ছোটগল্প - মৌ দাশগুপ্তা

কোন এক গাঁয়ের কথা
মৌ দাশগুপ্তা



বিয়েবাড়ীর কর্তা রগচটা স্বভাবের দীননাথ, প্যান্ডেলের এককোনে মাটির ওপর উবু হয়ে যেভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে, তাতে কে বলবে এই মোটে ঘন্টাখানেক আগে এই লোকই হাঁক ডাক করে পুরো বাড়ী সরগরম রেখে বাড়ীর মানুষগুলোকে একদম তটস্থ করে রেখেছিল।

- ওরে ভিয়েন বসলো? ময়রার পো’র আজ হল কি?

- ও টুলু, বরের বাড়ীর লোকদের আনার ব্যাবস্থা কি করলি বাবা ?

- কুনি মা,কোথায় গেলি, ভিতরবাড়ীতে মেয়েরা উলু টুলু দেয় না কেন দেখ দেখি।

- আহা, ও নাপিতভায়া তুমি পালাচ্ছো কই?কত কাজ বাকি যে।

- বলি ও বৌমা, জলখাবারটা কি দুপুর গড়ালে দেবে নাকি? তোমাদের মেয়ে আচার আর কত বাকি? আর তোমার সোয়ামীই বা কই?

- আমি একা মানুষ আর কত দিক সামাল দিই বলো দেখি?

- আরে দেখো দেখি কাদের বাড়ীর ছাগল এটা? মঙ্গলঘট মুড়িয়ে খাবে যে!

- ও ছোট কোথায় গেলি?

- দেখো দেখি কান্ড। যেদিকটায় দেখবো না সেদিকেই গন্ডগোল।

- ও পুনির মা, একটু চা হবে নাকি? বকে বকে গলাটা শুকিয়ে গেল যে।

দীননাথের দুই মেয়ে এক ছেলে।ছেলে ছোট।ছেলে এসে বংশে বাতি দেবার একটা পাকাপাকি সুবন্দোবস্ত করে ফেলার পর ওর কমকথা বলা বউ সুমতিকে ভালো কথায়, গাল দিয়ে, মারধোর করেও আরেকবার ছেলের বাপ হওয়ার সুযোগ পায়নি বেচারা।সব ঐ হেল্থ সেন্টার দিদিগুলোর বদশিক্ষা।নিজেদের ঘরবাড়ী তো শিকেয় উঠেছেই এখন খামোকা দেশ গাঁয়ের ভালোমানুষ বৌঝি গুলোর মাথা খাচ্ছে। মুদি দোকানদার দীননাথের সমস্যা ছিল মেয়ে বেশী পড়াশুনো করলে বিয়ে হবে না,লোকে নানান কুকথা বলবে, পাত্র পাওয়া দুষ্কর হবে, ওর ছোটভাই দীনন্ধুর বড়মেয়ে মুনিটা এই পুনির থেকে দু বছরের ছোট,পড়াশুনোয় মাথা নেই, মামাবাড়ীতে থেকে সেলাই টেলাই শিখছে ,তা ব্যাপার হোল সে মেয়ের ভালো একটা সম্বন্ধ এসেছে, বাড়ীর সবাই রাজী, কিন্তু মুনির বিয়ে আগে হয় কি করে? তাহলে তো পুনির আর বিয়ে দেওয়াই যাবে না, পুনির পর দীননাথের আরো এক গলার কাঁটা রয়েছে কুনি, তারই বা কি হবে? সাত পাঁচ ভেবে বাড়ীতে না জানিয়েই অনেকটা এগিয়ে গেছে দীননাথ, মেয়ের মাকে হাড়েহাড়ে চেনে,সহজে রাজী হবে না, লেখাপড়া করে স্বর্গে বাতি জ্বালাবে ওর মেয়ে, যত আদিখ্যেতা, সাধে কি বলে “মেয়েমানুষের বুদ্ধি বড় বালাই, বারো হাত শাড়ীতেও কাছা আঁটে না।“ এমনিতেই ঠাকুদ্দার দেওয়া পুনি কুনি নামে না ডেকে মেয়েদের নাম রেখেছে প্রথমা,কাজলী,হাজার গালিগালাজেও যার মুখে কথা নেই সে কিনা খালি মেয়েদের পড়াবে বলে মাথার কাপড় ফেলে সোয়ামী, দেওর, ভাজের সাথে গলা তুলে ঝগড়া করে? বাড়ীতে লুকিয়ে গয়না বেচে আসে? মাথায় বুদ্ধি থাকতে এমনটি হয় নাকি? আগে জানলে কোথা থেকে কি বিগড়ে রাখবে! অতএব বাড়ীর বোধবুদ্ধিহীনা মেয়েছেলেটিকে এই সব বিয়ে-থা, দেনা পাওনার কথা না জানানোই ভালো।বরঞ্চ দীনবন্ধুটা চালাকচতুর আছে, সামলে নেবে।

পুনি ওরফে প্রথমার বাড়ী যে অজ পাড়াগাঁয়ে সেখানে কোন হাইস্কুল নেই। জুনিয়র স্কুল একটা আছে বটে, সেখানে আর ক’জন মেয়েই বা পড়ে! তবু মায়ের নীরব প্রশ্রয়, নিজের পড়াশুনার আগ্রহ আর জেদ,গ্রামের ঐ জুনিয়র স্কুলের মিনি দিদিমনির অদম্য উৎসাহ, ভরসাকে সম্বল করে আজ প্রথমা উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডী পেরোতে চলেছে। বাইরের লোকেরা তো বটেই, ঘরেও বাধা দেবার লোকের খুব একটা কমতি ছিল না। বিশেষত বাবা বা কাকা কাকিমা তো বটেই এমনকি ছোটবোন কাজলী ছাড়া নিজের ভাইবোনেদের থেকেও কোন সাহায্য ও পায়নি, বরঞ্চ ক্লাস নাইন থেকে বাড়ী থেকে ২৫ কিমি দূরের গ্রাম কালীনগরে রোজ স্কুল যাওয়া নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি ঘরে।তাও ভালো রেজাল্ট করার জন্য অনেক ছোটাছুটি ধরাধরি করে স্কুল ফী মকুব করিয়ে দিয়েছিল মিনি দিদিমনি, বইও মিনি দিদিমনিই যোগাড় করে দিয়েছে এতদিন। পঞ্চায়েত থেকে একটা সাইকেল আর মাসিক বৃত্তিও পেয়েছিল প্রথমা। ওর ভাগের জল আনা, কাপড় কাচা,বাসনধোয়া জাতীয় অনেক কাজ মা নয়তো গ্রামের স্কুলের ক্লাস এইট পড়ুয়া কাজলী ওর বাবাকে না জানিয়ে ভাগাভাগি করে সেরে রাখতো , যাতে ও ঘরে কিছুটা পড়ার সময় পায়। নয়তো এতদিনে ওর অন্য খেলার সাথীদের মত বিয়ে থা করে বাচ্চাকাচ্চা সামলে উচ্চমাধ্যমিকের পড়া তো দূর অস্ত, লক্ষীর পাঁচালী পড়ারও সময় পেত কিনা কে জানে।

তা দীনবন্ধু শহরের সরকারী অফিসের বেয়ারা বলে কথা। সে আগেই বলে দিয়েছিল মেয়ের আঠরো বছর না পুরালে বিয়ে দেওয়াটা নাকি বেআইনি। চাই তো পুলিশেও ধরতে পারে। তাই পুনির আঠারো পুরতে আর একটা দিনও দেরি করেনি দীননাথ।ঘরশত্রু তো ঘরেই আছে। আবাগীর বেটি বিভীষণের থেকে কম যায় নাকি!বিয়ের কথা শোনা ইস্তক মা মেয়ে জোড়া গলায় পোঁ ধরেছে মেয়ে নাকি বিয়ে করবে না। কলেজে পড়তে যাবে। শোনো কথা।বিয়ে না দিয়ে ধেড়ে আইবুড়ো মেয়ে ঘরে বসিয়ে রেখে দীননাথ শেষে লোক হাসানোর পাত্তর হবে নাকি?মুনির বিয়ের কি হবে?সেটাও তো ভাবতে হবে।সবসময় বাড়ীর মেয়েছেলেদের কথা শুনে চললে হয়েছে আর কি।কথাতেই বলে ‘মরদ কা বাত , হাথী কি দাঁত’।

