ধারাবাহিক - নারায়ণ রায়


আমার না বলা কথা
নারায়ণ রায়

(১)


ঠিক ৪৩ বছর আগের কথা, দিনটা ছিল  পয়লা এপ্রিল, শনিবার আর সালটা ছিল ১৯৭২, আমি তখন ঝাড়গ্রামে। এমন চৈত্রের ভরা বসন্ত কালে শাল, পিয়াল, মহুয়া ও ইউক্যালিপটাসে ঢাকা ঝাড়গ্রামের আবহাওয়া বড়ই মনোরম। তখনও শহরটা এমন পূনর্বয়স্কা হয়নি, সে ছিল নিতান্তই এক কিশোরী। স্টেশন থেকে যে কোন দিকে আধ কিলোমিটার গেলেই শহর শেষ। আমিও তখন নব্য যু্বক, সেদিন আমরা তিন বন্ধু তিনটে সাইকেল নিয়ে শহরটা দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে কোর্টের সামনে দিয়ে জেলখানাকে বাঁ হাতে রেখে, ডান দিকে সোজা একেবারে এসডিও বাংলোর সামনে দিয়ে, হাসপাতালের ভিতর দিয়ে বিনোদমঞ্জরী স্কুল হয়ে, রঘুনাথপুরের মধ্য দিয়ে আবার স্টেশন।
আমাদের তিন জনের মধ্যে যখন প্রতিযোগিতাটা বেশ জমে উঠেছে......আমি প্রথম, অজয় দ্বিতীয় আর মোটকু সমীর হাঁপাতে হাঁপাতে তৃতীয়, ঠিক তখনই আমার পাশের বাড়ির ছেলে পিন্টু আমাকে দেখতে পেয়েই চিৎকার করে বলল, “তুই শিগগির বাড়ি যা তোর বাবা তোকে ডাকছেন।আমি ভয় পেয়ে সাইকেল থামাতেই অজয় বলল, “দুর বোকা জানিস না আজ পয়লা এপ্রিল।আমিও তাই পল্টুর কথাকে আর পাত্তা না দিয়ে আমরা আবার রেস শুরু করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমাদের পাড়ার এক পুলিশ অফিসার কাকু আমাকে দেখতে পেয়েই একই কথা বলায় আমি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। একজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ অফিসার নিশ্চই আমার সঙ্গে রসিকতা করবেন না, আমাদের বাড়িটা ছিল ঝাড়গ্রাম থানার ঠিক পাশেই তাই থানার অনেক পুলিশ কাকুরাই আমাকে চিনতেন।
অগত্যা সাইকেল ঘুরিয়ে দুরু দুরু বক্ষে বাড়ির দিকে রাওনা হলাম। সাইকেলে মাত্র তিন-চার মিনিটের পথ। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দূর থেকে দেখতে পেলাম বাবা হাসি হাসি মুখে একটা বাদামী রঙ্গের লম্বা খাম হাতে নিয়ে আমাকে দেখাচ্ছেন। সেদিন শনিবার, পয়লা এপ্রিল ১৯৭২, আমার জীবনের প্রথম চাকরীর নিয়োগ পত্রটি পেয়েছিলাম। আর তেসরা এপ্রিল সোমবার ৬, এস, এন, ব্যানার্জ্জী রোডে কলকাতা পৌরসভার একজন সাব-এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরীতে যোগদান করি। সেদিনের সেই মফঃস্বলের হাঁদা ভোঁদা ছেলেটির সেদিন থেকেই এই কলকাতা বাস শুরু...... তারপর বহু উত্থান - পতনের পর আজ অবসর প্রাপ্ত একজন বৃদ্ধ।

