব মাছ । নাম ও জানতাম না সবার । ঘরে ফিরলে মায়ের হাতে বেদম পিটুনি ।

- কোথায় পেলি এসব ? পুকুর থেকে চুরি করেছিস ?

- না তো ।

- তবে ?

- বিশ্বাস করো মা, হরিকাকা দিয়েছে ।

- আবার ওখানে গেছলি ? কতবার তোদের নিষেধ করেছি ।

শুনতাম না মার নিষেধ । আবার আবার ছুটে যেতাম । দেখতে পেতাম হরিকাকা সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে বৃষ্টির জল মাখত গায়ে। শস্যের ভেতর থেকে কিভাবে জেগে ওঠে প্রাণ – পরীক্ষা নিরীক্ষা করত এইসব । আমরা চুপি চুপি দেখতাম ।

হরিকাকার ঘরটা ছিল অদ্ভুত । নানা জাতের গাছের চারায় ভর্তি । তার মাঝে ছোট এক খণ্ড নির্মল স্থান । গোবর আর মাটি মিশিয়ে আলপনা দেওয়া । বিড় বিড় করে কিসব বলে যেত । আপাত অর্থহীন সেই প্রলাপ ভেদ করে তার মর্মোদ্ধার করার ক্ষমতা সেদিন আমাদের ছিলনা । তবু মায়ের বারণ , শম্পার আবদার কে উপেক্ষা করে নিজের কৌতূহলের তাগিদে হরিকাকার কাছে এসেছিলাম একদিন । কথা বলতেই হবে । জানতে হবে সব রহস্য । 

বলেছিল- তোর গায়ে মাটির গন্ধ আছে । 

- কই না তো ।

- আছে , একদিন তুই অন্তত আমাকে ঠিক বুঝতে পারবি ।

আমি চারপাশে তাকিয়ে থাকি । মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে থাকি অসীম জিজ্ঞাসায় 

- এসব কী ?

- ধনরত্ন । একদিন তোকে সবকিছু দিয়ে যাব , সব ...।

তারপর ই সামনের গাছটার দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে – নাম জানিস ?

- না । মাথা নাড়ি আমি ।

- ঠাকুরদা । বিজ্ঞান সম্মত নাম একটা আছে । আমি তো অত শত জানিনা। পুরানো গাছ তো । ওই নামেই ডাকি ।

আমি দেখছিলাম পুরানো গাছটা । কত পুরানো জানিনা । জীবনের সুখ দুঃখ আহ্লাদ অতিক্রম করে স্থিতধী ।- 

- মনখারাপ হলে ওর সামনে এসে দাঁড়াস , হরিকাকা বলে চলে – সব ঠিক হয়ে যাবে ওর আশীর্বাদে ।

আমি বেশ বুঝতে পারি আমার মাথার উপর ছাতা ।এক নির্মল ছায়ায় ভরে আছে চারপাশ । অন্য একটি গাছের দিকে আঙুল বাড়াই – কি সুন্দর ! 

- ওর নাম সঙ্গীত । ওর পাতার কাছে কান পাতলে গান শুনতে পাবি ।

এইভাবে হরিকাকা আমাকে একটার পর একটা গাছ চিনিয়েছিল । দুটো শিমূল গাছের নাম কক্ষনো এক হতে পারেনা । তাদের চেনার জন্য ডাকার জন্য ভালোবাসার জন্য হরিকাকার রাখা নামগুলোতেই ওদের ডাকতাম ।

বৃক্ষের অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে । ভালোবাসার জোর। এ অধিকার নিয়েই তারা মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকে অনন্তকাল । কখনও ছেড়ে যায়না । তাই কারোর সাধ্য নেই গাছকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার । মাটির ভেতর হাজার মাইল শেকড় । সেখানেও প্রাণ চিহ্ন । ঘাতকের জন্যও রেখে দেয় ভালোবাসা , অক্সিজেন ।

হরিকাকার এই উন্মাদনা আমার খুব ভাল লাগত । ভূমির ভেতর থেকে কিভাবে জেগে ওঠে অঙ্কুর , তৈরি হয় সবুজ ? এইসব জিজ্ঞাসায় জারিত হলেই ছুটে আসতাম প্রিয় মানুষটির কাছে । বুঝে নিতাম সবকিছু । বর্ষার আর্দ্রতা মাখানো উদ্ভিদ থেকে খুঁজে নিতাম বৃষ্টিপাতের অক্ষর । তাদের পাতাগুলো দেখতাম । গাছগুলো ফিসফিস করত হাওয়ায় ।

- শুনতে পাচ্ছ আমাদের কথা ?

- হ্যাঁ ।

- এই হলুদ পাতা আমাদের স্মৃতিচিহ্ন । ব্যর্থতা ভেঙে পড়া আর স্বপ্ন দেখার স্মারক ।

- বুঝতে পারছি সব ।

- আমরাও বুঝতে পারছি । দেখতে পাচ্ছি তোমার রক্তপাত, ছায়া আর আলোর অক্ষর ।

মনখারাপ হলে গাছেদের বলতাম । ব্যক্তিগত পাপ আর মালিন্যের দাগ গুলিও মুছে দিত পরম মমতায় । মাথার উপর ঝরে পড়ত হাজার হাজার পাতা । যন্ত্রণা দুঃখ শূন্যতার অনুভূতি গাছেদের দীর্ঘশ্বাসের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত । আমি কাঁদতাম অবিকল হরিকাকার মত । গাছেরা বলত – কাঁদো , কাঁদো , কাঁদো । এর নাম বাষ্পমোচন ।

গরমের দিনে ছটফট করত তারা । তৃষ্ণায় অধীর হয়ে উঠত । এক অদৃশ্য লক্ষ্যে আর্তি পাঠাত – জল দাও , জল দাও । 

বর্ষার মেঘেরা জড়ো হত একসময় । মাঠ বৃষ্টিতে , মমতায় ।

হরিকাকা বলত – গভীরভাবে চাইলে সব পাওয়া যায় । আমিও তো তাই চেয়েছিলাম ।

- কি চেয়েছিলে তুমি ?

- গাছ হতে ।

- গাছ । বিস্ময়ে চমকে উঠি । তাহলে মায়ের কথা , শম্পার কথাই ঠিক ।

- তুইও তো তাই চেয়েছিস ।

- -আমি ?

- না হলে কেউ শহরের স্কুল ছেড়ে গাঁয়ের পাঠশালায় পড়ে ? 


দেখতে পাই মাথার উপর আকাশ । আকাশে উড়ছে চিল । ডানায় রোদের গন্ধ । নির্জন আকাশের মানচিত্রে রামধনু । বর্ণময় । আমার পায়ের নীচে মাটি । আমাকে টানতে থাকে কাদার দিকে । জন্মভূমি , আমার শাশ্বত বাসভূমি । সম্বিত ফিরতেই দেখি গাছের পাতারা ঝরে পড়ছে নিঃশব্দে । মাটির সোঁদা গন্ধ নিয়ে আমার চারপাশে সবুজ । আবাল্য পরিচিত গন্ধ – দুধের গন্ধ ।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন