গল্প - ঋত্বিক দাশ শর্মা



ধূসর মনের টান
ঋত্বিক দাশ শর্মা

প্রচন্ড জোরে দৌড়াচ্ছে জোড়ানদৌড়াতে দৌড়াতে মুখে ফেনা উঠে গেছে, দম পাচ্ছে না আর। তবু প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে ওই শুয়োরটার পেছোনে।একবার পুকুরেও ঝাঁপাতে হয়েছে ওটার সাথে। তাও পারছেনা ধরতে। যে করেই হোক আজ যে ওটাকে ধরতেই হবে। তা নাহলে বউ ঘরে ঢুকতেই দেবে নাকাল পাড়ার মোড়লদের নিমন্ত্রণ করেছে বউ, শুয়োরের মাংস ও ভাত খাওয়াবে। নিজের রোজগারে কেনা ওই শুয়োরটাকে ঠিক করে বেঁধে রাখতে বলেছিল চামেলি। পঞ্চায়েতের অধীনে ঝাড়ুদারির চাকরী জুটিয়েছে ওদেরই তোষামোদ করে। তাই তার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এই আয়োজন কাল। আজ ওটাকে বাঁধতে গিয়ে হঠাৎই হাত ফসকে পালাতে আরম্ভ করে শুয়োরটা! জোড়ান বউকে খুব ভয় পায়। কারণ এতদিন তার বিশেষ কোন রোজগার ছিল না। লোকের বাড়ির নালা বা টয়লেট পরিষ্কার করে যা পেতো বেশীরভাগটাই মদ খেয়ে উড়িয়ে দিত, বউ চেঁচামেচি করলে তাকেও ধরে প্রথম প্রথম মারত। এখন মদ খেলেই বউ উল্টে মার দেয়, আর চাকরিটা পাওয়ার পর তাকে বাড়ির চাকর বানিয়ে রেখেছে একরকম। রাতে একসাথে শুতে পর্যন্ত দেয় না! জৈবিক তাড়নায় পৌরুষের দম্ভে যখন সে বলে ওঠে... “খাইচ্ছ দাইচ্ছ সিংগাইচ্ছ, অন্য মরদের সাতি ঘুইরে বেরাইচ্ছ, আর মু বইল্লে অন্ন ঘরে সিদোইচ্ছ?” এক বালতি ঠান্ডা অথবা গরম জল তার গায়ে ঢালতে দেরি করে না চামেলি। তাই আজ ওই শুয়োরটাকে বাড়িতে না নিয়ে যেতে পারলে কপালে তার আরও কি শাস্তি আছে কে জানে। তাই দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে দৌড়াচ্ছে। এদিকে আকাশে মেঘ কাল করে এসেছে, বিকেলবেলা যেন সন্ধে নেমে গেছে। শুয়োরটা তখন ধান জমির উপর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। জোড়ান এর হাঁপিয়ে দম আটকে যাওয়ার জোগাড়, তার উপর ওই ধান জমির মধ্যে ভিজে কাদা পাঁকে পা আটকে আর পারছেনা।
ওদিকে সুধা বেরিয়েছিল তার বাছুরটাকে খুঁজতে। আজ হঠাৎ দুধ দুইতে গিয়ে, পাশে বাঁধা বাছু্রটা দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যায়। কোনরকমে গরুটাকে বেঁধে দৌড়ে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে বাছুরটার পিছন পিছন। মেঘ ডাকছে বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করেছে। বাছুরটা ভয়ে আরও জোরে দৌড়াচ্ছে, তার পেছনে সুধাআজ বাছুরটাকে বাড়ি ফিরিয়ে না নিয়ে যেতে পারলে কপালে দুঃখ আছে। স্বামীটা আজকাল কথায় কথায় তাকে মারে। পান থেকে চুন খসতে পারে না। রাত হলেই মদ খেয়ে চলে অসহ্য শারীরিক অত্যাচার। মাঝে মাঝে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। কি করবে সে, কোথাও চলে যাওয়ার জায়গা নেই আজ। বাপের বাড়ি বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। ভাইয়ের সংসারে একবেলা থাকতে পারে না গিয়ে। তাই পড়ে পড়ে স্বামীর ঘরে দাসীবৃত্তি করা ছাড়া তার কোন উপায় নেই। তাই প্রাণপনে বাছুরটার পেছনে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে ধানের মাঠ পার করে বাছুরটা পাশের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। এখন উপায়? সুধার মাথায় হাত। কাছে পিঠে কোন লোক কে পেলে সাহায্য চাইতো। তাও দেখতে পাচ্ছে না এখন। ওই জঙ্গলের মধ্যে এই প্রায় সন্ধ্যেবেলা ঢুকে ওই বাছুর খুঁজতে যাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব না। এই সমস্ত যখন ভাবছে সুধা, তখন ওই ধানজমির ভেতর থেকে একটা গোঙ্গানির শব্দ পেল সে। আবছা অন্ধকারে একটা লোক জমির কাদার মধ্যে পড়ে গোঙাচ্ছে। তার কাছে এগিয়ে গেল সে। জোড়ান জমির মধ্যে দিয়ে দৌড়াতে গিয়ে পা পিছলে এমন মোচকে গেছে যে, আর উঠতেই পারছে না। এদিকে বৃষ্টি এসে গেল বলে। সুধাকে সামনে আসতে দেখে হাত দিয়ে তুলে ধরতে ইশারা করল সে। সুধার খুব মায়া হল। গ্রামের শক্তসমর্থ মেয়ে সুধা একটা হাত তার কাঁধে চাপিয়ে জোড়ান কে তুলে ধরল। বৃষ্টি বেশ জোরে পড়তে শুরু করেছে। সুধা জিজ্ঞেস করল, ‘যাবে কোথায়?’ জোড়ান বলল, ‘এখন জানি না কোথায় যেতে হবে।তুমি যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাব্‌, তুমি যাবে কোথায়?’ সুধা বলল, ‘আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই এখন’বৃষ্টিতে তখন দুজনে ভিজে সাপটে গেছে। সুধা কিছুক্ষণ জোড়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘চল আজ রাত্রে যেদিকে দুচোখ যায় আমরা চলে যাই এখান থেকে’।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন