বিশেষ সাক্ষাৎকারঃ
মিহির বসু-র মুখোমুখি শেখর রায়
বসিরহাটের গ্রামের ছেলে, দশ ভাই বোন, তবুও বাবার শাসন ছিল প্রচণ্ড। সারা দুপুর ফুটবল খেলে সন্ধ্যায় হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম ভাঙত বাবার মার খেয়ে। আমি পড়াশুনো না করে ফুটবল খেলি, বাবা পছন্দ করতেন না। মার খেয়ে বলতাম, আজ খেলি নি। বাবা তখন দেশলাই কাঠিতে তুলো জড়িয়ে আমার দুই কানে ঢুকিয়ে দিতেন। যথারীতি, তুলোতে কাদা মাটি লেগে যেত, শুরু হতো আবার মার, মিথ্যে বলার জন্য। ফুটবল কিন্তু ছাড়ি নি।
১৯৭৩ সাল। কোলকাতায় এলাম পোর্ট ট্রাস্ট-এর হয়ে খেলতে। অভাবের সংসার, একটা চাকরী জরুরি। ১৯৭৪-এ বি এন আর -এ সই করলাম। ৩০০ টাকার চাকরী হোলো রেলে। বসিরহাট-কোলকাতা রেলে যাই আসি। কোলকাতার মাঠে খেলছি, অল্প অল্প নাম ডাক হচ্ছে। এক ছুটির দিনে গ্রামের মাঠে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলছি। ধুলো উড়িয়ে দুটো গাড়ি এসে দাঁড়ালো। কারা যেনও আমার খোঁজ করছে। এগিয়ে গিয়ে দেখি ইস্টবেঙ্গলের জীবন, পল্টূ আরও অনেকে। আমাকে বাড়ি যেতে বলল। বেশ ঘাবড়ে গেলাম। বাড়িতে এলাম, ওরাও এলো। বাবাকে বলল, মিহির কে কলকাতায় নিয়ে যাবো, ওকে ইস্ট বেঙ্গলে খেলতে হবে। আমি বললাম, তবেতো রেলের চাকরী যাবে, সংসার চলবে কি করে! ওরা ব্যাঙ্কের চাকরীর কথা বলে একরকম আমাকে তুলে নিয়ে গেল সেদিন। শিয়ালদার একটা হোটেলে ৫ দিন বন্দি ছিলাম। সাথে ভাস্কর গাঙ্গুলি আরও অনেকে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেললাম। জীবনের প্রথম ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ম্যাচ। ৭ জুলাই, ১৯৭৭। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে গোল করলাম। সমর্থকদের মুখে মুখে আমার নাম। ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা এক সুরে গাইতে লাগলো, হাবিব নাচে, উল্গা নাচে, পি কে বাজায় ঢোল / দেখবি যদি আয়রে তোরা মিহির বোসের গোল । চোখের জল ধরে রাখতে পারি নি সেদিন। সেদিন বসিরহাটের বাড়িতে ঢুকতেই ছোট ভাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যে কটা দিন বাড়িতে ছিলাম, ভাই ঘরে ফেরেনি। আসলে আমার বাড়ির সবাই, এমনকি, আমিও ছিলাম মোহনবাগানের অন্ধ সমর্থক।
১৯৮০ তে মোহনবাগানে এলাম। ধীরেন দে বলেছিলেন, ঘটীর ছেলে হয়ে ইস্টবেঙ্গলে খেললে, যাও গঙ্গায় স্নান করে এসো, মোহনবাগানে সই করো। ১৯৮০-৮১, মাঝে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ ফিরেছিলাম ইস্টবেঙ্গলে। ১৯৮৫ তে আবার মোহনবাগানে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ খেললাম মোহামেডানের হয়ে। এই আমার দীর্ঘ ১২ বছরের কোলকাতার মাঠে খেলা । জাতীয় দলের হয়ে খেলেছি ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল । দুবাই, রাশিয়া, নর্থ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরে ভারতের হয়ে খেলেছি। খেলেছি সন্তোষ ট্রফি, ডুড়াণ্ড, ডি সি এম, আইএফএ শিল্ড, নেহেরু কাপ... । ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, কোলকাতায় সেদিন প্রথম জহরলাল নেহেরু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী ম্যাচে চীনের কাছে আমরা প্রথমার্ধে ০-১ গোলে পিছিয়ে ছিলাম। প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। আমরা পিছিয়ে থাকা অবস্থায় তিনি মাঠ ছেড়ে গিয়েছিলেন ব্রিগেডের এক সভা তে। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন, গোলটা শোধ হলে তাঁকে যেন জানানো হয়। দ্বিতীয়ার্ধে আমি গোলটা শোধ করেছিলাম। ইডেনের গগনভেদী উল্লাস পৌঁছে ছিল ব্রিগেডে তাঁর কানে। সেই মুহূর্তে তিনিও উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারেন নি। বলেছিলেন, আমরাও পারি। আমরা কারো থেকে পিছিয়ে নেই।
ফুটবল খেলোয়াড়রা চিরকালই মেয়েদের পছন্দের হয়। অনেক মেয়ে আমাকেও প্রেম নিবেদন করতে চাইতো। একদিন বিকেলে ইস্টবেঙ্গল মাঠের বাইরে গোখেলে পড়া একটি মেয়ে আমার সাথে আলাপ করলো। অফিসের ঠিকানা চাইল। দিলাম। সেই শুরু, প্রায় প্রতিদিনই দুপুরে আমরা দেখা করতাম চিড়িয়াখানায়। সে আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল। আমার ঘাড়ে তখন সংসারের জোয়াল। ভাইদের দাঁড় করাতে হবে, বোনদের বিয়ে দিতে হবে। নিজের সংসার আজও আমার করা হল না।
বসিরহাটে আমার ফুটবল গুরু ছিলেন শ্রদ্ধেয় রবীন সেনগুপ্ত। ওনার প্রেরণা আর শিক্ষায় আমি আজকের মিহির বসু। পরবর্তীতে কোচ হিসেবে পেয়েছি অনেককে, তাদের মধ্যে প্রিয় অমল দত্ত, অরুন ঘোষ। ঘটী বাড়ীর ছেলে হয়েও আমার প্রিয় ক্লাব ইস্টবেঙ্গল। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মধ্যে যে আবেগ আমি দেখেছি, অন্য ক্লাব-এর সমর্থকদের মধ্যে আমি তা খুঁজে পাই নি।
খেলার মাঠের সমর্থকরা খেলোয়াড়দের কাছে অনন্য অনুপ্রেরণা। ওঁদের উল্লাস, ওঁদের ভালবাসা, ওঁদের ধিক্কার খেলোয়াড়দের কাছে ভগবানের আশীর্বাদ। আমাদের সময় সমর্থকরা তাঁদের প্রিয় খেলোয়াড়দের নিয়ে ছড়া বানাতেন, আজ যা বিরল। মোহনবাগানের হয়ে খেলার সময় আমি গোল করলেই মোহনবাগান সমর্থকরা চিৎকার করে মাঠ কাঁপাতেন, সুরে গাইতেন, ২১ নম্বর জার্সি তাকেই শোভা পায়, আমাদের মিহির দা যেন কোনোদিন মোহনবাগান ছেড়ে না যায় ।
ফুটবলের জন্যেই সব দিয়েছি, যা কিছু পেয়েছি তা ফুটবালের জন্যেই। আজ একটা কথাই বার বার মনে হয়, ভূমি পুত্র যদি না তৈরি হয়, ভারতবর্ষের ফুটবলে বাংলার আধিপত্য কায়েম হবে না।
“একদিন ধীরেন দে বলেছিলেন, ঘটীর ছেলে হয়ে ইস্ট বেঙ্গলে খেললে, যাও গঙ্গায় স্নান করে এসো, মোহনবাগানে সই করো ...”
- সেদিন সন্ধ্যায় স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলার, মিহির বসু, উঁকি দিলেন শেখর রায় ।
বসিরহাটের গ্রামের ছেলে, দশ ভাই বোন, তবুও বাবার শাসন ছিল প্রচণ্ড। সারা দুপুর ফুটবল খেলে সন্ধ্যায় হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম ভাঙত বাবার মার খেয়ে। আমি পড়াশুনো না করে ফুটবল খেলি, বাবা পছন্দ করতেন না। মার খেয়ে বলতাম, আজ খেলি নি। বাবা তখন দেশলাই কাঠিতে তুলো জড়িয়ে আমার দুই কানে ঢুকিয়ে দিতেন। যথারীতি, তুলোতে কাদা মাটি লেগে যেত, শুরু হতো আবার মার, মিথ্যে বলার জন্য। ফুটবল কিন্তু ছাড়ি নি।
১৯৭৩ সাল। কোলকাতায় এলাম পোর্ট ট্রাস্ট-এর হয়ে খেলতে। অভাবের সংসার, একটা চাকরী জরুরি। ১৯৭৪-এ বি এন আর -এ সই করলাম। ৩০০ টাকার চাকরী হোলো রেলে। বসিরহাট-কোলকাতা রেলে যাই আসি। কোলকাতার মাঠে খেলছি, অল্প অল্প নাম ডাক হচ্ছে। এক ছুটির দিনে গ্রামের মাঠে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলছি। ধুলো উড়িয়ে দুটো গাড়ি এসে দাঁড়ালো। কারা যেনও আমার খোঁজ করছে। এগিয়ে গিয়ে দেখি ইস্টবেঙ্গলের জীবন, পল্টূ আরও অনেকে। আমাকে বাড়ি যেতে বলল। বেশ ঘাবড়ে গেলাম। বাড়িতে এলাম, ওরাও এলো। বাবাকে বলল, মিহির কে কলকাতায় নিয়ে যাবো, ওকে ইস্ট বেঙ্গলে খেলতে হবে। আমি বললাম, তবেতো রেলের চাকরী যাবে, সংসার চলবে কি করে! ওরা ব্যাঙ্কের চাকরীর কথা বলে একরকম আমাকে তুলে নিয়ে গেল সেদিন। শিয়ালদার একটা হোটেলে ৫ দিন বন্দি ছিলাম। সাথে ভাস্কর গাঙ্গুলি আরও অনেকে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেললাম। জীবনের প্রথম ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ম্যাচ। ৭ জুলাই, ১৯৭৭। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে গোল করলাম। সমর্থকদের মুখে মুখে আমার নাম। ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা এক সুরে গাইতে লাগলো, হাবিব নাচে, উল্গা নাচে, পি কে বাজায় ঢোল / দেখবি যদি আয়রে তোরা মিহির বোসের গোল । চোখের জল ধরে রাখতে পারি নি সেদিন। সেদিন বসিরহাটের বাড়িতে ঢুকতেই ছোট ভাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যে কটা দিন বাড়িতে ছিলাম, ভাই ঘরে ফেরেনি। আসলে আমার বাড়ির সবাই, এমনকি, আমিও ছিলাম মোহনবাগানের অন্ধ সমর্থক।
১৯৮০ তে মোহনবাগানে এলাম। ধীরেন দে বলেছিলেন, ঘটীর ছেলে হয়ে ইস্টবেঙ্গলে খেললে, যাও গঙ্গায় স্নান করে এসো, মোহনবাগানে সই করো। ১৯৮০-৮১, মাঝে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ ফিরেছিলাম ইস্টবেঙ্গলে। ১৯৮৫ তে আবার মোহনবাগানে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ খেললাম মোহামেডানের হয়ে। এই আমার দীর্ঘ ১২ বছরের কোলকাতার মাঠে খেলা । জাতীয় দলের হয়ে খেলেছি ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল । দুবাই, রাশিয়া, নর্থ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরে ভারতের হয়ে খেলেছি। খেলেছি সন্তোষ ট্রফি, ডুড়াণ্ড, ডি সি এম, আইএফএ শিল্ড, নেহেরু কাপ... । ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, কোলকাতায় সেদিন প্রথম জহরলাল নেহেরু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী ম্যাচে চীনের কাছে আমরা প্রথমার্ধে ০-১ গোলে পিছিয়ে ছিলাম। প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। আমরা পিছিয়ে থাকা অবস্থায় তিনি মাঠ ছেড়ে গিয়েছিলেন ব্রিগেডের এক সভা তে। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন, গোলটা শোধ হলে তাঁকে যেন জানানো হয়। দ্বিতীয়ার্ধে আমি গোলটা শোধ করেছিলাম। ইডেনের গগনভেদী উল্লাস পৌঁছে ছিল ব্রিগেডে তাঁর কানে। সেই মুহূর্তে তিনিও উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারেন নি। বলেছিলেন, আমরাও পারি। আমরা কারো থেকে পিছিয়ে নেই।
ফুটবল খেলোয়াড়রা চিরকালই মেয়েদের পছন্দের হয়। অনেক মেয়ে আমাকেও প্রেম নিবেদন করতে চাইতো। একদিন বিকেলে ইস্টবেঙ্গল মাঠের বাইরে গোখেলে পড়া একটি মেয়ে আমার সাথে আলাপ করলো। অফিসের ঠিকানা চাইল। দিলাম। সেই শুরু, প্রায় প্রতিদিনই দুপুরে আমরা দেখা করতাম চিড়িয়াখানায়। সে আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল। আমার ঘাড়ে তখন সংসারের জোয়াল। ভাইদের দাঁড় করাতে হবে, বোনদের বিয়ে দিতে হবে। নিজের সংসার আজও আমার করা হল না।
বসিরহাটে আমার ফুটবল গুরু ছিলেন শ্রদ্ধেয় রবীন সেনগুপ্ত। ওনার প্রেরণা আর শিক্ষায় আমি আজকের মিহির বসু। পরবর্তীতে কোচ হিসেবে পেয়েছি অনেককে, তাদের মধ্যে প্রিয় অমল দত্ত, অরুন ঘোষ। ঘটী বাড়ীর ছেলে হয়েও আমার প্রিয় ক্লাব ইস্টবেঙ্গল। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মধ্যে যে আবেগ আমি দেখেছি, অন্য ক্লাব-এর সমর্থকদের মধ্যে আমি তা খুঁজে পাই নি।
খেলার মাঠের সমর্থকরা খেলোয়াড়দের কাছে অনন্য অনুপ্রেরণা। ওঁদের উল্লাস, ওঁদের ভালবাসা, ওঁদের ধিক্কার খেলোয়াড়দের কাছে ভগবানের আশীর্বাদ। আমাদের সময় সমর্থকরা তাঁদের প্রিয় খেলোয়াড়দের নিয়ে ছড়া বানাতেন, আজ যা বিরল। মোহনবাগানের হয়ে খেলার সময় আমি গোল করলেই মোহনবাগান সমর্থকরা চিৎকার করে মাঠ কাঁপাতেন, সুরে গাইতেন, ২১ নম্বর জার্সি তাকেই শোভা পায়, আমাদের মিহির দা যেন কোনোদিন মোহনবাগান ছেড়ে না যায় ।
ফুটবলের জন্যেই সব দিয়েছি, যা কিছু পেয়েছি তা ফুটবালের জন্যেই। আজ একটা কথাই বার বার মনে হয়, ভূমি পুত্র যদি না তৈরি হয়, ভারতবর্ষের ফুটবলে বাংলার আধিপত্য কায়েম হবে না।
"নিজের সংসার আজও আমার করা হল না। ".....মন ছুঁইয়ে গেল....ভালো থাকবেন । আপনার খেলা আমি অনেকবার দেখেছি ,
উত্তরমুছুনবেলাল হোসেন
খুব ভালো লাগল পড়ে, অনেক কষ্ট করেছেন জীবনে তবেই সফল ফুটবলার হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বসিরহাটের মোটামুটি আপনাদের সমসাময়িক আর এক ফুটবলারের কথা খুব মনে পড়ে, তিনি বিক্রমজিৎ দেবনাথ। আপনি ভালো থাকুন নমস্কার জানবেন।
উত্তরমুছুনkhub bhalo laglo pore ...... proti shonkhyay Jodi emon bhabei kono celebrity r interview thake tahole potrikar akorshon barbe.....
উত্তরমুছুনApnader antorik bhalobasay aamra egiye chalbo.
মুছুন