ছোটগল্প - ডঃ সুজাতা ঘোষ

সাদামালা
ডঃ সুজাতা ঘোষ



ইলেকট্রিক চুল্লিতে বডি ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে গায়ের চাদরটা এক ঝটকায় পুড়ে উধাও হয়ে যায়। বডিটা আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে, গনগনে আগুন দুহাত বাড়িয়ে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নেহায় চির ঘুমন্ত শরীরটাকে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেওয়ার জন্য। দেবাঞ্জন দাঁড়িয়ে অসহায়, নিঃসঙ্গ, হতবাক নিজেকে নিয়ে একটু দূরে।

বেশিক্ষণ সময় লাগল না স্নেহার এই জীবনটা থেকে ধুলিসাৎ হয়ে যেতে। অন্যান্যরা সবাই ব্যস্ত নানা দরকারী কাজে। দেবাঞ্জন ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে ঘাটের দিকে। সমস্ত কাজ শেষ হওয়ার পরেও একা বসে রইল ঘাটের উপর। পেছন থেকে ওর ছোট ভাই এসে ডাকল, দাদা, বাড়ি চল।

দেবাঞ্জন একটুও বিচলিত নয়, কোথায় যাবে ও ? কার কাছে যাবে ? সব শূন্য করে স্নেহা চলে গেছে ওকে ছেড়ে চিরকালের মত।

কাল সন্ধেতেও সারা বাড়ি জুড়ে কত আনন্দ ছড়িয়েছিল, ওদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। কত আড্ডা – হাসি – আনন্দ – লোকজন। কি সুন্দরই না লাগছিল স্নেহাকে লাল কাঞ্জিভরম পরে। দুজনে মিলে পছন্দ করে কিনে এনেছিল। আগে থাকতেই বলে দিয়েছিল দেবাঞ্জনকে রজনীগন্ধার মালা আনার জন্য। খোঁপায় লাগাবে। দেবাঞ্জনের সবসময়ের ভুলো মন, যথারীতি ভুলে গেছিল মালা কিনতে। অফিসের এত চাপ সত্বেও সময় মতন যে বাড়ি ফিরতে পেরেছিল, এই অনেক।

গতকাল সকালে অফিসে ঢুকেই বসকে বলে রেখেছিল যে, সন্ধ্যের মধ্যে তাকে বাড়ি ফিরতেই হবে, প্রথম বিবাহ বার্ষিকী বলে কথা। কথাটা কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা অফিস ছড়িয়ে গেছিল। আর কোথায় যায় দেবাঞ্জন, সবাইকে মিষ্টি আনিয়ে খাওয়াতে হয়েছে। তাতেও ছাড়েনি অনেকে, কেউ কেউ যেচে রাতে বাড়িতে নিমন্ত্রণ নিয়েছে।

সমস্ত কাজ শেষ করে বিকেল পাঁচটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি যাওয়ার জন্য। সারাদিন কাজের চাপে ভুলেই গেছিল ফুলের কথাটা। রাস্তায় হঠাৎ দেখে একজন অল্পবয়সী ছেলে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা এক হাতে আর অন্য হাতে রজনীগন্ধার মালা নিয়ে বিক্রির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ওকে দেখতে পেয়ে দেবাঞ্জন মাঝ পথেই বাস থেকে নেমে পড়ে। ওর কাছ থকে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল আর দুটো মোটা মালা নিয়ে দেবাঞ্জন বাড়িতে ফেরে। স্নেহা ভীম নাগের সন্দেশ খেতে খুব ভালোবাসে, তাই শুধুমাত্র ওর জন্য এক প্যাকেট সন্দেশ কিনে নিয়ে যায় সে।

বাড়িতে পা রাখা মাত্রই হৈ – চৈ। ঘর ভর্তি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, আলো, গান , বাজনা – সব মিলিয়ে দারুণ লাগছে। স্নেহা হাত ধরে টেনে ওকে ভিতরে নিয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে অন্যরা হৈ হৈ করে ওঠে। কেউ আবার বলে, আরে সারা রাত তো পড়েই আছে, এখন একটু আমাদের সঙ্গেও কাটাও কিছুটা সময়।

দেবাঞ্জনের হাতে নতুন সিল্কের পাঞ্জাবি – পায়জামা ধরিয়ে দিয়ে স্নেহা নিজের খোঁপায় ধবধবে সাদা রজনীগন্ধার মালা লাগাতে থাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে। দেবাঞ্জন নিজে হাত বাড়িয়ে মালা আটকাতে সাহায্য করল স্নেহাকে। অন্যরকম একটা অনুভূতি অনুভব করল দেবাঞ্জন। রোজের দৌড়াদৌড়ির চেয়ে আলাদা অন্য একটা দিন। বিয়ের দিনের চেয়েও আলাদা, কোন চিন্তা, তাড়াহুড়া, ভয় কিছুই নেই বিয়ের দিনের মতন। তবে রোমাঞ্চকর আনন্দটা আছে সেদিনের মতই। বেশ ভালো লাগছে ভাবতে।

এরই মধ্যে ঘরে এক বন্ধু ঢুকে গান শুরু করল – “ এই রাত তোমার আমার ..................”। স্নেহা হা হা করে হেসে উঠল। দেবাঞ্জন লজ্জা পেয়ে পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।

-------------------------------

এখন রাত প্রায় পৌনে দুটো, দেবাঞ্জন আর স্নেহা নিভৃতে বসে আছে শোওয়ার ঘরের পাশের ব্যালকনিতে। রেলিং বেয়ে যে মাধবীলতা গাছটা উপরে উঠে এসেছে, তার ফুলগুলো মনে হচ্ছে ওদের বিবাহবার্ষিকীর ডেকরেশানের একটা বিশেষ অংশ। হাল্কা হাওয়ায় স্নেহার খোলা চুল উড়ে উড়ে পড়ছে দেবাঞ্জনের মুখে। মাথার ফুলের মালাগুলো দেবাঞ্জনের হাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে আর শিহরন জাগছে সমস্ত শরীরের শান্ত স্নায়ুতে। ধীরে ধীরে রক্তের স্রোত ক্রমশঃ অশান্ত হয়ে বয়ে চলে সমস্ত শরীরে তীরের গতিতে। দেবাঞ্জন আর নিজেকে থামিয়ে রেখে সময় নষ্ট করতে চায় না, এই মধুময় মুহুর্ত সে চরম প্রাপ্তিতে নিয়ে যেতে চায় স্নেহার মিলনে। রজনীগন্ধার মালা নিজের হাতে জড়িয়ে দেয় স্নেহার এলো চুলের সাথে। পাখির পালকের মত স্নেহা নিজেকে এলিয়ে দেয় দেবাঞ্জনের দু’হাতের ভিতর।

এখন রাত বাড়ছে, চাঁদটা মাথার উপর উঠে নির্লজ্জের মত মাধবীলতার সাথে জড়িয়ে ধরেছে নিজেকে। ফুলগুলো খুশিতে ঢলে পড়ছে নীচে এক এক করে। এভাবে অনেকক্ষণ কেটে গেছে, ঠিক কতক্ষণ তা জানে না ওরা কেউই। আজ দুজনেই খুশি মিলনানন্দে । ক্লান্ত শরীরদুটি পড়ে আছে মাধবীলতাদের মাঝখানে। দেবাঞ্জন হাত বাড়িয়ে স্নেহার হাতদুটি নিজের হাতে শক্ত করে ধরে বুকের কাছে টেনে ধরে, কিছু বলতে চায় সে, স্নেহা তার মুখ বন্ধ করে দেয় নিজের দুটি ঠোঁট দিয়ে। দেবাঞ্জন ভুলে যায় নিজের ভাষা, দুজনে হারিয়ে যেতে থাকে চরম সুখের নরম পথ ধরে।

হঠাৎই নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়ে স্নেহা দেবাঞ্জনের বুকের উপর। কোন সাড়া নেই, উত্তেজনা নেই, উত্তর নেই, প্রতিক্রিয়া নেই।

দেবাঞ্জন আলতো করে স্নেহার মুখ নিজের হাতের ভিতর নিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না, যে ঠিক কি হয়েছে। এবারে অজানা ভয় হাতুড়ির মত পেটাতে থাকে দেবাঞ্জনের বুকের ভিতর। স্নেহাকে পাগলের মত ঝাঁকাতে থাকে দুহাতে ধরে, তবুও কোন সাড়া শব্দ নেই ওর শরীরের ভিতর। স্নেহার চোখ বন্ধ হয়ে আসে চিরকালের মত। সমস্ত শরীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে এলিয়ে দেয় নিজেকে শূন্যে।

-----------------------------------



দেবাঞ্জনের হুঁশ ফিরল পিছন থেকে ভাইয়ের ডাকে। বোধহয় অনেকক্ষণ ধরেই ডাকাডাকি করছে ওরা সবাই, কোথায় যে হারিয়ে গেছিল .........। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল আস্তে খুব আস্তে। একটু একটু করে এগিয়ে যায় সামনের পথ ধরে। এবার বাড়ি ফেরার পালা, কেউ অপেক্ষা করে নেই আজ আর ঘরে। আনমনে চলতে চলতে ধাক্কা লাগে সামনে কারোর সাথে।

ছেলেটি নিজেকে সামলে নিয়ে আবার এগিয়ে যায় সাদা কাপড়ে ঢাকা বডির দিকে। এভাবে একের পর এক সাদা কাপড়ে ঢাকা বিভিন্ন অতৃপ্ত পড়ে থাকা শরীরগুলোর উপর থেকে সমস্ত ফুল তুলে নিতে থাকে সে নিজের হাতে।

নিজের অজান্তেই দেবাঞ্জন দাঁড়িয়ে যায় পা থমকে, পাশ থেকে কেউ ওর চোখ অনুসরণ করে বলে ওঠে, এই সমস্ত মালা – ফুলগুলো আবার বিক্রি করবে বাজারে, দেখলেও খারাপ লাগে। কে জানে, কারোর কোন শুভ অনুষ্ঠানে এগুলোই হয়তো ব্যবহার হবে!

দেবাঞ্জন চমকে ওঠে এক মুহুর্তের জন্য। সেও তো এরকমই এক জনের কাছে ফুল কিনেছিল গতকাল ...............।

তবে কি, কারোর অতৃপ্ত বাসনা সে ঘরে বয়ে নিয়ে গেছিল?

দুচোখ বেয়ে নোনতা জল বয়ে আসে কোন বাঁধা না মেনে। আর একবার ফিরে তাকাল সেই ফুল হাতে ছেলেটির দিকে। ওর মধ্যে কি স্নেহার মালাও আছে? ভাবতে থাকে দেবাঞ্জন আবার নতুন করে ।।


2 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ এ ১২:০৪ AM

    সুজাতা ঘোষের 'সাদা মালা' গল্পটি বড়ো মর্মস্পর্শী !

    উত্তরমুছুন
  2. ভীষণ...ভীষণ সুন্দর !! ঝরঝরে লেখা, শব্দ-চয়ন, কাব্যিক অনুষঙ্গ...সব...সব আছে এই লেখাটায়। তবু কি যেন একটা নেই ! কি যেন একটা অতৃপ্ত বাসনা জাগিয়ে শেষ হয়ে গেল লেখাটা !! বোধহয়, এই সাসপেন্স টা পাঠকের মনে গেঁথে দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল লেখিকার। কি হয়েছিল স্নেহার ? খুব বুদ্ধিমতীর মতই লেখিকা উহ্য রেখেছেন এটি।

    উত্তরমুছুন