প্রবন্ধ - স্বপন দেব

EUTHANESIA বা স্বেচ্ছা-মৃত্যু
স্বপন দেব



(২০১১ সালে ইউ এস এ তে বসে এই লেখাটি এখনো প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি বলেই এটা আপনাদের জ্ঞ্যাতার্থে আবার পেশ করলাম।)
বিতর্ক ছিলোই, চলেই আসছিলো, সম্প্রতি এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করলো অরুণা শানবাগ এর কেস টি। অরুণা ছিল মুম্বাইয়ের King Edward Memorial ( KEM ) হসপিটালের একজন দক্ষ, তরুণী , প্রাণচঞ্চল জুনিয়র নার্স। ২৭শে নভেম্বর, ১৯৭৩ এর রাতে যখন অরুণা তার পোশাক বদল করছিল, ঐ হসপিটালের একজন ওয়ার্ডবয়, যার নাম সোহনলাল বাল্মিকি, অরুণার গলায় কুকুরের চেন দিয়ে বেঁধে তার শ্বাসরোধ করে ধর্ষণ করে। গলায় চেন দিয়ে বাঁধার ফলে অরুণার মস্তিষ্কে অক্সিজেন এর যোগান বন্ধ হয়ে যায় এবং সেই থেকে কোমাতে আচ্ছন্ন অবস্থায় ঐ হসপিটালের বেড এ শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে থাকে অরুণা......কিন্তু তার অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়না। অন্ধ, কোমাচ্ছন্ন অবস্থায় ঐ ভাবেই অরুণা কাটিয়ে দিল দীর্ঘ ৩৭ টা বছর।

২০১০ সালে, অরুণার বন্ধু, পিঙ্কি ভিরানি নামে এক জার্নালিষ্ট অরুণা কে ইউথানেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার দেবার জন্যে সুপ্রিম কোর্ট এ আবেদন করেন। অরুণা বা ইউথানেসিয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এর রায় জানার আগে আসুন আমরা পিছন দিকে তাকিয়ে দেখে নেই, এই ইউথানেসিয়া বা মার্সি-কিলিং নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের আইন কি বলছে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশে অনেকদিন আগে থেকেই “Passive mercy killing” আইনসম্মত। ২০০৫ এ আমেরিকাতেও টেরীর নিষ্কৃতি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য এর জন্যে টেরীর পরিবার কে দীর্ঘদিন আইনী লড়াই চালাতে হয়েছিলো। আদালত ও আইনসভার অঙ্গনে বার বার আলোচিত হয়ে অবশেষে টেরীর আবেদনে বৈধতার সীলমোহর পড়ে। আমেরিকাতে শর্তসাপেক্ষে Passive mercy killing আইনসম্মত রূপে পরিগণিত হয়। কিন্তু ভারতে, এই কয়েকবছর আগেও প্রশাসন ও বিচারবিভাগীয় স্তরে মধ্যযুগীয় মানসিকতা বিরাজমান ছিল এই কৃপামৃত্যুর ক্ষেত্রে।

হায়দ্রাবাদের ২৫ বছর বয়েসি ভেঙ্কটেশ “muscular dystrophy” রোগে আক্রান্ত হয়ে ১০ বছর বয়েস থেকেই জীবনদায়ী যন্ত্রের সাহায্যে বেঁচেছিলেন। দীর্ঘ ১৫ বছর কেটেছিল বিছানায় শুয়ে, মস্তিষ্ক ছাড়া সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই অচল। ভেঙ্কটেশের শেষ ইচ্ছে ছিল যে, তার শরীরে লাগানো জীবনদায়ী যন্ত্রগুলি খুলে দিয়ে তাকে শান্তিতে মরতে দেওয়া হোক। ভেঙ্কটেশের এই শেষ ইচ্ছায় সম্মতি জানিয়েছিলেন তার মা সুজাতাও, যিনি ছিলেন অসুস্থ পুত্রের আ-মৃত্যু সঙ্গী। কিন্তু, ভেঙ্কটেশ ও সুজাতার আর্জি অন্ধ্র হাইকোর্ট খারিজ করে দেয় এই যুক্তিতে যে নিষ্কৃতি মৃত্যু এ দেশে আইনসম্মত নয়। এটা ২০০৬ এর ঘটনা।

৫ বছর ধরে কোমায় আচ্ছন্ন বিহারের হত-দরিদ্র দলিত পরিবারের গৃহবধু কাঞ্চন দেবী। তার পিতার ভাষায়, “জীবন্ত লাশ” ! কাঞ্চনের চিকিৎসার জন্যে এই পরিবারটির সবকিছু গেছে। পাটনা হাইকোর্ট এবং বিহারের রাজ্যপালের কাছে কাঞ্চনের পরিবারের আবেদন ছিল তার নিষ্কৃতি মৃত্যুর অধিকার প্রদান। না, সম্মতি মেলেনি। কারণ আইনি বাধা। এটা এপ্রিল ২০০৭ এর ঘটনা।

নিষ্কৃতি মৃত্যুর বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করলো ২০০৮ এর শেষের দিকে রাজস্থানের ৩ জন জৈন ধর্মাবলম্বীর “ সান্থারা” পালনের মাধ্যমে স্বেচ্ছা-মৃত্যু বরণ। জৈন ধর্মাচারে সান্থারার নিয়ম মেনে অন্ন জল পরিত্যাগ করে তিনজন ই মৃত্যু-বরণ করেন। এঁরা প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন রোগভোগ করছিলেন। তিনজনের বয়েস ছিলো যথাক্রমে ৬৪, ৭৮, ৮৪। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে খুব বেশীদিন আগে নয়, বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যেও “গঙ্গা যাত্রা” নামক ধর্মাচারের মাধ্যমে স্বেচ্ছা-মৃত্যু বরণের রেওয়াজ ছিলো। আমি তখন বেশ বড়। মাত্র ১৯৬২ সালে আমার ঠাকুমা ৮৪ বছর বয়সে গঙ্গা-যাত্রা করেন। গঙ্গার ঘাটের পাশেই গঙ্গাযাত্রার জন্যে আমাদের পরিবারের কয়েকটি ঘর ছিল। উনি তার একটি ঘরে থেকে এবং কেবলমাত্র ঐ দুষিত গঙ্গাজল পান করে ১১ দিন পর দেহত্যাগ করেন। প্রসঙ্গতঃ, এঁরা কেউ ই কিন্তু স্বেচ্ছা বা নিষ্কৃতি মৃত্যুর জন্যে প্রশাসনের দ্বারস্থ হন নি, যা ভেঙ্কটেশ এবং কাঞ্চনের কাছে অপরিহার্য ছিল। মৃত্যু কামনা করা আর সেই মৃত্যুকে বাস্তবায়িত করা এক জিনিস নয়। ভেঙ্কটেশ ও মৃত্যু-কামনা করেছিলো কিন্তু সেই মৃত্যুকে বাস্তবায়িত করার ক্ষমতা তার ছিলোনা। প্রয়োজন ছিল অন্য কোন ব্যক্তির বা ডাক্তারের সহায়তা, যিনি তার শরীরের সাথে যুক্ত জীবনদায়ী যন্ত্র গুলিকে বিচ্ছিন্ন করে দেবেন। কিন্তু সান্থারা বা গঙ্গাযাত্রার ক্ষেত্রে অন্য কোন ব্যক্তির সক্রিয় সহায়তা দরকার হয়না। এখান থেকেই উৎপত্তি ঘটেছে এক নতুন বিতর্কের। প্রশ্ন উঠেছে, ধর্মাচারের আড়ালে ইচ্ছা-মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া নৈতিকতা ও সামাজিক শৃঙ্খলার দিক দিয়ে কতখানি যুক্তিযুক্ত ? সান্থারা বা গঙ্গাযাত্রার মধ্যে যে ধর্মীয় ভাবনাটুকু আছে, সেটুকু বাদ দিলে তা অবিকল স্বেচ্ছামৃত্যুর সমতুল্য। কৃপা-হত্যা নয়, স্থূল অর্থে আত্মহত্যাও নয়, এ হোল ইচ্ছা-মৃত্যু। রাজপুত রমণীদের জহর-ব্রত বা যতিন দাস এর কারাগারে আ-মৃত্যু অনশন, কোন কিছুর সঙ্গেই স্বেচ্ছা-মৃত্যুর তুলনা করা যায়না। এ কারণেই বলা যেতে পারে, এ এক স্বতন্ত্র ধরণের মৃত্যু।

