প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

সেকালের থিয়েটার ও নটী বিনোদিনী
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



পুরুষতান্ত্রিক আমাদের সমাজে সমাজ প্রগতির প্রক্রিয়ায় নারীর অবদানকে যোগ্য স্বীকৃতি কোনদিনই দেয় না । বাংলা থিয়েটারে আদিপর্বে এক বারাঙ্গনা কন্যা তাঁর তন্ময় সাধনায় ও মেধায় সেকালের অভিনয় জগতের সম্রাজ্ঞী হয়ে উঠেছিলেন ও বাংলা থিয়েটারের নির্মাণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছিলেন, তার স্বীকৃতিও এই সমাজ দেয় নি । তিনি বিনোদিনী দাসী বা নটী বিনোদিনী ।

অন্যরকম ভাবে বাঁচার তাগিদে পিতৃ-পরিচয়হীনা বিনোদিনী থিয়েটারকেই তাঁর মুক্তিতীর্থ ভেবেছিলেন, প্রবল বঞ্চনা ও ছলনার শিকার হয়ে খ্যাতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেও মাত্র ২৩ বছর বয়সে চিরতরে মঞ্চত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন । আশার কথা, তাঁর জন্মের সার্ধশত বর্ষে এই মহীয়সী রমণীকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাঁর জীবনকাহিনী আমরা জানতে চাইছি ।

১৮৭৪এর শেষের দিক, তখন বাংলা থিয়েটারের নিতান্ত শৈশবকাল । ঠিক দু’বছর আগে, ১৮৭২এর ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়েছে দীনবন্ধু মিত্রর ‘নীল দর্পন’ নাটক দিয়ে । তার আগে কলকাতার ধনাঢ্য বাবুদের বদান্যতায় জমিদার বাবুদের আঙ্গিনায় সখের থিয়েটার হত মাঝে মধ্যে । কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তখন কলকাতার নতুন বিনোদন থিয়েটার দেখার সুযোগ ছিল না ।

ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সাধারণের জন্য থিয়েটারের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু নাটকের নারী চরিত্র রূপায়ণ করতেন পুরুষ অভিনেতারাই । ১৮৭৩এ বেঙ্গল থিয়েটার চারজন বারাঙ্গনা কন্যাকে অভিনেত্রী নিয়োগ করেছিলেন। মেয়েদের কাছে নাট্যাভিনয়ের দরজা খুলে গেলো সেই প্রথম, যে কাজের অক্লান্ত সৈনিক ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ।

মধুসূদনের বেঙ্গল থিয়েটারে নাটক দেওয়ার শর্তই ছিল নারীচরিত্রে অভিনয় মেয়েদের দিয়েই করাতে হবে । ১৮৭৩ সালের ১৬ই অগস্ট মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকটি দিয়ে বাংলা নাট্যাভিনয়ে অভিনেত্রী নিয়োগের ধারাবাহিকতার সূচনা হয় । এই যুগান্তকারী ঘটনাটি অবশ্য দেখে যেতে পারেননি মধুসূদন, তার আগেই মৃত্যু হয় বাংলা থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের পক্ষে অক্লান্ত সৈনিক মাইকেল মধুসূদন দত্তর (২৯জুন ১৮৭৩) ।

মেয়েদের জন্য থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জগতের মেয়েরা মর্য্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলেন । তাদের একটা তাগিদ ছিল – মুক্তির তাগিদ । থিয়েটারকে তাই তারা নিজেদের মুক্তিতীর্থ মনে করলেন, থিয়েটারকে ভালোবেসে পবিত্র হতে চাইলেন ।

এই পথ ধরে বিনোদিনীও এলেন থিয়েটারকে ভালোবাসতে । বারো বছরের বালিকা বিনোদিনী দশটাকা মাস-মাইনেতে ভর্তি হয়ে গেলেন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে, নাট্যশিক্ষক অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি ।

১৮৭৫এর শুরুতে অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফির পরিচালনায় গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার লক্ষ্ণৌ, লাহোর, দিল্লী প্রভৃতি স্থানে অভিনয় করে নীলদর্পণ, সুরেন্দ্রবিনোদিনী, সতী কি কলঙ্কিনী, গজানন্দ ও যুবরাজ প্রমু্খ ইংরাজ বিরোধী নাটক । বিনোদিনীও সেই দলে ছিলেন ।

তাঁদের নাটকেই ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরাজ-শাসন জারি করে কুখ্যাত নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন । গ্রেট ন্যাশনাল বন্ধ হয়ে যায়, বিনোদিনী যোগ দেন বেঙ্গল থিয়েটারে । এখানে বিনোদিনী অভিনয় করলেন ‘মেঘনাদ বধ’ নাটকে প্রমীলা, ‘দুর্গেশ নন্দিনী’’তে আয়েষা, ‘কপাল কুণ্ডলা’ প্রমুখ দুরূহ চরিত্রে । বেঙ্গল থিয়েটারে বিনোদিনী অভিনয় করেছিলেন মাত্র উনিশ মাস আর এই অল্প সময়েই সেকালের সব প্রধান নাট্যকারের নাটকের মুখ্য ভুমিকায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন বিনোদিনী ।

নজরে পড়েন গিরীশচন্দ্র ঘোষের । গিরীশচন্দ্র ঘোষ তাঁকে নিয়ে আসেন নিজ মালিকানাধীন ন্যাশনাল থিয়েটারে । চারবছর পরেই গিরীশচন্দ্রের ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিকানা বদল হয় । হীরা জহরতের ব্যবসায়ী মাড়োয়ারি যুবক প্রতাপ চাঁদ জহুরী থিয়েটার ব্যবসায়ে নামেন ও ন্যাশনাল থিয়েটার কিনে নেন ।

গিরীশচন্দ্র চাকুরী ছেড়ে পেশাদার বেতনভোগী ম্যানেজার হন । গিরীশচন্দ্রকে সামনে রেখেই প্রতাপ জহুরীর থিয়েটার ব্যবসায়ে নামা । প্রতাপ জানতেন গিরীশচন্দ্র থাকা মানেই বিনোদিনীর থাকা । কেননা ইতিমধ্যেই বিনোদিনীর অভিনয়ই তখনকার নাট্যজগতের প্রধানতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল ।

বস্তুত, এই সময় থেকে বাংলা থিয়েটার তার শৈশব কাটিয়ে পুরো মাত্রায় পেশাদারী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়িয়েছিল । বিনোদিনীর বারো বছরের অভিনয় জীবনের নয় বছরই কেটেছে গিরীশচন্দ্রের সঙ্গে, অভিনয় করেছেন ৯৬টি নাটকে ।

বিনোদিনীর নিজের কথায় - “তাঁহার শিক্ষায় আমার যৌবনের প্রথম হইতে জীবনের সারভাগ অতিবাহিত হইয়াছে” । অর্থাৎ বাংলা থিয়েটারের উদ্ভব পর্বের শৈশব অবস্থা থেকে পেশাদারী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় বিনোদিনীর যোগদান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল । বিনোদিনীকে বাদ দিয়ে ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই একযুগের বাংলা থিয়েটারের কোন আলোচনা করা যায় না ।

বিনোদিনীর সামনে অভিনয়ের কোন অনুসরণযোগ্য আদর্শ ছিল না । তাকে শুরু করতে হয়েছে শূণ্য থেকে । দ্বিতীয়ত, সেকালের অভিনেত্রীরা বারাঙ্গনা হওয়ার কারণে পত্র-পত্রিকাগুলিতে তাদের অভিনয়ের আলোচনা কদাচই থাকতো । বিনোদিনীর প্রথম অভিনয় ১৯৭৪এর ১২ই ডিসেম্বর, গিরীশচন্দ্রের ‘শত্রু সংহার’ নাটকে একটি অপ্রধান চরিত্র দ্রৌপদীর সখীর ভূমিকায় । মাত্র চার পাঁচটি সংলাপ । মাত্র তিনমাস পরেই ১৮৭৫এর ৬ই মার্চ ‘হেমলতা’ নাটকের নামভূমিকায় এবং তারপর অভিনয় করেন নীলদর্পণ, লীলাবতী, নবীন তপস্বিনী, সধবার একাদশী, সরোজিনীর মত গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের মঞ্চসফল নাটকগুলিতে ১৮৭৬এর ফেব্রুয়ারির মধ্যে ।