ছোট বেলা থেকেই আমার ডাক টিকিট সংগ্রহ ও পেনফ্রেন্ডশিপের হবি ছিল সেইজন্য বাড়িতে আমার নামে প্রায় প্রতিদিনই দেশ বিদেশ থেকে চিঠি পত্র আসত। তাই আমার নামে বাড়িতে রং বে-রঙ্গের চিঠি আসাটা খুব-ই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কিন্তু আজ এই বয়সে এসে পিছন ফিরে তাকালে মনে হয় ১৯৭২ সালের পয়লা এপ্রিল, একটিমাত্র সরকারী চিঠি আমার জীবনে যে অনির্বচনীয় আনন্দের সঞ্চার ঘটিয়েছিল, তেমন আনন্দ আমার এই দীর্ঘ জীবনে আর কোনদিন ফিরে পেলাম না।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি কথা খুব মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলেছেন বিবাহের প্রথম রাত্রিতে যে রাগিনীতে বংশীধ্বনি হয় সে রাগিনী চিরদিনের জন্য নহে.........।আবার সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষও এক জায়গায় লিখেছেন লোকে বলে এক মাঘে শীত যায় না, আমার কিন্তু এক মাঘেই শীত গিয়েছিল, এমনই এক মাঘ মাসে আমার বিবাহ হয়েছিল, তেমন মাঘ আর এই জীবনে ফিরে পেলাম কই?” ঠিক একই ভাবে আমার জীবনেও তেমন পয়লা এপ্রিল আর ফিরে এল কই?
জন্মগত ভাবেই এক এক জন মানুষের এক একটা চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য থাকে, আমার মধ্যে উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশটা খুব কম। একদিকে অন্তরে বহমান আনন্দের ফল্গুধারা আর অন্যদিকে শত আনন্দের মধ্যেও সেদিন এটুকু বুঝেছিলাম যে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে এবার থেকে আমার দায়িত্ব পালন শুরু আর বাবা মায়ের কাছ থেকে ভালবাসা ছাড়া আর পাওয়ার কিছু নেই।
অন্যদিকে অন্তরে, মন যেন আপনা থেকেই একটার পর একটা রঙ্গীন স্বপ্নের জাল বুনে চলেছে একে চৈত্রমাস, ঝাড়গ্রাম শহরে দিকে দিকে শাল, পিয়াল, মহুয়া আর ইউক্যালিপ্টাসের মন মাতাল করা গন্ধ, আর তার উপর আবার পাড়ায় পাড়ায় গাছে গাছে পাকা কাজু ফলের সুবাস...... তবুও তখনো পর্যন্ত আমার সর্বনাশ দেখার মত এক জোড়া চোখের সন্ধান আমি পাইনি। তেমন যদি কারো দেখা পেতাম তাহলে পরবর্তী প্রতিটা পয়লা এপ্রিলে আমি তার কাছে হাজার বার করে সব কিছু হারাতে রাজী ছিলাম। কারণ পয়লা এপ্রিল ১৯৭২ আমার যা পাবার তা তো পেয়েই গেছি।
তখন মোবাইল তো দুর অস্ত, গোটা ঝাড়্গ্রাম শহরে তখন ব্যক্তিগত টেলিফোন ছিল বোধ হয় মাত্র ৩/৪ জনের বাড়িতে। কিন্তু দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে’, বন্ধুরা একে একে অভিনন্দন জানাতে আস্তে শুরু করেছে, পরে ভালো করে খাওয়ানো হবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আগত সবাইকে চা বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করা হল।

বাড়িতে সবাই মিলে বসে ঠিক করা হল যে পরদিন ২রা এপ্রিল রবিবারেই কলকাতা যাওয়া হবে, যাতে করে সোমবার ৩রা এপ্রিল সকালেই চাকরীতে যোগদান করা যায়। কলকাতায় এর আগে বেশ কয়েকবার গেছি, প্রধান প্রধান রাস্তাঘাট মোটামুটি চিনি কিন্তু থাকবো কোথায়? কলকাতায় তো আমাদের তেমন কেউ নেই যার বাড়িতে গিয়ে অন্তত ২-১সপ্তাহ থাকা যায়? অবশেষে বাবার এক সহকর্মী সব সমস্যার সমাধান করলেনতিনি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন এবং এক সময় তিনি নিজে শিয়ালদা বৌবাজার মোড়ে একটা হোটেল-এ বেশ কিছুদিন ছিলেন ওখানে মাসকাবারি থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আশেপাশে আর-ও অনেক হোটেল বা মেস আছে তাই তার বিশ্বাস একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ।
রাত্রে কিছুতেই ঘুম আসছে না, মন ও শরীরের ভিতরে ভিতরে কি যেন একটা ঘটে চলেছে। আমার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না যে, এই আমি, যে কিনা লেখাপড়ায় একেবারে অতি সাধারন বলতে যা বোঝায় তাই......। উচ্চ মাধ্যমিকে ফল এতটাই খারাপ হয়েছিল যে কোন কলেজেই অনার্স পাইনি, তাই এক বছর বি এসসি (পাশ) পড়েও ছেড়ে দিয়ে বাধ্য হয়েই পলিটেকনিকে ভর্তি হয়েছিলাম। সেই আমি কিনা এই চব্বিশ বছর বয়সে আগামি পরশু থেকে একজন জুনিয়র অফিসার হিসেবে জীবন শুরু করব? আমার অধীনেও অনেকে কাজ করবে? তারা অনেকে আমাকে স্যার বলবে? আস্তে আস্তে স্মৃতির সরনী বেয়ে চলে যাই আরও অনেক পিছনে......
                                                                                            …… ক্রমশ
                                                                     


1 মতামত: