যুবরাজ
ইন্দ্রানী ঘোষ
(অস্কার ওয়াইল্ড-এর ছোটগল্প The Young Prince অবলম্বনে)
অমাত্যরা বিদায় নিয়েছে । যুবরাজ এই মুহূর্তে একা । একটু আগে বিশাল প্রাসাদের হলঘরে চলেছে আদব কায়দার প্রশিক্ষণ । সে একটা নিঃশ্বাস ফেলল । নকশা করা কুশানে মাথা রেখে চুপ করে শুয়ে রইল সে । চোখে তাঁর হরিণ শাবকের চঞ্চলতা । এক ব্যথার ইতিহাসে জন্ম যুবরাজের । রাজার একমাত্র সন্তান রাজকুমারী ভালবেসেছিলেন এক অনামা শিল্পী কে । তার আঙ্গুলে ছিল জাদু, ঠোঁটে বাঁশির সুর । ভালোবাসার মূল্য দিয়ে সরে যেতে হল তাঁকে । রাজকুমারীকে বিষ দেওয়া হল । সেই ভালবাসার ফল আজকের কিশোর যুবরাজ । তার জন্মের পর এক বিশ্বস্ত প্রহরী তাকে নিয়ে চলে যায় অরণ্যের ওপারে মেষপালকের কুটীরে । বৃদ্ধ রাজা মৃত্যুর সময় সেই পরিত্যক্ত শিশুটিকে রাজা ঘোষণা করলেন । সেই কিশোর যুবরাজের আজ রাত পোহালে অভিষেক ।
রাত্রি যখন বারটা, গোলাপজলে স্নান করান হল তাঁকে । বালিশে ছড়ান হল গোলাপের পাপড়ি । ঘুমে ঢলে পড়ল যুবরাজ। যুবরাজ ছিলেন সৌন্দর্য -এর পূজারী । তাঁর সমস্ত মন জুড়ে ছিল অভিষেকের সোনার পোশাক, তাঁর মুকুটের রুবি এবং তলোয়ারে খচিত মুক্তো । সমস্ত মন জুড়ে ঐশ্বর্য্য থাকা সত্ত্বেও তাঁর মনের নিভৃত কোণ ছিল ফাঁকা এবং তাঁর নান্দনিক বোধ তাঁর বুদ্ধিমত্তার মতই ভালবাসত একাকী উপাসক কে, আর সেই কারণে সে ছিল বহুজনের মাঝে একা।
মাঝরাত্রির পর ঘুমিয়ে পড়ল যুবরাজ, স্বপ্ন এলো দু’চোখ জুড়ে । সে দেখল এক তাঁতির ঘর, ছোট শিশুরা তাঁত বুনছে । তাদের আদুল গা, পেটে খিদে ।
চোখে আগুন ঝরিয়ে তাঁর দিকে তাকাল এক তাঁতি । তাঁতি প্রশ্ন করল “তুমি কে? আমাদের প্রভুর চর?”
“কে তোমাদের প্রভু?” বলল যুবরাজ ।
“আমাদের প্রভু আমাদের যুবরাজ,” বলে তাঁতি । “তাঁর রাজপোশাক বুনতে আঙুলের রক্ত ঝরিয়ে শেষ হয়ে যাব আমরা । আমরা তাঁর দাস”।
ঘুম ভেঙে যায় যুবরাজের । ঝরোখার ওপারে মধুরঙের চাঁদ তখন ধূসর রাতের আকাশে জেগে রয়েছে ।
আবার ঘুমিয়ে পড়ে যুবরাজ । এবার সে দেখে নীল সমুদ্র । সমুদ্রে ভাসছে এক একাকী জাহাজ । জাহাজের ডেকে শায়িত এক আফগান শেখ । সামনে তাঁর স্ফটিক এর বয়াম । একদল ক্রীতদাস সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে ডেকে । শেখ হুকুম দিলেন আর একটি ক্রীতদাস কে ঠেলে ফেলে দেওয়া হল সমুদ্রে । কতগুলো বোবা চোখ তাকিয়ে রইল । লোকটা ভেসে উঠল এক মুঠো মুক্তো নিয়ে, আবার চলে গেল সমুদ্র গর্ভে । এবার ফিরে এলো এক বিশাল মুক্তো নিয়ে ।
“পাওয়া গেছে যুবরাজের তলোয়ার-এর মুক্তো’ - চেঁচিয়ে উঠল আফগান শেখ । চোখ দুটো লোভে চকচক করে উঠল । মুখে রক্ত তুলে জাহাজের ডেকে ঘুরে পড়ল ক্রীতদাস। মরণ তাকে আশ্রয় দিল নিজের কোলে ।
ঘুম ভাঙল যুবরাজের । ভোর তখন তার ধুসর আঙুল বিস্তার করছে মলিন হয়ে আসা তারাদের অস্তিত্বে ।
ভোরের দিকে আবার চোখ বুজে আসে যুবরাজের এবার সে দেখতে পায় এক নদীগর্ভ । কতগুলো মানুষ উপড়ে ফেলছে বড় বড় পাথরের চাঙড় । তাদের পায়ের নিচে দলে যাচ্ছে লাল ফুল শুদ্ধু ক্যাকটাস ।
এক গুহাতে বসে তাঁদের দেখছে লোভ ও মৃত্যু । মৃত্যু জিজ্ঞেস করে লোভকে - ‘তোমার কালো চাদরের নীচে কী লুকিয়ে রেখেছ?’
‘তিনটি শস্য’ - বলে লোভ ।
‘একটা শস্য আমার চাই’ - বলে মৃত্যু ‘আমার বাগানে রোপণ করব আমি’ । ‘নাআআআ আমি দেব না’, চিৎকার করে বলে লোভ ।
‘নদীগর্ভে তোমার যে দাসেরা কাজ করছে আমি তাদের সকল কে মেরে ফেলব’ - বলে মৃত্যু ।
লাল ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায় মৃত্যু সেই লোকগুলোর দিকে । মুখে আগুন ঝরিয়ে বেরিয়ে আসে ড্রাগনের দল । হিসহিসিয়ে ওঠে বিষাক্ত সাপেরা । অট্টহাস্য করে মৃত্যু ।
‘নদীগর্ভে কারা ওরা ?’ -জিজ্ঞেস করে রাজপুত্র ।
‘ওরা তোমার মুকুটের রুবি খুঁজছে’ - বলে মৃত্যু । ঘর্মাক্ত কলেবরে ঘুম ভাঙে যুবরাজের । অন্তঃপুরে তখন ভোরের আলোর বন্যা ।
মেষপালকের পরিত্যক্ত পোশাক টেনে বার করে রাজপুত্র, খুঁজে বার করে তাঁর বাঁশি । এবার সে ছুটতে শুরু করে নগরীর পথ ধরে গির্জার দিকে, যেখানে ক্রুশবিদ্ধ আছেন রাজার রাজা প্রভু যীশু ।
পাত্র মিত্র আমত্যরা হায় হায় করে ওঠে । কোথায় চলেছেন যুবরাজ এই বেশে, নগ্ন পায়ে ?
‘আমি স্বপ্ন দেখেছি’ -বলে সে ।
‘এই স্বপ্ন দেখা পাগল যুবরাজ আমাদের রাজা হতে পারে না, একে মেরে ফেলা হোক’ । তলোয়ার তুলে তারা ধাওয়া করে কিশোর যুবরাজকে ।
গির্জায় পৌঁছে প্রভু যীশুর পায়ে আছড়ে পরে যুবরাজ । এক অনির্বচনীয় আলো ঘিরে ধরে তাকে । গির্জার অর্গান আপনা হতে বেজে ওঠে । পাদ্রী বলেন ‘আজ রাজার রাজা আপনার অভিষেক করলেন, যুবরাজ আপনাকে প্রণাম জানাই’ ।
মন্ত্রীদের চোখ ভিজে ওঠে । খসে পড়ে তলোয়ার । বেদী থেকে নেমে আসে নতুন রাজা । এক সমুদ্র মানুষকে দু হাতে সরিয়ে হেঁটে চলে সে । রাজার চোখের দিকে চায় না কেউ, কারণ সেই চোখ দেবদূতের চোখ । সেই মুখে দেবদূতের জ্যোতি ।
(অস্কার ওয়াইল্ড-এর ছোটগল্প The Young Prince অবলম্বনে)
অমাত্যরা বিদায় নিয়েছে । যুবরাজ এই মুহূর্তে একা । একটু আগে বিশাল প্রাসাদের হলঘরে চলেছে আদব কায়দার প্রশিক্ষণ । সে একটা নিঃশ্বাস ফেলল । নকশা করা কুশানে মাথা রেখে চুপ করে শুয়ে রইল সে । চোখে তাঁর হরিণ শাবকের চঞ্চলতা । এক ব্যথার ইতিহাসে জন্ম যুবরাজের । রাজার একমাত্র সন্তান রাজকুমারী ভালবেসেছিলেন এক অনামা শিল্পী কে । তার আঙ্গুলে ছিল জাদু, ঠোঁটে বাঁশির সুর । ভালোবাসার মূল্য দিয়ে সরে যেতে হল তাঁকে । রাজকুমারীকে বিষ দেওয়া হল । সেই ভালবাসার ফল আজকের কিশোর যুবরাজ । তার জন্মের পর এক বিশ্বস্ত প্রহরী তাকে নিয়ে চলে যায় অরণ্যের ওপারে মেষপালকের কুটীরে । বৃদ্ধ রাজা মৃত্যুর সময় সেই পরিত্যক্ত শিশুটিকে রাজা ঘোষণা করলেন । সেই কিশোর যুবরাজের আজ রাত পোহালে অভিষেক ।
রাত্রি যখন বারটা, গোলাপজলে স্নান করান হল তাঁকে । বালিশে ছড়ান হল গোলাপের পাপড়ি । ঘুমে ঢলে পড়ল যুবরাজ। যুবরাজ ছিলেন সৌন্দর্য -এর পূজারী । তাঁর সমস্ত মন জুড়ে ছিল অভিষেকের সোনার পোশাক, তাঁর মুকুটের রুবি এবং তলোয়ারে খচিত মুক্তো । সমস্ত মন জুড়ে ঐশ্বর্য্য থাকা সত্ত্বেও তাঁর মনের নিভৃত কোণ ছিল ফাঁকা এবং তাঁর নান্দনিক বোধ তাঁর বুদ্ধিমত্তার মতই ভালবাসত একাকী উপাসক কে, আর সেই কারণে সে ছিল বহুজনের মাঝে একা।
মাঝরাত্রির পর ঘুমিয়ে পড়ল যুবরাজ, স্বপ্ন এলো দু’চোখ জুড়ে । সে দেখল এক তাঁতির ঘর, ছোট শিশুরা তাঁত বুনছে । তাদের আদুল গা, পেটে খিদে ।
চোখে আগুন ঝরিয়ে তাঁর দিকে তাকাল এক তাঁতি । তাঁতি প্রশ্ন করল “তুমি কে? আমাদের প্রভুর চর?”
“কে তোমাদের প্রভু?” বলল যুবরাজ ।
“আমাদের প্রভু আমাদের যুবরাজ,” বলে তাঁতি । “তাঁর রাজপোশাক বুনতে আঙুলের রক্ত ঝরিয়ে শেষ হয়ে যাব আমরা । আমরা তাঁর দাস”।
ঘুম ভেঙে যায় যুবরাজের । ঝরোখার ওপারে মধুরঙের চাঁদ তখন ধূসর রাতের আকাশে জেগে রয়েছে ।
আবার ঘুমিয়ে পড়ে যুবরাজ । এবার সে দেখে নীল সমুদ্র । সমুদ্রে ভাসছে এক একাকী জাহাজ । জাহাজের ডেকে শায়িত এক আফগান শেখ । সামনে তাঁর স্ফটিক এর বয়াম । একদল ক্রীতদাস সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে ডেকে । শেখ হুকুম দিলেন আর একটি ক্রীতদাস কে ঠেলে ফেলে দেওয়া হল সমুদ্রে । কতগুলো বোবা চোখ তাকিয়ে রইল । লোকটা ভেসে উঠল এক মুঠো মুক্তো নিয়ে, আবার চলে গেল সমুদ্র গর্ভে । এবার ফিরে এলো এক বিশাল মুক্তো নিয়ে ।
“পাওয়া গেছে যুবরাজের তলোয়ার-এর মুক্তো’ - চেঁচিয়ে উঠল আফগান শেখ । চোখ দুটো লোভে চকচক করে উঠল । মুখে রক্ত তুলে জাহাজের ডেকে ঘুরে পড়ল ক্রীতদাস। মরণ তাকে আশ্রয় দিল নিজের কোলে ।
ঘুম ভাঙল যুবরাজের । ভোর তখন তার ধুসর আঙুল বিস্তার করছে মলিন হয়ে আসা তারাদের অস্তিত্বে ।
ভোরের দিকে আবার চোখ বুজে আসে যুবরাজের এবার সে দেখতে পায় এক নদীগর্ভ । কতগুলো মানুষ উপড়ে ফেলছে বড় বড় পাথরের চাঙড় । তাদের পায়ের নিচে দলে যাচ্ছে লাল ফুল শুদ্ধু ক্যাকটাস ।
এক গুহাতে বসে তাঁদের দেখছে লোভ ও মৃত্যু । মৃত্যু জিজ্ঞেস করে লোভকে - ‘তোমার কালো চাদরের নীচে কী লুকিয়ে রেখেছ?’
‘তিনটি শস্য’ - বলে লোভ ।
‘একটা শস্য আমার চাই’ - বলে মৃত্যু ‘আমার বাগানে রোপণ করব আমি’ । ‘নাআআআ আমি দেব না’, চিৎকার করে বলে লোভ ।
‘নদীগর্ভে তোমার যে দাসেরা কাজ করছে আমি তাদের সকল কে মেরে ফেলব’ - বলে মৃত্যু ।
লাল ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায় মৃত্যু সেই লোকগুলোর দিকে । মুখে আগুন ঝরিয়ে বেরিয়ে আসে ড্রাগনের দল । হিসহিসিয়ে ওঠে বিষাক্ত সাপেরা । অট্টহাস্য করে মৃত্যু ।
‘নদীগর্ভে কারা ওরা ?’ -জিজ্ঞেস করে রাজপুত্র ।
‘ওরা তোমার মুকুটের রুবি খুঁজছে’ - বলে মৃত্যু । ঘর্মাক্ত কলেবরে ঘুম ভাঙে যুবরাজের । অন্তঃপুরে তখন ভোরের আলোর বন্যা ।
মেষপালকের পরিত্যক্ত পোশাক টেনে বার করে রাজপুত্র, খুঁজে বার করে তাঁর বাঁশি । এবার সে ছুটতে শুরু করে নগরীর পথ ধরে গির্জার দিকে, যেখানে ক্রুশবিদ্ধ আছেন রাজার রাজা প্রভু যীশু ।
পাত্র মিত্র আমত্যরা হায় হায় করে ওঠে । কোথায় চলেছেন যুবরাজ এই বেশে, নগ্ন পায়ে ?
‘আমি স্বপ্ন দেখেছি’ -বলে সে ।
‘এই স্বপ্ন দেখা পাগল যুবরাজ আমাদের রাজা হতে পারে না, একে মেরে ফেলা হোক’ । তলোয়ার তুলে তারা ধাওয়া করে কিশোর যুবরাজকে ।
গির্জায় পৌঁছে প্রভু যীশুর পায়ে আছড়ে পরে যুবরাজ । এক অনির্বচনীয় আলো ঘিরে ধরে তাকে । গির্জার অর্গান আপনা হতে বেজে ওঠে । পাদ্রী বলেন ‘আজ রাজার রাজা আপনার অভিষেক করলেন, যুবরাজ আপনাকে প্রণাম জানাই’ ।
মন্ত্রীদের চোখ ভিজে ওঠে । খসে পড়ে তলোয়ার । বেদী থেকে নেমে আসে নতুন রাজা । এক সমুদ্র মানুষকে দু হাতে সরিয়ে হেঁটে চলে সে । রাজার চোখের দিকে চায় না কেউ, কারণ সেই চোখ দেবদূতের চোখ । সেই মুখে দেবদূতের জ্যোতি ।
Asadhran
উত্তরমুছুনAsadharan
মুছুন