মুখোমুখিঃ ওয়াসিম রিয়াজ কাপুর






মুখোমুখিঃ

চিত্রশিল্পী ওয়াসিম রিয়াজ কাপুর


চিলেকোঠা জলসাঘরের ব্যবস্থাপনায় গত সরস্বতী বন্দনায় আমরা সম্বর্ধনা দিয়েছিলাম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ওয়াসিম রিয়াজ কাপুর মহাশয়কে। চিলেকোঠার তরফ থেকে তাঁর সাথে আলাপচারিতায় কিছুক্ষণ।

চিলেকোঠা-- ওয়াসিম, চিলেকোঠায় আপনাকে স্বাগতঃ । আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে আমরা সবাই গর্বিত।

ওয়াসিম-- আপনাদের চিলেকোঠার এই সুন্দর পরিবেশ আমারও খুব ভালো লাগছে। আপনাদের কথা আমি আগেই শুনেছিলাম অলোকের মুখে। আর তাই আপনাদের সাথে আলাপ করতে আমারও খুব আগ্রহ ছিল।

চিলেকোঠা-- যেহেতু আপনি একজন চিত্রশিল্পী, তাই আপনার ছবি আঁকা নিয়েই কিছু কথা বলতে চাই।

ওয়াসিম-- বলুন। 

চিলেকোঠা-- শুনেছি আপনি নাকি রাত্রে ছবি আঁকেন ? রাতের পর রাত এইভাবে ছবি আঁকতে কোন অসুবিধা হয়না।

ওয়াসিম-- হাঁ, ঠিকই শুনেছেন। আমার ছবি আঁকার সময়টাই হল রাত বারোটা থেকে ভোর চারটে। বিষয়বস্তু ভাবনা চলে সারাদিন ধরেই। কিছু কিছু খাতায় স্কেচ করে রাখি। কিন্তু তার আসল প্রকাশ ঘটে ক্যানভাসে, সেটা রাত্রে। তখন কোলাহল মুক্ত পৃথিবী আমার চিন্তাধারায় কোন ব্যাঘাত ঘটায় না। আর তারপর তো বেলা এগারটা পর্যন্ত ঘুম...। হা...হা...হা...। আর এখন তো অভ্যাস হয়ে গেছে।

চিলেকোঠা-- আপনি কি ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতেন ?

ওয়াসিম-- আমার ছেলেবেলা আর দশজন বাচ্ছার মত কাটেনি। আমি আমার ছ’মাস বয়সে খাট থেকে পড়ে যাই। আর তারপর জীবনের প্রথম বারোটা বছর কেটেছে বিছানায় প্লাস্টার বাঁধা অবস্থায় হাসপাতাল আর বাড়িতে। দুবার অপারেশনও হয়েছে। ডাক্তার আরও একবার অপারেশন করার কথা বলেছিল, করাইনি। বাড়িতেই শুয়ে থাকতাম বিছানায়। আর জানলা দিয়ে দেখতাম, লোকজন, গাড়িঘোড়া। আর ইচ্ছা করতো খাতার পাতায় ওইসব ধরে রাখতে। তাই আমার বাবার কাছে আবদার করেছিলাম ছবি আঁকব বলে। বাবা আমায় কাগজ, পেন্সিল, রবার আর ক্রেয়ন রঙ এনে দিয়েছিলেন। আমি শুয়ে শুয়ে ছবি আঁকতাম। 

চিলেকোঠা-- শুয়ে কেন ?

ওয়াসিম-- আহা, আগেই তো বলেছি, আমার অসুস্থতার কারণে বেশীরভাগ সময়ই আমার পায়ে প্লাস্টার থাকতো। 
যাই হোক, সেইসময় আমার আঁকার প্রতি আগ্রহ দেখে আমার বাবা অমর নন্দন নামে একজনকে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করলেন। তিনিই হলেন আমার প্রথম শিল্পগুরু। আমি জীবনে বহু বিখ্যাত শিল্পীর সান্নিধ্যে এসেছি। তাঁদের কাছে শিক্ষালাভ করেছি। যেমন, দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী, অতুল বসু, যামিনী রায়, হুসেন, পরিতোষ সেন, বিকাশ রায়, গোপাল সান্যাল, চিত্ত দাস, আরও অনেক অনেক। কিন্তু অমর নন্দন স্যার-এর সান্নিধ্য ভোলার নয়।

চিলেকোঠা-- তারপর...

ওয়াসিম-- তারপর আর কি... মাষ্টারমশাই অমর নন্দের সহযোগিতায় আমি পনের বছর বয়সে ভর্তি হলাম আর্ট কলেজে। সেই প্রথম আমার বাইরের জগতের সাথে সরাসরি যোগাযোগ। বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম প্রথম দিন। এক অপরিচিত পরিবেশ, কত ছেলেমেয়ে, কোলাহল। আমার দাদা শামীম আমাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। আমার দু-বগলে ক্রাচ। তার সাথেই ধরা ছিল একটা ছোট্ট চামড়ার বাক্স ভর্তি রঙ। ক্লাসের মধ্যে ঢুকতে ভয় পাচ্ছিলাম। অলোকই প্রথম আমার হাত ধরে আমাকে তার পাশে বসায়। সেই থেকে এখনও আমরা একসাথে। আমার অসুস্থতার জন্য অলোক আমায় প্রতিদিন কলেজ ছুটির পর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যেত। তার জন্যে অনেক বিরূপ মন্তব্যও ওকে শুনতে হয়েছে। আমিও ওর উপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বাবা-মাও নিশ্চিন্তে থাকতেন অলোক সাথে থাকলে। ও এখন আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গেছে।

চিলেকোঠা-- আপনি প্রথম কবে ছবির প্রদর্শনী করেছেন ? আর এখনও কি ছবির প্রদর্শনী করে চলেছেন। তার সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই।

ওয়াসিম-- আমার আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শন বললে বলতে পারি আমার কলেজের প্রথম বছরের বার্ষিক প্রদর্শনী। সেইখানেই আমার ছবি প্রথম সর্বসমক্ষে আসে। তারপর প্রতি বছরই আমি সেই প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছি। কলেজ থেকে পাশ করার পর কোলকাতার বিভিন্ন আর্ট গ্যালারীতে আমি প্রদর্শনী করেছি, কখনও একা, আবার কখনও কয়েকজন বন্ধু মিলে। তারপর ভারতের প্রতিটা বড় শহরেই আমার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। তাছাড়া পৃথিবীর বহুদেশে আমার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে বা এখনও হয়ে চলেছে।

চিলেকোঠা-- ব্যক্তিগত স্তরে বা বহু গ্যালারীতে তো শুনেছি আপনার আঁকা ছবির সংগ্রহ করা হয়েছে। এ সম্বন্ধে যদি কিছু আলোকপাত করেন।

ওয়াসিম-- হাঁ তা আছে। আন্তর্জাতিক স্তরে কিছু দেশে আমার আঁকা ছবির সংগ্রহ আছে। আর আমাদের দেশেও কোলকাতার বিধানসভায়, উর্দু এ্যাকাডেমী, দিল্লী পার্লামেন্ট হাউস, ললিতকলা এ্যাকাডেমী, মুম্বাই, চেন্নাই, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানে আমার আঁকা ছবির সংগ্রহ আছে।

চিলেকোঠা-- আপনি ব্যস্ত মানুষ, আর বেশী সময় নেব না। শুধু শেষকালে একটা কথা বলি, বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে আপনি কি কোন বার্তা রেখে যাবেন।

ওয়াসিম-- দেখুন, কিছু বলার মত জায়গায় আমি এখনও পৌঁছতে পারিনি। তার জন্যে অনেক সাধনার প্রয়োজন। তাছাড়া আমি নিজেই এখনও শিক্ষার্থী। প্রতিনিয়তই আমি কিছু না কিছু শিখে চলেছি।
তবে আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে দেখেছি, কোন শিল্পীর যেটা সব থেকে বেশী দরকার, তা হল তার মন, চোখ আর অধ্যবসায়। এই তিনের মিলন ঘটলে, সে একদিন ঠিক ভালো শিল্পী হতে পারবে। তাই বলি ভাল ভাল ছবির প্রদর্শনী দেখুন, দেখুন ওল্ড মাষ্টারদের ছবি। তাদের ভাবনা, উপস্থাপনা, রঙের ব্যবহার। আর তারপর তা প্রয়োগ করুন নিজের ভাবনার সাথে, নিজস্ব সত্ত্বার সাথে। কিন্তু কখনই নকল করবেন না। নিজের উদ্ভাবনী শক্তিকে প্রকাশ করুন। আপনার অধ্যবসায়ই আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

চিলেকোঠা-- অনেক ধন্যবাদ ওয়াসিম। ভালো লাগল চিলেকোঠাকে এতটা সময় দেবার জন্যে। ভালো থাকুন।

ওয়াসিম-- আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ। আপনারাও সবাই ভালো থাকুন, চিলেকোঠা ভালো থাকুক। নমস্কার।

চিলেকোঠা-- চিলেকোঠার সবার তরফ থেকে আপনাকেও নমস্কার জানাই।


3 মতামত:

  1. দেবাশীষ সেন, জামশেদপুর৫ মে, ২০১৪ এ ৬:১২ PM

    এমন একজন গুনী মানুষের কিছু কথা জানতে পারলাম, বিশেষ করে তাঁর শৈশবের ঐ অবস্থার বিষয়ে জানা ছিল না, কিন্তু সেই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তিনি যে তাঁর মনের জোরে আজ ভারতবর্ষের এক অন্যতম কৃতি শিল্পী হয়ে উঠেছেন, তা সত্যিই অনুপ্রেরনা যোগায়।

    উত্তরমুছুন
  2. ভালো , কিন্তু মুগ্ধ হলাম না ।

    উত্তরমুছুন
  3. আরও কিছু জানবার ইচ্ছ রয়ে গেল মনের মধ্যে । শিল্পীর শিল্পসৃষ্টির রসদ, অনুপ্রেরণা এগুলো নিয়ে আরও কিছু আলোচনা, এসব যদি পরে আবার কোনও সংখ্যায় দেখতে পাই, খুব ভালো লাগবে ।

    উত্তরমুছুন