কিন্তু বিয়ের দিনই অঘটন।প্যান্ডেল বাঁধা শেষ, ভিয়েন বসেছে, প্যাঁ পোঁ সানাইয়ের ফাটা রেকর্ড বাজছে।বেজারমুখী বৌ আর গোমরামুখী মেয়ের আপত্তিকে নস্যাৎ করে পরিবারের আত্মীয়া আর প্রতিবেশিনীদের উদ্যোগে পুনির গায়ে হলুদের আয়োজন চলার মধ্যেই থানার মেজবাবু এসে হাজির , সাথে সেই সর্বঘটে কাঁটালী কলা মেয়ে দিদিমনিটিও।কি না দীননাথ নাকি সাবালিকা মেয়ের অমতে জোরজবরদস্তি তাকে পাত্রস্থ করছে। শোনো কথা।মেয়ের বিয়ে বাপে দেবে না তো কি মেয়ে হাটে বাজারে মালা হাতে ঘুরে ঘুরে নিজের বর ধরে আনবে? অমত আবার কি? কোন মেয়ে আর বাপের ঘরের আদর ছেড়ে পরের ঘরের বৌ হতে আল্হাদে লাট খেয়ে পড়ে? পুনির কিসে ভালো কিসে মন্দ তা ওর জন্মদাতা বাপের থেকেও কি বাইরের লোক বেশী বুঝবে নাকি? মনে মনে গজরালেও কিন্তু পুলিশের ভয়ে মাথা নীচু করে থেকেছে। লোকজন পাড়াপড়শী আত্মীয় স্বজনকে হাসিয়ে পুনি আর পুনির মাও যখন একই কথা বলেছে সবার সামনে তখন ও রাগে দিশাহারা হয়ে চোখ পাকিয়ে ওদের দিকে তাকয়ে থাকা ছাড়া কিছু করতে পারে নি দীননাথ। কেননা, প্রথমে হাতে উনুনে দেবার চেলাকাঠ নিয়ে পুনির মা’র দিকে তেড়ে যাওয়া মাত্র দশাশই পলোয়ান চেহারার কনেষ্টবলটি যেভাবে ঘাড়ে রদ্দা মেরেছিল, তারপর আর সাহস হয়নি। মেজবাবুটিও যাবার আগে শাসিয়ে গেছিলেন যে, এই সব নিয়ে বাড়ীতে অশান্তি করলে দু’ভাইকে গারদে পুরে ঠান্ডা করে দেবেন। তাই প্রানপণ ইচ্ছেতে মেয়ে বৌকে পিটিয়ে লাশ বানানোর শখটা ধামাচাপা দিয়ে দিতে হয়েছে।তারপরে ভেবেছিল ঘরে চাল ডাল আনা বন্ধ করে দেবে। অত বেশী বোঝে যখন তখন নিজেদের ব্যবস্থা ওরা নিজেরাই করে নিক।দীনবন্ধুর বাড়ীতে কোনমতে নিজের আর পানুর খাওয়ার ব্যবস্থাটা করে নিতে পারল তাই করত। কিন্তু ভাইবৌ কিছুতে রাজি হল না।ঘরের মেয়েছেলেরা আঁতাত গড়ে দীননাথকে গায়ে পড়ে অপমান করতে উঠে পড়ে লেগেছে আর কি। রাগে ও বাড়ী যাওয়াই বন্ধ করে দিল । তবে মেয়ের পড়াশুনোর খরচা যে আর বইতে পারবে না, সেটা বেশ খোলসা করে বাড়ীতে বলে দিয়েছে দীননাথ।মা দুইমেয়ের সাড়া না পেয়ে এটাও বুঝেছে যে ব্যাপারটা ওদের কাছে জানাই ছিল।

বাবার জিদের কাছে হার মানেনি প্রথমা।গ্রামেই ছোট বাচ্চাদের পড়িয়ে, নিজের হাতখরচ নিজেই তুলে নিয়েছে।ওর পড়াশুনোর জিদ দেখে অনেক নিরক্ষর মা-ই তাদের বাচ্চাকে ওর কাছে পড়তে পাঠিয়েছে।ওর মা সরকারী লোনে ছাগল পুষে, হাঁস পুষে যা পেয়েছে তাতে দুই মেয়ের পড়ার খরচ ছাড়াও মেয়েদের বাপের দু বেলা দুধ,নতুন লুঙ্গী, বিড়ির খরচা চালিয়ে দিয়েছে বলে বাড়ীতেও কথা কাটাকাটি ছাড়া বিশেষ সমস্যা হয়নি।বাড়ীর কাজ, বাচ্চা পড়ানো সামলে প্রানপণে নিজের পড়াটা পড়ত প্রথমা। ওকে যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।খেটে খাবে, চাকরী করবে।ভাইবোন দুটোকে পড়াবে।বাবার ও তো বয়স বাড়ছে। সংসারের হালও তো ধরতে হবে।

দু’বছর কেটে গেছে। আষাঢ় মাস। মুনির বিয়ে নিয়ে বাড়ী সরগরম। হেঁসেল আলাদা হলেও দু’বাড়ীর উঠান তো একই।মুনির কোনকালেই পড়াশুনোয় ঝোঁক ছিলনা।তাই বিয়েতেও কোন আপত্তি নেই।দীননাথ আবার বিয়ের তোড়জোড়ে ব্যস্ত।আত্মীয়স্বজন পাড়া পড়শীতে আবার গমগম করছে বিয়েবাড়ী।দীননাথের খুশীয়াল চোখের সামনেই হাসিমুখে কলকলাচ্ছে কুনি, পানু, ওদের মা। পুনিটার কলেজে আজ ফর্ম ফিল আপ, তাই ইচ্ছে না থাকলেও কলেজ গেছে। ওর আবার মর্নিং কলেজ। সকালেই বেরিয়ে গেছে। মুনিটার গায়ে হলুদ শেষ হবার আগেই চলে আসবে বলে গেছে।বিকেল গড়াতে না গড়াতেই খবরটা এলো।পোষ্টমাস্টার অভিরামের কিশোর ছেলেটা পোষা কুকুর ভুলোর হাঁকডাক শুনে শুনশান শ্মশান লাগোয়া নয়ানজুলির ধারে ঝোপ জঙ্গলে কাদামাখা দেহটা প্রথম দেখতে পায়।কিছু মানুষরূপী না-মানুষের পৈশাচিক দৈহিক চাহিদা মিটিয়ে, নখ দাঁতের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত দেহে লজ্জা নিবারনের সুতোটুকুও ছিলনা বলে দুর্গন্ধময় পাঁকই বুঝি পরম যত্নভরে পুনির মরা দেহটা ঢেকে রেখেছিল।পাশে ভাঙ্গা সাইকেলটা,বইয়ের ব্যাগটা পড়েছিল বটে কিন্তু তারা তো আর সাক্ষী দিতে পারে না।

মুনির বিয়ের ঠিক দু’বছরের মাথায় কুনির বিয়ে ঠিক করে ফেলে দীননাথ।পুনি মারা যাবার পর মেয়েকে আর দুরে পড়তে পাঠানোর সাহস হয়নি কারো। পড়াশুনোটা তাই বন্ধই হয়ে গেছিল কুনির।বড় মেয়ের বেলায় রুখে দাঁড়ালেও কিন্তু ছোটোমেয়ের বিয়ে নিয়ে আর মুখ খোলেনি পানু-কুনির মা।পড়াশুনো না হয় নাই হোল।মেয়েটাতো বেঁচে বর্তে থাক।


1 মতামত: