ধারাবাহিক - সহেলী



চোরাটান
(প্রথম কিস্তি)
 
সহেলী

অধৈর্য অমরেশ সমানে পা নাচিয়ে চলেছে। ট্রাফিক জ্যামে গাড়িটা ঠিক আজকেই ফাঁসতে হল? বাড়ি থেকে বের হতে আজ একটু দেরিই করে ফেলেছিল। এদিকে আজকেই জাপান থেকে স্পেশাল ইনভেস্টিগেটিং টিম আসছে সামনের প্রোজেক্টটার জন্য। এই প্রোজেক্টটা যদি হাতে আসে। উফ্! কতদিনের স্বপ্ন অমরেশের। আজ সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতা আর মেহনতে কোম্পানীর যে জায়গায় অমরেশ উঠে এসেছে, সেটা মধ্যবিত্ত যে কোন মানুষের কাছে স্বপ্নের মত। কিন্তু অমরেশের উচ্চাকাক্ষার কোন সীমা নেই। আর নেই বলেই হয়ত একটার পর একটা হার্ডল অনায়াসে পেরিয়ে আজ এই জায়গায়। অনেকের কাছে এটাই গন্তব্য হতে পারত। কিন্তু অমরেশের স্বপ্নটা অন্য। কোম্পানী এতদিন যা ব্যবসা করেছে, পুরোটাই দেশে। আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার সঙ্গে কোলাবোরেট করতে চলেছে এই প্রথম। তাও বলতে গেলে একা অমরেশের পূর্ণ যোগ্যতা আর চেষ্টায়। কিন্তু আজকেই এই মারাত্মক জ্যাম। আগে বুঝলে বাইপাস দিয়েই ঘুরে যেত। বিদেশী কোম্পানীগুলো সময়ের ব্যাপারে কীরকম পাংচ্যুয়াল সেটা অমরেশের খুব ভালোই জানা আছে। আর তাই অস্থিরতা বাড়ছে আরো। ড্রাইভার তপন ছেলেটা প্রায় দশ বছর তার গাড়িটা চালাচ্ছে। সাহেবের মুড মর্জি ওর চেয়ে ভালো কেউ বোঝে না। অমরেশ কম কথার মানুষ। কিন্তু তপন ওই বারবার পা নাচানো দেখেই বারকয়েক চেষ্টা করল গাড়িটা যদি ঘুরিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু একবার জ্যামে ফেঁসে গেলে কি আর বেরোনো যায়? কখন যে ছাড়বে দেবা না জানন্তি। অতএব ঘনঘন হর্ণ মারা আর অধৈর্য হওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই দুজনের সামনেই।
অমরেশ সেলফোনটা তুলে এর মধ্যে বারকয়েক ফোনও করে ফেলেছে অফিসে। মিটিং যদিও এখনো ঘন্টা দুয়েক, তবু কোলকাতার জ্যাম। কে বলতে পারে? তাছাড়া অফিসে পৌঁছে শেষ মুহূর্তে প্রোজেক্টটা আর একবার ঝালিয়ে নেওয়াও বাকি। ওটা অমরেশের বরাবরের অভ্যেস। স্কুল জীবন থেকে। পরীক্ষার আগেও হলে বসে নোটসগুলোতে একবার চোখ না বুলিয়ে নিলে যেন মনে হত সব ভুলে যাবে। অতএব গাড়িতে বসেই ল্যাপটপটা খুলে প্রোজেক্টটায় চোখ রাখলো সে। সামনের গাড়িগুলো মনে হচ্ছে একটু নড়াচড়া শুরু করেছে। এমন সময় পাশের কাঁচে ধাক্কা। ভিখারিগুলো এতো জ্বালায়। সম্পূর্ন এসি গাড়ির কাঁচ পুরো লকড্। কিন্তু বেশ জোরেই ধাক্কাটা পড়তে চরম বিরক্তি নিয়ে অমরেশ তাকালো ওদিকে। একটা ভাঙাচোরা বয়স্ক মুখ। গাড়িটাও সেই মুহূর্তে নড়ে উঠল। এতক্ষনে অল ক্লিয়ার। যাক্ বেশি দেরী হবে না। সময়ের মধ্যেই পৌঁছনো যাবে।

সন্ধ্যায় ক্লান্ত অমরেশ নিজের কেবিনে বসে আছে। সকালে মিটিং শেষ করে খানিকটা বিরতি। লাঞ্চের পর যখন সুখবরটা শুনলো, তখনও অমরেশ পুরো ঘোরের মধ্যে। সারা অফিস এসে তাকে কনগ্রাটস্ জানিয়ে গেছে। এমনকি কোম্পানীর হেড নিজে তার কেবিনে এসে পিঠ চাপড়ে বলে গেল একটু আগে, "আরেকটা সুখবরের জন্য তৈরী থাকো বোস।" জানতোই অমরেশ। বিদেশে যদি ওদের কোম্পানীর কাজ শুরু হয়, তাহলে ওখানকার কোম্পানীর দায়ভার সামলানোর সবচেয়ে বেশি দাবী আর যোগ্যতা তারই। তাই ঘোরের মধ্যেই যান্ত্রিকভাবে সবাইকে থ্যাঙ্কস্ জানিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে মনে করে একবার বাড়িতেও ফোন করে দিয়েছে, "জয়ি, নাও তোমার অনেক দিনের ইচ্ছা এবার পূর্ণ হতে চললো। এ দেশের তল্পিতল্পা গোটাতে শুরু করতে পারো এবার।"
গত কয়েকদিন জয়িতা প্রচন্ড ব্যস্ত। প্যাকিং, বিলিব্যবস্থা সব নিয়ে মাথাখারাপ অবস্থা। মাসখানেক আর বাকি। এর মধ্যে সব সেরে এখানকার পাট তুলতে হবে। কদিনের জন্য এদিক ওদিক বেড়াতে যাওয়া তো নয়। এ হল একেবারে এতোদিনের সমস্ত হিসেব নিকেশ চুকিয়ে বিদেশে পাড়ি। কতদিনের জন্য জানা নেই। বেশ কয়েক বছর, বা কে বলতে পারে সারা জীবনের জন্যও হতে পারে। ওর তো কতদিনের স্বপ্ন। আজ শুধু অমরেশের জন্য পূরণ হতে চলেছে। অমরেশের প্রতি ভালোবাসায় ওর মনটা ভরে ওঠে। এ তো ওর কাছে ছিল স্বপ্নের মত। স্বপ্ন যে এভাবে পূরণ হতে পারে তা ওর কল্পনাতেই ছিল না এতোদিন।
জয়িতাও অমরেশের মত একদম সাদামাটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। খুব বেশি স্বপ্ন দেখেনি কোনদিন। কিন্তু না চাইতেও কারো কারো জীবনটা যেন স্বপ্নের মতোই হয়ে যায়। কদিন ধরে এই কথাটাই শুধু মনে হচ্ছে জয়িতার। তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় জয়িতার যখন বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করেছিল বাবা খবরের কাগজ দেখে, তখন সে কলেজের ফাইনাল ইয়ার। হয়তো আর একটু পড়ার ইচ্ছা ছিল। খুব মেধাবী না হলেও আর্টের খুব ভক্ত ছিল জয়িতা। নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি, সবদিকেই ভালোলাগা ছিল। বাবা বিয়ের সম্বন্ধ দেখতে শুরু করতেই মাকে জানিয়েছিল একবার নিজের ইচ্ছার কথা। কিন্তু মা তাকে নিজেদের অপারগতার কথা জানিয়ে প্রায় অনুনয়ই করেছিল বিয়ে করে নিতে। বাবার চাকরি আর বেশি দিন নেই। শরীরটাও ভালো না। নীচে আরো দুই বোনকিছুটা বাধ্য হয়ে জয়িতা নিমরাজি হয়ে গিয়েছিল মায়ের কথায়। তারপর অমরেশের সম্বন্ধটা আসতে ভেবে দেখেছিল শুধু বাপ বেটার সংসার। মা নেই। বলতে গেলে সংসারে কর্ত্রী হয়েই সে যাবে। আর বিশেষ করে বাবা আর ছেলে দুজনেরই স্বভাব, সৌজন্যবোধ, নম্রতা, সব কিছুই প্রথমেই ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিল। খুশি মনেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি হয়ে গিয়েছিল।