অতএব আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, অভিনয় দক্ষতার জন্যই মাত্র একবছরের মধ্যে নাটকের ক্ষেত্রে বিনোদিনী কত অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন ।

বিনোদিনী তাঁর ১২বছরের নাট্যজীবনে চারটি মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন – গ্রেট ন্যাশনাল’ ‘বেঙ্গল থিয়েটার’, ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ ও ‘স্টার থিয়েটার’। নাট্য শিক্ষক পেয়েছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি(গ্রেট ন্যাশানাল), শরৎচন্দ্র ঘোষ (বেঙ্গল) এবং গিরীশচন্দ্র ঘোষ (ন্যাশনাল ও স্টার থিয়েটার) । বেঙ্গল থিয়েটারে দু’বছর থাকা কালীন বিনোদিনী যথার্থ পরিণত হয়ে উঠেছিলেন । বঙ্কিমচন্দ্রের মৃণালিনীতে ‘মনোরমা’, ‘কপাল কুন্ডলা’, দূর্গেশ নন্দিনীর ‘আয়েষা’ ও ‘তিলোত্তমা’, মেঘনাদ বধ’এ ‘প্রমীলা’র মত জটিল চরিত্রের অভিনয়ে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছিলেন । মৃণালিনীতে ‘মনোরমা’র জটিল চরিত্রটিকে বিনোদিনী কেমন বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেকথা আত্মকথায় লিখে গেছেন, “একসঙ্গে বালিকা, প্রেমময়ী যুবতী, পরামর্শদাতা, মন্ত্রী, অবশেষে পরম পবিত্র চিত্তে স্বামী সহ-মরণ অভিলাষিণী দৃঢ়চেতা এক রমণী”। বিনোদিনী তখন ১৪বছরের বালিকা । এমন বিশ্লেষণই বলে দেয় তাঁর অভিনয় প্রতিভার গভীরতা ।

স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র মৃণালিনীর অভিনয় দেখে মন্তব্য করেছিলেন, “আমি মনোরমার চিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখনো যে প্রত্যক্ষ করিব এমন আশা করি নাই । আজ বিনোদের অভিনয় দেখিয়া সে ভ্রম ঘুচিল”।

এহেন বাংলা থিয়েটার বিনোদিনীকে মনে রাখেনি । বিনোদিনীকে পাওয়ার লোভে গুর্মুখ রায় মুসাদ্দি নামে এক মাড়োয়ারি যুবক থিয়েটারের ব্যবসায়ে নামেন । তিনি একটি থিয়েটার বাড়ি নির্মাণ করে দেবেন, কিন্তু গিরীশচন্দ্রদের শর্ত দিলেন বিনোদিনীকে তাঁর রক্ষিতা হয়ে থাকার জন্য রাজি করাতে হবে, আর থিয়েটার হবে বিনোদিনীর নামে । নিজেদের থিয়েটার হবে, শিল্পীদের থিয়েটার হবে তাঁর নামে, এই প্রতিশ্রুতিতে বিনোদিনী সম্মত হয়েছিলেন গিরীশচন্দ্রদের প্রস্তাবে । নানা গন্ডগোলের কারণে গুর্মুখ রায় থিয়েটার বাড়ির বদলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন বিনোদিনীকে ।

বিনোদিনী নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভ হেলায় ত্যাগ করেছিলেন । বলেছিলেন থিয়েটার বাড়ি না হলে তিনি গুর্মুখের সঙ্গিনী হবেন না । দেড়শ’ বছর আগে পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভ হেলায় ত্যাগ করেছিলেন যিনি, তাঁকে প্রতারিত হতে হ’ল তাঁর সহ অভিনেতা নাট্যরথীদের কাছ থেকে । বাংলা পেশাদারী থিয়েটারের উদ্ভব কালের সে এক ক্লেদাক্ত ঘটনা ।

বিনোদিনী তাঁর আত্মকথায় লিখে গিয়েছেন, “শীঘ্র শীঘ্র প্রস্তুতের জন্য রাত্র পর্যন্ত কার্য হইত । সকলে চলিয়া যাইতেন । আমি, গুর্মুখ বাবু আর দু’একজন রাত্রি জাগিয়া কার্য করাইয়া লইতাম” । থিয়েটার বাড়ি হল, কিন্তু গুর্মুখ রায় বা বিনোদিনীর অজান্তে গিরীশবাবুরা সেই থিয়েটারের রেজিস্ট্রী করে নিলেন বিনোদিনী থিয়েটার নয়, ‘স্টার থিয়েটার’ নামে ।

বিনোদিনী তাঁর আত্মকথায় লিখে গিয়েছেন, “আমি তখন একেবারে উহাদের হাতের ভিতর! আর আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই যে, উহারা ছলনা দ্বারা আমার সহিত এমনভাবে অসৎ ব্যবহার করিবেন” ।

এই প্রবঞ্চনা সত্বেও থিয়েটারের প্রতি তাঁর ভালোবাসার জন্য বিনোদিনী স্টার থিয়েটারেই থেকে গিয়েছিলেন । ১৮৮৩র ২১শে জুলাই স্টার থিয়েটারের উদ্বোধন হয় গিরীশচন্দ্রের ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটক দিয়ে, সতীর ভুমিকায় বিনোদিনী ।

মাত্র ছয়মাস পরেই অসুস্থতা ও পারিবারিক চাপে গুর্মুখ থিয়েটার ব্যবসা ত্যাগ করেন । গুর্মুখ চেয়েছিলেন যার জন্য তিনি থিয়েটার বানিয়েছিলেন সেই বিনোদিনীকে থিয়েটারের স্বত্ব দিয়ে যেতে । এবারেও গিরীশ বাবুরা বাধা দিলেন । সরলমতী থিয়েটারে নিবেদিতপ্রাণা বিনোদিনী আবারও বঞ্চিত হলেন ।

মাত্র এগারো হাজার টাকায় স্টার থিয়েটার কিনে নিয়েছিলেন অমৃতলাল মিত্র, দাশুচরণ নিয়োগীরা ।

কেন এই প্রতারণা ? সেকালের নাট্যরথীরা বলেছিলেন, এক বারাঙ্গনা কন্যার নামে থিয়েটার সে যুগের সমাজ মেনে নিত না, থিয়েটার চলতো না ।

অথচ এই বারাঙ্গনা কন্যার অভিনয়ই সেদিন বাংলা থিয়েটারকে মর্যাদামন্ডিত করেছিল । ১৮৮৪’র ২রা অগস্ট গিরীশচন্দ্রের ‘চৈতন্য লীলা’য় নিমাই চরিত্রে বিনোদিনীর অভিনয় দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ দেব ভাববিহ্বল হয়ে পড়েন, বিনোদিনীর মস্তক স্পর্শ করে আশির্বাদ করেন । থিয়েটারে অশুচিতার বেড়া ভেঙ্গে যায় । ১৮৮৬র ১৬ই অগস্ট রামকৃষ্ণ দেবের মৃত্যু, আর তার চারমাস পরেই একরাশ ক্ষোভ ও যন্ত্রণা নিয়ে অভিনয় খ্যাতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেও ১৮৮৭র ১লা জানুয়ারী থিয়েটার ত্যাগ করেন মাত্র ২৩ বছর বয়সে । আর ফিরে আসেন নি ।

মঞ্চ ত্যাগের পর আরো পঞ্চান্ন বছর বেঁচে ছিলেন বিনোদিনী । বৃদ্ধ বয়সেও স্টারে থিয়েটার দেখতে আসতেন । গিরীশবাবুরা তাকে মঞ্চে ফিরিয়ে আনার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি ।

সেকালের সব অভিনেত্রীই আসতেন বারাঙ্গনা পল্লী থেকে, যাঁরা সকলেই বাংলা থিয়েটারের নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছেন, বাংলা থিয়েটারকে মর্যাদামন্ডিত করেছেন, তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকুও এই সমাজ দেয় নি । গিরীশচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহে মালা দেবার অধিকারটুকুও তাদের দেওয়া হয়নি । বিনোদিনীর কন্যা সন্তানকেও সমাজপতিরা বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে বাধা দিয়েছিলেন, বিনোদিনী পারেননি তার কন্যা শকুন্তলাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে । থিয়েটারের প্রথম অভিনেত্রী গোলাপ সুন্দরী বা স্বনামে সুকুমারী দত্ত দেশের প্রথম মহিলা নাট্যকারের সম্মান অর্জন করেছিলেন, গিরীশ-যুগের অভিনেত্রী কৃষ্ণভামিনী তাঁর অর্জিত সম্পত্তি দান করেছিলেন শিক্ষা বিস্তারের কাজে । আবার গিরীশ-যুগ থেকে শিশির-যুগের অভিনেত্রী কুসুম কুমারী বৃদ্ধা বয়সে রংমহল থিয়েটারের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতেন ।

৭৯ বছর বয়সে ১৯৪১এর ১২ই ফেব্রুয়ারি জন্মস্থান ১৪৫নম্বর কর্নওয়ালিশ ষ্ট্রীটের বাসায় নিভৃতে তাঁর মৃত্যুকালে বাঙ্গালির সমাজ অনেক উদার, তবুও কিন্তু অন্ধকার জগত থেকে উঠে আসা , আমাদের থিয়েটারের নির্মাণে অসামান্য অবদান রেখে যাওয়া এক নটীর মৃত্যুতে কোন শোকসভা হয়নি ।

কোন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল কি না জানা নেই । তাঁর একটি কবিতার পংক্তিতে “স্মৃতি হ’তে বিস্মৃতিতেই অধিক সন্তোষ” মনে করেছিলেন বিনোদিনী । দেড়শ বছর পর আমরা কিন্তু ইতিহাসের সেই ছিন্নপত্র সন্ধান করে বেদনাহত হয়ে যাই ।


4 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ এ ২:২৭ PM

    নটী বিনোদিনীকে কেন্দ্র করে গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও তৎকালীন নাট্যজগতের এক সময়-পর্বকে ধরেছেন শ্রদ্ধেয় ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় তাঁর মনোজ্ঞ প্রবন্ধ 'সেকালের থিয়েটার ও নটী বিনোদিনী'তে ! এই লেখা পাঠককে সেই সময়ের নাট্যজগত সম্পর্কে সম্বৃদ্ধ করবেই ।

    উত্তরমুছুন
  2. লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ দেবাশিস কাঞ্জিলাল । যেকোন লেখা পড়ে একজন পাঠকও যদি তাঁর পাঠপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তা সে ভালোলাগা বা নালাগা যাই হোক , লেখক উতসাহিত হন

    উত্তরমুছুন
  3. ফাল্গুনী গুণী মানুষ। তৎকালীন নাট্য জগত কে যে ভাবে সোসিও-ইকনমির পার্স্পেক্টিভ এ বর্ণনা করেছেন, তার যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন এবং সর্বোপরি যে ভাবে বিনোদিনির বঞ্চনা কে সামনে এনেছেন, তা কোন প্রশংসার ই ধার ধারেনা ! আমি এই লেখাটি থেকে সমৃদ্ধ হলাম।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. সমকালীন সময়ের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটটি তুলে না ধরলে কোন লেখাই অর্থবহ হয় না বলেই আমার বিশ্বাস । মাননীয় স্বপন দেব এই সত্যটিকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁর পাঠ প্রতিক্রিয়ায় । তিনি নিশ্চিত ভাবেই মননশীল ও মনযোগী পাঠক , লেখাটি পড়েছেন বলে ধন্যবাদ ।

      মুছুন