ধারাবাহিক - সৈয়দা মকসুদা হালিম

আমার মুক্তি যুদ্ধ
সৈয়দা মকসুদা হালিম


পর্ব-২

১৯৭১ সালের যুদ্ধের স্মৃতি আমার সব কিছু স্পষ্ট মনে নেই। সংরক্ষণের অভাবে অনেক কিছুই মন থেকে মুছে যাচ্ছে। যদিও তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, প্রথমবর্ষ অনার্সে। তারপরেও এতো দীর্ঘ সময় পর অনেক কিছুই মনে করতে পারি না। [তবে ভয় কি! আমার একজন প্রুফ-রিডার আছে, ভুল হলেও সংশোধনের আশা আছে ]!

২৫শে মার্চের পর ২৬,২৭—তারিখ পার হয়ে গেল। ইউনিভার্সিটি নাই, কাজী সাহেবের অফিসও নাই। আমরা তিনজন ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকি, নয়তো তাস নিয়ে ব্রে খেলি। কারফিউ ব্রেকের সময়টুকু বাদে সারাক্ষণ গোলা-গুলির শব্দ বিরামহীন চলতে থাকে। মন অস্থির ! কাজের ছেলে আবদুল কোনমতে ভাত-ভর্তা রাঁধে!

২৮ তারিখে সম্ভবত একটু বেশিক্ষণ কারফিউ ব্রেক ছিল, সকাল ১০টার পর বদরুল আলম এলো, আমাদেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। তার কথা, আমরা একা পড়ে গেছি, আশেপাশের বাঙালিদের সাথে তেমন ভাব-সাব নাই। বললো, “আমরা অনেক বাঙালি একসাথে আছি, আপা, হালিম ভাই, আমার স্বামীবাগের বাড়িতে চলেন, আমরা সবাই একসাথে থাকবো।“ হায়! তখনো আমাদের আশা, একসাথে অনেক বাঙালি থাকলেই বুঝি আমরা নিরাপদ থাকবো!

আমরা যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। এমন সময় মিউজিক কলেজের প্রিয় অধ্যাপক তাহের স্যার এলেন আমাদের নিতে। বললেন, “ আমরা গ্রামে যাচ্ছি, মকসুদা, হালিম সাহেব, আমাদের সাথে চলেন!” কিন্তু আমরা বদরুলের সাথে যাচ্ছি বলায় তিনি একটু মনঃক্ষুন্ন হলেন। বললেন, “যেখানেই যান, সাবধানে থাকবেন আর পারলে গ্রামে চলে যান।”
বদরুলের স্বামীবাগের বাড়িতে অনেক লোকজন। বদরুলের স্ত্রী, অপরূপ সুন্দরী মেয়ে লীনা, তাদের ছোট্ট মেয়ে নীলা আরও ওর ভাইবোন মিলিয়ে অনেক জন। বদরুল রেডিও, টিভির এনলিস্টেড গায়ক। মিউজিক কলেজের সে কিছু না হলেও তাকে নিয়ে আমরা টেলিভিশনে দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান করেছি।

যাহোক, বেশ হৈ চৈ আনন্দে দিন পার হলো। পরদিন সকালে ১০টার পর বদরুলের মেজভাই জহিরুল আলম এলেন। তিনি তখন ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক। সম্পাদক ছিলেন আনোয়ার জাহিদ।

তিনি এসেই বললেন, “তোরা রেডি হয়ে নে, আমরা সবাই গ্রামের বাড়ি করিমপুর যাচ্ছি, আজই। ঢাকা শহরে থাকা কোনমতেই উচিৎ হবে না। গতকাল আমরা সাংবাদিকরা ‘বঙ্গ ভবনে’ গিয়ে যা বুঝলাম- পাকিস্তানীরা এই দেশকে সম্পূর্ণ ম্যাসাকার করে দেবে! কোথাও আমরা নিরাপদ না। তবু গ্রামে যাই। ওরা সবার আগে ঢাকা শহরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে।

আমি বললাম, “তাহলে আমরা বাড়ি চলে যাই, আমরা গ্রামে যাবো না।” বদরুল বললো, “আপা না গেলে, আমিও যাবো না, আমার ফ্যামিলিও যাবে না।” জহির ভাই বললেন, ভাবী, আপনি যাবেন না কেনো ? আমরা ওদের লিস্ট দেখেছি। ওরা সব বিখ্যাত মানুষ, দেশের সব বুদ্ধিজীবী খতমের নীল নক্সা তৈরি করেছে। আপনারা টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করেছেন না ? মানবোনা, বন্ধনে মানবো না! আপনার নামও ওদের লিস্টে আছে! কাজেই চলেন!”

বললাম, “আমি বিখ্যাত না, বুদ্ধিজীবীও না। আমার কিছুই হবে না। আমি যাবো না।” কিন্তু কাজী সাহেব বললেন, তিনি যাবেন। কারণ তিনি যে বীভৎস মৃত্যু দেখেছেন তাতে তিনি ভীত! লাশ ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে তিনি রায়সা বাজারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, যেতে পারেননি। দোকানপাটের মধ্যে সারিসারি মানুষ আগুণে পুড়ে কাঠকয়লা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! চারিদিকে ধিকিধিকি আগুণ জ্বলছে! এ কেমন নৃশংসতা!
আমরা খুব দ্রুত বাসায় এসে কাজের ছেলে আবদুলের কাছে বাড়িঘর বুঝিয়ে দিয়ে আবার স্বামীবাগ এলাম। তারপর সবাই একসাথে সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ডে হাজির হলাম। সেখানে দেখি জহিরভাইয়ের ফ্যামিলি, তার শ্বশুর বাড়ির ফ্যামিলি, মামা শ্বশুরের ফ্যামিলি, চাচা মফিজুল ইসলামের (নজরুল গীতির শিক্ষক ও গায়ক) ফ্যামিলি, বদরুলের মা ও বোনেরা এবং বদরুলরা আর আমরা—বিশাল জন সমাবেশ। আমাদের দিয়েই প্রায় বাস ভর্তি হয়ে গেলো।

যাওয়ার পথে রাস্তার দুই পাশে খালের মধ্যে মানুষের লাশ! আমি তাকাতেই ভয় পাচ্ছিলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তা ভাঙ্গা, আমাদের হাঁটতে হবে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে হাঁটা দিলাম। গ্রামের মানুষেরা বড় বড় ধামায় করে মুড়ির মোয়া আর খাবার পানি নিয়ে পথের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো, তারা আমাদের খাবার বিলাতে লাগলো,পয়সা দিলেও নিলো না। কোথাও রুটি আর পানি, কোথাও বিস্কুটের ডালা নিয়ে গ্রামবাসী, পথচারী উদবাস্তুদের সেবা করতে লাগলো।

দুপুরের পর আমরা নরসিংদী বাজার পার হয়ে নদীরঘাটে এলাম,এরপর ছইওয়ালা নৌকায় চড়ে সন্ধ্যার আগে দিয়ে করিমপুর ঘাটে এসে ভিড়লাম।

কিছুদূর হেঁটে এসে একটা আম বাগান, তারপর ছোট্ট একটা মাঠ। এই মাঠ সংলগ্ন বদরুলের দাদা বাড়ি। বদরুলের দাদা এলাকায় খুব প্রভাবশালী গন্যমান্য লোক ছিলেন। এই বাড়ি, মাঠ, বাগান –সব তাদের। বাইরের কাছারি ঘর পার হয়ে বাড়ির মধ্যে সবাই ঢুকলাম। ভিতর বাড়িতে চারটা ছোট বড় ঘর। সামনের বড় ঘরটায় জহিরভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন,শাশুড়ি-ছেলেমেয়ে নিয়ে, স্ত্রী-শাহনাজ ছেলে টিটোকে নিয়ে, মামী শাশুড়ি-ছোট্টমেয়ে শাবানাকে নিয়ে , তাদের মধ্যে আমি। একঘরে লীনা মেয়ে নিয়ে, তারসাথে বদরুলের তিন চারজন বোন, আরেক ঘরে বদরুলের মা, চাচী আর পাঁচজন কাজের বুয়া এবং অন্যপাশে একটা ঘর নিলেন মফিজ চাচা।

ঠিক হলো, স্ত্রীলোক-ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে ভিতর বাড়িতে আর পুরুষেরা সবাই বাইরের কাছারি ঘরে শোবে। আমরা যে যা পারি-জহিরভাইকে সাহায্যের হাত বাড়ালাম, কেউ পঞ্চাশ, কেউ একশ করে টাকা দিলো। জিনিসপত্র খুব সস্তা। যেমন মাঠের সামনের রাস্তা দিয়ে এক জেলে নদী থেকে মাছ ধরে নিয়ে বাজারে যাচ্ছে, জহিরভাই ডাক দিলেন, “এই, এদিকে আয়, তোর ঝুড়িতে কি দেখি।” দেখা গেলো একঝুড়ি চিংড়ি মাছ বেশ বড়বড়। সবগুলো লাফাচ্ছে! দাম দর করে চার আনা দিয়ে সেগুলো কেনা হলো। কমপক্ষে পাঁচ কেজি হবে। চার আনায় পাঁচ সের দুধ। এই রকম।

আমাদের মেয়ে-বউদের কোন কাজ নেই। খাই আর ঘুরে বেড়াই। সাতদিনের মধ্যেই বাগানের ছোট ছোট আম যতদূর হাতে পাওয়া যায়- সব শেষ। গল্প আর কতো করা যায়, শেষে আমরা উঠোনে দাগ কেটে এক্কা-দোক্কা খেলা শুরু করলাম।
সপ্তাহ দুয়েক পর বদরুলের ছোটভাই জগলুল(আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছে) এসে হাজির। সে এসেই ঘোষণা করলো, “আমি যুদ্ধে যাবো!”

মা বললেন, “না, তুই যুদ্ধে যাবি না!” সে বলে, “আমি যুদ্ধে যাবোই!” জহির ভাই বললেন, “ না, তুই মায়ের অমতে যুদ্ধে যাবি না!” কিন্তু সে গোঁ ধরে থাকলো- যুদ্ধে যাবেই। কোনমতে না পেরে জহির ভাই তাকে মারতে লাগলেন, মারতে মারতে হাতের লাঠি ভেঙ্গে গেলো, তবু তাকে দিয়ে না করানো গেলো না।

শেষে জহির ভাই একটা বাঁশ তুলে নিয়ে এক বাড়ি দিয়ে বললেন, “বল, তুই যুদ্ধে যাবি না!” সে মাটিতে পড়ে গিয়েও বলে, “আমি যুদ্ধে যাবোই!”

জহির ভাই আবার বাঁশ তুলেছেন- “মায়ের অমতে যুদ্ধে যেতে চাইলে তোকে মেরেই ফেলবো!” আমরা হা- হা- করে উঠলাম। মা চিৎকার করে বললেন, “আমি মত দিচ্ছি, ও যুদ্ধে যাক, ও জহির আর মারিস নে!”

জহির ভাই বাঁশটা নামিয়ে জানতে চাইলেন, “আপনি অনুমতি দিচ্ছেন?” মা বললেন, “ হ্যা, আমি অনুমতি দিলাম, ও যুদ্ধে যাক!” জগলুল আলম- আমাদের জগু যুদ্ধে চলে গেলো!

কতোই বা বয়স তার! সে আর আমি একসাথেই সেইবার ইন্টার-মিডিয়েট পাস করে দুজনেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। আমার চেয়ে সে বেশ ছোট।

যা হোক, আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবন। খাই দাই, খেলা করি, গান করি আর সন্ধ্যের পর বসে বসে রেডিওতে খবর শুনি। কোলকাতা থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সংবাদ পাঠের পর বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা আর পাকিস্তানী সেনাদের নির্মমতার কথা- খুব আবেগঘন কন্ঠে বর্ণনা করেন, এই প্রোগ্রামটার নাম আমার মনে নাই। আর এম.আর. আখতার মুকুলের “চরম পত্র” আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম।
মাস খানেক পার হওয়ার পর একদিন সকালের পর পরই ছোট্ট এক রাখাল ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে খবর দিলো যে লঞ্চ ভর্তি করে, অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মিলিটারিদের একটা বাহিনী নদীর ঘেটে নেমেছে। জহির ভাই দৌড়ে এসে বললেন, “এক মিনিটের মধ্যে বাড়ির ছেলে মেয়ে বউরা সবাই ঐ মাঠের মধ্যে যে ভাঙ্গা ঘরটা আছে, তার মধ্যে ঢোকো!”

আমরা হুড়মুড় করে সবাই দৌড়ালাম। ক্ষেতের মাঝখানে ভাঙ্গাচোরা একটা ঘর, চালে তেমন খড় নাই, বেড়া ভাঙ্গা ভাঙ্গা,দরজার খিল নাই। তার মধ্যেই বাড়ির সবাই গিয়ে ঢুকলাম। বাড়িতে থাকলেন শুধু দুই বুড়ি। মা আর চাচী। মফিজ কাকু এমনিতেই রসিক মানুষ, তিনি লুঙ্গী কাছা দিয়ে পরে একটা ছেঁড়া গেঞ্জী গায়ে দা দিয়ে বাঁশ চাঁচতে বসে গেলেন। বুড়িরা একজন শাক বাছতে লাগলেন অন্যজন চুলায় পানির হাঁড়ি বসিয়ে খড় কুটো দিয়ে জ্বাল দিতে লাগলেন।

মিলিটারির লোকেরা গটগট করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে প্রতিটা ঘরে ঘরে ঢুকে উঁকি ঝুকি দিলো , মফিজ কাকুকে তারা যা-ই জিজ্ঞেস করে তিনি একটাই উত্তর দেন, “ নেহি হায়!” যেমন, তারা বলে,” মুক্তি হ্যায়?” “নেহি হায়”। “হিন্দু হ্যায়?” “নেহি হায়”! যেন ঐ একটা উর্দু শব্দ ছাড়া তিনি আর কিছু জানেন না। ভাগ্যিস তারা “তুম মুসলিম হো”? জিজ্ঞেস করে নাই!
সৈন্যগুলো বাড়ি থেকে বের হলো। সামনের মাঠে ছোট্ট একটা ছেলে ছাগলের দড়ির খোঁটা পুঁতে দিচ্ছিলো, একজন সৈন্য গিয়ে খোঁটা উপড়ে ছাগলটাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দিলো। তাদের লঞ্চ চলে গেলে নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা সবাই আবার ঘরে ফিরলাম।
[ চলবে ]


3 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ এ ১১:৫০ PM

    সৈয়দ মকসুদা হালিমের 'আমার মুক্তিযুদ্ধ' ধারাবাহিকের এই পর্বে যে স্মৃতিচারন তিনি করেছেন,তা আগের পর্বগুলির মতই রোমাঞ্চকর ! ১৯৭১ সালের বাংলার মুক্তিযুদ্ধের এমন আনুপুর্বিক নিজের চোখে দেখা ইতিহাস আমরা খুব কমই পড়ার সুযোগ পেয়েছি আগে । পাঠকেরা সাগ্রহে পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকবেন তা বলাই যায় !

    উত্তরমুছুন
  2. ভিনদেশি লেখকের লেখায় লাইক কমেন্টস করতে দ্বিধা হওয়া স্বাভাবিক। হয়তো এই কারণেই কমেন্টস তেমন আসছে না। তবে প্রথম পর্বে বেলাল ও দ্বিতীয় পর্বে দেবাশিস কাঞ্জিলালের দুইটা কমেন্টসই 'মেরা মু মে ঘি-শক্কর ডাল দিয়া ! মোগাম্বো খুশ হুয়া'!

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ ! শিহরিত হচ্ছি। আরও অবাক হলাম, একাত্তরে, ঢাকায় টিভি ছিল !

    উত্তরমুছুন