স্বেচ্ছা-মৃত্যুকে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সমর্থন করা যেতে পারে। “জীবন স্বতঃ মূল্যবান” শুধুমাত্র এই যুক্তিতে জীবন্ত-লাশ বা উদ্ভিদের মত বেঁচে থাকাকে সমর্থন করার কোন যৌক্তিকতা নেই। জীবনের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ যদি থাকে তাহলে স্বেচ্ছা-মৃত্যুকে সমর্থন করা উচিৎ , কারণ জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সন্মান বশতই ব্যক্তি স্বেচ্ছা-মৃত্যুর মাধ্যমে নিজের জীবনকে সন্মানীত করছে যে জীবন একদা তাঁর কাছে ছিল অতীব মূল্যবান।

ফিরে আসি অরুণা শানবাগ এর কথায়। ১৭ই ডিসেম্বর, ২০১০ এ সুপ্রিম কোর্ট অরুণার স্বেচ্ছা-মৃত্যুর অধিকার অর্জনের জন্যে করা পিঙ্কি ভিরানীর আবেদনটি গ্রহণ করেন এবং ২৪শে জানুয়ারী, ২০১১ এ কোর্ট একটি তিন সদস্যের মেডিকাল বোর্ড গঠন করে অরুণার মেডিক্যাল রিপোর্ট এক মাসের মধ্যে জমা দেবার নির্দেশ দেন। অরুণার মেডিক্যাল রিপোর্ট টি বিবেচনা করে সুপ্রিম কোর্ট তার মার্সি-কিলিং এর আবেদনটি খারিজ করে দেন বটে কিন্তু , ঐ ৭ই মার্চ, ২০১১ তে সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে এখন থেকে ভারতে শর্তাধীনে Passive Euthanasia চালু করার সপক্ষে অনুমতি দেন। উন্নত মানবিক চেতনা থেমে থাকেনা...... দাবী ওঠে... অধিকার অর্জনের দাবী, অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী... আর সমাজ কে একদিন না একদিন মেনে নিতে হয় সেই দাবী। সুপ্রিম কোর্ট এর রায় কে আমরা স্বাগত জানাই।

বাধা এখনো অনেক আছে... কিন্তু উদার মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে অনারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত যন্ত্রনা-কাতর মানুষের আইনি আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবার নিশ্চয় সময় এসেছে।


3 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ এ ২:৫৬ PM

    স্বেচ্ছা-মৃত্যু বা ইউথ্যানাসিয়া একটি বহু-বিতর্কিত বিষয় ! সেই বিষয়ে স্বপন দেব তাঁর মননশীল প্রবন্ধটিতে তথ্য-আধারিত কিছু মতামত দিয়েছেন । সুলিখিত এই প্রবন্ধটি আমাদের বিষয়টি নিয়ে আরো চিন্তা ভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করবে তা নিঃসংশয়ে বলা চলে।

    উত্তরমুছুন
  2. স্বেচ্ছামৃত্যু বিষয়ে মাননীয় স্বপন দেব মহাশয়ের রচনাটি তথ্যবহুল ও যুক্তিপূর্ণ এবং অবশ্যই সুন্দর । কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যু আইন পাশ হলেই তো হবে না সেটা দেবার ভার থাকবে কোনও চিকিৎসকের ওপর । চিকিৎসকরা চিকিৎসার প্রাক্কালে শপথ নেন তাঁরা একটি জীবন রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবেন কিন্তু কোনও প্রাণ অন্ততঃ সজ্ঞানে হরণ করবেন না । যদি কোনও চিকিৎসককে স্বেচ্ছামৃত্যু দেবার জন্য ডাকা হয় তবে তাঁর অবস্থা হবে জল্লাদের মত । এটা তাঁরা কিভাবে মেনে নেবেন সেটাও ভাবার । "যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষন আশ" এই নীতিতেই বিশ্বাসী হয়েই চিকিৎসকরা কাজ করেন । এভাবে একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক মৃত্যুর জন্য তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য বিপন্নও হতে পারে ।

    উত্তরমুছুন
  3. অসুস্থ ছাড়া কি সুস্থ মানুষ সেচ্ছা মৃত্যুর আবেদন করতে পারেনা ???

    উত্তরমুছুন