ভ্রমন কাহিনী - তাপস নন্দী

পোখরা ভ্রমন
তাপস নন্দী



সে দিনটা বেশ মনে পড়ে, দিনটা ছিল জানুয়ারির প্রথম দিকে। সকালের দিকে পিঠে রোদ দিয়ে নিউজ পেপারটা বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ছি, শুনি সহজ পাঠের দুটো লাইন বিল্টু বলতে বলতে আসছে, ‘মনে মনে ভাবে ফুল উড়ে যাব কবে, / যেথা খুশি সেথা যাব ভারি মজা হবে’। ভাবছি এই লাইন দুটো কেন! নিশ্চয়ই ব্যাটা মনে মনে আবার নতুন কোনো ফন্দি এঁটে আসছে। এইত গত অক্টোবর মাসে বাবু উদয় হলেন অন্তরা চৌধুরির গান গাইতে গাইতে, ‘ও মাগো মা ময়না পাড়ার মেয়ে / নুতুন জামা ফ্রক পাওনি বুঝি চেয়ে’।

বুঝতে পারলাম আমার পকেট গ্যাঁড়াতে আসছে। এসেই বলল হাতে একদম সময় নেই বুঝলি, বসার কথা বলবি না। এখন কিছু মালকড়ি ছাড়ত দেখি, ন’পাড়ার বস্তির বাচ্চাগুলোর জন্য জামা কাপড় কিনতে যাব। অগত্যা কী আর করা, মানি পার্স থেকে কড়কড়ে কয়েকটা বার করে দিতে হল। যাওয়ার সময় বলে গেল ষষ্ঠীর সকালে ন’টার মধ্যে প্যান্ডেলে চলে আসবি, ওখানেই কথা হবে।

তাই ওর গান আবৃত্তি মানেই আমার পকেট খালি করার ফন্দি, এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তাই মনে মনে মা-কালীকে ডাকতে লাগলাম। একটু দেখ মা, এবার যেন আমার পকেট না কাটে। কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখি ব্যাটা আমার সামনে হাজির। বলল দাদা যদি অনুমতি দিস তো আমার কয়েকটা কথা নিবেদন আছে। আমি কোনো কথা না বলে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।

দাঁড়া পিসিকে আগে চায়ের কথা বলে আসি, তারপর জমিয়ে শুরু করছি। বলেই সে বাড়ির ভিতর দিকে অর্ন্তধান হল। আমি এদিকে কাগজ এক পাশে সরিয়ে রেখে ওর অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি মুর্ত্তিমান দুই হাতে দু’কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। আমার হাতে এক কাপ ধরিয়ে দিয়ে, নিজে মোড়া টেনে নিয়ে বসে চায়ে চুমুক দিল। আমি এদিকে খাব কি, কাপ ধরে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আর মনে মনে ভাবছি গলাটা ও কীভাবে কাটবে, জবাই করে না এক কোপে!

চায়ে কয়েকবার চুমুক দিয়ে ও বলল, “জানুয়ারি তো প্রায় এসেই গেল, এবার কোথাও ঘুরতে যাব না?” কথাটা শুনে ধড়ে প্রাণ এল। যাক এই যাত্রায় মনে হচ্ছে রক্ষা পেলাম। চা শেষ করে বললাম, “কোথাও একটা গেলেই হল। তুই একটা জায়গা ঠিক কর না, না হয় সেখানেই যাওয়া যাবে”। এর পরের কথাতেই বুঝতে পারলাম কথাটা বলে কি ভুল করে ফেলেছি। বলল, “ফরেন যাব”।

কথাটা শুনেই আমি থ! কথার ধাক্কায় আমি একেবারে মনুমেন্টের মাথা থেকে, ধপ করে মাটিতে এসে আছাড় খেয়ে পড়লাম। ঢোক গিলে তো তো করে বললাম, “হ্যারে মাথাটা ঠিক আছে তো? পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া ওই সব জায়গা যাওয়া যায়! আর তা ছাড়া এখন পাসপোর্ট করতে অনেক হ্যাপা, বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার”।

কথাটা শুনে বিল্টু একেবারে হই হই করে উঠল। বলল, “দাদা মনে হছে তোর মাথাটা একদম গেছে। কেন! পাসপোর্ট না থাকলে বুঝি যাওয়া যায় না? বলি নেপাল যাওয়ার জন্য কি ইন্ডিয়ানদের পাসপোর্ট লাগে”?

কথাটা শুনে একটু দমে গেলাম। সত্যিই তো, নেপালে যাওয়ার জন্য আমাদের, ভারতীয়দের কোনো পাসপোর্ট লাগে না। মনে মনে ব্যাটার প্রশংসা না করে থাকতে পারলাম না। বললাম, “সেটা ঠিক। কথাটা আমার একদম মনে ছিল না। এখন বল কবে যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করেছিস”।

“যাব্বাবা! আমি কি একা সব ঠিক করতে পারি? তোর মতামত নিতে হবে না। না কি ঠিকমত একটা itinerary (পরিকল্পনা) না করেই বেড়িয়ে পরব”?

বুঝলাম এই কথাটাও একটু বোকার মত হয়ে গেছে। বললাম, টেবিলের উপর থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে নেপালে সার্চ দিয়ে দেখ না একবার।

ও ল্যাপটপটা নিয়ে আমার পাশে বসে অন করে নেপালের ওয়েবসাইটে সার্চ দিল। ওমা! এ যে দেখি দারুণ বেড়াবার জায়গা। জায়গাগুলির প্লেস অফ ইনটারেস্ট সম্বন্ধে বিস্তারিত দেওয়া আছে। এরই সঙ্গে ইন্ডিয়ান কারেন্সি ও নেপালি কারেন্সির মধ্যে কত ডিফারেন্স সেটাও খুব পরিষ্কার করে দেওয়া আছে। সুতরাং টাকা পয়সার দিক থেকে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এবার ঠিক করতে হবে কী ভাবে যাব। কলকাতা থেকে যেতে গেলে দেখা গেল কাছাকাছি চারটে এনট্রান্স আছে নেপালে ঢোকার। বিহার দিয়ে ঢোকার দু’টো রাস্তা আছে, আর সিকিম এবং দার্জিলিং দিয়েও আছে একটা করে। ঠিক হল বিহারের রক্সৌল দিয়ে ঢুকব আর বেরোব সিকিমের কাঁকড়াভিটা হয়ে। ঐ সুযোগে সিকিমটাও হালকা ঘুরে নেওয়ার প্ল্যান ছিল আর কি।

দিনক্ষণও ঠিক করে নিলাম দু’জনে বসে। এরপর দুজনে মিলে এক দিন গেলাম নেপাল কনস্যুলেটের অফিসে নেপালের ট্যুর আপডেট আনতে। ওরা একটা সুপরামর্শ দিল। বলল নেপালের কোনো ATM-এ ইন্ডিয়ার কোনো ATM কার্ড access করা যাবে না। সুতরাং যা কিছু টাকা পয়সা আমাদের সঙ্গেই নিয়ে যেতে হবে।

যাইহোক ট্রেনের রিজার্ভেশনও ঠিক সময় মত করে ফেললাম। দেখতে দেখতে নির্দিষ্ট দিনও এসে গেল। মাভৈঃ বলে রুকস্যাক কাঁধে নিয়ে দুই ভাই স্টেশনের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলাম।

দুপুর ৩.৪৫ মিনিটের মিথিলা এক্সপ্রেস ঠিক সময়েই হাওড়া ছাড়ল। ঘর থেকে খেয়ে বেরিয়েছিলাম, তাই খাওয়ার কোনো তাড়া নেই। রাত্রের খাবার বিল্টু ভালো করে প্যাক করে নিয়ে এসেছিল, সুতরাং নিশ্চিন্ত হয়ে দু’জনে মিলে কালকের itinerary নিয়ে বসলাম। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই রক্সৌল পৌঁছে যাব, তারপর একটা টাঙ্গা ধরে বর্ডার পার হব। গল্পে গল্পে সময়টা সুন্দর পার করে রাত্রে সময়মত শুয়ে পড়লাম, সকাল সকাল উঠতে হবে। না হলে সব মাটি।

সকালে নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘন্টা দেরিতে ট্রেন ঢুকলো বিহারের রক্সৌল স্টেশনে। যথারীতি দুজনে রুকস্যাক কাঁধে নিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে একটা টাঙ্গা নিয়ে তাতে চড়ে বসলাম। স্টেশন থেকে বর্ডার এক কিলোমিটার। ঐ পারে বিরাটনগর।



বিরাটনগর বাস স্ট্যান্ড, রক্সৌল স্টেশন থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূর। বেশ অনেকটাই পথ। টাঙায় করে টুক টুক করে যেতে বেশ ভালোই লাগছিল। বর্ডারের প্রবেশদ্বারটা বেশ বড় আর উঁচু। প্রচুর লোকজন যাতায়াত করছে। টাঙ্গা, অটো, রিকশা, টেম্পো কি নেই, সব রকম যানই আছে। তবে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তা বেশ অপরিষ্কার।

ষ্টেশনের সামনে থেকে কন্ট্রাক্ট নেওয়া টাঙ্গাওয়ালাদের বিভ্রাটের জন্য, অন্য আর একটা টাঙ্গা নিয়ে প্রায় ঘন্টা দুই দেরিতে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। এসে শুনি প্রায় সব বাস ছেড়ে গেছে, শুধু একটাই সবেধন নীলমণি দাঁড়িয়ে আছে। এবং সেটাও মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ছেড়ে দেবে। আমাদের হাতে আর কোনো অপশান নেই। ওটাতেই চড়তে হলো। ওটাই ‘পোখরা’ যাওয়ার সেদিনের শেষ বাস। আমাদের প্রথম গন্তব্যও ‘পোখরা’।

যাই হোক টিকিট কেটে বসার সাথে সাথে বাস ছেড়ে দিল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাসস্ট্যান্ড ছেড়ে আসার পর থেকেই লক্ষ করলাম দ্রুত দৃশ্যপট বদলাতে লাগল। বাইরের দৃশ্য দেখে মনে হতে লাগল, যেন বইয়ের পাতা থেকে ছবিগুলি বেরিয়ে এসে চোখের সামনে নাচছে। সেসব ভাষায় প্রকাশ করার মত জ্ঞান আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে একদম নেই। তাই ওই দিকে মন না দিয়ে যে কাজ করছিলাম সেই কাজেই মন দিই। ‘পোখরা’ প্রায় ছ’ ঘন্টার রাস্তা। পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেল। প্রায় রাত ন’টার সময় ‘পোখরা’ এসে নামলাম। বাইরে ঘু্টঘুটে অন্ধকার, রাস্তায় একটাও আলো জ্বলছে না। বাস থেকে নামতেই হোটেলের দালালরা ছেঁকে ধরল। ওদের কোলাহলে কার সাধ্য বোঝে যে ওরা কী বলতে চায়। মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল যে, ‘পোখরা’ লেকের ধারেই রয়েছে বেশিরভাগ হোটেল। অন স্পট ঠিক করে নিলাম যে আমরা লেকের আশপাশেই থাকব। সেইমত একটা ট্যাক্সি নিয়ে এক দালালকে ধরে হোটেলে এসে উঠলাম।




সকালে উঠে জানতে পারলাম, যে সহৃদয় ব্যক্তি ওই অন্ধকার রাতে আমাদের পথ দেখিয়ে হোটেলে নিয়ে এসেছিলেন, তিনিই স্বয়ং এই হোটেলের মালিক। এদের ব্যবহার আমাদের সত্যিই মুগ্ধ করলো। এদের অতিথি বাৎসল্যের কোনো তুলনা হয় না। অন্তত আমি এর আগে পাইনি।

শুধু একটাই অসুবিধা সোলার হিটারের মাধ্যমে গরম জলের ব্যবস্থা। তাই একটু বেলায় গরম জল পাওয়া যায়। অগত্যা কী আর করা। মুখ ধুয়ে চা খেয়ে প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় পা দিয়েই চোখটা পুবদিকে আটকে গেল। হোটেলের ফাঁক দিয়ে দেখি তুষার ধবল এভারেস্ট উঁকি মারছে। দেখে চোখ সার্থক হয়ে গেল। এর জন্যই তো এত দূর আসা।

বিল্টু বলল “দাদা কী বুঝছিস! আমার প্রস্তাবটা কেমন হয়েছে এ বার বল”!

“সত্যি রে, এই এখানে আসাটা মনে হচ্ছে সার্থক হয়েছে। তোর জন্যই আজ এত সুন্দর একটা দেশ দেখতে পেলাম। চল এখন একটু লেকের আকারটা চাক্ষুষ করে আসি, পরে এসে এক্সপ্লোর করবো”।

দু’জনে গল্প করতে করতে রাস্তার নীচের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের এই রাস্তাটা একেবারে লেকের ধারে গিয়ে উঠেছে। আধ কিলোমিটার মত গেলেই লেক। সুতরাং পথ হারাবার কোনো প্রশ্ন নেই। আমরা নিশ্চিন্তে এগিয়ে চললাম। তখনও সব দোকানপাট খোলেনি। হাঁটতে হাঁটতে একটা চৌমাথায় এসে থামলাম। দেখি সামনের রাস্তাটা সোজা লেকের ধারে চলে গেছে। লেকের দু’দিক ঘিরে দোকানপাট, হোটেল সার দিয়ে আছে। আমরা সোজা নাক বরাবর এগিয়ে গেলাম, এবং লেকের ধারে পৌঁছেও গেলাম। গেট পেরিয়ে ভিতরে এসে ঢুকলাম। আহা কি দৃশ্য! দু’চোখ ভরে গেল। লেকের চারপাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা, দারুণ সুন্দর।



লেকের পাড়ের কাছে জলের উপর একটা view point করা আছে, আমরা ওখানে গিয়ে উঠলাম। ওখান থেকে লেকের বিস্তার দেখে বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে গেল, একদম বাকরূদ্ধ হয়ে গেলাম দু’জনে।



চোখের সামনে অগাধ জলরাশি, যার একূল ওকূল ঠিক মত দেখা যাচ্ছে না। দূরে পাহাড়ের সারি, যেন সার বেঁধে ঘিরে জলকেলির শোভা দেখছে। আমরা ক্ষুদ্র প্রাণী, এর অপার মহিমা দেখে মনের তৃষা ভরাচ্ছি আর ভাবছি, এই দেশটা দেখতে না এলে একটা খুব সুন্দর জায়গা দেখা থেকে বঞ্চিত থাকতাম।

আমরা ছিলাম middle Himalayan range-এ। এত উঁচুতে, এত বড়, বিস্তৃত লেক সবারই মন জয় করে নিয়েছে। এই সকালেও লেকের ধারে আনেক লোকের মেলা। লেকের নামেই এই শহরের নাম, সার্থকনামা।



চারিদিকের নয়নসুখ সুন্দরতা প্রাণভরে উপভোগ করছি, মুগ্ধ হয়ে চারদিকের শোভা দেখছি, এমন সময় বিল্টু বলল, ‘চল দাদা টিফিন করে এসে লেকে বোটিং করতে নেমে পড়ি’।

বললাম, ‘এখন বোটিং করতে নামলে অনেক বেলা হয়ে যাবে। তার চেয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে এসে বোটিং করলে, হাতে অনেক সময় পাওয়া যাবে, আবার অনেকটা ঘোরাও যাবে।

‘ঠিক আছে তাই হোক, দুপুরেই না হয় আসা যাবে। কিন্তু এক ঘন্টা বোটিং করিয়ে উঠিয়ে নেবে, তা কিন্তু হবে না। অন্তত দু’ ঘন্টা ঘোরাতে হবে’। বিল্টু বলে উঠল।

বললাম, ‘ঠিক আছে’।



যথারীতি দুটোর পর আমরা লেকের ধারে চলে এলাম। বোট ভাড়া নিয়ে জলে ভেসে পড়লাম। এখানে দেখলাম বোট মাঝি ও লাইফজ্যাকেট ছাড়া ভাড়া দেয় না। মাঝিকে নিয়েই বোটে চড়ে বসলাম।



নৌকো যত এগিয়ে চলেছে ততই দৃশ্যপট বদলাতে লাগলো। কোন দিক ছেড়ে কোন দিকে তাকাব বুঝে উঠতে পারছি না। যেদিকে তাকাই সেদিকেই চোখ আটকে যাচ্ছে। প্রকৃতির রূপের ছটা চারিদিকে যেন ঝুরঝুর করে ঝরে পরছে।



যত পার দু’চোখ ভরে আরামসে দেখে নাও, কেউ মানা করার নেই। বোটে‌র মাঝি আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। দেখলাম ও কলকাতার ফুটবল টিম সম্বন্ধে ভালোই ওয়াকিবহাল। গল্প করতে করতে আমরা এগিয়ে চললাম, এরই সঙ্গে দ্রুত পটও পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। ঠিক থই রাখা মুশকিল।

বিল্টু বলল, ‘দাদা এক দিনে সবটা দেখে ওঠা সম্ভব নয়। কাল আর একবার এলে হয় না?’

বললাম, ‘তাহলে পোখরাতেই থেকে যাই। বাকি পোগ্রাম গুলি বাদ দিয়ে দি? কী বলিস?’

শুনে বিল্টু বলল, ‘কাঠমাণ্ডু থাকা এক দিন কমিয়ে, এখানে এক দিন বাড়িয়ে নিলেই হল’।

বললাম, ‘কাল সকালেই বাস আসবে সাইট সিন দেখাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য,
সেটার কী হবে?’

শুনে একটু দমে গেল ও।

বললাম, ‘কাল নয় পরশু এখানে থাকব। বিকালের দিকে কাঠমাণ্ডুর বাসের টিকিট বুক করে নেব, কি বলিস?’
খুশির চোটে বলল ও, ‘ঠিক বলেছিস। এই না হলে আমার দাদা!’

যথারীতি ঘুরতে ঘুরতে আলো কমে আসছিল। বোটও ধীরে ধীরে পাড়ের দিকে ফিরতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে বোট ছেড়ে ডাঙায় এসে উঠলাম। পাড়ে উঠে কোমরের টান ছাড়িয়ে নিয়ে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। আজকের মত ঘোরা সাঙ্গ হল। কাল আবার নতুন দিকে যাত্রা।

সক্কাল বেলায় ডোর বেলে ঘুম ভাঙল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নীচে নেমে এলাম। দেখি বাস আমাদের নেওয়ার জন্য রাস্তার ধারে অপেক্ষা করছে। হুড়মুড় করে বাসে উঠে পড়লাম। বাস ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শহর ছেড়ে বাস গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলল। উঁচু নীচু পাহাড়ি রাস্তায়, বাস বেশ জোরেই চলেছে। দু’ একটা ছোট ছোট জনপদ ছাড়িয়ে বাস একটা পার্কের পাশে এসে দাড়াল। এখানে নামতে হবে। নামলআম। এখানে ‘ব্যাট কেভ’ দেখতে হবে।

আমি ভাইকে বললাম, ‘হ্যারে চামচিকে দেখার জন্য গুহায় ঢোকার কোনো দরকার আছে? ওখানে আমাদের বাড়িতেই তো অনেক দেখা যায়। এখানে পয়সা খরচ করে চামচিকে দেখার কোনো মানে হয় না’।

ও বলল, ‘দেখ দাদা আমরা যদি পয়সা খরচ করে চামচিকে না দেখি, তাহলে ওদেরই বা চলবে কী করে। আমরা ঘুরতে এসেছি যখন, ওদের কথাটাও তো একটু ভাবতে হবে!’

কথা না বাড়িয়ে টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। টিকিট কাটার সময় দেখলাম ‘ফরেনার’-দের সঙ্গে আমাদের টিকিটের দামের অনেক ফারাক।

পার্কের পাশ দিয়ে গুহায় ঢোকার রাস্তা নেমে গেছে। টিকিট ম্যান হাতে একটা টর্চ ধরিয়ে দিয়ে বলল এটা নীচে দরকার হবে, নিয়ে যান। টর্চটা হাতে নিয়ে বেশ অনেকটা নীচে নামার পর গুহার মুখ দেখা গেল। ভিতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। টর্চ জ্বেলে কুঁজো হয়ে ঢুকলাম। বেশ কিছুটা রাস্তা হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে, অবশেষে একটা জায়গা পেলাম মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার।



ভাগ্যিস টর্চটা সঙ্গে দিয়ে ছিল, না হলে এতক্ষণে হাত পা না ভাঙলেও নির্ঘাত মচকাত। ভিতরে দাঁড়িয়ে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পেরে বাঁচলাম। বিল্টুকে বললাম, ‘আর এরকম জায়গায় আসতে বলিস না’।

ও কোনো কথা না বলে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। বলল, ‘চামচিকে কই রে দাদা?’

পাশ থেকে এক জন হিন্দিতে বলল, ‘উপরে তাকান’।

আলো ফেললাম উপরে ছাদের দিকে। দেখি অনেক চামচিকে ছাদ থেকে ঝুলছে। বেশ অনেকগুলো, প্রায় শ’খানেক, তিরতির করে কাঁপছে। অন্ধকার ও ছায়ায় সবাইকে কেমন যেন লাগছিল। ওই অন্ধকার বদ্ধ জায়গায় কেমন একটা অশরীরি গন্ধ। ওই অন্ধকারের ভইতর ভূতের দেখা না হলেও, ব্যাটের দেখা হয়ে গেল।

এবার বেরিয়ে আসার পালা। ধীরে ধীরে সবাই আমরা বাইরে বেরিয়ে এসে আবার বাসে চাপলাম। এবারের গন্তব্য স্থল ‘মহেন্দ্র কেভ’। পথের শোভা দেখতে দেখতে আরও একটা পার্কের পাশে এসে বাস দাড়াল। মনে মনে ভাবলাম যাক একটা হলেও হিস্টোরিক্যাল প্লেস দেখা যাবে। কিন্তু তখনি মনে একটা খটকা লাগল। ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হ্যারে যুবরাজ মহেন্দ্র নেপালে এসে ছিল?’

ও বলল, ‘দাদা আমি ইতিহাসে পাতিহাস ছিলাম, তাই বলতে পারব না’।



এগিয়ে গেলাম গেটের দিকে। টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়ে পার্কের ভিতরে ঢুকলাম। ফুলের বাগানটা বেশ সুন্দর। বাগানের পিছন দিকে কেভে নামার রাস্তা। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। এখানে ভিতরে আলোর ব্যবস্থা আছে।

কিন্তু ও হরি! এখানে কোথায় কী? কোথায় মহেন্দ্র? এ যে দেখি এক পুরোহিত গণেশ সাজিয়ে পুজো করছে। কি আর করা, নামের মাহাত্যে ধোঁকা খেয়ে গেলাম। ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দিয়ে কপালে টিকা লাগিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

এখানের পার্কটা বেশ সুন্দর করে ফুল বাগিচায় সাজান। সেই ফুলের বাগিচা দেখে কিছুটা সময় কাটালাম। সময় হয়ে আসছে দেখে পার্ক থেকে বেরিয়ে বাসের কাছে এসে দেখি বাস ফাঁকা।



কেউ কোথাও নেই। ব্যাপার কি? খোঁজ নিয়ে দেখি সবাই মধ্যাহ্ন ভোজনে বসেছে। আমরাও যোগ দিলাম।

সবাই বাসে ওঠার পর বাস ছাড়লো। এর পরের ডেস্টিনেশান কোনো এক অখ্যাত লেক। খানিক গিয়ে বাস একটা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়াল। আমরা বাস থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়লাম। দেখি সামনেই এক পাহাড় দৃষ্টি আড়াল করে দাঁড়িয়ে। কোথায় সেই লেক? আমরা সবাই এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। ভাবছি কোন দিকে যাব। ড্রাইভার বলল, ‘সামনের দিকে একটু এগিয়ে যান, লেক দেখতে পাবেন’।






আমরা সবাই হেঁটে লেকের পাশে এসে দাঁড়ালাম।

সামনেই সুদূর জলরাশি, বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এই বিস্তীর্ণ জলরাশি একূল ওকূল ছাপিয়ে পাহাড়ের এক খাঁজের মধ্যে ঢুকে বিলীন হয়ে গেছে। শান্ত স্থির এই জলরাশি খুবই মনোমুগ্ধকর।

সুদূর প্রান্তের ওই সুউচ্চ পাহাড় শ্রেণি এই বিশাল জলরাশিকে দুই হাত দিয়ে ঘিরে রেখে, এর শোভা বৃদ্ধি করেছে। অপূর্ব এর সিনিক বিউটি। ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব, ফলে সেই ধৃষ্টতা আমি দেখাবোও না।



এই লেক পোখরার মত বিশাল নয়। তবে বেশ বড় এবং নিরিবিলি। লোক এখানে খুব বেশি নেই। বোধহয় শহরের থেকে অনেক দূরে বলেই এখানে সেরকম লোক সমাগম হয় না। বড় শান্ত, মিষ্টি পরিবেশ। এই শান্ত নীরবতা বেশ উপভোগ্য।

এখানেও বোটিং-এর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু হাতে খুব বেশি সময় নেই, তাই আর জলে নামা হল না। পাড়ের ধারে ধারে ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। তার পর বাসের কাছে ফিরে এলাম।



ড্রাইভার আমাদের সবাইকে তুলে বাস ছেড়ে দিল। সন্ধ্যা নামার আগেই আমাদের ফিরিয়ে এনে পোখরা লেকের ধারে নামিয়ে দিল বাস। কিউরিও শপগুলির উইন্ডো শপিং করতে করতে হোটেলে ফিরে এলাম।

পরের দিন সকালে উঠে টিফিন করে শহরটা দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। একটা পাবলিক বাস ধরে শহরের প্রাণকেন্দ্রে এসে নামলাম। রোদ ঝলমল করছে চারদিক, নির্মল আকাশ, হইহট্টগোলহীন শান্ত পরিবেশ। বেশ লাগছে। হঠাৎ পুবদিকে চোখ পড়তেই চোখ আকাশের শেষ প্রান্তে আটকিয়ে গেল। আহা কি দৃশ্য!



চোখ জুড়িয়ে গেল। এই দৃশ্য দেখার জন্যই না এত দূর আসা। এতদিন ছবিতে এভারেস্টের রূপ দেখেছি, আর আজ সেই এভারেস্ট একদম আমার চোখের সামনে হাজির, প্রোজ্জ্বল। ধবলগিরির ধবল চূড়ায় রোদের আলো পড়ে ঠিকরে যাচ্ছে। দেখে মনে হছে যেন এক খণ্ড বিরাট শাদা হিরে সারা আকাশ জুড়ে তার অত্যাশ্চর্য্য দ্যুতি ছড়াছে। ওহ্‌ কি মনোমুগ্ধকর বিস্ময় সৃষ্টিকারী দৃশ্য। দেখে প্রাণ ভরে উঠল কানায় কানায়। এ সব লিখে বোঝানো যায় না, এ একান্ত উপলব্ধির।



যাক অদ্যই পোখরায় আমাদের শেষ রজনী। কাল সকালেই সুন্দরী পোখরা থেকে বিদায় নেব। আর এখানে আসা হবে কি না কে জানে। হোটেলে ফিরে মালিককে বললাম আমাদের দুটো কাঠমাণ্ডু যাবার টিকিটের ব্যবস্থা করে দিতে। ওঁকে সেই মত টিকিটের দাম ও হোটেলের পাওনাগন্ডা সব মিটিয়ে দিলাম।

রাত্রে ওরা আমাদের স্পেশাল মিল খাওয়াল। খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পরলাম। খুব সকালে উঠে বাস ধরতে হবে পরের দিন।

খুব ভোরে উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। চা খেয়ে নীচে নেমে দেখি ট্যাক্সি গেটের সামনে দাড়িয়ে আছে। হোটেলের সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। গন্তব্য বাস স্ট্যান্ড।

বাস স্ট্যান্ড দেখে, চোখ ট্যারা হয়ে যাবার অবস্থা। বিশাল স্ট্যান্ড, সব লাক্সারি এসি বাস। এখান থেকেই নেপালের বিভিন্ন দিকে বাস ছাড়ে। এখন আমরা যাচ্ছি শিব ঠাকুরের দেশ কাঠমাণ্ডু। ওটা আবার আরেক গল্প। সময় পেলে আবার না হয় বসব গল্পের ঝাঁপি নিয়ে।

আপাতত টা টা বাই বাই।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন