গল্প - পারমিতা চ্যাটার্জী



সকল শূণ্য করে
পারমিতা চ্যাটার্জী

আজ অনেকদিন পর তোমার চিঠি পেলাম, অনেক বছর পর, যখন জীবনের অনেকটা সময় পার করে এসেছি।
জানো শুভম আজ তোমায় একটা সত্যি কথা লিখছি, তোমার চিঠি পেয়ে যতটা ভালো লাগার কথা ছিল তত খুশী হতে পারলাম না।
আজ আমার কাছে গৌরবের অভাবটা বড় বেশী, ওর কাছ থেকে শুধু নিয়েই গেলাম কিছু দিতে পারলামনা।
যেদিন গৌরব আমার জীবনে এলো সেদিন তুমি ছিলে আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা, সেদিন বাবা মায়ের কথার দাম দিতে গৌরবকে মেনে নিয়েছিলাম।
বিয়ের পর গৌরবের সাথে চলে গেলাম ওর চাকরির যায়গায়।
পাহাড়ের ওপর একটা সুন্দর ছোট শহর। এক রকম সব কোয়ার্টার, সামনে ফুলের বাগান, পিছনে সবজি বাগান।
গৌবব বুঝে ছিল নীরবে আমি সব কাজ করে গেলেও কোথায় যেন একটা আড়াল রাখার চেষ্টা করি।
ও আমায় বলল...
--
যতদিন না তোমার মনের দরজা খোলা পাই, আমি বাইরেই থাকব, ঢোকার চেষ্টা করব না।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম, এমন মানুষও হয়!
ও আমার ঘরটাকে আমার ভালোলাগার সব জিনিস দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের ছবি, গীতবিতান, সঞ্চয়িতা, বিভিন্ন লেখকের লেখা রবীন্দ্রজীবনী, কোন কিছুর অভাব রাখেনি।
ওর প্রতি ঠিক প্রেম না থাকলেও অসীম শ্রদ্ধায় দিন দিন মনটা ভরে যাচ্ছিল, প্রাণপণে চেষ্টা করতাম সহজ হবার, নিজেকে খুব স্বার্থপর নিষ্ঠুর মনে হত, মাঝখানের পাঁচিলটা ভেঙে ওর কাছে যাবার চেষ্টা করতাম, ও বলত...
--
নিজেকে এতো কষ্ট দিওনা, এটুকুতো বোঝ, তুমি কষ্ট পেলে আমি অনেক বেশী কষ্ট পাই...
--
আমি কান্নায় ভেঙে পড়ে বললাম, তুমি বিশ্বাস করো আমি মা হতে চাই...
--
ও বলল, ভেবে বলছতো?
--
আমি বললাম হ্যাঁ।
আরও তিন বছর পার হয়ে গেল, আমাদের ছোট্ট মেয়ে মউলকে নিয়ে আমরা মেতে থাকতাম, ফাঁকটা অনেক কমে গেলেও কোথায় যেন একটু থেকে গেল।
মউল আস্তে আস্তে বড় হল, স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে কলেজ পে্রিয়ে গেল, তারপর সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে চলে গেল পড়তে।
আমরা আবার একা হয়ে গেলাম , মাঝে মাঝে আমায় মনমরা দেখে গৌরব বলত...
--
চল বেড়িয়ে আসি, আমিও বলতাম চল, মাঝে মাঝে মনের দরজা ভেঙে তুমি ঢুকে পড়তে, তোমার সাথে কাটান প্রথম যৌবনের রঙিন প্রেম মনে করে অকারণেই চোখে জল আসত, মনে হত তুমি ঠিক আছ তো? আমার দিন তো কাটছে একরকম করে।
গৌরব আমার এই বদলটা ধরতে পারত, আমায় একা ছেডে দিত, নিজেও যে প্রায় সারাজীবনই একটা না পাওয়ার মধ্যে দিয়ে কাটাল তা কখনও আমায় বুঝতেও দেয়নি।
একদিন গৌরবের আসতে অনেক দেরী হচ্ছে, আমি ঘরবার করছি, সেদিন যেন মনে হচ্ছিল আজ ওকে অনেক ভালোবাসায় ভরিয়ে দেব, কখন যে আমার নিষ্ঠুর মনটাকে এমন করে দখল বসে আছে, নিজেও বুঝতে পারিনি।
সেদিন ওর পছন্দ মতোন ঘর সাজালাম, রান্না করলাম, রান্না অবশ্য আমি সব সময় ওকে নিজেই করে খাওয়াতে ভালবাসতাম, এ নিয়েও ও একদিন বলেছিল...
--
কেন এতো কষ্ট করো? একটা রান্নার লোক রাখলেই তো হয়? আমি বলেছিলাম...
--
দোহাই তোমার এটুকু আনন্দ আমার কেড়ে নিওনা,
ও বলল
...
--
আমি তো তোমার কিছুই কেড়ে নিতে চাইনি, যেটুকু তুমি নিজে দিয়েছ, শুধু সেটুকুই নিয়েছি;
আমি বললাম...
--
সেখানেই তো আমায় অপরাধী করে রেখে দিয়েছ।
যাই হোক আবার ফিরে যাচ্ছি সেদিনের কথায়, হঠাৎ দরজায় বেলের শব্দে চমকে উঠলাম, এ তো ওর বেল নয়, তবে?
দরজা খুলে দেখি কিছু অচেনা লোক, ওরা বলল...
--
আমরা গৌরবদার অফিসের লোক,
--
বৌদি গৌরবদা হাসপাতালে, আপনাকে একটু আমাদের সাথে যেতে হবে।
যন্ত্রের মতন ওদের সাথে গাড়ীতে উঠলাম, হাসপাতালে পৌঁছে দেখলাম আমার গৌরব অভিমানীর মতন সাদা চাদরে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে, ম্যাসিভ হার্ট এটাক। আমায় কোন সুযোগ না দিয়ে আমায় ছেড়ে চলে গেছে।
আজ ওর মৃত্যুর তিন বছর হল, অনেক ফুল দিয়ে সাজিয়েছি, ওর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে শুধু কবিগুরুর সেই কথটাই মনে আসছে...
-"
তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূণ্য করে"
শুভেচ্ছা রইল,
দিঠি।



0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন