সুস্মিতা বসু
নারী তুমি ধর্ষিতা-সে কবে থেকে কে জানে !! দামিনীর আর্তচিৎকার তো সভ্যতার আদি প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে, একটু কান পাতলেই শোনা যায়......
পুরাণ মতে মহারাজ দুষ্মন্ত ও আশ্রমকন্যা শকুন্তলার পুত্র ভরত-ই ভারতবর্ষের আদি রাজা এবং ভারতবাসীরা তাঁরই বংশধর । সেই সুত্রে মহাভারতকে যদি ভারতবর্ষের জন্মের আদিবৃত্তান্ত হিসাবে ধরে নিই, তবে তো বলতে হয়, গোড়াতেই গলদ । সে ইতিহাসের দায় কোনোভাবেই এড়ানো সম্বব নয় ।
মূল কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে মহাভারাতের উপকাহিনীগুলি ঘাঁটলে দেখা যায় সেখানে নারীর প্রতি অসংখ্য পীড়ণ, অত্যাচার, দমন, পরাজিতকরণ – এক কথায় ধর্ষন; শারিরীক ও মানাসিক ।।
এইরূপ অসংখ্য ধর্ষনের মধ্যে অন্তত দুইটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মূল কাহিনীর অন্তর্গত এই দুইটি ঘটনা না ঘটলে ভারতবর্ষের ইতিহাস হয়ত অন্যরকম হতো । সেই ঘটনা দুটিই বর্তমান আলোচনার উপজীব্য।
***
প্রথম ঘটনাটির ঘটনাকাল মহারাজ বিচিত্রবীর্যের অকাল প্রয়ানের ঠিক পরবর্তী সময় । বিচিত্রবীর্যের দুই স্ত্রী, অম্বিকা ও অম্বালিকা নিঃসন্তান । বিচিত্রবীর্যের অপর ভ্রাতা, চিত্রাঙ্গদ পুর্বেই প্রয়াত; প্রথা মতে, বংশরক্ষার দায় বর্তায় বিচিত্রবীর্যের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, মহারাজ শান্তনুর প্রথম পুত্র দেবব্রত-ভীষ্মের ওপর । কিন্তু তিনি যে পিতার কাছে আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের ভীষণ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ !!
এদিকে মাতা সত্যবতী চিন্তিতা । মহারাজ শান্তনুর বংশ লোপ পেতে চলেছে । কোনও উপায় না দেখে তিনি প্রায় সমবয়সী পুত্র, ভীষ্ণের সঙ্গে পরামর্শে বসলেন। আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো, নিয়োগপ্রথা অবলম্বন করা ছাড়া আর কোনো উপায়ান্তর নেই।
এমত অবস্থায় সত্যবতীর মনে পড়লো একটিই নাম – তিনি হলেন সাগ্নিক ব্রাহ্মণ মুনিশ্রেষ্ঠ পরাশরের ঔরসে আদিমাতা সত্যবতীর গর্ভে , তাঁর কুমারী কালে জাত পুত্র, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। না, এই মিলনে কোনো বলপ্রয়োগ ছিলো না। যদিও বিবাহ বহির্ভূত, তবুও দুই পক্ষের সম্মিলিত মিলনেচ্ছাতেই জন্ম ব্যাসদেবের। বল প্রয়োগের ইতিহাস এর পরবর্তী...
সত্যবতীর একান্ত আনুরোধে ব্যসদেব রাজী হলেন পরকামে নিযুক্ত হতে। পাঠক, একটি বার ভাবুন, সেই সদ্য বিগত-ধবা দুই কিশোরী সুন্দরী অনাথবৎ রাজমহিষীদ্বয়ের কথা, ভীষ্ণ যাঁদের স্বয়ম্বর সভা থেকে অপহরণ করে আনলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের জন্য; রাজমহিষী তাঁরা, কিন্তু নিঃসন্তান! শাস্ত্রে বলে, নিঃসন্তান বিবাহিতা নারীর পরলোকে নরক প্রাপ্তিও নাকি হয় না। একদিকে অনিশ্চিত পারলৌকিক জীবনের উৎকন্ঠ উদ্বিগ্নতা, অন্যদিকে বংশরক্ষার গুরুদায়িত্ব পালনের অক্ষমতার লজ্জা ও কুণ্ঠা । এমনিতেই তাঁরা অর্ধমৃতা, তার ওপর অন্তিম আঘাতটি পড়ল এই নিয়োগপ্রথার নির্মম সিদ্ধান্তে। একটিবারও কেউ তাঁদের মতামত জানতেও চাইলেন না।
ব্যাসদেব শর্ত দিলেন; একবৎসর কঠিন ব্রতধর্ম আচার অনুষ্ঠান পালনে আত্মিক শুদ্ধিকরণ, যাতে তেজঃদীপ্ত দ্বিজশ্রেষ্ঠ ঋষিপ্রবরের ঔরস যথার্থ গর্ভাধান লাভ করে । ঋষিশ্রেষ্ঠ হয়তো বা কিছুটা সময় দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সত্যবতী রাজী হলেন না, এতোদিন অপেক্ষা করা যাবে না।
অগত্যা দিন ধার্য হল। সত্যবতী বধূদের প্রস্তুত করলেন। রাত্রির আঁধার ঘনিয়ে এলো। দেবকন্যার মত রূপবতী, দেবোপম সুখবিলাসে অভ্যস্তা, সুস্নাতা, সালঙ্কারা, সদ্য বিগত-ধবা জ্যেষ্ঠা রাজমহিষী আম্বিকা শয়নকক্ষের শয্যায় অপেক্ষমানা। দীপ্যমান প্রদীপালোকে সেখানে ব্যাস উপস্থিত হলেন। ঘন কৃষ্ণ তাঁর গায়ের রং, তপস্যার রুক্ষতায় তাঁর কনকপিঙ্গল জটাকলাপ, আগুনের ভাঁটার মতো তপোঃদীপ্ত দুই চোখ, মুখে একরাশ দাড়ি, পাঁশুটে গোঁফ, কালো মুখোগহ্বর, পরনে অজিন আবরণ, গায়ে বিকট দুর্গন্ধ।
ভয়ে, ঘৃনায়, অনীহায় রাজমহিষী চক্ষু মুদলেন। তবুও মৈথুনক্রিয়া সম্পন্ন হলো। সত্যবতী জানতে চাইলেন, ফল? বলশালী, বিদ্বান, রাজপ্রতীম, কিন্তু মাতার আচরণ হেতু অন্ধপুত্র!!
হাহাকার করলেন সত্যবতী, সতর্ক করে দিলেন অম্বালিকাকে। দৃষ্টান্ত স্মরণ করে অম্বালিকা চোখ খুলে রাখলেন ঠিকই, কিন্তু ওই বীভৎসদর্শন, অসুরপ্রতীম ঋষিপ্রবরকে দেখে ভয়ে বিবর্না হয়ে গেলেন। জন্ম হলো পান্ডু-র ।।
মহারাজ শান্তানুর বংশ রক্ষা পেল। ধর্ষণ ছাড়া এই দুই রতিক্রিয়াকে কি অন্য কোনো নাম দেওয়া যায়? পাঠক, আপনিই বিচার করুন!! মহারাজ ভরতের কালে যে বংশের সূচনা, মহারাজ শান্তনুর পরবর্তীতে যে বংশ লোপ পেতে বসেছিলো, সেই বংশের ধারায় আবার প্রানপ্রবাহ প্রতিষ্ঠিত হলো দুটি ধর্ষনের ফলে, পুরাণমতে যে বংশপ্রবাহ আজও বর্তমান।
হায় ভারতবাসী, হায় মহারাজ ভরতের বংশধর, যে মায়ের ধর্ষনে আজ তুমি প্রতিবাদে সোচ্চার, যে জ্যেষ্ঠা-কনিষ্ঠা ভগিনীর আর্তচিৎকারে তোমার কর্নপটহ বিদীর্ণ, তাকে তুমি উপেক্ষা করবে কি করে !! তোমার নিজের জন্মের ইতিহাসও যে কালিমালিপ্ত !!! এ দায় আজ তোমায় নিতেই হবে ।।
***
দ্বিতীয় ঘটনাটির ঘটনাকাল ঠিক এক প্রজন্ম পরে, স্থান মহারাজ কুন্তিভোজের রাজঅন্তঃপুর, দর্পিত পুরুষের লালসার শিকার রাজা কুন্তিভোজের পালিতা কন্যা পৃথা-কুন্তী; জন্মসূত্রে যিনি যাদব, মহারাজ শূরের প্রথম কন্যা, মহামতী বাসুদেবের ভগিনী, সেই সূত্রে কৃষ্ণের পিতৃস্বসা।
রাজা কুন্তিভোজের প্রাসাদে আতিথ্য গ্রহণ করলেন প্রখরস্বভাবা মুনি দূর্বাসা। উগ্রস্বভাব, হঠাৎক্রোধী, আভিশাপপ্রবণ এই মুনির আতিথেয়তার গুরু দায়িত্ব পড়ল পালিতা কন্যা পৃথার উপর। রাজা কন্যাকে সতর্ক করলেন ঃ কন্যার কোমল অথচ কর্তব্যনিষ্ঠ স্বভাবের কথা বলার পরে তিনি কুন্তীর জন্ম পরিচয় উল্লেখ করে তাঁকে অনেক প্রসংশা করলেন। কিন্তু অবশেষে উল্লেখ করতে ভুললেন না, শূরনন্দিনী পৃথার হাতেই এখন রাজা কুন্তিভোজের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব। এ যেন পিতার সতর্কীকরণ নয়, রাজার আদেশ ।।
রাজাজ্ঞা পালিত হল অক্ষরে অক্ষরে। দুর্বাসা সন্তুষ্ট হলেন। অলোকসামান্যা রূপবতী কুমারী কুন্তীকে ইচ্ছামত দেব-সঙ্গমের মন্ত্র বর দিলেন মুনিশ্রেষ্ঠ।
বিপত্তির সূত্রপাত এখানেই। দুর্বাসা দেব-সঙ্গমের রহস্যমন্ত্র সদ্য যৌবনবতী কুন্তীকে শিখিয়ে দিয়ে চলে যেতেই কুন্তীর কুমারী হৃদয়ের অজ্ঞতা, চঞ্চলতা ও কৌতুহলপ্রিয়তা তাঁকে অস্থির করে তুলল। তিনি কিছুতেই সম্বরণ করতে পারলেন না মন্ত্রের বলাবল পরোখ করার প্রবল বাসনা...............
বালখিল্য চপলতায়, একদিন প্রত্যুষে রাজঅন্তঃপুরের পুষ্প শয্যায় শায়িতা পুষ্পবতী কুন্তী নবোদিত কোমল কিরণময় সূর্যকে আহ্বান করলেন মন্ত্রবলে। মুহূর্তে মূর্তমান হলেন আদিত্যদেব। নম্র সম্ভাষণে কুন্তীর আনুগত্য স্বীকার করলেন, মন্ত্রের শর্ত অনুযায়ী। কিন্তু এই অনুগতভাব বেশীক্ষণ রইল না, যখন কুন্তী তাঁকে ফিরে যেতে বললেন।
দেবপুরুষ হাতের কাছে কৃশকটি, অলসগমন, মধুর হাস্যময়ী, সদ্য যৌবনবতী, সুন্দরী কুন্তীকে পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। কুন্তীর শত কাকুতিমিনতী উপেক্ষা করে এক দীর্ঘ বচসার পর নিজেকে আর দমিত রাখতে পারলেন না। স্পষ্টতই তিনি কুন্তীকে লোকলজ্জা ও অভিশাপ প্রদানের ভয় দেখিয়ে কুন্তীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গমে প্রবৃত্ত হলেন, স্পর্শ করলেন কুন্তীর নাভিদেশ।।
পুরুষের ধর্ষণ মুখরতায় যৌবন শোভার আধার কুন্তী মহাবিষ্টা লতার মত সংজ্ঞা হারিয়ছেন । আর দুর্ধর্ষ সূর্য সঙ্গম সম্পন্ন করে অচৈতন্য কুন্তীকে ফেলে রেখে চলে গেছেন। জন্ম হয়েছে কর্ণের।।
স্বাভাব অভিমানী, অসম্ভব উচ্চাকাঙ্খী ও প্রতিশোধস্পৃহ কর্ণ নিজের স্বার্থে অন্ধ পিতৃস্নেহে ক্রমাগত দুর্বিনীত ও দুর্দান্ত হয়ে ওঠা, অহংকারী অথচ কিছুটা মূর্খ ও সুক্ষতাহীন দুর্যোধনকে ব্যবহার করেছেন। মহাভারতের সুবিশাল ভারতযুদ্ধ, যা পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের ইতিহাসকে অন্য এক রূপ দিয়েছে, তা ত্বরান্বিত ও সংঘটিত করার পেছনে কর্ণের বিশেষ অবদান আছে, এ কথা বলাই বাহুল্য।
মহাভারতের সুপ্রসারিত পরিসরে এইরূপ ঘটনা আরো আছে, কিন্তু এই দুইটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য, কারণ এই দুই ঘটনাই কাহিনীর গতিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রন করেছে, ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে বিশেষভাবে। যে কাহিনী দুটির অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে ধর্ষনের মতো এক মর্মান্তিক ঘটনা, ভারতবর্ষের ইতিহাসকে তা নিয়ন্ত্রিত করেছে, ভাবতেই বেদনার্ত হয় মন।
আলোচনার শুরুতেই যে বিষয়ভাব অনুষঙ্গের প্রস্তাবনা, তার যথার্থ মূল্যায়ন করা গেল কিনা জানিনা, তবুও পাঠকের চিত্তবৃত্তিতে যদি কিছুমাত্র আবেদন রেখে থাকে প্রবন্ধটি, তবে লেখিকার প্রয়াস সার্থকতা লাভ করবে, এ কথা অনস্বীকার্য।।
অনুপ্রেরনা ও কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ-
নারী তুমি ধর্ষিতা-সে কবে থেকে কে জানে !! দামিনীর আর্তচিৎকার তো সভ্যতার আদি প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে, একটু কান পাতলেই শোনা যায়......
পুরাণ মতে মহারাজ দুষ্মন্ত ও আশ্রমকন্যা শকুন্তলার পুত্র ভরত-ই ভারতবর্ষের আদি রাজা এবং ভারতবাসীরা তাঁরই বংশধর । সেই সুত্রে মহাভারতকে যদি ভারতবর্ষের জন্মের আদিবৃত্তান্ত হিসাবে ধরে নিই, তবে তো বলতে হয়, গোড়াতেই গলদ । সে ইতিহাসের দায় কোনোভাবেই এড়ানো সম্বব নয় ।
মূল কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে মহাভারাতের উপকাহিনীগুলি ঘাঁটলে দেখা যায় সেখানে নারীর প্রতি অসংখ্য পীড়ণ, অত্যাচার, দমন, পরাজিতকরণ – এক কথায় ধর্ষন; শারিরীক ও মানাসিক ।।
এইরূপ অসংখ্য ধর্ষনের মধ্যে অন্তত দুইটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মূল কাহিনীর অন্তর্গত এই দুইটি ঘটনা না ঘটলে ভারতবর্ষের ইতিহাস হয়ত অন্যরকম হতো । সেই ঘটনা দুটিই বর্তমান আলোচনার উপজীব্য।
***
প্রথম ঘটনাটির ঘটনাকাল মহারাজ বিচিত্রবীর্যের অকাল প্রয়ানের ঠিক পরবর্তী সময় । বিচিত্রবীর্যের দুই স্ত্রী, অম্বিকা ও অম্বালিকা নিঃসন্তান । বিচিত্রবীর্যের অপর ভ্রাতা, চিত্রাঙ্গদ পুর্বেই প্রয়াত; প্রথা মতে, বংশরক্ষার দায় বর্তায় বিচিত্রবীর্যের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, মহারাজ শান্তনুর প্রথম পুত্র দেবব্রত-ভীষ্মের ওপর । কিন্তু তিনি যে পিতার কাছে আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের ভীষণ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ !!
এদিকে মাতা সত্যবতী চিন্তিতা । মহারাজ শান্তনুর বংশ লোপ পেতে চলেছে । কোনও উপায় না দেখে তিনি প্রায় সমবয়সী পুত্র, ভীষ্ণের সঙ্গে পরামর্শে বসলেন। আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো, নিয়োগপ্রথা অবলম্বন করা ছাড়া আর কোনো উপায়ান্তর নেই।
এমত অবস্থায় সত্যবতীর মনে পড়লো একটিই নাম – তিনি হলেন সাগ্নিক ব্রাহ্মণ মুনিশ্রেষ্ঠ পরাশরের ঔরসে আদিমাতা সত্যবতীর গর্ভে , তাঁর কুমারী কালে জাত পুত্র, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। না, এই মিলনে কোনো বলপ্রয়োগ ছিলো না। যদিও বিবাহ বহির্ভূত, তবুও দুই পক্ষের সম্মিলিত মিলনেচ্ছাতেই জন্ম ব্যাসদেবের। বল প্রয়োগের ইতিহাস এর পরবর্তী...
সত্যবতীর একান্ত আনুরোধে ব্যসদেব রাজী হলেন পরকামে নিযুক্ত হতে। পাঠক, একটি বার ভাবুন, সেই সদ্য বিগত-ধবা দুই কিশোরী সুন্দরী অনাথবৎ রাজমহিষীদ্বয়ের কথা, ভীষ্ণ যাঁদের স্বয়ম্বর সভা থেকে অপহরণ করে আনলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের জন্য; রাজমহিষী তাঁরা, কিন্তু নিঃসন্তান! শাস্ত্রে বলে, নিঃসন্তান বিবাহিতা নারীর পরলোকে নরক প্রাপ্তিও নাকি হয় না। একদিকে অনিশ্চিত পারলৌকিক জীবনের উৎকন্ঠ উদ্বিগ্নতা, অন্যদিকে বংশরক্ষার গুরুদায়িত্ব পালনের অক্ষমতার লজ্জা ও কুণ্ঠা । এমনিতেই তাঁরা অর্ধমৃতা, তার ওপর অন্তিম আঘাতটি পড়ল এই নিয়োগপ্রথার নির্মম সিদ্ধান্তে। একটিবারও কেউ তাঁদের মতামত জানতেও চাইলেন না।
ব্যাসদেব শর্ত দিলেন; একবৎসর কঠিন ব্রতধর্ম আচার অনুষ্ঠান পালনে আত্মিক শুদ্ধিকরণ, যাতে তেজঃদীপ্ত দ্বিজশ্রেষ্ঠ ঋষিপ্রবরের ঔরস যথার্থ গর্ভাধান লাভ করে । ঋষিশ্রেষ্ঠ হয়তো বা কিছুটা সময় দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সত্যবতী রাজী হলেন না, এতোদিন অপেক্ষা করা যাবে না।
অগত্যা দিন ধার্য হল। সত্যবতী বধূদের প্রস্তুত করলেন। রাত্রির আঁধার ঘনিয়ে এলো। দেবকন্যার মত রূপবতী, দেবোপম সুখবিলাসে অভ্যস্তা, সুস্নাতা, সালঙ্কারা, সদ্য বিগত-ধবা জ্যেষ্ঠা রাজমহিষী আম্বিকা শয়নকক্ষের শয্যায় অপেক্ষমানা। দীপ্যমান প্রদীপালোকে সেখানে ব্যাস উপস্থিত হলেন। ঘন কৃষ্ণ তাঁর গায়ের রং, তপস্যার রুক্ষতায় তাঁর কনকপিঙ্গল জটাকলাপ, আগুনের ভাঁটার মতো তপোঃদীপ্ত দুই চোখ, মুখে একরাশ দাড়ি, পাঁশুটে গোঁফ, কালো মুখোগহ্বর, পরনে অজিন আবরণ, গায়ে বিকট দুর্গন্ধ।
