ধারাবাহিকঃ
আমার মুক্তিযুদ্ধ - ৪
সৈয়দা মকসুদা হালিম
আমাদের জীবন বয়ে চলেছে সময়ের সাথে তাল রেখে। হাজার অরাজক পরিবেশেও মানুষের জীবনযাত্রা থেমে থাকে না। আহার-নিদ্রা, জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ-দাম্পত্য—সবই আপন নিয়মে ঠিকই চলে। ভার্সিটি খোলা, আমি ভার্সিটিতে যাই। আগে তিন নেতার মাজার পার হলেই রেসকোর্সের মাঠে ঘোড়দৌড় দেখতে দেখতে যেতাম। একটা পুকুর ছিলো, তার চারদিক দিয়ে ঘোড়া দৌড়াতো, রিক্সায় বসে বসে দেখতাম।এখন সব ফাঁকা। রাস্তার যত্র-তত্র পাকিস্তানী সৈন্য, মেশিন গান উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুনির চৌধুরী স্যার ডিপার্টমেন্টের হেড। অন্য সব টিচাররাও আছেন। তবে পরিবেশ খুব থমথমে আর হালকা। ছাত্ররা প্রায় নেইই। শুনলাম, প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উঠার পরীক্ষা হবে। রুটিন নিয়ে এলাম। পরীক্ষা দেবো। দুলাল হাসতে হাসতে বললো, “ভাবী, আপনি পাকিস্তানীদের সাথে সহযোগিতা করছেন, মুক্তিযোদ্ধারা আগে টের পাক!” বললাম, “এটাও একটা মুক্তিযুদ্ধ। আমরা স্বাভাবিক থাকার ভাব নিচ্ছি যাতে করে আর্মিদের কড়াকড়িতে ঢিল পড়ে, সেই সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের মধ্যে ঢুকতে পারবে। আর তাছাড়া আমার এতোগুলো দেবর মুক্তিযোদ্ধা, আমার আবার ভয় কিসের ?”
আমার ছোট দেবর ওদুদ ভাই যশোর থেকে আমাদের দেখতে আসে। শ্বশুর আমাদের জন্য ব্যস্ত হয়েছেন, আমরা মরে গেছি না বেঁচে আছিজানতে চান। তার মুখে আমাদের বাড়ির যে কাহিনী শুনলাম, এখন সেটা বলি…..
ঢাকা আক্রান্ত হয়েছে ২৫শে মার্চের রাত থেকে। তখনো ঢাকার বাইরে আর্মির কর্মতৎপরতা শুরু হয়নি। খুব সম্ভব গোলা-বারুদ, সৈন্য-সামন্ত নিয়ে যেতে তাদের দেরী হচ্ছিলো! ওদুদ ভাই আবহাওয়া অফিসে চাকুরী করে। আবহাওয়া অফিসটা ছিলো এয়ারপোর্টের ভিতরে।আর ওর কোয়ার্টার থেকে এয়ারপোর্ট দেখা যায়। এক বিহারী সহকর্মী ছিলো তার, সে জানিয়েছিলো ভাবীসাবকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। বাড়িতে আছেন বৃদ্ধ শ্বশুর, বড় ভাই, দুই বউ আর বাচ্চা-কাচ্চা। বড়ভাই যশোর এম.এম.কলেজের অধ্যাপক, যুদ্ধের আগে দিয়ে উগ্রপন্থী কিছু বাঙালি, বিহারীনিধন যজ্ঞ শুরু করেছিলো। কলেজের দারোয়ান ছিলো বিহারী। সে বড়ভাইয়ের পা ধরে কাঁদাকাটা করে, তাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য। আমাদের বাড়িতে বিরাট একটা পুরনো রান্নাঘর ছিলো মূল বিল্ডিং থেকে একটু দূরে। ঘরটা খালি ছিলো। তো-সেই বিহারী পরিবারকে বড়ভাই সেখানে থাকতে দিয়েছিলেন। তিনি বিহারী নিধন সমর্থনকরেননি। বিহারীরা কেন বাংলাদেশের শত্রু হলো? আসলে শুধু বিহারী না, অনেক উদ্বাস্তু বাঙ্গালিরাও বাংলাদেশ চায়নি। তাদের কথা ছিলো-‘আমরা ইন্ডিয়া থেকে মার খেয়ে পাকিস্তানে এসেছি, এখন এই পাকিস্তান যদি আবার ইন্ডিয়ার খপ্পরে পড়ে তাহলে আমরা কোথায় যাবো ?” যাহোক, ২৫শে মার্চের পর থেকেই প্রায়ই ছেলেরা এসে বলতো,“স্যার, আপনারা গ্রামে চলে যান, শহরে থাকবেন না।” কিন্তু বুড়ো শ্বশুর, ৮০বছর বয়স, তিনি বাড়ি ছাড়তে চান নি। তা ছাড়া ওদুদ ভাই বাড়ি ছিলো না, তাকে রেখেও কেউ কোথাও যাচ্ছিলোনা।
এপ্রিলের ৪ তারিখে ওদুদ ভাই সবেমাত্র অফিসে ঢুকেছে, এক অবাঙালি সহকর্মী বললো, “কাজী ভাই, যদি বাঁচতে চান তো এই মুহূর্তে এখান থেকে পালান, কোন প্রশ্ন করবেন না।” ওদুদ ভাই দৌড়ে ঘর থেকে বের হলো। অফিসের সামনে অনেকটা জায়গা বাঁধানো খোলা চত্বর, তারপরেই খাদ। সে মাঝামাঝি গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে গাড়ি ভর্তিআর্মি ঝুপ ঝুপ করে নেমে অফিসের ভিতর ঢুকলো। সে খাদের কাছে গিয়ে আবার ঘাড় ফিরিয়েদেখে, আর্মিরা ছাদে উঠে ফটাফট গোলাগুলি করা শুরু করেছে। একটা গুলি তার কানের পাশ দিয়ে যেতেই সে লাফ দিয়ে খাদের মধ্যে পড়লো। উঠে দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছে না, হামাগুড়ি দিয়ে সরে যেতে লাগলো। চারিদিকে ঝোপঝাড়। তার ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। সর্বত্র আর্মির ছড়াছড়ি। দাঁড়াবে কোথায় ? ক্রমে সে গ্রামের ভিতর ঢুকে গেলো। সন্ধ্যার পর এক লোকের গোয়াল ঘরে ঢুকে খড়ের গাদায় শুয়ে পড়লো, সকালে উঠে আবার দৌড় ! এয়ারপোর্ট আমাদের বাড়ি থেকে৪/৫ মাইল দূরে। স্বাভাবিক সময়ে হেঁটে বাড়ি আসতে বেশি সময় লাগার কথা না।কিন্তু এখনতো স্বাভাবিক সময় না।সে কখনো ঝোপের আড়ালে চুপকরে শুয়ে থেকে, কখনো হামাগুড়ি দিয়ে, কখনো দৌড়ে দুইদিন পর সন্ধ্যারদিকে বাড়ি পোঁছায়। পর দিন সকালে সবাই গোসলকরে উঠোনের তারে কাপড় শুকাতে দিয়েছে। নাস্তা খাওয়া শেষ। চারিদিক অসম্ভব থমথমে পরিবেশ। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দে সবাই সচকিত হয়ে দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধকরে দেয়। কিছুক্ষণ পরেই একদল আর্মি গুলি করতে করতে বাড়ির মধ্যে ঢোকে এবং দরজায় থাবা দিয়ে সবাইকে ঘর থেকে বের হতে বলে। এখানে বাড়ির লোকদের একটা বোকামি হয়েছিলো। উঠোনের তারে যে ভিজা কাপড় মেলে দেওয়া আছে তাকেউ খেয়াল করে নাই। কাপড়গুলো না থাকলে হয়তো খালি বাড়ি ভেবে আর্মিরা বাড়িতে ঢুকতো না। ওদুদ ভাই,ওর বউ, বাচ্চারা ভয়ে লুকানোর জায়গা খোঁজে, কেউ বড় মটকার মধ্যে নামার চেষ্টা করে,কেউ খাটের তলে ঢুকতে যায়।বড়ভাই বললেন, এসব করে লাভ নেই, ওরা যদি দরজা ভেঙ্গে ঢোকে তাহলে কাউকে জ্যান্ত রাখবে না। কি আর করা! সবাই বের হয়ে এলেন। তাদেরকে বারান্দায় লাইনধরে দাঁড় করানো হলো। আমার শ্বশুর এমনিতেই দৈনিক ৯ ওয়াক্তের নামাজ পড়তেন। পাঁচ ওয়াক্ত বাদেও চাশত, ইশরাক, আওয়াবীন আর গভীর রাতে তাহাজ্জদ। এছাড়া প্রায় সব সময় তাঁর হাতে তসবিহ থাকতো। যাহোক, বুক পর্যন্ত সাদা দাড়ি,লম্বা পায়জামা পরে তিনি দাঁড়ালেন। সবাইকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে কয়েকজন আর্মির মধ্যে থেকে একজন জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা বাঙালি নাকি বিহারী ?” হিন্দু নাকি মুসলিম –তা জিজ্ঞাসা করে নাই। কাজেই বড়ভাই বললেন, “বাঙালি!” “স্যুট কর দো!” বলে হুকুম দিলো একজন অফিসার। এক সৈন্য মেশিনগান তাক করেছে, গুলি করবে। সেই সময় এক বেলুচি অফিসার মেশিনগানের মাথা নিচু করে দিয়ে বললো, “ ছোড়দো, বাল, বাচ্চা, বুড্ডা!” সঙ্গের অফিসার-খুব সম্ভব পাঞ্জাবি—সে বললো, “ মেজর সাবের হুকুম, বাঙালি হলেই স্যুট করে দিতে, স্যুট কর দো!” আবার মেশিনগানধারী অস্ত্র উঁচু করেছে, “আরে ইয়ার, ছোড়দো। বাল-বাচ্চা-বুড্ডা!” বলে বেলুচিটা বাধা দেয়। তারপর তারা মেশিনগানধারী সহ সরে গিয়ে এদিক ওদিক কিছুক্ষণ গোলাগুলি ফাটালো এবং ঐ ভাবে গুলি করতে করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেলো। শ্বশুর বললেন, “আর তো এখানে থাকা যায় না। চলো, গ্রামের দিকেই যাই।” শুধুমাত্র গহনার পোটলা আর রেডিওটা সঙ্গে নিয়ে আলমারি আর ঘরে তালা দিয়ে সবাই বাড়ি থেকে বের হলেন। পাশের ঘরে বিহারী যে পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিলো, তারা কিন্তু ঘর থেকে একবারও বের হয়নি। খুলনা রোড ধরে সবাই হাঁটছেন কিছুক্ষণ পরপরই খুলনা থেকে লরী ভর্তি করে সশস্ত্র সৈন্য যশোরের দিকে আসছে, গাড়ির শব্দ কানে যেতেই সবাই হুড়মুড় করে রাস্তা ছেড়ে পাশের খাদে নেমে ঝোপঝাড়ের আড়ালে উপুড় হয়ে বসছেন, আবার গাড়ি চোখের আড়াল হলেই সবাই রাস্তায় উঠে আসছেন। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর মধ্যে কাজী মারুফা (আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছে)সামান্য বড়, তার ছোট মাহমুদ আর সবচেয়ে ছোট মালা মায়ের কোলে। কিছুদূর যাওয়ার পর শ্বশুর ৮০ বছরের বৃদ্ধ, তাঁর পায়ে বাতের ব্যথা! তিনি রাস্তার মধ্যে বসে পড়লেন। বললেন, “বাবারা, তোমরা যাও, আমি এমনিতেই বুড়ো মানুষ –মরার সময় হয়েছে, আমি এখানেই থাকি! আমার জন্য চিন্তা করোনা, তোমরা প্রাণ বাঁচাও!” বলেনকি!তাই কখনো হয়! শেষে দুই ছেলে চার হাতএকত্র করে পাল্কির মতো বানিয়ে তার উপর বাপকে বসিয়ে হাঁটতে থাকে। এরপর গ্রামের পথে ঢুকলে এক ছাত্রের সাথে দেখা হয়, সে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়।পরদিন ফুপুর বাড়ি মুজগুন্নি যান এবং মেহেরপুরে চাচাশ্বশুরকে খবর পাঠান। চাচাশ্বশুর পরদিন গরুর গাড়ি পাঠিয়ে সবাইকে মেহেরপুর নিয়ে যান। এটা কুষ্টিয়ার মেহেরপুর না, যশোরের কেশবপুর থানার মেহেরপুর গ্রাম, এমনই গ্রাম, যেখানে এই একবিংশ শতাব্দীতেও এখনো বিদ্যুৎ যায় নি !
(চলবে)
খুব উৎসাহের এবং অবশ্যই উৎকণ্ঠার সঙ্গে সৈয়দা মকসুদা হালিমের "আমার মুক্তিযুদ্ধ" পড়ে চলেছি। চে গুয়েভারা ও কিউবা আন্দোলনের কথা অনেকদিন আগে পড়েছিলাম, তখনও শিহরিত হয়েছিলাম, কিন্তু, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আপনাদের অভিজ্ঞতা ও বর্ণণা যেন শরীর ও মন দিয়ে শেয়ার করে নিতে পারছি...এদেশে বসেও ঐ সময়ে কিন্তু আমরা বাংলাদেশের দুই ধরণের মানুষেরই সংস্পর্শে এসেছিলাম, তখনও দেখেছি, ঢাকা থেকে চলে আসা বেশ কিছু লোক ঐ আন্দোলনকে বাঁকা চোখে দেখছে ।
উত্তরমুছুন