ছোটগল্প - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

লিভ টুগেদার
অরুণ চট্টোপাধ্যায়


সুষমা আর দিব্যেন্দুর মধ্যে বিয়েটা টিকল না । কারণ এই দুজনের মধ্যে মালা এসে পড়েছিল । মালা কলেজের অধ্যাপক দিব্যেন্দুর কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী । বাগানের প্রথম ফোটা ফুলের মতই আপন সৌন্দর্য দিয়ে মালা নিজেকে গেঁথে অধ্যাপকের গলায় পরিয়ে দিতে ব্যগ্র ছিল প্রথম থেকেই । যদিও সে জানত দিব্যেন্দুর গলায় মালা হয়ে ঝুলছে আগে থেকেই আর একজন । সে হল সুষমা ।

মালা দিব্যেন্দুর বাড়িতেই পড়তে আসত । বইয়ের পাতার থেকেও বেশী করে সে তাকিয়ে থাকত দিব্যেন্দুর মুখের দিকে । মনোযোগ সহকারে বইয়ের তত্ব বোঝার থেকে বেশী করে মনোযোগী হত অধ্যাপকের দেহ-সৌষ্ঠবের আর বাচনভঙ্গির দিকে ।

আপনভোলা অধ্যাপকের নজরে সেটা না পড়লেও সুষমার পড়েছিল । মনের আকাশে কালো কিছু মেঘ হঠাৎ জড় হতে লাগল । একটা আশ্রয়হীনতার আশঙ্কা তাকে ক্রমশঃ গ্রাস করতে লাগল । সেই আশংকা জন্ম দিয়েছিল বহু ভিত্তিহীন সন্দেহের । সংসারে অশান্তি যে ক্রমে বেড়েই চলেছিল এটার জন্যে বেশী বর্ণনা খরচ করার দরকার নেই ।

এই অশান্তি শেষে আদালতের দরজায় কড়া নাড়ল । ডিভোর্স আর সেপারেশন এটাও কোনও কষ্টকল্পনা নয় । মালা যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী তখন এমন ঘটনা ঘটল । ভাগ্য ভাল দিব্যেন্দুর সংসারে ইতিমধ্যে কোনও নতুন অতিথি আসে নি । ভাগ্য বেশী করে ভাল সেই অনাগত নতুন অতিথির পক্ষে । কারণ রাজা-রাণীর যুদ্ধে এই অসহায় অনাগত উলুখাগড়াটির কোনও বিপদ হল না ।

মালা পায় নি দিব্যেন্দুকে । চেষ্টার ত্রুটি রাখে নি । তবু পায় নি । তাতে অবশ্য তার কোনও ক্ষোভ নেই । কারণ সে এখন একজন আই-এ-এসের বউ আর এক আই-পি-এসের গোপন সঙ্গিনী । এই গোপনতা বিদেশী ভাষায় যাকে বলে “ওপেন সিক্রেট” । কারণ এই আই-এ-এসের আরও এক “ওপেন সিক্রেট” সঙ্গিনী ছিল ।

ঢিল ছুঁড়ে জগতকে বশ করা যায় না । বরং আরও শত্রু হতে হয় । কিন্তু ডিল করে করা যায় । মালাকে ঘিরে তার স্বামী –প্রেমিক-তস্য প্রেমিক এইসবের যে মালা ছিল তাদের পরস্পরের মধ্যে কাজ করছিল এই চমৎকার ডিল । তাই স্ক্যান্ডাল শব্দটা কেঁদে কেঁদে বেড়াতে লাগল তাদের চারপাশ ঘিরে কিন্তু কোনও এন্ট্রি নিতে পারল না ।

মালা একদিন আয়নায় তার প্রতিবিম্বকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, কি ? আর তোমার দিব্যন্দুকে দরকার ?

আয়নার প্রতিবিম্ব হেসেছিল শুধু । কিছু বলে নি । বোঝা গিয়েছিল সেই প্রতিবিম্বটি খুব সুখেই আছে ।

সাত বছর পরে দেখা হয়েছে সুষমা দিব্যেন্দুর মধ্যে । দিব্যেন্দু তার কলেজের ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে এক্সকারসনে বেরিয়েছিল পুরী । ফেরার আগের দিন ছেলেমেয়েরা বিচে নিজেদের মত কাটাচ্ছিল । আর একান্তে সমুদ্রের ঢেউ গুণে নিজের মত সময় কাটাচ্ছিল তাদের স্বল্পভাষী শিক্ষক ।

সন্ধে তখন হয়ে আসছে । দিগন্ত তখন রঙের খেলায় মেতেছে । ছাত্র ছাত্রীরা তাদের নিজেদের মত হোটেলে ফিরবে । ওদের বলাই আছে । আজ শেষ দিন হওয়ায় রাশ একটু আলগা করেছে দিব্যেন্দু ।

সুষমাকে দেখে অবাক হয় নি সে । শুনেছিল ডিভোর্সের পরে একটা চাকরি পেয়ে কোথায় চলে গেছে সুষমা । তা, সে তো পুরীতে আসতেই পারে । সূর্য দিগন্তের পারে চলে গেলেও সাগরের আলকাতরার মত কালো জল ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলতেই পারে । ঢেউগুলো মুখে করে দূরের আলোগুলোর প্রতিফলনে চকচকে বুদবুদ তুলে বেলাভূমিতে ফেটে পড়তেই পারে ।

আর সুষমাও সেগুলো দেখার ইচ্ছায় এসে বসতে পারে দিব্যেন্দুর অদূরে । দিব্যেন্দুর অস্তিত্ব না জেনেই । দিব্যেন্দুর হটাত চোখে পড়ে যেতে পারে । সে চমকে উঠতে পারে । কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্যে । সুষমার আশপাশে তাকাতেই পারে তার নতুন স্বামী বা ছেলেমেয়ের সন্ধানে ।

না, এখনও একাই আছে সুষমা । প্রাথমিক সামান্য বিস্ময়, কৌতূহল আর অস্বস্তি কাটিয়ে উঠে কথা বলেছে সে দিব্যেন্দুর সঙ্গে । নিয়েছে তার খোঁজ খবর । হাওয়াটা এখন বেশ জোর । একটু ঠাণ্ডাও বটে । শাড়ী ব্লাউজ ছাড়া সুষমা গায়ে আর কিছু দেয় নি । একটু কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠছিল । নিজের শালটা তার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে দিব্যেন্দু । একটুও আপত্তি করে নি সুষমা । দিব্যেন্দু তো চিরকাল এরকমই করত । সম্পর্কের পাতায় সাত বছরের ধুলো পড়লেও স্মৃতি তো এখনও ঝাপসা হয়ে যায় নি ।

ব্যাগটা খুলেছে সুষমা । বার করেছে একটা চমৎকার এন্টিক পিস । না, এটা অবশ্য সে কেনে নি দিব্যেন্দুর জন্যে । কারণ তার সঙ্গে এমনভাবে দেখা হবে তা তো জানত না । হয়ত কিনেছে দিব্যেন্দুর স্মৃতির জন্যে । তাই দিয়েছে দিব্যেন্দুর হাতে । হ্যাঁ, এমন এন্টিক পছন্দ করত দিব্যেন্দু ।

- এক বান্ধবীর ফ্যামিলির সঙ্গে এসেছি । ওরা এদিক-ওদিক আছে । সুষমা বলল । সে একটু সরেই বসেছে দিব্যেন্দুর দিকে । দিব্যেন্দু আপত্তি করে নি ।

সুষমা একটা ট্রান্সফার নিতে পেরেছে । দিব্যেন্দুর শহরের কাছাকাছি । অবশ্য ভাগ্য সহায় হয়েছিল হয়ত । সুষমা তার একদা নিজের বাড়ী অর্থাৎ বর্তমানে তার স্বামীর বাড়ী আর যায় নি । ডিভোর্সের পরে তো বটেই, এমন কি এই ফিরে দেখার পরেও । ইতিহাস ইতিহাসই থাক । সেটাকে আর উপন্যাস বানানোর ইচ্ছে তার নেই ।

সে ইচ্ছে নেই দিব্যন্দুরও । তাই রোজ আটটায় ওরা এই পার্কে এসে বসে । পাশাপাশি কাছাকাছি । একজন আর একজনের খবর রাখে । একজনের সুখে সুখী আর দুঃখে সমব্যথী হয় ।

- ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে সু ?

- - যাওয়া হয় নি গো । সময় করে উঠতে পাচ্ছি না । তাছাড়া –

- তাছাড়া ? দিব্যেন্দু মুখ ভার করেছে, তুমি বুঝতে পারছ না কেন তোমার এই পেট ব্যথাটা অনেক খারাপ রোগের কারণে হতে পারে । আচ্ছা আমি ডাঃ দত্তগুপ্তকে ফোন করে দেব । উনি খুব ভাল গ্যাস্ট্রোলোজিস্ট ।

- সে তো না হয় হল । কিন্তু তোমার চোখ দিয়ে জল পড়াটা কি ভাল ? তুমি বুঝতে পারছ না পড়াশোনাই তোমার কাজ । ভগবান না করুন চোখে যদি সাংঘাতিক কিছু হয়ে যায় ? চোখের একজন ভাল ডাক্তার আমার অফিসের নীলিদির হাজব্যান্ড । আমি কালই নীলিদির সঙ্গে কথা বলছি ।

ওরা এখন লিভ টুগেদার করছে । দিব্যেন্দু ব্যখ্যা করতে চেয়েছে এই লিভ শব্দটার ।

- এই লিভ মানে কিন্তু বাস করা নয় সু । দিব্যেন্দুর মুখের কথা মাঝপথে কেড়ে নিয়েছে সুষমা । হাসিমুখে বলেছে, জানি গো জানি । এই লিভ মানে বাঁচা । বাঁচার মত করে বাঁচা । পরস্পরের জন্যে বাঁচা । এই বাঁচায় নেই কোনও সন্দেহ, নেই কোনও অসূয়া, নেই আক্রোশ, নেই ঈর্ষা । শুধু একজন আর একজনের হাত ধরে চলা ।

সন্ধ্যার অন্ধকারে তারা দুজনে পাশাপাশি আসে । কাছাকাছি আসে । তবু একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরে না ।

কারণ তাদের হৃদয় পরস্পরকে জড়িয়ে রেখেছে । বেশ শক্ত বন্ধনে ।



1 মতামত: