ছোটগল্প - অরুণ চট্টোপাধ্যায়



আন্নাকালির সাহস
অরুণ চট্টোপাধ্যায়

আনারকলি সেন । আদরের নাতনির জন্যে দাদু এই নামটাই বেছেছিল । ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা বস্তাপচা এমন নামটা নিয়ে এমনিতেই খুব বিরক্ত ছিল আনারকলি । ইতিহাসে পড়েছে এই সুন্দরীর জীবন ছিল বড় করুণ । শাহজাদার প্রেমিকা হওয়ায় সম্রাটের আদেশে এক পাথরের দেওয়াল তার অবশিষ্ট জীবনের সমস্ত আলো আর বাতাস কেড়ে নিয়েছিল ।
আনারকলি ভেবেছিল যদি সে কোনোদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে তবে সংসদে একটা বিল আনবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ তার মেয়ের নাম যেন আনারকলি না রাখে ।
তার  বিড়ম্বনা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বন্ধু-বান্ধব আর কাছের লোকেরা নামটা আরও ছোট করে নিয়ে ডাকত আন্নাকালি বলে। খুব ঘনিষ্ঠরা আন্না, আন্নাদি, আন্নামাসি, আন্নাবৌদি এইসব ।
আনারকলি ওরফে আন্নাকালির শিক্ষা, জ্ঞান, বুদ্ধি বা অন্য ভাল ভাল গুণের ঘাটতি ছিল না । খুব ভাল গাইতে পারত, এমনকি নাচতেও । কিন্তু ছিল না তার সাহস । ভূতের ভয়টা তার ছেলেবেলা থেকেই । তাছাড়া চোর ডাকাত, গুন্ডা এসবের ভয় তো আছেই । ছোটবেলায় খুব মোটাসোটা লোককে দেখলেই সে তাকে ভাবত ডাকাত বা ছেলেধরা। দেখা মাত্রই পিলে তার চমকে যেত । কোনও কালো মোটাসোটা মানুষের উস্কোখুস্কো চুল আর কপালে লাল টিপ দেখলে ভাবত কাপালিক বলে । ছেলেবেলায় বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা সে বহুবার পড়েছিল । কারণ এটা যেমন ছিল রোমান্টিক তেমনই একটা থ্রিলার বটে । আবার ট্র্যাজেডি ভাবাও অন্যায় নয়।
সেই থেকে কাপালিকদের সে খুব ভয় করত । ওরা নাকি নরবলি দেয় হাড়িকাঠে ফেলে, চকচকে খাঁড়া দিয়ে । নিরীহ মানুষগুলোর রক্তে ভেসে যায় সারা ঘর ।
নবকুমারকে সে খুব পছন্দ করত । আর ভাবত আহা কোনও নবকুমার যদি রাস্তা ভুল করে তাদের গলিতে ঢুকে পড়ে তো সে জিজ্ঞেস করবে, পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ ?
যত সে বড় হয়েছে তার মনের ভয়ও বড় হয়েছে পাল্লা দিয়ে । আর এখন তো রোগা-প্যাঁটকা ছেলে দেখলেই ভাবে ছিঁচকে চোর আর না হয় ছিনতাইকারি । প্রথমে লেডিজ কম্পার্টমেন্টে, আর পরে লেডিজ স্পেশালে স্কুল কলেজ অফিস যাবার সময়ও কোনও রোগা চেহারার হকার দেখলেই তার বুক এমনভাবে ঢিবঢিব করত যেন হৃৎপিণ্ডটা এখুনি খুলে পড়ে যাবে। তার মনে হত এ একটা ছদ্মবেশী চোর কি পকেটমার । হাতে আঙুলের কোন ফাঁকে একটা ব্লেড গুঁজে রেখেছে তা কেউ জানে না ।
সেদিন অফিসের এক কলিগ নন্দিনী গল্পটা তাকে বলছিল । গল্প ঠিক নয় । গল্পের মত করে বলা সত্যি কাহিনী । নন্দিনীর একটা ছেলে আছে । বছর সাতেক মাত্র বয়েস । নন্দিনী অফিস থেকে বাড়ী ফেরে সাড়ে পাঁচটা বা পৌনে ছটায় । কত্তা আসতে আসতে সেই আটটা । ছেলের কাছে একটা চাবি দিয়ে দিয়েছে নন্দিনী । ছেলে ইস্কুল থেকে ফিরে কেন আর বসে থাকে রাস্তায় ? চারটের সময় সে ফিরে আসে তারপর আর কোথাও যায় না বাড়িতে বসে কম্পিউটারে গেম খেলে।

নন্দিনী ভাবে এ এক রকম মন্দের ভাল । বাইরে খেলার হাঙ্গামা বড় । নানান বিদকুটে ছেলের সঙ্গে কোনদিন কি ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে পড়বে তার থেকে বাড়িতে বসে বসে এই ভাল । তাছাড়া বাড়িটা পাহারা দেওয়াও হবে। আজকাল যা ঝামেলা হচ্ছে চারিদিকে বাবা !
শীত পড়ার মুখে । নভেম্বর মাস । সূর্যদেবের শীত করে বলে তিনি আগেই ঘুমোতে চলে যান । রাস্তায় একটু অন্ধকার অন্ধকার । নন্দিনী এসে কলিং বেল টিপবে কি হঠাৎ তার মনে হল দরজাটা একটু ভেজানো মাত্র । ছিটকিনি নেই ।
দরজা কখনও খোলা রাখে না ছেলে সুকান্ত । মায়ের কড়া নির্দেশ সে মেনে চলে অক্ষরে অক্ষরে । তাই এখন ভাবল ভেতরে ঢুকেই ছেলেটাকে একটা কড়া করে ধমক লাগাতেই হবে । কিন্তু ভেতরে এত খুটখাট কেন ? তাছাড়া কম্পিউটার গেমের আওয়াজই বা কই ?
- সু । বলে মৃদু একটা আওয়াজ তুলে দরজা ঠেলে ঢুকেছিল নন্দিনী । আর অমনি চোরটা পেছনে কোথা থেকে এসে পিঠে একটা পাতলা ছুরি ঠেকিয়েছিল, টুঁ আওয়াজ করবি তো গলার নলি একেবারে
মুহূর্তে চকচকে ছুরিটা পিঠ থেকে একেবারে তার কণ্ঠনালীর কাছে । একটু খানি নড়লে বা নিশ্বাস একটু জোরে নিলেই ভবলীলা একেবারে সাঙ্গ ।
তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে সব লুঠ করে নিল ছেলেটা । সঙ্গের অফিস ব্যাগটায় ভরল তার ছেলের মোবাইল, কটা আইপড, কতগুলো ইলেক্ট্রনিক ক্যালকুলেটর, নন্দিনীর কটা দুল-ফুল এসব গয়না । যেগুলো নন্দিনীর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার-ফয়ারে থাকে আর কি । বুদ্ধিমান চোর । এমন জিনিস বেছেছে যেগুলো ওজনে আর আয়তনে হালকা কিন্তু দামে দারুণ ভারি ।
সারাক্ষণটা নন্দিনীর কাজ ছিল চুপ করে শুধু দেখে যাওয়া । বলতে গেলে একটা থ্রিলার দেখা দুর্ভাগ্যক্রমে যার নায়িকা সে নিজেই । দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করা ছিল । নন্দিনীর ভয় হচ্ছিল এরপর তার শরীরটাই না দাবি করে বসে ছেলেটা ।






সেটা অবশ্য সে করল না । বুদ্ধিমান আর সতর্ক চোর । ঝামেলায় জড়াতে চায় না । যাবার সময় শুধু নন্দিনীর কাছ থেকে নিয়ে গেল তার গলার হার আর কানের দুল । আর পার্সটা । চেয়েই নিল অবশ্য । চাইল বেশ ভদ্র ভাষাতেই ।
- দাও তো দিদি এগুলো । লক্ষ্মী দিদি আমার । তোমার চাকরি আছে, বরের চাকরি আছে । অনেক করে নিতে পারবে । কিন্তু আমার তো চাকরি নেই ।  দাও দিদি কটা মাস একটু আরামে কাটাই । তারপর আবার –
নন্দিনীর মনে হচ্ছিল ঠাস করে একটা বিলিতি চড় (মানে বিলিতি স্টাইলে আর কি) মারে ছেলেটার দুই গালে । কিন্তু মনের ইচ্ছেটা মনেই ঘুরপাক খেতে লাগল । কারণ সে যদি সামান্য ঘুরপাকও খায় তো গলার নলি দু টুকরো ।
ছেলেটা বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলেই যাচ্ছে, তারপর দেখি তোমার আবার এমন কিছু মালদার বন্ধু বান্ধবীর দেখা যদি পাই –
নন্দিনী আর কি করবে ভেবে পায় না । প্রাণের থেকে কি ঐ গয়নাপাতির দাম বেশি হতে পারে ? অতএব -
যাবার সময় ছেলেটা আবার একবার সাবধান করল, আমি ঐ মোড় পর্যন্ত যাবার আগে তুই গলায় আওয়াজ বার করবি কি
হাতের ছুরিটা চকিতে ছুঁড়ে দিল পনের ফুট দূরের ডাইনিং টেবিলে। সেটা টেবিলে বিঁধে গেল । সেটা নিয়ে ব্যাগে ভরে ছেলেটা বলল, হাতের টিপটা তো নিজের চোখেই দেখলি ? এমন কি বাইরের রাস্তা থেকে ছুঁড়লেও বুকে বিধে যাবে অন্তত দু ইঞ্চি । আর ওতেই যথেষ্ট ।
এরপর একটা ভারি সুন্দর আর নিরীহ দৃশ্য । সবাই দেখল সেই সন্ধ্যায় নন্দিনীর বাড়ী থেকে বেরোল একটা সুদর্শন ছেলে হাতে ফোলিও ব্যাগ । সবাই ভাবল নন্দিনীর কোনও অফিস কলিগ । অনেকে আবার দেখল বেশ মন দিয়ে । আর মনে মনে বলল, বাঃ ভারি সুন্দর দেখতে তো ভদ্রলোককে।
 গল্পটা শোনা ইস্তক বুকের ঢিব ঢিবানিটা আরও বেড়েছে আন্নাকালির । তার হাজব্যান্ডেরও তো ফিরতে দেরি হয় । নিজেও তো ফেরে সাতটা । ছেলেটা একা থাকে । তাও নন্দিনীর ছেলের মত চালাক চতুর নয় তত। নিতান্তই গোবরগণেশ মার্কা । কম্পিউটার গেমস খেলতেও ভয় পায় কারণ ওর ভেতরেও ভূতপেত্নী দত্যিদানো কত কিছু থাকে । তাছাড়া কম্পিউটারে থাকে ভাইরাস বলে একটা জিনিস । জিনিসটা নাকি খুব মারাত্মক যে তাড়ালেও যায় না । সকলের মুখেই শুনেছে ।
শুধু রোগ নয়, মাঝে মাঝে বিপদ জিনিসটাও বেশ সংক্রামক হয় । নন্দিনীর বিপদ একদিন আন্নাকালির বাড়িতেও হানা দিল । সেদিন অবশ্য আন্নাকালি আর ওর ছেলের ছুটি ছিল । তার বরের নয় ।
আন্নাকালি একটু ও পাড়ায় গিয়েছিল । মহিমাদির সঙ্গে অনেকদিন গল্প করা হয় নি । পেট ফুলে আইঢাই । অফিস আর নানান কাজের চাপে ব্যস্ত দুজনেই ।
আজ যখন একটু সুযোগ মিলেছে তো কাজে লাগিয়ে দেওয়া যাক । ফিরে এসে দেখে ছেলে ছুটতে ছুটতে নিজেদের বাড়ির দিকে আসছে । নিশ্চয় এদিক ওদিক কোথাও গিয়েছিল । ভীষণ বুক ঢিব ঢিব করছে আন্নাকালির । দরজাটা ঠেলতেই কিন্তু খুলে গেল ।


চোখ পাকিয়ে ছেলের দিকে তাকাল সে । দৃষ্টিতে কৈফিয়ত তলব ।
- বেশি দূর নয় মা । এই তো বলাইদের বাড়ি গিয়েছিলাম । দু’মিনিটও হয়নি ।
খানিকটা ভয় কাটলেও পুরো ভয় কাটল না । বলল, এই সুযোগে কেউ বাড়ির ভেতর ঢুকে যেতে পারে এ জানিস না ক্যাবলারাম ?
মনে মনে বলল, না কেউ ঢোকেনি । বলাইদের বাড়ি বেশি দূরে নয় । ছেলেকে বেশি না বকাই ভাল ।
দরজাটা নির্বাধায় খুলে গেল । কিন্তু ভেতর থেকে খুট খুট আওয়াজ আসছে কেন ? হ্যাঁ, হ্যাঁ দুটো বেড়াল থাকে বটে বাড়িতে । ছেলে পুষেছে আর সে সঙ্গ দেয় । যত যাই হোক ছেলে-অন্ত প্রাণ যে ।
ওরা রান্নাঘরে মাছ আর ভাঁড়ার ঘরে ইঁদুর খুঁজেই চলে নিরন্তর । খুট খাট খটাস খটাস আওয়াজ তো লেগেই আছে । কত পলায়মান টিকটিকি ওদের হাতে পড়ে লেজ হারিয়ে লজ্জায় আর ডাকে নি কট কট করে কতদিন । কত পতঙ্গের ওপর মাতঙ্গের মত যখন তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা নিশিদিন । তাই শব্দ তো হতেই পারে এ বাড়িতে ।
- আমি ভেতরে গিয়ে আলো জ্বালছি মা । ছেলেটা দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। এখানেই দাঁড়িয়ে রইল আন্নাকালি । ছেলেটাকে বারণ করার সময়ও পেল না বেচারি । মনকে অবশ্য প্রবোধ দিয়েই যাচ্ছে যে কোনও বিপদ নেই ভেতরে। ছেলে আর সে বেশ নিরাপদ ।
এখানে বলে রাখা ভাল এখন কিন্তু সে আর আন্নাকালি নয়। এফিডেভিট করে সুপর্ণা হয়েছে । ছোট করে পর্ণা বলে ডাকতেও বলেছে সবাইকে । কিন্তু সে নাম ধরে কেউই ডাকে না বলতে গেলে । আসলে মানুষ অভ্যাসের যে বড় ভক্ত
ছেলে গেল তো গেল আর আসে না । কয়েকবার ডাকে সাড়া না পেয়ে এগোল আন্নাকালি ভেতর দিকে । হঠাৎ ছেলের চিল-চিৎকার ভেতর থেকে, চোর চোর ! মা চোর !! সব চুরি করে নিচ্ছে 
আন্নাকালির বুকের ধড়াস ধড়াস আওয়াজটা এমন বেড়ে গেল যে সে নিজেই শুনতে পাচ্ছিল । কি হবে এখন ? বাচ্চা ছেলেটা যে ঐ চোরের খপ্পরে ? ওদের হাতে কত কি থাকে । নন্দিনীর চোরটার হাতে ছিল ছুরি । এর হাতে না জানি কি  
একবার ভাবল বাইরে বেরিয়ে লোক ডাকে । পরক্ষণেই মনে হল তার ছেলে যে এখন চোরের খপ্পরে । লোক ডাকলে যদি তার কোনও ক্ষতি হয়?দ্রুত ঢুকে গেল ভেতরে । একটা রোগা প্যাঁটকা স্যান্ডো গেঞ্জি পরা আঠার কুড়ির ছেলে । চুরির মালপত্র তখন একটা ব্যাগে গোছাচ্ছিল সবে । সুপর্ণা ওরফে আন্নাকালির ছেলে বাধা দেওয়ায় তাকে আটকে রেখেছে । 
তার ছেলে চোরের খপ্পরে ! হে ভগবান এখন কি হবে ? না না, ছেলেটাকে তো বাঁচাতেই হবে । হঠাৎ যেন কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল ।  ঝট করে তার হৃৎপিণ্ডের ঝটপটানি কমে গেল । ভয়ের বদলে এল একটা প্রচণ্ড রাগ আর ঘৃণা । একটা বাচ্চা ছেলের ওপর জোর ফলান ওঃ কত বড় বীরপুরুষ রে আমার !
 দৌড়ে এল একেবারে শতাব্দী এক্সপ্রেসের বেগে । এদের হাত কখনও ধরতে নেই । পালাবার সুবিধের জন্যে এরা হাতে তেল মাখে । মনোজ বসুর নিশিকুটুম্বের তিন খন্ড কতবার সে পড়েছে । সজোরে গিয়ে ধরল ছেলেটার স্যন্ডো গেঞ্জিটার সামনের দিকটা । আর ঝটিতে টেনে আনতে চাইল দরজার দিকে ।



ছেলেটাও বেশ ঘাবড়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে । মুখে কিন্তু তড়পাচ্ছে, এই ছাড়ো বলছি । নইলে ব্লেড মেরে দেব । এই দেখ ব্লেড ।
হাতের মুঠোর মধ্যে কোন ফাঁকে একটা ব্লেড আছে কি নেই সেটা খোঁজার সময় নেই আন্নাকালির । তার মাথায় এখন চিন্তা চোরটাকে টানতে টানতে নিয়ে দরজার সামনে যাওয়া । ওর খপ্পরে তার বাচ্চা ছেলে ভাবা যায় ?
কে যেন দিল তার রোগা শরীরে হাতির বল । এবার তার ছেলেও হাত লাগিয়েছে চোর-বিতাড়নে । মায়ের সাহসে বেড়ে গেছে তারও সাহস ।
মা টানছে গেঞ্জির গলা ধরে আর ছেলে পেছন থেকে দিচ্ছে ঠেলা । ঠিক যেন একটা গরুকে গলার দড়ি ধরে গোয়াল ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জোর করে ।
দুজনে মিলে ওকে বার করে একেবারে বাড়ির বাইরে রাস্তায় । দু একটা লোকের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে যেন । বেশ একটু স্বস্তি আন্নাকালির। অন্ততঃ বিপদ অতটা আর নেই বলেই মনে হয় ।
এখানটায় একটু শান বাঁধানো । কিছুদিন আগেও একটা কল ছিল পৌরসভার । এখন সেটা শিফট করে অন্য দিকে নিয়ে গেছে । কাঠামোটা রয়ে গেছে । আন্নাকালি টানতে টানতে ছেলেটাকে আছড়ে ফেলল সেই শানের ওপর । কদিন আগেই বৃষ্টি হয়েছিল । জায়গাটা বেশ পেছল । আন্নাকালি পিছলে যেতেই চোরটা গেঞ্জি ছাড়িয়ে পগার পার ।
আশপাশের লোকগুলো ততক্ষণে দর্শক হয়ে মজা দেখছে । চোরটা পালাতেই তারা বেশ সক্রিয় হয়ে উঠল । চোর পালাতে তাদের বুদ্ধিও বেশ বেড়ে গেছে বোঝা গেল । জিজ্ঞেস করতে লাগল নানা কথা যেন চোর সে নিজেই । আবার সহানুভূতি আর প্রশংসার বন্যা বইতেই রেগে মেগে শতাব্দীর বেগে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল আন্নাকালি । ধড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজাটা ।
চোরটা পালাতে তার যে কত আক্ষেপ হচ্ছে ভেবে পাচ্ছে না । আর অতগুলো লোক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু মজা দেখল । অথচ ওরা একটু ছোটাছুটি করলেই চোর কিন্তু ধরা পড়ত। 
একজন বলেছিল, পালিয়েছে ? যাক বাঁচা গেছে । ধরা পড়লেই তো থানা পুলিশ কোর্ট-কাছারি, সাক্ষী-সাবুদ । বাবা বিস্তর হাঙ্গামা ।
লোকটার যেন ঘাম দিয়ে ম্যালেরিয়ার জ্বর ছাড়ল এমন মনে হল ।
আর একজন বলল, ক আর করবেন দিদি । খুব ছেলেমানুষ । দেখছেন তো চাকরির এই অবস্থা । পার্টির ক্যাডার না হলে কি আর চাকরি জোটে ? দেখে মনে হল ছেলেটার যা চেহারা ঝান্ডা মান্ডা কিছুই তুলতে পারবে না বেচারা । হাড় একেবারে জির জির করছে ।
রাগে গা একেবারে রি রি করছে আন্নাকালির । ছি ছি এরাই নাকি আবার খবরের কাগজে অসুস্থ লোকের রাস্তার পাশে পড়ে থাকা আর পাশ দিয়ে লোক চলে যাওয়ার খবরের সমালোচনা করে । বলে, এ আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের সূচনা । ভাবতে ঘেন্না হয় এই সমাজে আমরাও বাস করি ।

যেন সমাজ নামের ঐ একটা কিছুর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিলেই আমার দোষ ক্ষালন । এই সব লোক ! ছিঃ !
বন্ধ দরজার এপাশে ছেলেটা সাহস ফিরে পেয়েছে এবার । মাকে বলল, মা তুমি যে বল চোরকে তোমার এত ভয় তা এত সাহস হঠাৎ পেলে কি করে?
মুখে সামান্য হাসি ফুটল আন্নাকালির । সেটা গর্বের । কিন্তু তার পরই সেটা মিলিয়ে গেল । দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়ল কান্নায়, তুই-ই যে আমার শক্তি বাবা । তুই-ই যে আমার সাহস । তোকে হারাতে হবে এই ভাবনাই আমাকে সাহস জুগিয়েছে । তুই সঙ্গে না থাকলে ক যে হত তা জানি না ।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন