চিলেকোঠা সরগরম

এই সংখ্যার বিষয়ঃ
VIRTUAL RELATION-এ আবেগ আছে, স্থায়িত্ব নেই


[ এই বিতর্ক বিভাগের সমস্ত মতামত সম্পূর্ণ ভাবে অংশগ্রহণকারীদের নিজস্ব, তা চিলেকোঠা ওয়েবজিনের মতামত নয় ]


পক্ষেঃ

১. শ্রীরূপা চ্যাটার্জী

VIRTUAL RELATION এ আবেগ আছে স্থায়িত্ব নেই ' আমি সম্পূর্ণ ভাবে এই মতটির পক্ষে। VIRTUALজগতে আমরা যখন এক জনের সাথে আলাপ করি, তখন আমরা জানতেই পারিনা সেই মানুষটা আসলে কেমন, কী করে, এমনকি সে নারী না পুরুষ এবং তাঁর সঠিক বয়স, সঠিক পরিচয়ও আমরা জানতে পারিনা, শুধুমাত্র তাঁর কথার উপর বিশ্বাস করে আবেগে ভেসে গিয়ে আমরা একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করি, অনেক সময়ই দেখা যায় একটা মিথ্যার উপর নির্ভর করে একটা নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি করতে গিয়ে আমরা আমাদের জগত সংসার ভুলে, এমনকি পাশের বাড়ির বন্ধুকে ভুলে, সেই virtual জগতের বন্ধুর কথাই ভাবতে থাকি। তারপর যখন কোনভাবে আসল সত্যিটা সামনে চলে আসে, তখন শুধুই কষ্ট পেতে হয়। আবেগে ভেসে গিয়ে আমরা তার বিনিময়ে শুধু চোখের জলই পেয়ে থাকি। তাই এই বন্ধুত্বে স্থায়িত্ব থাকেনা। যতক্ষণ না আমারা তার সামনে মুখোমুখি হচ্ছি, তার সাথে নিজের মত বিনিময় করছি, ততক্ষণ আমরা জানতেই পারিনা আসল মানুষটাকে। তাই বন্ধুত্বে স্থায়িত্ব পেতে গেলে মানুষটার সাথে সামনাসামনি পরিচয়টা খুব জরুরি। আর সেই জন্যই বোধহয় আমরা virtual বন্ধুদের সাথেও বাস্তবে দেখা করি, তাদের সাথে নিজেদের সুখ দুঃখও আদান প্রদান করি, সম্পর্কটাকে একটা স্থায়িত্ব দিতে চাই।





২. বৃষ্টি ব্যানার্জী

মাননীয় বিচারকমণ্ডলী ও বিপক্ষের বন্ধুরা,

Virtual Relation-এ আবেগ আছে, স্থায়িত্ব নেই, এই মত আমি সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করি। Motion-এর দুটি ভাগ – Virtual Relation-এ আবেগ ও স্থায়িত্ব। প্রথমে আবেগের কথা ধরা যাক। প্রকাশ যেমনই হোক, মানুষ মাত্রেই আবেগ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেকটা মানুষ আজ সামনের দিকে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটছে। নিজের সঙ্গে কথা বলার সময়ও এখন অপ্রতুল। ছুট্‌-ছুট্‌-ছুট্‌ -- সঙ্গী শুধু নিজের passion আর খানিকটা আবেগ, এক মুহূর্তও দাঁড়াবার সময় নেই। আর ঠিক এখানেই আসে স্থায়িত্বের প্রসঙ্গ।

চলমান এই শতাব্দীতে এসে তো স্বায়িত্ব শব্দটার Definition-ই বদলে গেছে। স্থায়িত্ব বলতে আমাদের আগের Generation-এর মানুষজন যা বোঝেন, আমাদের কাছে তার অন্য মানে। কারুর সঙ্গে ছ’মাস Relation থাকলেই মনে হয় সে অনেক দিনের চেনা। আসলে কোনো কিছু নিয়ে অনেকক্ষণ বা অনেকদিন ধরে ভাবার সময়ই আমাদের আর নেই।

ভারতে Virtual Relation সংক্রান্ত সমস্যার ইতিহাস বড়োজোর ৪/৫ বছরের পুরনো। তাই বিষয়টি যদি আমাদের আগের Generation-এর দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিশ্লেষণ করি, তাহলে তো মাত্র ৪/৫ বছরের Relation Finally Stability পাবে কিনা, সেটা বিচারেরই সময় এখনও আসে নি, তাই না?

Virtual World আমাদের রুদ্ধশ্বাস দৈনন্দিন জীবনে মুক্তির জানালা। মুহূর্তে পৃথিবী আমার ১৫ ইঞ্চি screenবন্দী। নিভৃত অবসরে আবেগ তাড়িত হয়ে বিভিন্ন রকম Relation-এ জড়িয়ে পড়ি আমরা। বেশীরভাগ সময়ই মোহভঙ্গ হয়, কষ্ট পাই। কিন্তু তবুও সত্যটাকে মর্মে মর্মে জানি বলেই মেনে নিই অত্যন্ত সহজে। দুদিনের মনখারাপ, কিন্তু সেটা নিয়ে বসে থাকার সময় কোথায়? তাই আবার এগিয়ে চলা, চলতে চলতে আবার কারোর সঙ্গে দেখা হওয়া, কিছু ভালো মুহূর্ত তার সঙ্গে share করা। মনে মনে কিন্তু তৈরী থাকা, স্বীকার করি বা না করি। আসলে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে, আমরা মেনে নিয়েছি।

Virtual Relation আমাদের Practical Life-এ Secondary Choice। Virtual World-এ শুরু হওয়া Relation তখনই Stability পায়, যখন সেটা Real Life-এ Introduced হয়। আর তখন Relationটা আর Virtual থাকেই না। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে, But exception proves the rule only, তাই না? So, Virtual Relation আর Stability একসঙ্গে যায়ই না, এই নিয়ে কোনও তর্কই নেই।



৩. শ্রীশুভ্র


ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কে আবেগ তো থাকবেই! কারণ আবেগের সূত্রেই আমরা অপরিচয়ের গণ্ডী পেরিয়ে পরস্পরের কাছে এসে পৌঁছোই! সে কাছে আসা শারীরীক নৈকট্যের প্রচলিত ধারণার দূরবর্তী হলেও মন মানসিকতা মমতায় হৃদয়বৃত্তির নিকটবর্তী হতে তো বাধা নেই কোনো! কিন্তু তাই বলে ভারচ্যুয়াল সম্পর্ক থেকে স্থায়িত্ব আশা করাটা অনেকটাই সোনার পাথরবাটির মতোই কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কি হতে পারে? সবচেয়ে বড়ো কথা যে সামাজিক অন্তর্জাল ব্যবস্থাকে মাধ্যম করে এই ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের গ্রন্থনা, সেটি কিন্তু বিজ্ঞানের নবীনতম আবিষ্কার! যার বয়স এক দশকের বেশী নয়! তাহলেই বোঝা যায়, এই ব্যবস্থার দৌলতে গড়ে ওঠা সম্পর্কগুলির এখনও শৈশব দশাই ঘোচেনি! তাই না!

তাহলেই দেখা যাচ্ছে মাত্র দশ বছরের সময়সীমায় গড়ে ওঠা এই যে ভার্চ্যুয়াল জগতের সম্পর্কের বিন্যাস, তাতেই স্থায়ীত্বের সীমানা নির্ধারণ করা অনেকটাই গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল গোছের! এদিকে ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের আবেগ নিয়ে যারা স্থায়ীত্বের সুখস্বপ্নে বিভোর, অচিরেই জীবন বাস্তবতার কঠিন ভূমিতে আছাড় খেয়ে তাদের স্বপ্নভগ্নের অভিজ্ঞতায়, ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের আবেগের ক্ষণস্থায়ীত্ব তাঁদের উপলব্ধিতে ধরা পড়ে! এটাই ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের বৈশিষ্ট! আবেগ আসে ঢেউয়ের মতো! যত দ্রুত তার উত্থান ততধিক দ্রুতই তার পতন! এটাই স্বাভাবিক! একটা সম্পর্কের স্থায়ীত্ব নির্ভর করে যে যে বিষয়গুলির উপর, ভার্চুয়্যাল জগতের অলিন্দে সেগুলি কোথায়?

যে কোনো সম্পর্কের স্থায়ীত্বে পারস্পরিক দায়িত্ব কর্তব্য মায়া মমতার যে ভূমিকা থাকে, ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের আলগা পরিসরে সেইগুলির অভাবই এই সম্পর্কের স্থায়ীত্বের পক্ষে প্রধানতম অন্তরায়! যে সম্পর্ক মাউসের একটা দুটো ক্লিকেই আনফ্রণ্ড থেকে ব্লকের সলিল সমাধিতে সমাধিস্ত করা যায়, সে সম্পর্কের ভবিষ্যত নিয়ে আর যাই হোক স্থায়ীত্বের গর্ব করা যায় না! তাই আবেগের আতিশয্যকেই যারা স্থায়ীত্বের নিশ্চয়তা বলে পরামানন্দে বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তাদের প্রজ্ঞা সম্বন্ধে যথেষ্ঠই সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়! তাই বন্ধু, আবেগের ছোঁয়ায় ভার্চ্যুয়াল সম্পর্ক উপভোগ করুন; কিন্তু স্থায়ীত্বের কুহক মায়ায় নিজেকে প্রলোভিত করে ঠকাবেন না!


৪. নারায়ণ রায়

সেদিন পটাইবাবুর সাথে দেখা, মুখ দেখে মনে হ’ল বেশ দুঃশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। পটাইবাবুর মুখখানি এমন রোদে পোড়া আমসির মত কেন, একথা শুধাতেই পটাইবাবু বললেন, “আর বলবেন না, ক’দিন ধরে মাঝে মধ্যেই মনটা কেমন যেন উচাটন হয়ে উঠছে।” কিন্তু এর কারণটা কি? একথা জিগ্যেস করতেই তিনি বললেন, “এই মধুমাধবে থেকে থেকেই আমার এক বাল্যবন্ধুর কথা মনে পড়ছে।” আমি বললাম, “এ তো খুবই স্বাভাবিক, আমারও এমন হয়, তখন আমরা যেকোন একজন আরেকজনের বাড়ি চলে যাই আর সারাদিন ধরে গল্প গুজব হাসি মশকরা করে মনকে শান্ত করি, আমাদের দুজনের ঘরনীরাও পরস্পরের সঙ্গে বেশ ঘনিস্ঠ হয়ে উঠেছেন, আমরা এখন পরস্পরের খুব ভালো ফ্যামিলি ফ্রেন্ড যাকে বলে তাই, আপনিও তাই করুন।” এ কথা শুনে আমি যেন অবিবেচকের মত কিছু একটা বলে ফেলেছি এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আরে দুর মশাই! সে কি করে সম্ভব? তিনি একজন দক্ষিন ভারতীয় মহিলা নাম ‘মধুজা’ কেরলে থাকেন, একসময়ে আমার পত্রবন্ধু ছিলেন, সম্প্রতি অনেক চেষ্টা করে এটুকু খবর যোগাড় করেছি যে বর্তমানে স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে দিল্লিতে সুখে সংসার করছেন, আর তাঁর স্বামীতো ব্যাপারটা জানেনই না।” আমি বললাম, “তাহলে তো এই সম্পর্ক আপনার ভূলে যাওয়াই উচিৎ,” একথা শুনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে পটাইবাবু বললেন, “সেটাইতো পারছি না, এমন আবেগ-তাড়িত সস্পর্ক যে যতই ভূলে থাকার চেষ্টা করি ততই মনে পড়ে যায়, সেই সুগন্ধী রঙ্গীন খামে ভরা কত মিষ্টি মিষ্টি কথা, কত রঙ্গীন ছবি! আমরা তখন ‘শয়নে স্বপনে কিবা জাগরনে’ একজন অপরের জন্য নিবেদিত।” আমি বললাম “সত্যি আপনাদের প্রেম ধন্য, আপনার কথা শুনে আমার লায়লা-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট এদের কথা মনে পড়ে যায়,” একথা বলার পর আমি আবার একটি অবিবেচকর মত কথা বলে ফেলি, “আচ্ছা পটাইবাবু, আপনি বরং আপনার ঐ মধুজাকে ভোলার জন্য বর্তমানে আবার কোন সোস্যাল মিডিয়াতে আপনার মনের মত একজনের সঙ্গে বন্ধু্ত্ব করুন।” এবার একটু মুচকি হেসে পটাইবাবু বললেন, “আপনাকে চুপি চুপি বলছি যে, সেটাও আমি করেছি এবং এক নয় একাধিক। সম্প্রতি তো একজনকে সঙ্গে নিয়ে পুরী পর্যন্ত ঘুরে এলাম।” একথা শুনে আমি বলি “তাহলে আর চিন্তা নেই, যাকে সঙ্গে নিয়ে পুরী পর্যন্ত ঘুরে এসেছেন বাকী জীবনটাও তাকে নিশ্চই স্থায়ি ভাবেই সঙ্গে পাবেন।” এরপর পটাই বাবু বড়ই বিষন্ন বদনে বললেন, “না না ঘন্টুরানী এখন তার সংসার নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পরেছেন যে তাকে আর অন লাইনে পাওয়াই যায় না।” এরপর হটাৎ পটাইবাবু কেমন যেন দার্শনিক হয়ে গেলেন, বললেন “জানেন রায়বাবু, জীবনে এসব অনেক করলাম, পত্রবন্ধু, টেলিফোনে বন্ধু কিম্বা সোস্যাল মিডিয়ায় বন্ধুত্ব…. একটা কথা সার বুঝেছি যে এইসব মিডিয়ার মাধ্যমে দুজনের যোগাযোগ হতেই পারে, এমন কি ঘনিষ্ঠতাও হতে পারে আর তখন যদি দুজনেই Single হয় এবং বিয়ে করা সম্ভব হয় তাহলে বিয়ে করে বাকী জীবনটা সুখী হতেই পারে, কিন্তু শুধু এই ধরনের virtual relation এর জীবন কখনো স্থায়ী হতে পারে না।” একথা বলতে বলতে পটাইবাবু এতটাই ভেঙ্গে পরলেন যে তাঁকে আর বেশী ঘাটাতে ইচ্ছা করল না এবং আমি বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি ফেরা ইস্তক আমার সামনে পটাইবাবুর বিষন্ন মুখটা ভেসে উঠতে থাকলো। হটাৎ কি ইচ্ছা হ’ল ডিকশনারীটা হাতে নিয়ে দেখতে চাইলাম virtual শব্দটির অর্থ কি? দেখলাম Oxford Dictionary দুটো অর্থ দিয়েছে (1) Almost or nearly the thing described, but not completely (2) ‘Computing’ not existing in reality but made by software to appear to do so. আমার মনে হয় এই দ্বিতীয় অর্থটাই আমাদের বিতর্কের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে যথেষ্ঠ অর্থাৎ যা real বা বাস্তবই নয় তা স্থায়ী হবে কি করে?



৫. রুমনি সেন


-চিত্রলেখা?
-বলো সুইট হার্ট
-আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। আই লাভ ইউ
-মি টু, সোনা
-যখন তোমার ছবিগুলো দেখি তখন আমার ইচ্ছে করে (আর লেখা সম্ভব নয়)
-যাঃ আমার লজ্জা করছে। তবে আমারও ওই সব ইচ্ছে করে।
-তোমার সাথে কিভাবে দেখা করা যাবে
-দেখা করার দরকার কি?
-দরকার কি মানে? ডোন্ট ইউ লাভ মি?
-লাভ ইউ, সুইট হার্ট
-তাহলে আমাকে এড়িয়ে চলো কেন? তোমার ঠিকানা ফোন নাম্বার কিছু দাও না কেন?
-তুমি জান না আমাদের বাড়ি খুব কনজারভেটিভ। বাবা খুব রাগী। জানতে পারলে কেটে ফেলবে।
-আর এই যে রাত দুটোর সময় চ্যাট করছ তাতে বাবা কিছু বলবে না? আসলে তুমি আমায় এখনও বিশ্বাস করতে পারছ না।
-প্লিজ ও কথা বোলো না।
-তাহলে কেন এমন করছ?
-আমাকে একটু সময় দাও, প্লিজ। গুড নাইট... সুইট ড্রিম
-চিত্রলেখা শোনো।

এইভাবেই চলছিল সৌম্য আর চিত্রলেখার প্রেম। প্রায় দুমাস হল ফেসবুকে তাদের
প্রেম চলছে কিন্তু এই মেয়ে এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সে সৌম্যর প্রেমের
কথা, কামনা বাসনার কথা শোনে ও উপভোগ করে, কিন্তু যখনই ঠিকানা বা ফোন
নাম্বার চাওয়া হয় তখনই অফ লাইন হয়ে যায়। সৌম্য দিনে দিনে হতাশ এমন কি
ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন সে চিত্রলেখার পরিচয় জানতে পারে।

ট্রেনের কামরায় এক মহিলা সৌম্যর ঠিক মুখোমুখি বসল। বয়স্ক, চুলে ঈষৎ পাক
ধরেছে। তার চোখ, মুখের হাসি সব কিছু সৌম্যর খুব চেনা চেনা লাগল। ভীষণ
চেনা। মহিলার সঙ্গে তারই সমবয়সী আর একজন মহিলা ছিল। দুজনে নিজেদের মধ্যে নানা সাংসারিক গল্প করছিল। সেই চেনা চেনা মহিলাকে দেখতে দেখতে সৌম্য মনে মনে বলল, পেয়েছি, এ তো হুবহু চিত্রলেখা। মুখটা একেবারে কেটে বসানো। নিশ্চয় ওর মা হবে। মহিলা হঠাৎ বলল,
-আমার ছেলের কথা আর বোলো না। রাতদিন কাজে ব্যস্ত, নাওয়া খাওয়ার সময় পায় না। কোম্পানি ওকে দিন রাত খাটিয়ে নিচ্ছে কিন্তু মাইনে দেয় সামান্য। ওর
খাটুনি চোখে দেখা যায় না। রাত জেগেও ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করে।
-কি করা যাবে লেগে থাকুক, একসময় নিশ্চয়ই উন্নতি হবে।
-সেই আশাতেই তো আছি। জানো আমার ছেলে কম্পিউটারে ভীষণ এক্সপার্ট। ফটোশপ টপ... সবকিছু খুব ভালো পারে। এই তো সেদিন আমার পুরনো দিনের একগাদা ফটো চাইল, বলল ফেক আইডি বানাতে হবে। অফিসের কাজে দরকার। তাই নিয়ে সারাদিন পড়ে রইল, নাওয়া খাওয়া ভুলে, এমন কাজ পাগল ছেলে।
সৌম্যর কান মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। সে বলল,
-কাকিমা আপনার ছেলের নাম কি সুজয়? মানে কিছু মনে করবেন না। আমি সুজয় নামে একজনকে জানি, কম্পিউটার খুব ভালো জানে আর ফটোশপ ফেকাইডিতে তো একেবারে মাস্টার। লিলুয়া থাকে। ওখানে সবাই ওকে চেনে।
ছেলের বিষয়ে প্রশ্ন করায় মহিলা খুব খুশী হল।
-না আমার ছেলের নাম শুভ্রদীপ। আমরা মানকুন্ডু থাকি। আমার ছেলেও খুব ফেমাস। তুমি ইন্টারনেট পারো? আমার ছেলে পারে। ইন্টারনেটে শুভ্রদীপ ভট্টাচার্য লিখলেই ওকে দেখতে পাবে।
-আপনার কোন মেয়ে আছে?
-না আমার একই ছেলে।
সেদিন রাত্রে চিত্রলেখা চ্যাটে এল
-কি করছ সোনা?
-আমি কি করছি তাতে তোর কি মা****র শুভ্রদীপ। শুওরের বাচ্চা, মাকে বেচে
খাচ্ছিস? ভালো ভালো। কাল রাতে পাঠিয়ে দিস। দশটা টাকা দেব।
চিত্রলেখা (বা শুভ্রদীপ) দমার পাত্র নয়
-চোপ। তোর তো শালা মেয়েছেলে দেখলে ***এ লাল পড়তে থাকে। এতদিন তো দিব্যি প্রেম চালাচ্ছিলি। দাঁড়া সালা, চ্যাটিং এর স্ক্রিন শট নিয়ে সব পোস্ট করব।
-যা যা করিস, আমার *** ছিঁড়বি। হ্যাঁ আমার মেয়েছেলে দেখলে লাল পড়ে আর তোর তো শালা ব্যাটাছেলে দেখলে লাল পড়ে। মুখে লিপস্টিক মেখে রাস্তায় দাঁড়া।
তাতেও দুটো পয়সা আসবে।
রাগে গরগর করতে করতে সৌম্য চিত্রলেখার প্রোফাইলে গেল। একসাথে রিপোর্ট ও
ব্লক করবে। কিন্তু দেখল চিত্রলেখা তাকে আগেই ব্লক করে দিয়েছে।









বিপক্ষেঃ




১. রানী সিনহা

ভারচুয়াল সম্পর্কে স্থায়িত্ব অবশ্যই আছে, আমি এর পক্ষেই কিছু কথা বলতে চাই...আমি কিছুতেই স্বীকার করবো না ভারচুয়াল এই সম্পর্কের কোনও স্থায়িত্ব নেই ।

কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, যাদের আমরা চিনি না, কিছু জানিনা তারা কেমন মানুষ, কোথায় থাকে, কি তার পেশা ।

ফেসবুক এ আসতে হলে তাদের একটা ছবি দিতে হয়, তাই সেই সুবাদে ওরা আমার কাছে পরিচিত। আমি একে Face book বা মুখ-বই বলতে পারবো না।

আমার কাছে এটা একটা সোসাইটি। একটা পরিবারের মত, পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া, খুনসুটি, সবকিছু আছে এখানে, আবার আবেগ আছে পুরো মাত্রায় ।

শোক, শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা, সন্মান, ভালোবাসা, মেলামেশা, আন্তরিকতা সব কিছু আছে এখানে। নিজেদের জানা অজানা অনেক কিছুই আদান প্রদান হয়, আর এই ভাবেই দিনের দিন কেটে যায়। কিন্তু একবারও মনে আসে না, এরা আমাদের কেউ নয়। সকলের অজান্তেই আপন হয়ে যায় সবাই কখন আমরা বুঝতেও পারি না। এই ভাবেই কখন একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আর এই সম্পর্ক গুলোর মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে আস্তে আস্তে কেমন স্থায়িত্বও এসে যায়। তখন মনে হয় ওরা আমার পরিবারের কেউ। সুখে-দুঃখে খোঁজখবর নেওয়া, শরীর ঠিক আছে কিনা, তার জন্য আবার সাবধান করে দেওয়া, এই ভাবেই আস্তে আস্তে স্থায়িত্ব এসে যায় এবং সেটা চিরস্থায়ী হয় । বাস্তবিক জীবনে স্কুল কলেজ বা সংসারে আমরা অনেকের সঙ্গেই মেলামেশা করি কিন্তু সকলের সঙ্গে কি স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে ওঠে ?

তেমনি এই ভারচুয়াল জগতেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবেগ থাকে আর আমাদের এই আদান প্রদান, লেখালিখির মাধ্যমে স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে ওঠে ।



২. স্বপন দেব

সভার মোশন এর সপক্ষের বন্ধুগণ এবং শ্রদ্ধেয় পাঠক-পাঠিকা মণ্ডলী,

এটা যে একটা বিতর্কের বিষয় হতে পারে, আমি ভাবতেই পারিনা ! সপক্ষের বন্ধুরা যে কি-বোর্ড এ টাইপ করে আপনারা বক্তব্য পেশ করছেন, সেটাও কিন্তু একটা ভার্চুয়াল কি বোর্ড ! সভা এবং সপক্ষের বন্ধুরা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ভার্চুয়াল সম্পর্কে আবেগ আছে ! আমার যৌবনকালে বিতর্ক বা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিষয় থাকতো, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ ! আর আমার বার্দ্ধক্যে এসে শুনছি, এক ধরণের সম্পর্ক দিয়েছে আবেগ কিন্তু, অনিশ্চিত করেছে তার বেগ বা স্থায়িত্ব ! যাই হোক, সপক্ষের বন্ধুরা এবং সভা যে এটাকে আবেগ বলে মেনে নিয়েছেন, আমি তাতেই খুশি ! একটা সম্পর্কের স্থায়িত্ব নির্ভর করে দুটো বিষয়ের ওপর। একটি আবেগ বা ভালোবাসা এবং আর একটি পারস্পরিক বিশ্বাস এর ওপর। আপনাদের স্বীকারোক্তিতেই পরিষ্কার যে আবেগ বা ভালোবাসা এখানে বিদ্যমান। বাকি থাকে, পারস্পরিক বিশ্বাস। সেটা কিন্তু, ভারচুয়াল বা রিয়ালিটির ওপর নির্ভরশীল নয়।

পুরুষ মাত্রেই By nature, polygamist. এটা মেয়েরা তো জানেই, সারা বিশ্বই জানে। সব রকম সম্পর্কেই মেয়েরা এটা মেনে নিয়েই সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখে ! রাখতে বাধ্য হয়। এর সঙ্গে ভার্চুয়াল বা রিয়ালিটির কোন সম্পর্ক নেই।

এবার বলুন তো আমার সপক্ষের বন্ধুগণ , রাধাকৃষ্ণ বা কৃষ্ণ-দ্রৌপদীর সম্পর্ক কি ভার্চুয়াল ছিল, না রিয়েলিটি ছিলো ? মহাভারতীয় যুগ থেকে আজ অবধি কিন্তু তাঁদের সম্পর্কের আবেগ এবং স্থায়িত্ব দুটোই বর্তমান ! আচ্ছা বলুন তো, রোমিও-জুলিয়েট বা ওথেলো-ডেসডিমোনার সম্পর্ক ঠিক কি ছিলো ? নাগ-রাজ কন্যা উলূপীর সঙ্গে অর্জুনের মাত্র একরাত সহবাস হয়েছিলো। তার পরিণতিতে উলূপী-অর্জুনের সন্তান কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের পক্ষে যোগদান করে বীরের মৃত্যু বরণ করেন। এটাকে কি বলবেন আমার সপক্ষের বন্ধুগণ ? আসলে ভার্চুয়াল শব্দটিই নতুন প্রজন্ম, যাকে G নামে অভিহিত করা হয় তাঁদের জন্যে। এই G নামক প্রজন্ম টি কিন্তু সদা এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল। 2G থেকে 4G তে আসতে এদের বেশী সময় লাগেনা। স্থায়িত্ব কথাটাই আপেক্ষিক। বিশ্ব-চরাচরে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। আর প্রেম-হীন, বিশ্বাস-হীন নিরুপায় অভ্যস্ত দাম্পত্যের থেকে যে সম্পর্ক আবেগময়, ভালবাসায় প্রাণবন্ত তার মূল্য অনেক বেশী।



৩. অনুপম দাশশর্মা

প্রথমতঃ স্থায়িত্বের কোন বাঁধাধরা সংজ্ঞা নেই। আপেক্ষিক তত্ত্বের তত্ত্বতালাশ ঘাঁটলে দেখা যাবে সময়ের আশির্বাদপুষ্ট বাছাই ভাগ্যধর লিঙ্গ নির্বিশেষে কোথাও কোথাও দীর্ঘ সম্মতিতে স্থায়িত্বের সুবিধা পায়। মূল ব্যাপারটা যেখানে সম্পর্কের ভূমিকায় জড়িয়ে আছে তখন যে কথাটি চলে আসে তা হলো আবেগ। আবেগ সম্পর্কের প্রথম বর্ণমালা।

আবার ব্যক্তিকে সবসময় ছাপিয়ে যায় সমষ্টির দাপট। তাই ভার্চুয়াল রিলেশনে ব্যক্তির ইচ্ছা-ঘূর্ণিতে বিপাকে পড়ে কেউ নিছক আবেগকে মুকুট পড়ালে বোধহয় সম্পর্ক'র প্রতি অবিচার করা হবে।

কেউ একজন বা দুজন, দশজন উদাহরণ হয়ে দাঁড়াতে পারে না বেশীর ভাগ শুভবুদ্ধি ধারকদের। প্রতিদিন যাঁরা ছায়ার আড়ালে মনের যাবতীয় সুখ আহ্লাদ অকাট্য উপস্থিতিতে এই ভার্চুয়াল জগতে হাজির করেন, রিয়েল স্টেজে তাঁদের কজন'কে এই বেগবান কঠিন জীবনে আমরা সেভাবে পাই?

সব জায়গায় কিছু বেয়াদব কৃষ্টি(?) রিপুতাড়িত হয়ে আঁচড় কাটে সৌহার্দে, ভার্চুয়ালি সে মুখগুলো সক্রিয়, ক্ষিপ্রও ততোধিক। কিছু করার নেই। কিন্তু বাকী সংস্কৃতিমুখর সুজনদের অভাব কি অস্বস্তি বাড়ায় না কোনসময় অন্তর্জালের যান্ত্রিক বিভ্রাটে?

হয়। হতেই হয়। আর তখনি স্থায়িত্বের আস্থাভোট হই হই করে জয়ী হয়ে ওঠে।



৪.অরুণ চট্টোপাধ্যায়


দিন যত যাচ্ছে পৃথিবী তত ছোট হয়ে আসছে। কিন্তু মানুষের কাজের গতি ততই বেড়ে চলেছে। ইঁদুর দৌড়ের এই যুগে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে তার জীবনযাত্রার স্বাভাবিক ছন্দ। মানুষের মনের ওপর চাপ বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন। নানা সমস্যার চাপে মানুষের প্রতি মুহূর্তেই উঠছে যেন নাভিশ্বাস। মন চায় একটু বিশ্রাম কিন্তু পায় না। আপন জনেরাও যে যার নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত। তাছাড়া আজকের দিনে পরিবারগুলি হয়ে পড়েছে পরমাণু-সদৃশ। পড়াশোনা আর রুজি রোজগারের টানে পরিবারের অন্যান্যরা ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে।

একাকীত্ব মানুষের কাছে একটি অভিশাপ। মানুষের মনে গভীর আর সুদূরপ্রসারী এক বিষবৃক্ষের শেকড় গেড়ে দিতে পারে এটি। হতাশা আর অবসাদ তার জীবনে আনতে পারে এক চরম দুর্দিন। তাই এই অবস্থায় মানুষ চেয়েছে তার প্রতি মুহূর্তের একটি মনের মত সঙ্গী। সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং সাইটগুলি বিশেষভাবে ফেসবুক সেই সুযোগ করে দিয়েছে। বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষদের সঙ্গে তার যোগাযোগের দরজা খুলে দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সম্পর্ক বন্ধু নামে অভিহিত হলেও মানুষ পরবর্তী পর্যায়ে অন্য নানা নিকট সম্পর্ক পাতিয়ে বসে।

ভার্চুয়াল কথাটার মানে হল যার অস্তিত্ব আছে কিন্তু তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাধারণতঃ সোশাল নেট ওয়ার্কিং সাইটগুলোর সম্পর্কেই এই ভার্চুয়াল সম্পর্কের প্রশ্ন ওঠে। এই সম্পর্কগুলির সম্পর্কে বিস্তারিত কেউ আমরা বিশেষ জানতে পারি না বলেই হয়ত এ প্রশ্ন ওঠে।

মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী। সে জানে শুধুমাত্র আবেগ সর্বস্ব হয়ে বাচা যায় না। তাই সমস্ত “অলীকত্ব” ঘুচিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বাস্তবসম্মত সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহী ও উদ্যোগী হয়।

এটা ঠিক যে এই ভার্চুয়াল সম্পর্কের মোহে পড়ে বহু প্রেমের পরিণতি হতাশাগ্রস্ত ও বিভিন্ন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু আবার এটাও ঠিক যে বহু প্রেমের ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলি বিবাহ নামক স্থায়িত্বের ছোঁয়া পেয়ে সুখে ঘরসংসারও করছে।

ইদানীং ফেসবুক তার ভার্চুয়াল খোলসখানা ছেড়ে ফেলতে উদগ্রীব। ফেসবুকের বন্ধুদের মধ্যে বাস্তবসম্মত দেখাসাক্ষাৎ, নানা অনুষ্ঠান, বনভোজন, সমাজসেবা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বন্ধুত্বের টানে দূর প্রবাস এমন কি বিদেশ থেকেও ছুটে আসছেন এরা নানা অনুষ্ঠানে। এ বিষয়ে চিলেকোঠা গ্রুপটি বেশ কিছুটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও পালন করছে তার সাম্প্রতিক কাজকর্ম এমনি ইঙ্গিত দেয়। শুধুমাত্র আবেগতাড়িত হয়ে কি এরা এত কিছু করতে পারতেন? একটা স্থায়িত্বের নির্দিষ্ট লক্ষের দিকেই হয়ত এগিয়ে চলেছে আজকের ফেসবুক-জগত।



৫. বেলাল হোসেন

ভার্চুয়াল রিলেশনশিপে আবেগ আছে, স্থায়িত্ব নেই ? তাই কি ? ক্ষেত্র বিশেষে তা সত্য হতে পারে, কিন্তু, ইংরেজিতে যাকে বলে, জেনেরালাইজড, তা কিন্তু নয়। বেশ কিছু ঘটনার আমি সাক্ষী যেখানে, সোশ্যাল মিডিয়াতে পরিচয় হয়ে, পরে তা বৈবাহিক সম্পর্কে পরিণতি লাভ করেছে। কিছুদিন আগে একটি অপরিণত মেয়ে আমার চেম্বারে দেখাতে আসে, সে ছিল গর্ভবতী। আমি যখন তার মাকে বলি ‘এত বাচ্চা মেয়ের বিয়ে দিলেন, তাও ঠিকমত শিখিয়ে পড়িয়ে দিলেননা ! আপনাদের মত বাবা মাকে তো পুলিশে দেওয়া উচিৎ ! সরকার থেকে এত চেঁচামেচি, এত প্রচার, সব জলাঞ্জলি যাচ্ছে !’ তার মায়ের উত্তর ছিল, ‘আমরা কি দিয়েছি ! ..দেখছেন না, আমরা হলাম ঘোষ, আর মেয়ে হল কিসকু’। বললাম, ‘তাতে কি হয়েছে, সে তো হতেই পারে’। আসল কথা হল মেয়েটি ক্লাস টেন-এ পড়াকালীন চ্যাট করে বন্ধু যোগাড় করে পালিয়েছিল। চেন্নাইয়ে। ছেলেটি নেহাত ভালো , মেয়েটি গর্ভবতী হওয়ায় বেশ ভয় পেয়ে যায়। তার সেখানকার বন্ধুদের পরামর্শে ফিরে আসে।

আমরা নিজেরাও কি কিছু ভার্চুয়াল সম্পর্ককে আন্তরিকতার স্পর্শে জড়িয়ে নিইনি ? হ্যাঁ, পাঁচশো বন্ধুর মধ্যে হয়তো অন্ততঃ পনেরটা সম্পর্ক সামাজিকতার বন্ধনে বাঁধা হয়েছে। বেনোজল নিশ্চয় বেশি।

মিসড কল শেষ পর্যন্ত মিসেস কল এ পরিনত হওয়ার উদাহরণও আছে । প্রফেসনাল কারণে, আমার পক্ষে এসব ঘটনা জানার সুযোগ বেশি।

আমার ছেলে ব্যাঙ্গালোরে থাকে, হোস্টেলে। গত বছর, হঠাৎ, এক সন্ধ্যায় ওর বিব্রত ফোন পেয়ে বিপদে পড়ে গেছলাম, ওর পাশের রুমে একটি ছেলে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে, সেই পরিস্থিতিতে পড়ে আমার ছেলে ভয় পেয়ে বমি টমি করে ভীষণ প্রবলেমে পড়ে যায়, আমি আমার ডক্টর’স গ্রুপের ওয়ালে এ নিয়ে একটা লেখা পোষ্ট করি, ব্যাঙ্গালোরে মিলিটারিতে কর্মরতা এক ডাক্তার, যে আমাদেরই কলেজ থেকে পাশ করেছে, আমি পাশ করবার অন্ততঃ পনের বছর পরে, যাকে আমি কোনোদিনই দেখিনি, সে ব্যাপারটা জানা মাত্র আমার ছেলের ফোন নম্বর চায়, এবং তৎক্ষণাৎ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং করে দেয়।

বন্ধুপুত্র, আই আই টি তে পড়ত। নেট এ বন্ধুত্বের সূত্রে অস্ট্রেলিয়াতে ইণ্টার্ণশিপ যোগাড় করেছে, থাকার জায়গা পেতে সুবিধা হয়েছে, আবার পাশ করবার পরে চাকরিও জুটিয়েছে। হয়তো সুবিধাবাদিতা, কিন্তু যিনি উপকার করেছেন, তিনি তো হৃদয় দিয়ে করেছেন।

আসলে ব্যাপারটা নির্ভর করে মানুষের মানসিক কাঠামোর উপর। একজন স্বার্থপর মানুষ , তার চোখের সামনে যতই ভালোমানুষ থাকুক, যারা উপকার করতে পিছপা নয়, সেরকম লোকেরও প্রয়োজনের সময়, সেই স্বার্থপর মানুষের দেখা পাওয়া যাবেনা। সে কিছুনা কিছু অজুহাত খাড়া করবেই। আর সে যদি একটু বেশি বিদ্যে বুদ্ধি ধরে, তাহলে তো আর কথাই নেই। সোস্যাল মিডিয়াতে সে জ্ঞান দিয়ে ফাটিয়ে দেবে। আবেগের অস্থিরতায় অস্থির হয়ে পড়বে। বাস্তবে, কাজের লোকেরা চিরদিনই নীরবে কাজ করে গেছে, তারা প্রচারের আলো থেকে একটু দূরে থাকতেই ভালবাসে; সে মানুষের মাঝেই হোক, কি ভার্চুয়াল জগতেই হোক। কিন্তু, ভার্চুয়াল জগৎটা যেহেতু নিজের ঢ্যাঁঢরা পিটবার জায়গা, তাই সেখানে ঢক্কানিনাদের লোকজনই বেশি। তবে, তার জন্য সিস্টেমকে দোষ দেওয়া যায়না।

বাস্তব জগতের একটা ‘আবেগ আছে, স্থায়িত্ব নেই’ এর মজার উদাহরণ দিয়ে লেখা শেষ করি। একজন বেশ গরীব এক রোগী ক্লিনিকে ভর্তি হল, ভর্তির সময়েই সে জানিয়ে দিয়েছে, তার কতদূর কী ক্ষমতা; সেই অনুযায়ী একটা বাজেট করে তার চিকিৎসা চলছে। মাঝপথে একদিন, তার কোন ধনী আত্মীয় (যে আমারও হয়তো অচেনা নয়) হাজির হল। সে তো এসেই, আবিষ্কার করবে, ‘আরে কী চিকিৎসা হচ্ছে তোর এটা ! এই হচ্ছেনা, সেই হচ্ছে না ..চলতো দেখি, আমি নিজে ডাক্তারবাবুকে চিনি, তাঁর সঙ্গে আমি নিজে কথা বলবো....’ । যথাসময়ে সেই মক্কেল এবারে আমার রুমে হাজির হবে, আমি তার বাক্যবাণ শেষ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, তারপর বলবো , ‘আসলে আপনার আত্মীয় বেশ গরীব মানুষতো, তার পক্ষে হয়তো অসম্ভব, আপনি যদি এই দামী ওষুধগুলি কিনে দেন..’ এই বলে তাঁর হাতে একটি ওষুধের লিস্টি ধরিয়ে দেব। এর পর আর সেই ভদ্রলোকের টিকিটির সন্ধান পাওয়া যাবেনা । তিনি তো সেই গরীব মানুষটির হাতে ততক্ষণে সেই মেডিসিন স্লিপটি ধরিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছেন। কী সমাজে, আর কি ভার্চুয়াল জগতে, সর্বত্রই এই ধরনের সিউডো ( Pseudo ) পরোপকারী লোক সংখ্যায় বেড়ে গেছে, তাই আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় ‘আবেগ আছে, স্থায়িত্ব নেই’ । এতে তর্কের কী আছে। এই নিয়েই চলব।


4 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ এ ৩:৪০ PM

    'চিলেকোঠা সরগরম' বিতর্ক বিভাগে এই সংখ্যার বিষয়,
    "VIRTUAL RELATION-এ আবেগ আছে, স্থায়িত্ব নেই ।"

    এবারের বিতর্কে যে পাঁচজন পক্ষে মতামত দিয়েছেন তাঁরা হলেন স্রীরূপা চ্যাটার্জী,বৃষ্টি ব্যানার্জী,শ্রীশুভ্র,নারায়ন রায় ও রূমনী সেন। যে পাঁচজন বিপক্ষে লিখেছেন,তাঁরা হচ্ছেন রানী সিনহা,স্বপন দেব,অনুপম দাশশর্মা,অরুন চট্টোপাধ্যায় ও বেলাল হোসেন।
    মতামতগুলি তাঁদের ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন । তবে আশা রাখি এই সব মতামত সব পাঠককে ভাবাবে,নতুন ভাবে চিন্তা করাবে ও প্রত্যেককে তাঁদের নিজস্ব মত গঠনে সহায়ক হবে। সেটুকু কিন্তু এক বড়ো পাওয়া আমাদের।
    তাই প্রতি সংখ্যায় বিষয়-ভিত্তিক বিতর্ক জারী থাক,আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে ভাবাক !

    সবশেষে একটি কথা,এই বিতর্ক বিভাগের সমস্ত মতামত কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে অংশগ্রহণকারীদের ব্যক্তিগত, তা চিলেকোঠা ওয়েবজিনের মতামত নয় ।

    উত্তরমুছুন
  2. চিলেকোঠা সরগরম বিভাগটি আক্ষরিক অর্থেই বর্তমানে যথেষ্ট সরগরম । ওয়েব জিনের পরিচালক বর্গকে সাধুবাদ না দিয়ে পারা যায় না প্রথমতঃ এই বিভাগটির সূচনা আর দ্বিতিয়তঃ বিতর্কের বিষয়গুলি নির্বাচন । এই ধরণের আলোচনা ও সমালোচনা মানুষের চিন্তাশক্তিকেই শুধু বাড়ায় না, তার দৃষ্টির স্বচ্ছতাও আনে । যারা লিখছেন তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও সমাজের উল্লেখযোগ্য স্থানে অবস্থিত । সামাজের বিভিন্ন নেশা ও পেশায় ব্যস্ত ও ন্যস্ত । তারা সমাজকে বিস্তৃত ও গভীরভাবে দেখছেন । তাই আলোচনাগুলি অত্যন্ত মূল্যবান ।

    উত্তরমুছুন
  3. বিতর্ক ব্যাপারটা আমরা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। আমার ছাত্রাবস্থায় এবং বহুদিন অবধি কলকাতায় তো বটেই, বিভিন্ন জেলাগুলিতেও বিতর্ক প্রতিযোগিতা চালু ছিল। চিলেকোঠা ওয়েব জিন এ শুধু বিতর্কের বিষয়-বস্তু নয়, অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাও উপেক্ষা করার মত নয় মোটেই। এটা চালু থাকুক, এই কামনা করি।

    উত্তরমুছুন
  4. আমার দুটি অভিযোগ। এবং দুটোই বিশেষ বিবেচনার অবকাশ রাখে। প্রথমতঃ বিতর্কের বিষয়-বস্তু, সময় এবং নিয়মাবলী জানিয়ে যে পোষ্ট টি করা হয়, সেটা কেন যে Pinned করা হয়না তা আমার বুদ্ধির অগম্য। কেউ যদি, কোন কারণে ঐ পোষ্ট এর দিন বা তার পরদিন অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তার পক্ষে এটা খুঁজে বার করাটাই খুব দুষ্কর। দ্বিতীয়তঃ এটা যেহেতু কোন প্রতিযোগিতা নয়, নিছক যুক্তি-তর্কের আসর, এবং যেখানে সবাইকে আহবান করা হচ্ছে মনের সব কথা খুলে বলার জন্যে......সেখানে ৩০০ শব্দের একটা সীমারেখা টেনে দেওয়া অনুচিত। এটা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে হতে পারে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে হওয়া উচিত নয়। আমরা যারা এককালে প্রচুর বিতর্কে অংশ-গ্রহণ করেছি, তারা জানি ৩০০ শব্দের একটি লেখা পড়তে যা সময় লাগে তার থেকে ঢের বেশী সময় পাওয়া যায় একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। আর এটা তো কোন প্রতিযোগিতাই নয়। আমার আবেদন শব্দ সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৫০ থেকে ৩৭৫ এর মধ্যে রাখা হোক। অবশ্য আমার এই কমেন্ট টি কোন আয়োজক এর নজরে পড়বে কিনা, এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে !!

    উত্তরমুছুন