না, সেদিন তার ওই ডিসিশানে কোন ভুল ছিল না আজ স্বীকার করে জয়িতা। তখন অমরেশ এই বেসরকারি অফিসে খুবই সাধারণ একটা পোস্টে। কিন্তু নতুন জীবনের প্রথম কয়েকদিনেই জয়িতা বুঝে গিয়েছিল অমরেশের মত সুখী তাকে আর কেউ কোনদিন করতে পারবে না। জয়িতাকে পাগলের মত ভালোবাসায় ভরিয়ে দিত অমরেশ। আজও সেই ভালোবাসায় একটুও ঘাটতি পড়ে নি কোনভাবে। অমরেশ উচ্চাকাংক্ষী, কিন্তু উশৃঙ্খল নয়। তার জীবনে দুটি মাত্র কক্ষপথ। চাকরি আর সংসার। চাকরির জায়গায় নিজের সেরা পারফর্মেন্স, আর বাকি সবটুকু সময় সংসারের জন্য। এইরকম আজ্ঞাকারী পুত্র, সদাহাস্যময় দায়িত্বশীল স্বামী, স্নেহময় পিতা আজকালকার দিনে খুব কমই চোখে পড়ে। সেই সঙ্গে জয়িতার শ্বশুরমশাইও মাটির মানুষ। বিয়ের পরের দিন জয়িতাকে ডেকে বলেছিলেন, "নিজের সংসার বুঝে নাও মা। আজ থেকে আমরা এই দুই ভালোবাসার কাঙাল তোমার দ্বারের ভিখারি। তুমি যেমন রাখবে, তেমনি থাকবো। তুমি শুধু কথা দাও, মা অন্নপূর্ণার মত আমাদের আগলে রাখবে সারাজীবন।" মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর এ কথার খেলাপ হয়নি কোনদিন। আজ তিনি থাকলে যে কী খুশি হতেন, সে কথা ভেবে জয়িতার চোখে জল এসে যায়।
কিন্তু এই সব খুচরো মনখারাপ নিয়ে পড়ে থাকলে কি আর চলবে এখন? জয়িতা সংসার গোটাতে মন দেয়। সোজা কথা নাকি? এতোদিনের সংসার। হুট বলতেই চলো। কি রাখবে, কোনটা কাকে দিয়ে যাবে, কোনটা এর মধ্যেই বিক্রি করতে হবে, এর সঙ্গে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ তো আছেই। তাও তো শ্বশুরবাড়ির দিকের কাউকেই চেনে না। ওরা বরাবরের প্রবাসী। আগেও যোগাযোগ ছিল না বড় একটা। আর অমরেশের মা মারা যাওয়ার পর শ্বশুরমশাই যখন ওখানকার চাকরি ছেড়ে কোলকাতায় চলে এসেছিলেন স্কুল পড়ুয়া অমরেশকে নিয়ে, তখন থেকে সবার সঙ্গে একেবারেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এখন শুধু জয়িতার বাপের বাড়ির লোকজন, অমরেশের অফিস কলিগেরা, তাদের ফ্যামিলি, ফ্ল্যাটের বাদবাকি লোকজন। অমরেশের এই খবরটার পর তো রোজই বিকেলে কেউ না কেউ আসছে দেখা করতে। এদিকে অমরেশও ভীষণ দেরী করে ফিরছে আজকাল। এতো দেরী সে কোনদিনও করে না। মাঝে মাঝে তো রাত এগারোটা বারোটাও বাজিয়ে ফেলছে। বোঝে জয়িতা। ওকেও তো অফিসের কাজ গোছাতে হচ্ছে। বাড়ি ফিরে তাই বোধহয় এদিকে কোন খোঁজখবরই করে না। জানে জয়িতা আছে, সামলে নেবে। রাতে ঘুমোতেও কম দেখছে যেন। বড্ড বেশি এপাশ ওপাশ করে। মাঝে মাঝে উঠে ব্যালকেনিতে পায়চারিও করতে শুরু করে দেয় কোনো কো্নো দিন। জয়িতার ঘুম ভাঙলে চমকে ওঠে। প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে আসে শুতে।
