প্রবন্ধ - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার ও ভারতের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
অরুণ চট্টোপাধ্যায়



প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার কথাটা শুনে অনেকে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হতে পারেন । ভাবতে পারেন যৌনাচার জিনিসটাই তো প্রকৃতির দেওয়া, তাহলে তা আবার প্রকৃতিবিরুদ্ধ হয় কি করে ? শুধু মানুষ কেন পশুপাখি, জীবজন্তু, এমন কি উদ্ভিদ পর্যন্ত যৌনক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করে বংশগতিকে রক্ষা করার তাগিদে । তাহলে যৌনক্রীড়া তো জীব বা উদ্ভিদের একটি প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্মের মধ্যেই পড়ে ।

তবে আমরা জানি, মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়ে এবং প্রকৃতির ওপরে উঠে দেখাতে চায় সে প্রকৃতির বশ নয় বরং প্রকৃতিই তার বশ । এজন্যে বিজ্ঞান অবশ্যই তার এক মূল্যবান হাতিয়ার ।

প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার বলতে গেলে প্রকৃতিসম্মত যৌনাচার সম্পর্কে কিছু বলতে হয় । আর তার আগে প্রকৃতি আর যৌনাচার এই দুটি কথাও একটু একটু করে ব্যাখ্যা করতে হয় ।

প্রকৃতি বলতে বিভিন্ন জনে বিভিন্ন কথা জানেন । কেউ বলেন, প্রকৃতি হল লতা-পাতা, ফুল-ফল, গাছপালা, পাহাড়- পর্বত, নদীনালা এসব । উদাহরণ স্বরূপ তারা বলেন কবি, লেখক এঁরা হলেন প্রকৃতি- প্রেমিক । কারণ, এঁরা পাহাড়- পর্বত, ঝোপ- জঙ্গল এসব দেখলেই ভাবতে বসে যান । তক্ষুনি অথবা কিছু পরে তাঁদের কলমে থেকে ঝরতে থাকে কাব্য অথবা সাহিত্যরস ।

আবার কেউ জানেন প্রকৃতি মানে হল স্বভাব । যেমন, বাঘ সিংহের হিংস্র প্রকৃতি, গরু ভেড়া ছাগলের মৃদু প্রকৃতি, এইসব । মানুষেরও বিভিন্ন প্রকৃতি থাকে । নরম মেজাজের বা উগ্র মেজাজের । এমন কি প্রকৃতির নিজেরও থাকে রুদ্ররূপ ও কোমল রূপ বা প্রকৃতি । যেমন, বাতাসের রুদ্ররূপ হল ঝড়, সূর্যের রুদ্ররূপ হল ভয়ানক গরম এইসব । এই রকম বহু । উদাহরণের ডালা সাজাতে বসলে পুজো করার আর সময় থাকবে না ।

প্রকৃতি কথাটার বহু অর্থের একটি হল স্বাভাবিক । অর্থাৎ সঠিক । যদিও সঠিক শব্দটি নিজেই সঠিক অর্থে সঠিক নয় । কারণ, একশ ভাগ সঠিক জিনিসটা একমাত্র গণিত শাস্ত্র ছাড়া আর কোথাও নেই । তবু নব্বই ভাগ বা তার বেশী যদি আমাদের পৌঁছানোর লক্ষ্য মাত্রা নির্দিষ্ট থাকে, আর যদি বেশীর ভাগই তা মেনে নিই, তবে সেটাই হবে সঠিক অর্থাৎ তাই হল প্রকৃতি । যেমন ধরা যাক, প্রতিবছর জুলাই-আগস্ট মাস বর্ষাকাল । এখানে, এর অর্থ এই নয় যে, জুনের কিছু দিন বা সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের কটা দিন বৃষ্টি পড়বে না । তবে বেশীর ভাগ বৃষ্টিটাই পড়বে এই জুলাই-আগস্ট মাসে । এটাকেই প্রকৃতির নিয়ম কিম্বা বৃহৎ অর্থে প্রকৃতি বলে ধরে নিই । এবার যদি কোনও বছর আগস্ট পেরিয়ে গেলেও বৃষ্টির দেখা না থাকে, তবে সেটা অবশ্যই হবে প্রকৃতির বিরোধিতা । অথবা ধরুন, ডিসেম্বর-জানুয়ারি প্রকৃতি নির্দিষ্ট শীতকাল হলেও ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেও যদি শীতের দেখা না মেলে তবে সেটা হবে বিরুদ্ধ প্রকৃতির চেহারা । কিংবা জানুয়ারি মাসটা যদি মাসভর অঝোরে বৃষ্টি ঝরতে থাকে তবে তাকেও প্রকৃতির বিরুদ্ধতাই বলব ।

আশা করি, প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছি ।

এবার আসা যাক যৌনাচারের কথায় । কোনও প্রাপ্ত-বয়স্ক পুরুষ বা নারীকে এটি বিশদ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না । কারণ জন্মানোর পর থেকেই প্রকৃতি আমাদের মনে একটু একটু করে যৌন বিষয়ে ধারণা তৈরি করতে থাকে ।

বিষয়টি বুঝিয়ে বলা যাক । আমাদের মস্তিষ্ক হরমোন নামক এক প্রকারের রাসায়নিক পদার্থকে সৃষ্টি করে । মস্তিষ্কের Sphenoid Bone –এর ফাঁকে আটকে থাকা পিটুইটারি গ্ল্যান্ড সমস্ত রকম হরমোন ক্ষরণের জন্য দায়ী । আকারে মাত্র মটরের দানার মত এই গ্ল্যান্ডটি বহু প্রকারের হরমোন নিঃসৃত করে এবং শরীরযন্ত্রের বিভিন্ন স্থানে তারা বিভিন্ন ভাবে কাজ করে । কিন্তু সে তো প্রসঙ্গান্তর । আপাতত সে ব্যাপারে হেঁটে গেলে মূল বিষয়ে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে । তবে সামান্য একটু ধারণা দিতেই হয় । এই পিটুইটারি গ্ল্যান্ড যে হরমোন বা হরমোনগুলি নিঃসৃত করে, তারা আবার শরীরের অন্যান্য গ্ল্যান্ড, যেমন, থাইরয়েড, প্যারা থাইরয়েড, এড্রেনাল, ওভারি (ডিম্বাশয় - মেয়েদের ক্ষেত্রে), টেস্টিস (বীর্য থলি- পুরুষের ক্ষেত্রে) ইত্যাদির ওপর কাজ করে তাদের কাউকে অন্যান্য হরমোন নিঃসৃত করতে উৎসাহিত করে বা তাদের অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণে বাধা দেয় । সারা দেহে এরকম বহু গ্ল্যান্ড রয়েছে, কিন্তু সমস্ত গ্ল্যান্ডের নিয়ন্ত্রক পিটুইটারিকে বলে Master Gland.

পিটুইটারি মাস্টার গ্ল্যান্ড হলেও তার ওপরে কিন্তু আবার একটা হাইকম্যান্ড আছে সে হল ব্রেনের প্রধান একটি অংশ অর্থাৎ হাইপোথ্যালামাস । হাইপোথ্যালামাস তৈরি করে কতগুলি হরমোন উৎপাদক উত্তেজনা ( Hormone Releasing Factors) যারা পিটুইটারির ওপর কাজ করে । হাইপোথ্যালামাস আবার নিজেও স্বাধীন নয় । তাকেও কিন্তু খানিকটা নির্ভর করতে হয় পরিবেশের ওপর । পরিবেশের সঙ্গে ব্রেনের যোগাযোগ হল চোখ, কান, নাক , জিভ, চর্ম, আর মন বা চিন্তন । এদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু হাইপোথ্যালামসকেও চলতে হয় ।

হরমোনগুলি প্রোটিন জাতীয় পদার্থ আর এরা রক্ত দ্বারা সারা শরীরে প্রবাহিত হয় । মজার ব্যাপার হল এরা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে Feedback Control পদ্ধতিতে। হরমোনগুলির অসংখ্য কাজের মধ্যে রয়েছে দেহ ও দেহের অঙ্গগঠন ও তাদের পুষ্টিসাধন, তাদের উত্তেজিত করণ । হরমোনগুলির আধিক্য বা ঘাটতি শরীরে নানা রোগের জন্ম দেয় । মায়ের শরীর থেকে সন্তানের শরীরে এই হরমোনগুলি প্রবেশ করে প্রধানতঃ দুই ভাবে । এক, গর্ভস্থ অবস্থায় আর দুই, ভূমিষ্ঠ হবার পর স্তনদুগ্ধ পানের মাধ্যমে । মাতৃস্তন পানের অনেক উপকারিতার মধ্যে একটি কিন্তু এই মায়ের শরীর থেকে শিশুর শরীরে হরমোন প্রবেশ ।

আমরা হরমোন প্রসঙ্গে বেশী ঢুকলে ফেরার ট্রেন পাব না । তবু কয়েকটা স্টেশন তো সেদিকে যেতেই হবে না হলে সেক্স বা যৌনতা জিনিসটিকে সঠিকভাবে বোঝানো হয়ত যাবে না । তাই সেদিকেই একটু হাঁটা যাক । এই সমস্ত হরমোনগুলির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সেক্স-হরমোন । যারা সেক্স-যন্ত্রগুলিকে (Sex Organs) জনন বা Reproduction এর উপযোগী করে তোলে । শরীরে যৌন-উত্তেজনা আনে । এবং অত্যন্ত সুন্দর ও মসৃণভাবে আর ধীরে ধীরে একটি মানুষকে (শিশু > কিশোর > তরুণ > যুবক ) যৌন- সচেতন করে তোলে । যৌন উন্মেষ ( Onset of Sex Feeling) কিন্তু একদিনে আসে না । যদিও মিডিয়া অর্থাৎ বাইরের যোগাযোগ যেমন দেখা, শোনা, ঘ্রাণ গ্রহণ, বই পড়া, ছবি বা ভিডিও দেখা ইত্যাদি যৌন উন্মেষের অনেকগুলি কারণ ও তারা যৌন উন্মেষ ঘটাতে পারে দ্রুত, তবু একথা মানতেই হবে বাইরের জগৎ থেকে মুক্ত বা গুহার অন্ধকারে আবদ্ধ প্রাণীরও যৌন উন্মেষ ঘটবে । কারণ প্রকৃতিই এই কাজটি সুসম্পন্ন করে থাকে ।

আগেই বলেছি, যৌন উন্মেষের একটি সুনির্দিষ্ট ও পূর্ব নির্দিষ্ট পথ আছে ।

কিন্তু পথটি যদি মসৃণ না হয় বা জটিল হয় তো মানুষের যৌনশিক্ষা (এক্ষেত্রে প্রকৃতির দ্বারা ) বিকৃত হতে পারে । জীবনের বিভিন্ন ভাগে মানুষ কিন্তু যৌন-বিকৃতির কোপে পড়তে পারে । প্রকৃতি আপ্রাণ চেষ্টা করে তাকে সঠিক পথে আনার । কিন্তু যদি ব্যর্থ হয় তখন মানুষ যৌন বিকারগ্রস্ত মানসিক রুগী (Sex Maniac বা Perverted Sex) হতে পারে বা হতে পারে বিভিন্ন যৌন কুকর্মের কর্তা অর্থাৎ যৌন অপরাধী (Sex Offender) । তখন প্রয়োজন হয় চিকিৎসার । চিকিৎসার ফলে কে কি ভাবে ভাল হয় বা না হয় সে কিন্তু অন্য প্রসঙ্গ । আমাদের বর্তমান প্রসঙ্গের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক নেই । আমরা এখানে শুধু কারণ আর ফল নিয়েই আলোচনা করব প্রতিকার নিয়ে নয় ।

ওপরের প্যারাগ্রাফগুলি হয়ত পাঠকদের কিছুটা ধারণাও দিতে সমর্থ হয়েছে কিভাবে প্রকৃতি সেক্স বা যৌনতাকে মানুষের ( বা অন্যান্য জীবের) মধ্যে আনে, আর তাকে যৌন বিষয়ে পারদর্শী করে তোলা, যাতে পরিণত একটি মানুষ ( বা জীব বা উদ্ভিদ ) উপহার দিতে পারে তার ভবিষ্যৎ সুন্দর এক প্রজন্মকে ।

জীব (এর মধ্যে উদ্ভিদকেও ধরতে হবে), জড় আর শক্তি এই তিনটিই প্রকৃতির তৈরি করা জিনিস বলে আমরা মনে করতে পারি । আর প্রকৃতি কিন্তু সব সময়ই চায় এই তিনটি জিনিস যেন বয়ে চলে নিজের নিজের খাত ধরে । সেজন্য প্রকৃতিই সুন্দর ব্যবস্থা করে রেখেছে । বংশধারাকে নিজস্ব ধারায় প্রবাহিত করতে প্রকৃতি কিন্তু সদা-উন্মুখ ( ব্যতিক্রম কিন্তু ব্যতিক্রমই )।

তাহলে প্রকৃতি আর যৌনাচার দুটি বিষয় কিছু কিছু নিশ্চয় আমাদের বোধগম্য হয়ে থাকবে । যাদের না হবে তাদের অনুরোধ, একটু সময়ের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রথম থেকে আবার পড়ে নেবেন ।

এবার সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচারগুলি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে । মনে রাখবেন আমরা এখানে শুধুমাত্র এই ধরণের আচারগুলি নিয়ে আলোচনা করব । তাদের পরিণতি বা সেগুলি আইনসম্মত কি আইনবিরোধী কিংবা হলে তাদের কি বা কতটা শাস্তি এসব নিয়ে আলোচনা এখানে হবে না । কারণ সেগুলি আইন বিষয়ের ব্যাপার এবং বর্তমানে আমাদের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয় । এই নিবন্ধটি সমাজের বা লোকাচারের সঙ্গে যুক্ত । আইনের সঙ্গে নয় ।

দুটি প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে মিলিত হয়ে যৌনাচারে লিপ্ত হতে পারে । এক্ষেত্রে তারা বা তাদের কেউ একজন বিবাহিত হতেও পারে বা নাও হতে পারে । উভয়েই বিবাহিত হতে পারে বা উভয়েই অবিবাহিত হতে পারে । তবে প্রত্যেককেই প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে আর প্রত্যেকের সম্মতি (লোভ, ভয়, বলপ্রয়োগ বা নেশা দ্বারা আচ্ছন্নতা ব্যতিরেকে ) থাকা চাই । বহু দেশে অনেকে এইভাবে লিভ টুগেদার বা একত্র বসবাস করে থাকে । বা প্রাক-বিবাহ কালে যৌন অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকে । এই মিলনে সাধারণতঃ কারোর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি না হবারই সম্ভাবনা । এটি একটি সাময়িক চুক্তি মাত্র । তবে এরও কিছু সমস্যা থাকে। যেমন, ১) অসতর্কতার জন্য অবাঞ্ছিত সন্তান উৎপাদনের ঝুঁকি, ২) এর মধ্যে দুই বা যে কোনও এক পক্ষ বিবাহিত হলে তাদের বা তার সংসারের অশান্তি ও তৎ সংক্রান্ত সামাজিক ও আইনগত জটিলতা, ৩) যৌনরোগগুলির সংক্রমণ (Spreading of Sex-contaminated diseases) । বহুপত্নী (Polygamy) বা বহুস্বামী (Polyandry) আইনত সম্ভব নয় । সেজন্য বহু লোকে ( পুরুষ বা স্ত্রী ) এ ধরণের যৌনাচারে লিপ্ত হয় বা হতে পারে । এই যৌনাচারের পথগুলি প্রকৃতিবিরুদ্ধ না হলেও নানান সামাজিক ও সাংসারিক জটিলতার জন্ম দিতে পারে । নীতির অবনমনও ঘটতে পারে । তাই এই বিষয়টি সম্পর্কে এই প্রবন্ধের স্পষ্ট কোনও মত নেই ।


ধর্ষণ বা বলাৎকার বা Rape:

উপরোক্ত ক্ষেত্রে যদি যে কোনও এক পক্ষের সম্মতির অভাব থাকে তবে তাকে এই অভিধায় অবিহিত করা হয় । একথা মনে রাখতে হবে যৌনাচার বিষয়টি কোনও এক পক্ষের সিদ্ধান্ত দ্বারা সীমায়িত নয় । বিবাহিত নারীপুরুষ যখন মিলিত হয় তখন ধরে নেওয়া হয় যে পারস্পরিক ইচ্ছাতেই তারা এই কাজ করছে । একথা ঠিক যে অনেক সময় স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কোনো একজনের সাময়িক অসম্মতি থাকতে পারে । যেমন, অফিস থেকে ফেরা ক্লান্ত স্বামী মিলনে অনিচ্ছা প্রকাশ করতে পারে বা গৃহকর্মে বা অন্যান্য মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত স্ত্রী মিলনে অনিচ্ছা প্রকাশ করতে পারেন । পরে হয়ত ভালবাসার খাতিরে তারা মিলিত হন । হয়ত পৃথিবীর কিছু কিছু দেশ এই অনিচ্ছাকেও ধর্ষণের সমতুল হিসেবে দেখে। তবে আমাদের দেশের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি একে এখনও পর্যন্ত ধর্ষণ হিসেবে দেখে না । ধর্ষণে এক পক্ষ (ধরা যাক পুরুষ যারা নারীর তুলনায় শক্তিশালী ) ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে বা বল প্রয়োগ করে বা আঘাত করে বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে বা নেশা দ্বারা প্রতিপক্ষকে আচ্ছন্ন করে অন্য পক্ষকে যৌনাচারে বাধ্য করে থাকে । সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই যৌনাচার প্রথাসম্মত নয় ও নিষিদ্ধ ।


সমকামিতা (Homo-sexuality):

সম লিঙ্গ অর্থাৎ দুই পুরুষ বা দুই মহিলার মধ্যে পারস্পরিক যৌনাচার । এখানে দুই পক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক হলেও বা তাদের সম্মতি থাকলেও, উভয়ের মধ্যে বলপ্রয়োগ, লোভ, মৃত্যুভয়, নেশা দ্বারা আচ্ছন্নতা না থাকলেও তা কোনোভাবেই ধর্তব্য নয় । এইরূপ যৌনাচারকেও প্রকৃতিবিরুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয় । কারণ, এখানে যৌনাচারের নিজস্ব নির্দিষ্ট যৌনাঙ্গগুলির পরিবর্তে বিকল্প অঙ্গগুলি ব্যবহৃত হয় । যৌনাচারের নিজস্ব পথ ও প্রথাটি বিলুপ্ত হয় । অনেক সময় এটি একটি বিকৃত মানসিকতারও (Perversion) জন্ম দিতে পারে । যেমন ধরা যাক, যারা এই ভাবে অভ্যস্ত তারা স্বাভাবিক যৌনাচারে বিমুখ হতে পারে । প্রকৃতি তার ওপর তার বংশধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার যে দায়িত্ব দিয়েছে, তাকে দূরে ঠেলে সরিয়ে সে বিবাহ ও সংসার-জীবন থেকেই দূরে সরে থাকতে পারে । এবং এর দ্বারা বিভিন্ন যৌনরোগগুলির সৃষ্টি ও বিস্তার ঘটতে পারে ।


মেয়েদের মধ্যে সমকামিতা বা Tribalism or Lesbianism:

এই ক্ষেত্রে দুইটি নারী তাদের নিজ নিজ যৌনাঙ্গগুলি ব্যবহার করে থাকে যৌনাচারের জন্য । এখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিরুদ্ধ-যৌনসঙ্গী হিসেবে কল্পনা করে তৃপ্তি পায় । বলাই বাহুল্য এইরূপ যৌনাচার প্রকৃতি ও সমাজ সমর্থন করে না ।


মানবেতর প্রাণীর সঙ্গে যৌনাচার বা Bestiality:

এটা অনেকের ক্ষেত্রে বিস্ময়ের হলেও সত্যি যে, কিছু কিছু মানুষ পশুপাখিকেও তাদের যৌনাচারের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারে । সাধারণতঃ গরু, বাছুর, ভেড়া ছাড়াও হাঁসমুরগি পর্যন্ত এই কাজে ব্যবহৃত হতে পারে । তবে এই যৌনাচার স্বাভাবিক মানসিকতার দ্বারা সংঘটিত হয় না । বিকৃত মানসিকতা আর পশু পাখীর দ্বারা সঙ্গমে যৌনরোগগুলির নিরাময় হতে পারে এই ভ্রান্ত বিশ্বাস কিছু কিছু অস্বাভাবিক মানুষকে এই প্রকারের প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচারে লিপ্ত করতে বাধ্য করে । অনেকের পশুপাখি বেছে নেওয়ার অন্য অর্থ হল তাদের দ্বারা কোনও অনিষ্ট হবে না (তারা নিশ্চয় যৌনাচারী মানুষটির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে যাবে না ) এই বিশ্বাস ও নির্ভয়তা-প্রাপ্তি । ভারতীয় সমাজ এই যৌনাচার সমর্থন করে না।


শিশুর সঙ্গে যৌনাচারঃ

মন ও শরীর দ্বারা প্রাপ্তবয়স্ক নয় এমন শিশু যৌনাচারের কোনও পক্ষ হতে পারে না । কারণ তাদের যৌনাঙ্গগুলি ও মস্তিষ্ক যৌনাচারের পক্ষে অপরিণত থাকে । এই প্রকার যৌনাচার শুধু তাদের শরীরেই নয় মনেও প্রভাব বিস্তার করে অত্যন্ত গভীরভাবে আর এই প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী এমন কি সারাজীবন ধরে তার মানসিক স্বাস্থ্যকে পঙ্গু করে দিতে পারে । সংগত কারণেই প্রকৃতি ও সমাজ এই ধরণের কাজ সমর্থন করে না ।


নিকট রক্ত-সম্পর্কের ব্যক্তির সঙ্গে যৌনাচার (Sexual act between two persons having very near blood relationship) বা Incest:

খুব নিকট সম্পর্কের ব্যক্তি যেমন বাবা/মেয়ে, মা/ছেলে, কাকা-কাকিমা/ ভাইঝি-ভাইপো, সৎ মা-বাবা/ সৎ ছেলে-মেয়ে, ভাই/বোন, সৎ ভাই/ সৎ বোন, ঠাকুরদা / নাতনি, ঠাকুমা/ নাতি ইত্যাদি । সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে এগুলি অস্বাভাবিক ।

ওপরে যে ধরণের যৌনাচারগুলির কথা বলা হল সেগুলি ছাড়াও আরও বহু প্রকার যৌনাচার আছে । মনে রাখতে হবে, এই আচারগুলির কিছু কিছু হয়ত কোনও কোনও দেশে আইনসিদ্ধ, আবার হয়ত কোনও কোনও দেশে আইনবিরুদ্ধ । এ সম্পর্কে এই প্রবন্ধকারের কোনও বক্তব্য নেই । আইনের কথা আইন বলবে । আমরা সমাজের লোক আমরা শুধু সমাজের কথা বলব ।

পাঠকরা লক্ষ করে দেখেছেন হয়ত, আমি প্রকৃতিসম্মত যৌনাচার সম্পর্কে কিছুই বলি নি । পাঠকরা আরও লক্ষ করে দেখেছেন যে, আমি না বলা সত্ত্বেও এই বিষয়টি কিন্তু ইতিমধ্যেই তাঁদের বোধগম্য হয়েছে । কারণ ইতিবাচক বিষয়টি পাবার একটি রাস্তা হচ্ছে নেতিবাচক বিষয়গুলিকে বাদ দেওয়া । যেমন চাল থেকে কাঁকর বাছা বা ছাঁকনি দিয়ে চায়ের পাতাগুলিকে চায়ের লিকার থেকে আলাদা করা । সেটা তাঁরা করেছেন আর আসল বিষয়টি নিজে নিজেই পেয়ে গিয়েছেন । এই কৃতিত্ব আসলে শুধু লেখকের নয়, সচেতন পাঠকেরও বটে ।

এটা সকলেই স্বীকার করবেন যে, যৌনতাকে বাদ দিয়ে জীবন হয় না । কারণ যৌনতার আবশ্যকতাই হল বংশধারাকে স্বখাতে প্রবাহিত-করণ । মানুষ অত্যন্ত উন্নত প্রজাতির প্রাণী । তাই সে শুধুমাত্র সুন্দর বর্তমান নিয়েই খুশি ও সুখী নয় । তার সুখ আর আনন্দ সুন্দর এক ভবিষ্যতকে খুঁজে নেওয়ার মধ্যেও । সুস্থ যৌনতা মানুষকে সেই সুযোগ দেয় । সুস্থ যৌনতা মানে সুন্দর জীবন । বৃহৎ অর্থে তা একটি সুন্দর সমাজ গড়তে সাহায্য করে । মানুষের মনের অসুস্থ ও বিকৃত কামনা সমাজের নানা অশান্তি ও অপরাধের সূচনা ঘটাতে পারে । সূচনা করতে পারে নানা মানসিক ব্যাধি ও তৎ সংক্রান্ত জটিলতা । দিনে দিনে দিকে দিকে যৌন বিকার আর যৌন অপরাধগুলি বেড়েই চলেছে । আজকের সমাজ তাই এক অদ্ভুত যৌন সংকটের ভারে ভারাক্রান্ত । তাই আসুন না, আজ থেকে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক সুস্থ যৌনতা – সুস্থ জীবন – সুস্থ সমাজ আর পরিশেষে সুন্দর ও উজ্জ্বল এক ভবিষ্যৎ ।


5 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ এ ৩:০৯ PM

    অরুণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার ও ভারতের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ' প্রবন্ধটিতে খুব গভীরভাবে চিন্তা করে তাঁর কিছু মতামত জানিয়েছেন। তিনি একজন হোমিয়োপ্যাথ,সেই সুবাদে যৌনতার কিছু শারীরবৃত্তীয় ব্যাখ্যা এই প্রবন্ধে তিনি দিয়েছেন,যা' বড়োই কৌতূহলোদ্দীপক ! মনে হয় প্রবন্ধটি পাঠকের মনে কিছু প্রশ্ন জাগাতে পারে, সেক্ষেত্রে উৎসাহীরা স্বচ্ছন্দে তাঁদের মতামত দিয়ে মন্তব্য ও প্রশ্ন করতে পারেন।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. শ্রদ্ধেয় দেবাশিস কাঞ্জিলাল মহাশয়কে ধন্যবাদ । বর্তমানে আমাদের সমাজ একটি গভীর অবক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে । যৌনতাকে শুধুমাত্র বিনোদন হিসেবে না দেখে এটিকে মানব সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য স্তম্ভ হিসেবে দেখার প্রয়োজনীয়তা আমার দ্বারা উপলব্ধ হয়েছে । প্রত্যেক পাঠকের কাছে আমার অনুরোধ প্রবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পড়ে আপনার সুচিন্তিত ও মূল্যবান ম্নতব্যটি দিন । এতে অর্থাৎ এই মত বা দৃষ্টি ভঙ্গির বিনিময়ে অন্য সকলের মত লেখকও উপকৃত হবে ।

      মুছুন
    2. শ্রদ্ধেয় দেবাশিস কাঞ্জিলাল মহাশয়কে ধন্যবাদ । বর্তমানে আমাদের সমাজ একটি গভীর অবক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে । যৌনতাকে শুধুমাত্র বিনোদন হিসেবে না দেখে এটিকে মানব সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য স্তম্ভ হিসেবে দেখার প্রয়োজনীয়তা আমার দ্বারা উপলব্ধ হয়েছে । প্রত্যেক পাঠকের কাছে আমার অনুরোধ প্রবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পড়ে আপনার সুচিন্তিত ও মূল্যবান ম্নতব্যটি দিন । এতে অর্থাৎ এই মত বা দৃষ্টি ভঙ্গির বিনিময়ে অন্য সকলের মত লেখকও উপকৃত হবে ।

      মুছুন
  2. অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের স্বভাব-সিদ্ধ প্রাঞ্জল ভাষা এবং তাঁর শারীরবৃত্তীয় জ্ঞান লেখাটিকে একটা আলাদা মাত্রা দিয়েছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে, অরুণদার কিছু কথার সঙ্গে সহমত নই। মানুষের গো-দুগ্ধ পান ও কিন্তু প্রকৃতি বিরুদ্ধ ! আপনারা কি প্রকৃতিতে মানুষ ছাড়া আর একটি স্তন্যপায়ী জীবের নাম বলতে পারেন, যে অপর একটি প্রাণীর স্তন-নিসৃত দুধ পান করে ? আর একজন শরীর-তত্ত বিদ হিসাবে অরুণ দা যখন হরমোন নিয়ে আলোচনাই করলেন, তখন এটা কেন উল্লেখ করলেন না যে প্রতিটি পুরুষের মধ্যে যেমন কিছু স্ত্রী হরমোন আছে, প্রতিটি নারীর মধ্যেও কিন্তু পুরুষ হরমোন আছে। এই দু ধরণের হরমোনের সমতা না থাকার জন্যেই, কিছু পুরুষের পৌরুষের বদলে মেয়েলী ভাব এবং কিছু নারীর মেয়েলি ভাবের চেয়ে পৌরুষত্ত প্রকাশ পায়। কারো কারো গোঁফ-দাড়িও গজায় ! এবং সমকামিতার ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে দুজন পুরুষ বা মহিলা শারীরবৃত্তীয় ভাবে স্ব-গোত্র হলেও ওই হরমোনের হেরফের এর কারণে একজন মেয়েলী এবং অপরজন পুরুষালী স্বভাবের হয়। সে যাই হোক, বিষয়-বস্তু নিয়ে মতভেদ থাক্তেই পারে, তবে অরুণ দার লেখাটির প্রশংসা না করে পারলাম না !

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ মাননীয় স্বপন দেব মহাশয়কে । আমার প্রবন্ধে হরমোন সম্পর্কে ততটুকই আলোচনা করা হয়েছে যতটা দরকার যৌনতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য । হরমোন অর্থাৎ Endocrinology একটি বিশাল subject. অনাবশ্যকভাবে এতটা আলোচনা করে পাঠকের সময় আর ধৈর্য কেড়ে নেওয়াতে তাঁদের ওপর একটা অত্যাচার বিবেচনা করে আমি আর সেদিকে এগোই নি । আপনি খেয়াল করে দেখবেন আমার সেই অপারগতার কথা আমার প্রবন্ধে আমি বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছি ।

      মুছুন