ভয়ে, ঘৃনায়, অনীহায় রাজমহিষী চক্ষু মুদলেন। তবুও মৈথুনক্রিয়া সম্পন্ন হলো। সত্যবতী জানতে চাইলেন, ফল? বলশালী, বিদ্বান, রাজপ্রতীম, কিন্তু মাতার আচরণ হেতু অন্ধপুত্র!!
হাহাকার করলেন সত্যবতী, সতর্ক করে দিলেন অম্বালিকাকে। দৃষ্টান্ত স্মরণ করে অম্বালিকা চোখ খুলে রাখলেন ঠিকই, কিন্তু ওই বীভৎসদর্শন, অসুরপ্রতীম ঋষিপ্রবরকে দেখে ভয়ে বিবর্না হয়ে গেলেন। জন্ম হলো পান্ডু-র ।।
মহারাজ শান্তানুর বংশ রক্ষা পেল। ধর্ষণ ছাড়া এই দুই রতিক্রিয়াকে কি অন্য কোনো নাম দেওয়া যায়? পাঠক, আপনিই বিচার করুন!! মহারাজ ভরতের কালে যে বংশের সূচনা, মহারাজ শান্তনুর পরবর্তীতে যে বংশ লোপ পেতে বসেছিলো, সেই বংশের ধারায় আবার প্রানপ্রবাহ প্রতিষ্ঠিত হলো দুটি ধর্ষনের ফলে, পুরাণমতে যে বংশপ্রবাহ আজও বর্তমান।
হায় ভারতবাসী, হায় মহারাজ ভরতের বংশধর, যে মায়ের ধর্ষনে আজ তুমি প্রতিবাদে সোচ্চার, যে জ্যেষ্ঠা-কনিষ্ঠা ভগিনীর আর্তচিৎকারে তোমার কর্নপটহ বিদীর্ণ, তাকে তুমি উপেক্ষা করবে কি করে !! তোমার নিজের জন্মের ইতিহাসও যে কালিমালিপ্ত !!! এ দায় আজ তোমায় নিতেই হবে ।।
***
দ্বিতীয় ঘটনাটির ঘটনাকাল ঠিক এক প্রজন্ম পরে, স্থান মহারাজ কুন্তিভোজের রাজঅন্তঃপুর, দর্পিত পুরুষের লালসার শিকার রাজা কুন্তিভোজের পালিতা কন্যা পৃথা-কুন্তী; জন্মসূত্রে যিনি যাদব, মহারাজ শূরের প্রথম কন্যা, মহামতী বাসুদেবের ভগিনী, সেই সূত্রে কৃষ্ণের পিতৃস্বসা।
রাজা কুন্তিভোজের প্রাসাদে আতিথ্য গ্রহণ করলেন প্রখরস্বভাবা মুনি দূর্বাসা। উগ্রস্বভাব, হঠাৎক্রোধী, আভিশাপপ্রবণ এই মুনির আতিথেয়তার গুরু দায়িত্ব পড়ল পালিতা কন্যা পৃথার উপর। রাজা কন্যাকে সতর্ক করলেন ঃ কন্যার কোমল অথচ কর্তব্যনিষ্ঠ স্বভাবের কথা বলার পরে তিনি কুন্তীর জন্ম পরিচয় উল্লেখ করে তাঁকে অনেক প্রসংশা করলেন। কিন্তু অবশেষে উল্লেখ করতে ভুললেন না, শূরনন্দিনী পৃথার হাতেই এখন রাজা কুন্তিভোজের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব। এ যেন পিতার সতর্কীকরণ নয়, রাজার আদেশ ।।
রাজাজ্ঞা পালিত হল অক্ষরে অক্ষরে। দুর্বাসা সন্তুষ্ট হলেন। অলোকসামান্যা রূপবতী কুমারী কুন্তীকে ইচ্ছামত দেব-সঙ্গমের মন্ত্র বর দিলেন মুনিশ্রেষ্ঠ।
বিপত্তির সূত্রপাত এখানেই। দুর্বাসা দেব-সঙ্গমের রহস্যমন্ত্র সদ্য যৌবনবতী কুন্তীকে শিখিয়ে দিয়ে চলে যেতেই কুন্তীর কুমারী হৃদয়ের অজ্ঞতা, চঞ্চলতা ও কৌতুহলপ্রিয়তা তাঁকে অস্থির করে তুলল। তিনি কিছুতেই সম্বরণ করতে পারলেন না মন্ত্রের বলাবল পরোখ করার প্রবল বাসনা...............
বালখিল্য চপলতায়, একদিন প্রত্যুষে রাজঅন্তঃপুরের পুষ্প শয্যায় শায়িতা পুষ্পবতী কুন্তী নবোদিত কোমল কিরণময় সূর্যকে আহ্বান করলেন মন্ত্রবলে। মুহূর্তে মূর্তমান হলেন আদিত্যদেব। নম্র সম্ভাষণে কুন্তীর আনুগত্য স্বীকার করলেন, মন্ত্রের শর্ত অনুযায়ী। কিন্তু এই অনুগতভাব বেশীক্ষণ রইল না, যখন কুন্তী তাঁকে ফিরে যেতে বললেন।
দেবপুরুষ হাতের কাছে কৃশকটি, অলসগমন, মধুর হাস্যময়ী, সদ্য যৌবনবতী, সুন্দরী কুন্তীকে পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। কুন্তীর শত কাকুতিমিনতী উপেক্ষা করে এক দীর্ঘ বচসার পর নিজেকে আর দমিত রাখতে পারলেন না। স্পষ্টতই তিনি কুন্তীকে লোকলজ্জা ও অভিশাপ প্রদানের ভয় দেখিয়ে কুন্তীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গমে প্রবৃত্ত হলেন, স্পর্শ করলেন কুন্তীর নাভিদেশ।।
পুরুষের ধর্ষণ মুখরতায় যৌবন শোভার আধার কুন্তী মহাবিষ্টা লতার মত সংজ্ঞা হারিয়ছেন । আর দুর্ধর্ষ সূর্য সঙ্গম সম্পন্ন করে অচৈতন্য কুন্তীকে ফেলে রেখে চলে গেছেন। জন্ম হয়েছে কর্ণের।।
স্বাভাব অভিমানী, অসম্ভব উচ্চাকাঙ্খী ও প্রতিশোধস্পৃহ কর্ণ নিজের স্বার্থে অন্ধ পিতৃস্নেহে ক্রমাগত দুর্বিনীত ও দুর্দান্ত হয়ে ওঠা, অহংকারী অথচ কিছুটা মূর্খ ও সুক্ষতাহীন দুর্যোধনকে ব্যবহার করেছেন। মহাভারতের সুবিশাল ভারতযুদ্ধ, যা পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের ইতিহাসকে অন্য এক রূপ দিয়েছে, তা ত্বরান্বিত ও সংঘটিত করার পেছনে কর্ণের বিশেষ অবদান আছে, এ কথা বলাই বাহুল্য।
মহাভারতের সুপ্রসারিত পরিসরে এইরূপ ঘটনা আরো আছে, কিন্তু এই দুইটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য, কারণ এই দুই ঘটনাই কাহিনীর গতিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রন করেছে, ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে বিশেষভাবে। যে কাহিনী দুটির অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে ধর্ষনের মতো এক মর্মান্তিক ঘটনা, ভারতবর্ষের ইতিহাসকে তা নিয়ন্ত্রিত করেছে, ভাবতেই বেদনার্ত হয় মন।
আলোচনার শুরুতেই যে বিষয়ভাব অনুষঙ্গের প্রস্তাবনা, তার যথার্থ মূল্যায়ন করা গেল কিনা জানিনা, তবুও পাঠকের চিত্তবৃত্তিতে যদি কিছুমাত্র আবেদন রেখে থাকে প্রবন্ধটি, তবে লেখিকার প্রয়াস সার্থকতা লাভ করবে, এ কথা অনস্বীকার্য।।
অনুপ্রেরনা ও কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ-
মহাভারতের ছয় প্রবীণ, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
কৃষ্ণা কুন্তী এবং কৌন্তেয়, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
Susmita, tomar lekha porlam.. uposthapona khub sundor.. khani gulo jodio ba jana tobu o porar por sei protikriya e holo ja prothom jobe buhjte shikhechhilam tokhon ja mone hoyechhilo.. kar ki mone hoy jani na.. amar byaktigoto mot holo jodi ei rokom ekti boi/mohakabyo amader dhormo grontho hoy.. tobe ekbingsho sotabdir somaj ke dosharop kore kone labh nei..
উত্তরমুছুনtumi o eki katha likhechho... bhalo laglo..
DHONNOBAAD DADA. MAHABHARAT KE AMI DHORMO GRONTHER CHEYE ONEK BESI SAHITTYO EBONG SAMAJIK DOLIL BOLEI MONE KORI. AMAR BEKTIGOTO BHABE MONE HOY EKI BHOUGOLIK PORIBESHE EBONG EKI MUL SANGOSHKRITI TE (TA SE JOTOI PORIBORTITO HOK NA KENO)HAJAR HAJAR BOCHHOREO MANUSHER CHARITRIK BOISISHTHER BISESH PORIBORTON HOY NA,MAHABHARAT I TAR UJJOL UDAHORON. TAI TO BOLE : JA NEI BHAROTE , TA NEI BHAROTE...
মুছুননিজেদের ধর্মকে নগ্ন করা আমাদের একটি সুখকর বিলাসিতা। আমরা নিজেদের সর্বত্র শিক্ষিত বলে দাবী করি। সেই সময় না আপনি না আপনার অগ্রপদ শতপুরুষ এ রটনার প্রত্যক্ষদর্শী তবু জামা কাপড় খুলে নিজেদের সভ্যতাকে উলঙ্গ করতে আমরা দ্বিধাহীন। তবু যাই নগ্ন কালী কে মা সম্বোধনে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম জানাতে, প্রসাদ ভক্তিতে আঢাকা মাছি ভনভনানো খাবার খেতে। যতদিন হিন্দুধর্মে এইসব ভন্ডদের গো-চারণ থাকবে ভারতের হাল ফিরবেনা।
মুছুনকরুন তো ইসলাম ধর্মের কোন অবমানননা, বুঝব সৎ ও সতী।
Lekhati porlam....Jana jinis k eto sundor vabe khub kom lok jon e pare bisleson korte, darun laglo
উত্তরমুছুনTHNX, JAY....
মুছুন