স্মৃতিচারণঃ
দাদু
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য
আজকাল, ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ে । কি নিশ্চিন্ত জীবন ছিল, আগে ।
আমি মামাবাড়ী কোলকাতার বাঘাযতীন কলোনীতে থেকে বিজয়গড় শিক্ষানিকেতনে পড়তাম । মা- বাবা, ওডিশার পারলাখেমুণ্ডিতে । বাবা দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন সেখানকার কলেজে । দেশভাগের আগে দাদু, ওপার বাংলার রাজশাহীর বেলদারপাড়ায় ডাক্তার ছিলেন । এল.এম. এফ পাশ দেওয়া, কারমাইকেল কলেজ থেকে ( এখন এন.আর.এস) । দাদু এপারে চলে এলে, সেই পশার সেভাবে প্রথম দিকে না পেলেও পরে বেড়েছিল, তাঁর চিকিৎসার গুণে । পশার না থাকাতে রেগে গিয়ে বলতেন- আমি লম্ফ ডাক্তার, কে পোঁছে আমাকে ?
বড়মামা, রোজ এক প্যাকেট সিগারেট দিতেন । ওটাই বরাদ্দ ছিল দাদুর দিনভর । সাথে ওপার থেকে আনা এক সিগারেট হোল্ডার । একটা ষ্টিলের ছোট বাক্সে, সিগারেটগুলো ব্লেড দিয়ে আর্ধেক করে রেখে দিতেন, দুটো ছাড়া । ওই দুটো খেতেন, দু’বেলা ভাত খাওয়ার পর ।
কাজ না থাকায় দাদু – রোজই দিদিমার ওপর খবরদারি করতেন । বসে থাকতেন, ডাল, তরকারীতে লবণ/নুন হয়েছে কিনা চাখতে । সেদিন একবার হাঁসের ডিমের কষা করেছে দিদিমা । সেদ্ধ করে নিয়ে, সুতো দিয়ে ভাগ করা দুটো টুকরো যেন একেবারে ডুগি তবলা । স্কুল ফেরত, খাবো এসে আরাম করে । সারাদিন ভালো করে ক্লাসের পড়াই শুনতে পেলাম না ।
সব সময় ডিমের কুসুমের চকচকে হলুদ গন্ধ নাকে যেন ভেসে আসছিল । স্কুল ছুটি হতেই খিদে ভরা পেটে বাড়ী ফিরে দেখি দাদু গৃহত্যাগ করে বাণপ্রস্থে যাবেন। বাড়ীতে আর কেউ নেই । আমি সেই মাত্র এসে পৌঁছলাম ।
দিদিমা, কান্নাভেজা গলায় বলল :- দ্যাখ্, আমি খালি বলেছি, আর কোনো কাজ নেই তোমার ? দিনরাত ট্যাঁকট্যাঁক করো !!!!! সারাদিন না খেয়ে বসে আছে লোকটা ।
আমি গিয়ে দাদুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম- খেয়ে নিন দাদু ( তখন আমরা “আপনি” বলতাম ) । খেলে সারা পিঠ একশো বার চুলকে দেবো ।
সত্যি ?
তিন সত্যি !
চল্, আমরা একসঙ্গে খাই
পিঁড়ি পেতে বসলাম খেতে । দাদু বলল :- ওগো বুজলে? জীবনে অনেক ডিম খেয়েছি, আমার ভাগের হাফ ডিমটা নাতিকে দাও ।
গরমের ছুটিতে কোলকাতা থেকে ওডিশার পারলাখেমুণ্ডি যেতাম । পৌঁছনোর পর থেকেই, মায়ের জুলুম- এটা খা, ওটা খা ।
হাঁটুর কাছে একটা বিশাল কার্বাঙ্কল হয়েছিল । যত্ন করে, ড্রেস করে দিতেন বাবা।
ব্যাথা তখনই সেরে যেত অর্দ্ধেক ।
আমি জ্বরের ঘোরে ভাতের স্বপ্ন দেখে প্রলাপ বকতাম । ঘুম ভাঙলে, মায়ের চোখে জল । জ্বর হলে, মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিত । বাবা আনতেন কচি ডাব । ভাত খাওয়া বারণ ছিল তখনকার দিনে জ্বরের সময় ।
আতপ চাল ছাড়া কিছু পাওয়া যেতনা তখন পারলাখেমুণ্ডিতে । দিদিমা, সের তিনেক সেদ্ধ চাল দিয়ে দিতেন আমার সাথে । রোজ করলে, তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে বলে, সপ্তাহে একদিন সেই সেদ্ধ চালের ভাত হত।
বাবা একদিন হাসি মুখ করে বাড়ী ফিরলেন । বিশাল একটা ব্যাগ নিয়ে পেছনে একজন । বাসের ড্রাইভারকে বলে রেখেছিলেন বাবা । ব্রহ্মপুর ( গঞ্জাম) থেকে বাবা আনিয়েছেন। বাবা নিরামিষাশী ছিলেন । পেঁয়াজ, রসুনও খেতেন না । মায়ের রান্নার গুণে বুঝতেই পারতাম না, সেগুলোর অভাব ।
আজকাল দুপুরে প্রায়ই স্বপ্ন দেখি- মা, হলুদের দাগ লাগে শাড়ী পরে আমায় বলছে:-
তোর জন্য আজ সেদ্ধ চালের ভাত করেছি...
বাবা বলতেন – দিবাস্বপ্ন নিস্ফলা !!!
হায় রে, দেশভাগ !!!!
মর্মস্পর্শী লেখাটি পড়ে নস্ট্যালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম।
উত্তরমুছুনএই ধরনের সরস স্মৃতিকথার বৈশিষ্ট্য হল,তা শুধু কথককেই স্মৃতি-মেদুরতায় আচ্ছন্ন করে না,পাঠকের মনেও এক ভালোলাগার বোধ ছড়ায়,কেমন এক একাত্মতা-বোধের জন্ম দেয়।
এ ক্ষেত্রেও সেই অনুভব জাগল । তাই স্মৃতিকথার পরবর্তী পর্বগুলির আশায় রইলাম।
Khub bhalo laglo. Dhanyobad. Kichhu byapar ektu songshodhon korle bhalo hoy. 1. Chhobi ti Steve Jobs er moto lagchhe. 2. Ramkrishna Acharya bodhoy Ramkrishna Bhattacharya hobe. 3. " হলুদের দাগ লাগে শাড়ী " ekhane bodh hoy dag "LAGA" shari hobe ... Egulo chhoto khato byapar. Abar bolchhi khub bhalo laglo :D
উত্তরমুছুনঅনবদ্য লেখা।
উত্তরমুছুনমুগ্ধ হলাম।
এরকম আরো লিখুন না?
উত্তরমুছুনএরকম আরো লিখুন না?
উত্তরমুছুন