বিশেষ প্রতিবেদন - তিমিরকান্তি পতি

পুরাতাত্ত্বিকতার আলোকে বাঁকুড়ার গ্রাম - হাড়মাসড়া
তিমিরকান্তি পতি



জেলা শহর বাঁকুড়া থেকে ৩২ কিমি ও মহকুমা শহর খাতড়া থেকে ১৯ কিমি দূরে অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধশালী জন পদ হাড়মাসড়া। গ্রামের এরূপ নাম নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই বলেন হাড়াম নামে কোন আদিবাসী সর্দারের নামানুসারে এরূপ নামকরণ। তাঁদের যুক্তি সাঁওতালী ভাষায় অড়া শব্দের অর্থ বাসস্থান । অর্থ্যাৎ হাড়াম > অড়া = হাড়ামের বাসস্থান বা বাড়ী। ক্রমে হাড়ামঅড়া থেকে আজকের হাড়মাসড়া। কয়েক ঘর আদিবাসী বসতি ছাড়া এর কোন প্রামান্য নেই।

বাঁকুড়ার তালডাংরা ব্লকের এই গ্রামটিতে কান পাতলে আজও শোনা যায় জৈন ও বৌদ্ধ যুগের ইতিহাসের পদধ্বনী। এখনো খোলাচোখে দেখতে পাওয়া যায় গ্রাম / এলাকার আনাচে কানাচে অযত্নে, অবহেলা আর অনাদরে নষ্ট হচ্ছে অসংখ্য প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য বাঁকুড়া – খাতড়া ভায়া হাড়মাসড়া বাস রাস্তায় গেলেই সবার নজর কাড়বে ৩০-৩২’ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মাকড়া পাথরে নির্মিত একটি জৈন মন্দির। স্থানীয় বয়োঃ জ্যেষ্ঠ মানুষজন ও পুরাতাত্তিকদের মতে, এরকম মন্দির এই গ্রাম ও এলাকায় আরো ছিল। তার উৎকৃষ্ট প্রমান ঐ মন্দির চত্বর ছাড়াও পার্শ্ববর্ত্তী কেশাতড়া ও ভীমাড়া গ্রামে এরূপ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে।

পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, শিলাবতী নদী তীরবর্ত্তী অঞ্চলে ঐ সব জৈনমন্দির জৈনধর্মালম্বী উত্তর কলিঙ্গের রাজা ষোড়শ শতাব্দীতে এই সব তৈরি করেছিলেন। বিশিষ্ট্য প্রাবন্ধিক , লেখক ও কবি প্রয়াত শক্তি সেনগুপ্ত তাঁর ‘ দামুন্দা কপিসা শিলাবতী গ্রন্থে ( অক্টোঃ ১৯৯৬ ) উল্লেখ করেছেন , “ গ্রামের সানবাঁধা পুকুর খনন কালে ৬ ফুট উচ্চতার সপ্তনাগ ফনাবিশিষ্ট্ ক্লোরাইট পাথরের একটি পার্শ্বনাথ মূর্তি পাওয়া গেছে । ঐ পুকুর খননকালে আরও দুটি জৈন্ তীর্থঙ্কর মূর্ত্তি পাওয়া গেছে যার মধ্যে একটি সিংহলাঞ্ছিত মহাবীর ও অপরটি নেমিনাথ মূর্ত্তি। যা এখনও পাঁচঘরিয়া পাড়ার শিব মন্দিরে রক্ষিত আছে। ঐ গ্রন্থে তিনি আরো অভিমত প্রকাশ করেছেন , “ বর্তমান মন্দিরের সমগ্র পশ্চাদ ভূমি ও ভিত্তি অঞ্চল, কাছাকাছি সানবাঁধা ও পতির পুকুরের সূ উচ্চ ভূমি, পলাশ ডাঙার ঢিবি অঞ্চল দেখে আমার মনে হয়েছে, যে অর্ধমাইল পরিধি বিশিষ্ট এই উচ্চ ভূমি ভাগের সমস্তটাই একটি খননযোগ্য প্রত্নভূমি। এখানে অনেক মন্দিরের ধ্বংসস্তুপে বহু প্রত্ন বিষয় উদ্ধারের সম্ভাবনা আছে ।

এছাড়াও ঐ সানবাঁধা পুকুর পাড়েই গাছের তলায় সপ্তনাগ ফনাবিশিষ্ট্ একটি প্রাচীন মূর্ত্তি আছে। যা নাকি ঐ পুকুর খনন কালে পাওয়া যায়। স্থানীয় ‘ হাঁড়ি সম্প্রদায়ের মানুষজন এই মূর্ত্তিটি কে ভক্তি ভরে খাঁন্দারানী নামে পূজা করেন । পার্শ্ববর্তী ভীমাড়া – কেশাতড়া গ্রামের মানুষের অভিমত,এই মূর্ত্তিটি খাঁন্দাসিনী জঙ্গল থেকে রাতের অন্ধকারে তুলে আনা। তাই এর নাম খাঁন্দারানী।

শিলাবতী নদী তীরবর্ত্তী এই অঞ্চলটি যে অতি প্রাচীন ও এক কালে যথেষ্ঠ সমৃদ্ধশালী ছিল তার প্রমান মেলে। এই নদীর ঘাট গুলির নাম যেমন- ইটাঁপোড়া, শতীরডাঙা, শহরঘাটা, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাছাড়াও এখানের সুলগী ও চুনালু মৌজাতে মাঠ খনন কালে আজও পোড়া মাটির পাত্র, ভাঙা অস্ত্র – শস্ত্র, লোহা গলাবার উনুন মেলে। এর থেকেই আন্দাজ করা যায় এলাকাটি শিল্প সমৃদ্ধ ছিল।

কিন্তু এই সব উদ্ধারে সরকারী স্তরে কোন পদক্ষেপ নেই। যদিও সম্প্রতি ‘ ওয়েষ্ট বেঙ্গল হেরিটেজ কমিশন ; ১৬,৯৮,৩৪৮ টাকা ব্যায় করে প্রাচীন জৈন মন্দিরটি সংস্কার করেছেন। এখনই এই সব অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্জ না চালালে প্রকৃতি ও মানুষের আগ্রাসনে একদিন হারিয়ে যাবে এই প্রত্ন নির্দশন।



4 মতামত:

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. দেবাশিস কাঞ্জিলাল১৭ অক্টোবর, ২০১৩ এ ৯:৩৫ AM

    তিমিরকান্তি পতি'র বাঁকুড়ার হাড়মাসরা গ্রামের পুরাতাত্বিক তাৎপর্য নিয়ে প্রতিবেদনটি বেশ তথ্যপূর্ণ ।এই জৈন ধর্মের সুপ্রাচীন পীঠস্থানটি একটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে এখন সুপরিচিত। এখানে খুব কাছেই কয়েকটি সুন্দর জলপ্রপাত রয়েছে যা' কাছের শিলাই নদীতে পড়েছে । তবে তালড্যাংরায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে বাঁকুড়ার এই অংশে পর্যটক এখন খুবই কম ! আরেকটি কথা খুব কৌতূহলোদ্দীপক মনে হবে,এখানে প্রাচীন জৈন মন্দিরগুলিতে এখন পরেশনাথ ও অন্যান্য মূর্তি হিন্দু মতে পূজিত হয়ে থাকেন । উৎসাহীরা এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বেশ কিছু বছর আগে প্রকাশিত ' বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি ' বইটি পড়ে দেখতে পারেন । ১৬/১০/২০১৩

    উত্তরমুছুন
  3. আমাদের আসেপাশে কত অজানা এমন নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে যা আমরা গ্রাহ্যও করিনা, এমন একটা জিনিস কে সামনে তুলে ধরার জন্য লেখক কে ধ্যন্যবাদ। এটি দেখার এক সুপ্ত ইচ্ছে মনে জন্মালো।

    উত্তরমুছুন