যাইহোক, আর মাত্র কিছুদিন। ওখানেই গিয়েও হয়তো প্রথম প্রথম এইরকম হেকটিক থাকবে কিছুদিন। স্ট্রেস কমতে সময় লাগবে। এসব ভেবে বেশি কিছু বলতো না। কিন্তু প্রথম খটকাটা সেদিন লাগলো, যেদিন গাড়িটা নিয়ে বেরিয়েছিল একটু কেনাকাটা করতে। রোজই মনে হচ্ছে কিছু কেনা দরকার। অমরেশকে বলেছিল অফিসে পৌঁছে গাড়িটা পাঠিয়ে দিতে। তপন ছেলেটা ভালো। অনেকদিন কাজ করার সুবাদে ওর সঙ্গে একটু গল্পও হয়। অমরেশকে সাহেব বললেও ওকে বৌদি বলে। জয়িতা তাড়াতাড়ি করছিল। গাড়ি আবার অমরেশকে পাঠাতে হবে। তপনই বললো," বৌদি, আপনি হুটপাটা করছেন কেন? আমার তো আজ আর ডিউটি নেই।" জয়িতা বেশ অবাক হলো, "সেকি? অমরেশ ফিরবে কীসে?" তপন একটু দোনোমনো করে বলেই ফেললো,"বৌদি, কয়েকদিন ধরে আপনাকে একটা কথা বলবো ভাবছিলাম। আসলে সাহেব বেশ কয়েকদিন হলো আমার গাড়িতে ফিরছেন না। বিকেলে রোজ আমাকে ছুটি দিয়ে দিচ্ছেন।" জয়িতা জিজ্ঞাসা করলো,"কেন? দেরী হচ্ছে বলে?" তপন আমতা আমতা করে জানালো,"না বৌদি। সাহেব তো রোজ বিকেলেই অফিস থেকে বের হয়। কিন্তু আমার গাড়ি নেন না। টাক্সি নিয়ে কোথায় যেন যান।" জয়িতা আকাশ থেকে পড়ল। কি বলবে বুঝতেই পারলো না আর। তপনই আবার একটু চুপ করে একটু ইতস্ততঃ করে বললো,"বৌদি কিছু মনে করবেন না। কথাটা বলা হয়তো আমার উচিৎ হচ্ছে না। কিন্তু সাহেবকে নিয়ে, মানে সাহেবের এই রোজ বিকেলের যাওয়াটা নিয়ে অফিসেও কানাঘুষো শুরু হয়েছে। কে যেন ওনাকে... মানে ওই খারাপ জায়গায় দেখতে পেয়েছে একদিন। কেউ কেউ বলাবলি করছে, বোসেরও তাহলে রোগ ধরে গেল। এই হচ্ছে উঁচু পদের মহিমা। কিন্তু বৌদি বিশ্বাস করুন, আমি বিশ্বাস করি না। কম দিন তো এ কাজ করছি না, কম মানুষও দেখিনি। মানুষ চিনি। সাহেব আমার দেবতুল্য মানুষ। উনি খারাপ কোন কাজ করতেই পারেন না। আর কেউ হলে আমি জানাতাম না। কিন্তু আপনাকে বললাম। সাহেবের বদনাম হলে আমার সইবে না। একটু খোঁজ নেবেন বৌদি। দরকার হলে বলবেন। যত রাতই হোক, সাহেবের দরকার হলে আমি নিয়ে যাবো।" কিন্তু জয়িতার কানে আর কিছু ঢুকছিল না। মাথা পুরো ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করেছে। শুকনো মুখে তপনকে বাড়ির দিকে যেতে বললো।
______________________________ (ক্রমশঃ)


3 মতামত: