ছোটগল্প - নারায়ণ রায়

শ্রী কুঞ্জ বিহারী সিংহ
নারায়ণ রায়



বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। রমেনের বয়স তখন মাত্র ২৪ কি ২৫ বছর। বি কম পাশ করে সবে একটা সওদাগরি অফিসে ‘অ্যাকাউন্টস এসিসট্যান্ট’ হিসেবে চাকরীতে ঢুকেছে । ওর অফিসটা শহর থেকে একটু দূরে কলকাতার উপকন্ঠে। প্রায় দশ-বারো একর জমির উপর একটা ছোট খাটো রেডিমেড পোশাকের কারখানা। অবশ্য কারখানা বলতে আমাদের চোখের সামনে যে ছবিটা ভেসে ওঠে, এই অফিসের পরিবেশটা ঠিক সেরকম নয় । এই অফিসের পরিবেশটা রমেনের বেশ ভালো লাগে। মূল কারখানায় আলাদা কয়েকটা শেড আছে, কাটিং সেকশন, স্টিচিং সেকশন, প্যাকেজিং, স্টোর ইত্যাদি। এছাড়া একটি অফিস বিল্ডিং, ক্যান্টিন, গেস্ট হাউসও আছে। আর রয়েছে ক্যাম্পাসের মধ্যেই একটি বাঁধানো ঘাট সমেত পুকুর ও বেশ কিছু ফল ও ফুলের গাছপালা। পরিবেশটা এতোটাই মনোরম যে শীতকালে মালিকের জানাশোনা অনেকে এখানে পিকনিক করে আসে। রমেনের বাড়ি কলকাতা থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা জেলা শহরে, তাই অফিসের কাছেই স্টেশনের পাশে ওরা অফিসরই ক’জনে মিলে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে মেসের মত করে থাকে। রমেনের বাড়ির আর্থিক অবস্থা মোটামুটি খারাপ নয়, অর্থাৎ তার আয়ের উপর সংসার নির্ভরশীল নয়। তাই সংসারের প্রতি সেই অর্থে কোন দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজন হয় না। আর সেই জন্যই বোধ হয় রমেনের মত ছেলেদের চাকরীর এই প্রথম জীবনটাই সব চেয়ে সুখের। একলা মানুষ, আর্থিক স্বাধীনতা আছে অথচ ঘাড়ের উপর সংসার নামক জোয়াল টানার দায় নেই। বয়সটাও আনন্দ করারই বয়স, যাকে বলে মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলরের জীবন।

অল্প দিনের চাকরীতেই রমেনের বেশ সুনাম হয়েছে অফিসে। শান্ত, নম্র, ভদ্র রমেনকে ওর বড়বাবু নিতাইবাবু কিম্বা উপরওয়ালারা যখনই যা কাজ দেন নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালন করে রমেন।

অফিসে ঢুকে প্রথম বড় ঘরটির চার পাঁচটি চেয়ার টেবিলের প্রথম সারিতেই বসে রমেন, পাশাপাশি ওর কয়েক জন সহকর্মী ও একটি কিউবিকলের মধ্যে বসেন বড়বাবু নিতাইচন্দ্র জোয়ারদার। এহেন রমেন একদিন যখন অফিসের কাজে ব্যস্ত, ঠিক তখনই ওর সামনে এসে দাঁড়ালো সেই লোকটি। রমেন মাথা তুলে লোকটিকে দেখেই বুঝতে পারলো সে অফিসের কোনও কর্মী নয়, তাই রমেন মুখ তুলে ভালো করে একবার লোকটিকে দেখে নিলো তারপর জিজ্ঞেস করলো-“কি চাই বলুন?” পৃথিবীতে কিছু কিছু লোক থাকেন যাদেরকে কোনমতেই সুন্দর দেখতে বলা যাবে না, অথচ তাদের দুটি চোখ আর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হওয়াও যায় না। লোকটির গাত্রবর্ণ বেশ কালো, শীর্ণ ও ছোটখাটো চেহারার, অতি সাধারণ পোষাক পরিহিত এবং সাতদিনের না কামানো কাঁচা পাকা দাড়ি শোভিত মুখে একাদশীর চাঁদের ন্যায় একফালি দাঁত বার করে, অদ্ভুত একটি মায়াবী হাসি হেসে হাত দুটি জোড় করে বললো, “আজ্ঞে আমার নাম শ্রী কুঞ্জ বিহারী সিংহ।” রমেন কোনরকমে তার হাসিটি চেপে জিগ্যেস করলো “কিন্তু এখানে কি চাই?” কুঞ্জবিহারীর চটপট জবাব “ আজ্ঞে কাজ।” কথাটা লোকটা এত সহজ ভাবে বলল, যেন এক গ্লাস জল খেতে চাইল। রমেনের মত একজন অতি নবীন কর্মচারীর পক্ষে এইরকম একজন ব্যক্তিকে অফিসের চাকরী সংক্রান্ত ব্যাপারে কি বলা উচিত, যখন এইসব ভাবছে, ঠিক তখনই বড়বাবু নিতাইচন্দ্র জোয়ারদার মশাই তার ঘর থেকে বেরিয়ে সাহেবের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন।

নিতাইবাবু কিছু বলার আগেই লোকটি হাত দুটি জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল “আজ্ঞে আমি শ্রী কুঞ্জ বিহারী সিংহ।” নিতাইবাবু উভয়ের কাছ থেকে ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বললেন “দেখ বাপু আজকাল চাকরী কি এতই সহজ? আমাদের কাজ আছে,এখন তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই, তুমি এখন এসো বাপু।”

“আঙ্জ্ঞে আমি সব কাজ পারি, রান্না করা, জামা কাপড় কাচা থেকে শুরু করে সব রকমের কাজ…. ছেলেমেয়ে গুলো আমার না খেতে পেয়ে মরতে বসেছে বাবু…. একটু দেখুন না বাবু!” নাছোড়বান্দা কুঞ্জবিহারীকে বোঝাতে হিমসিম খেয়ে দুজনায় যখন নাজেহাল তখন খোদ বড় সাহেব বেরিয়ে এলেন তাঁর ঘর থেকে। একটা সময় তারা সবাই বুঝতে পারলেন যে কুঞ্জবিহারীকে পরাস্ত করা এক কথায় অসম্ভব। তখন সাহেব ঠিক করলেন, নিয়মিত চাকরী দেয়া যেহেতু সম্ভব নয়, তাই কুঞ্জবিহারী প্রতিদিন অফিসে এসে অপেক্ষা করবে এবং যেদিন যেমন প্রয়োজন সেইমত ওকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া হবে আর সপ্তাহান্তে ওকে দৈনিক ভিত্তিতে ভাউচারে পেমেন্ট করা হবে। সেই অনুযায়ী কুঞ্জবিহারীকে দিয়ে কয়েকটি কাগজ-পত্রে সই করিয়ে নেয়া হ’ল এবং সর্বত্র সে একই ভাবে সাক্ষর করল …. শ্রী কুঞ্জ বিহারী সিংহ।

যথারীতি কুঞ্জবিহারী পরদিন বেলা দশটার অনেক আগেই অফিসে এসে হাজির…. দুই-চার দিনের মধ্যেই অফিসের সবাই বুঝতে পারলো যে কুঞ্জবিহারী সত্যিই বেশ কাজের লোক, মোটামুটি সব ধরনের কাজই সে জানে। বেশ চটপটে, কোন কাজেই তার না নেই, এই ফিল্টারে জল ভরে দিচ্ছে, তো পরক্ষনেই ক্যান্টিন থেকে বাবুদের চা-বিস্কুট এনে দিচ্ছে। এমনকি ঝাড়ুদার না এলে পুরো অফিসটা ঝাঁট দিয়ে দেয় এক নিমেষে। এখন আর দুপুরে বাবুরা ক্যান্টিনে খেতে যান না, কুঞ্জবিহারীই সবার খাবার বয়ে নিয়ে আসে ক্যান্টিন থেকে। আসলে টিফিন কিম্বা দুপুরের খাবার যাই হোক না কেন, সবার খাবার থেকে একটু করে ভাগ পেলেই ওর নিজের খাবারটা হয়ে যায়। আর সপ্তাহান্তে অফিস থেকে পাঁচ-সাতশো যা পায় সেটা তো আছেই। তেমন সুযোগ পেলে কোন কোন দিন ক্যান্টিনের বাড়তি খাবার চেয়ে নিয়ে বাড়ি নিয়ে যায়, কেউ কিছু জিগ্যেস করলে বলে, “কি করব? অনেকগুলো ছেলেপুলে!” যদি কেউ বলে-“এ যুগে এত ছেলেপুলে নিয়েছ কেন, কুঞ্জ বিহারী ?”

কুঞ্জ তার উত্তর দেয় –“কি আর করব বলুন সবই ভগবানের দান।” আস্তে আস্তে তার সদা হাস্যময় মুখ আর কাজের প্রতি নিষ্ঠার জন্য কুঞ্জ বিহারী অফিসে সবার কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল, আবার অন্যদিকে সবার কাছে এটা ওটা, অর্থাৎ টাকা পয়সা, পুরানো জামা-কাপড়, খাবার-দাবার চেয়ে বেড়ানোটাও অনেকের বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়ালো। অনেকেই বলতে লাগলো, কুঞ্জর অনেক গুন আছে বটে কিন্তু ওর এই উঞ্ছবৃত্তিটা মোটেও ভালো লাগে না।

কুঞ্জ বিহারীর কানে এসব কথা গেলেও সে তার ওই মায়াবি হাসিটা দিয়ে বলে “কি করব বলুন? অনেকগুলো ছেলেপুলে!” তবে ইদানিং কুঞ্জর প্রায়ই অফিসে আসতে দেরী হয়, একদিন বড় সাহেব বকাবকি দেয়ার ফলে বলল, “কি করব বলুন স্যার একটা চাকরীতে এতবড় সংসার আর টানতে পারছি না, তাই সকালে একটা বাড়িতে কাজ নিয়েছি, সেখানে সকালে ঝাঁট দেয়া, পাম্প চালিয়ে জল ভরে বাবুদের ফাইফরমাস খেটে আসতে আসতে একটু দেরী হয়ে যায়। কি করব বলুন অনেকগুলো ছেলেপুলে!”

দেখতে দেখতে প্রায় দুবছর হ’ল, আজকাল রমেন বুঝতে পারে কুঞ্জর শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না, কাজে কর্মে সেই উৎসাহটাও যেন আস্তে আস্তে হরিয়ে ফেলেছে, কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাব, একমাত্র রমেনই ওকে সন্মান করে কুঞ্জদা বলে, তাই একদিন রমেন বলল, “কুঞ্জদা এবার তুমি অবসর নাও, তোমার বয়স হয়েছে, চিরদিন তো আর মানুষ খাটতে পারে না? তোমার তো অনেকগুলো ছেলেপুলে ? বড় সাহেবকে বলে তাদের একজনকে এই কাজে লাগিয়ে দাও।” কুঞ্জ ম্লান হেসে উত্তর দেয় “আসলে ছেলেগুলো বড্ড ছোট, তাদেরতো এখনও কাজ করার বয়সই হয়নি।” রমেনের কাছে কথাটা কেমন যেন হেঁয়ালী বলে মনে হয়, একজন ষাট পঁয়ষট্টি বছরের লোকের সন্তানরা কতই বা ছোট হতে পারে? কিন্তু এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার মনে করে রমেন আর এ ব্যাপারে এগোতে চাইলো না। এর কদিন পর থেকেই হঠাৎ দেখা গেল কুঞ্জবিহারী আর অফিসে আসছেই না। একদিন গেল, দুদিন গেল, চারদিন গেল… না কুঞ্জর কোন দেখা নেই। অফিসেরও এ ব্যাপারে কোন দায় নেই কারণ কুঞ্জ ছিল একেবারে ক্যাজুয়াল কর্মী, কাজ করলে পয়সা, নইলে নয়, বরং হিসেব করে দেখা গেল কুঞ্জই অফিসের কাছে পাঁচদিনের টাকা পাবে। অফিসের অনেকে তো খোলাখুলি বলতেই লাগলো যে, যাক পাগলটা এতদিনে বিদায় হয়েছে। একমাত্র রমেনের কেন জানিনা কুঞ্জর প্রতি একটা মায়া পড়ে গেছে, রমেনের কাছে ওর একটা ঠিকানা আছে, শ্যামবাজার এলাকার একটা ঠিকানা। রমেন মনে মনে ভাবলো, ‘এই সপ্তাহটা দেখা যাক, সামনের সোমবার নাগাদ গিয়ে একটু খবর নেবার চেষ্টা করব।’

সোমবার সকাল, আবার একটা সপ্তাহ শুরু হ’ল, প্রতিদিনের অভ্যেস মত চান করতে যাবার আগে চা-এর কাপটা নিয়ে খবরের কাগজটা হাতে তুলে নেয় রমেন। ‘দুর দুর…. আজকাল খবর মানেই যত্ত সব খুন ধর্ষন, কাগজের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আপন মনে বিড় বিড় করে রমেন। যাই হোক, ওদিকে আবার বাথরুমে একজন ঢুকেছে সে না বের হলে রমেন চান করতে যেতেও পারছে না। হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় কাগজের ছয়ের পাতায়। এ কি ! এ তো কুঞ্জর ছবি !

খবরের শিরোনাম.. “চলে গেলেন পথ-দাদু” – উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর এলাকায় অসংখ্য পথশিশুর দায়িত্ব নিতেন যিনি হাসিমুখে, এলাকায় পথ-দাদু নামে পরিচিত কুঞ্জবিহারী সিংহ (৬৫) গতকাল আর জি কর মেডিকেল কলেজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। গত এক সপ্তাহ তিনি অসুস্থ ছিলেন।

অকৃতদার প্রবীন কুঞ্জবাবু সারাদিন বিভিন্ন দোকানে বাড়িতে বা অফিসে কাজ করে যে অর্থ উপার্জন করতেন তার সবটাই এলাকায় পথশিশুদের খাবার, পোশাক ও পড়াশুনার জন্য খরচ করতেন। এলাকায় তিনি সবার ‘পথ-দাদু’ নামে পরিচিত ছিলেন।


4 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ এ ৪:০৬ PM

    নারায়ণ রায় একটি অসাধারন চরিত্র এঁকেছেন তাঁর 'শ্রী কুঞ্জ বিহারী সিংহ' গল্পে। স্যাট্যায়ারের আদলে লেখা এই গল্পটির নাম-চরিত্র কিন্তু শেষ দিকে এসে নিজেকে উন্মোচিত করে ! মর্মস্পর্শী লেখাটি ক্ল্যাইমাক্সটুকু পাঠককে মুগ্ধ করবেই সব শেষে !

    উত্তরমুছুন
  2. কুঞ্জ বিহারী এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। লেখাটি মর্মস্পর্শী, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। হ্যাঁ, গল্পের শেষের ক্ল্যাইমাক্স টাও অসাধারণ ! কিন্তু, নারায়ণ দার চিন্তা, যুগোপযোগী নয়, এটাও মানতে হবে !! অপরাধ নেবেন না নারায়ণ দা...... চিলেকোঠার অধিকাংশ সদস্য কিন্তু, আমার, আপনার থেকে বয়সে অনেক কম...আমাদের শিখতে হবে তাদের ভাষায় কথা বলা !!

    উত্তরমুছুন
  3. Debasish Kanjilal & Swapan Deb Dujonei Kintu Thik-i Bolechhen...

    উত্তরমুছুন