বোম্বে হাইওয়ে
পিনাকি চক্রবর্তী
সাহাব, ই তো কারবুরেটর ওভারফালোট হ্যায়...
এক সপ্তাহ ধরে তিওয়ারীজীকে যতোটা চিনেছি, গাড়ীর আভ্যন্তরিক ব্যাপারে ইনি সাঙ্ঘাতিক রকম সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলে থাকেন। কিন্তু কারবুরেটার ওলোট পালোট মানে কি? ভেঙ্গেচুরে গেল নাকি ইঞ্জিনটা? জীপের বনেট খুললে সেটা এসে উইন্ডস্ক্রীনের ওপর চেপে বসে, ভেতরে বসে কিছুই বোঝা যায়না বাইরে কি হচ্ছে। তড়াক করে নেমে এসে তিওয়ারীজীর পাশ দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আড়ে আর বহরে জীপের প্রায় সমমাপের তিওয়ারীজীর পাশ দিয়ে কিছু দেখা সহজ নয়। শুধু এইটুকু বুঝলাম যে তিনি অভিমানিনী প্রিয়ার মানভঞ্জন করার জন্য একটা স্প্যানারের উলটো দিকটা দিয়ে ইঞ্জিনের প্রত্যন্ত প্রদেশে কোথাও আলতো করে ঠোনা মেরে যাচ্ছেন একমনে। কোনো কথায় কান দিচ্ছেন না। হতাশ হয়ে বিকল জীপটার সঙ্গ ছেড়ে রাস্তার পাশের একটা মাইলস্টোনের ওপর চেপে বসে গত সপ্তাহের ঘটনাবলী মনে মনে রোমন্থন করতে লাগলাম।
একটা তেলের কম্পানিতে জিওলজিস্টের চাকরী করি, দেশের ঈশান কোণের পাহাড় আর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই তেলের সন্ধানে, হাতে হাতুড়ি আর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে। ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং তাম্বুমন্দিরে। হঠাৎ হেডকোয়ার্টারে তলব।
পিনাকী, তোমাকেই গাড়ীদুটো নিয়ে যেতে হবে ভাই কাঁঠালিয়া পর্যন্ত। বলবিন্দর সিং রানাওয়াত, আমার পার্টী চীফ এবং বন্ধু, অনুরোধের সুরে বলেছিলো আমাকে। হাবেভাবে মনে হচ্ছিল ‘সিধে রাস্তা, সোয়া ঘন্টার পথ, গেলেই হল’ – এইরকম কিছু একটা বোঝাচ্ছে আমাকে। পার্টীচীফ যখন বলছে, সেটা তো আর অনুরোধ নয়, হুকুম, সুতরাং যেতেই হবে। কিন্তু, সত্যি করে তো আর কিছু সোয়া ঘন্টার পথ নয়, কলকাতা থেকে ত্রিপুরার দক্ষিণপ্রান্ত, হিসেব মত দু হাজার কিলমিটারের ওপর। দুই দুটো জীপ, পেছনে ট্রেলারে ভর্তি যন্ত্রপাতি, তাঁবু, খাটিয়া মায় বিছানা পর্যন্ত, মাক্সিমাম স্পীড উঠবে চল্লিশ। দিনে দুশো কিলোমিটার গেলে মোট লাগবে দশ এগারো দিন, তাও যদি গাড়ী ঠিকঠাক চলে। নাহলে খোদায় মালুম কবে পৌঁছাবো।
তাও নাহয় হলো, কিন্তু সঙ্গে যাবে কে? ড্রাইভার তিওয়ারীজী আর জোরা সিং এবং অ্যাটেন্ডেন্ট ভুট্টিপ্রসাদ। অন্য একজন অফিসার কই? আর কেউ নেই, তোমাকেই সামলাতে হবে দুটো গাড়ী। যাব্বাবা! রাস্তাঘাটে কিছু বিপদ আপদ হলে কি হবে? আপদ বিপদ কিছু হবে না, গাড়ী দুটো টনাট্টন সারানো আছে। প্লীস্ পিনাকী, আর কেউ নেই আমার হাতে!
মানে? আমি ওর হাতে আছি? আহ্লাদের ঘনঘটা আর কি! আমাকে পেয়েছে কি ও? আর, এই তো গাড়ী সারানোর নমুনা! প্রথম দিনে বারাসাত পৌঁছতেই দুপুর গড়িয়ে গেল। তিওয়ারীজীর গাড়ী “মৌসম পাকড়তিহী নহী।” অনেক হাঁচোড়পাঁচোড় করে বুঝলাম মৌসম মানে মোশন, সাদা বাংলায় গাড়ী পিকআপ নিচ্ছে না। আমরা যতক্ষণ চাঁপাডালির মোড়ে পাইস হোটেলে ডালভাত খেলাম, তিওয়ারীজী গাড়ীর মৌসম ঠিক করলেন। তারপর সন্ধ্যেবেলা মধ্যাহ্নভোজন করলেন তিনি। বহু কষ্টে বহরমপুর পৌঁছলাম মাঝরাতে।
প্রথম দিনের ধাক্কায় পরের দিন দেরী হয়ে গেল বেরোতে বেরোতে। বহরমপুর থেকে লালগোলা, ফরাক্কা, মালদা হয়েরায়গঞ্জ এসে সব্বাই ক্লান্ত। থেকে গেলাম রায়গঞ্জ ডাকবাংলোতে। পরের দিন রায়গঞ্জ থেকে বেরিয়ে ইসলামপুর সবে পেরিয়েছি আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে, এমন সময়ে ঘটংঘট করে গাড়ী ফুলস্টপ। আশীর্বাদের ব্যাপারটা হাল্কাভাবে নেবেন না। যাঁরা রাস্তাঘাটে যাতায়াত করেন তাঁরা বুঝবেন ইন্টারস্টেট বাউন্ডারি একবার এপার একবার ওপার করা কি যন্তর জিনিস! আর এই ঘটনাটা ঘটে ডালখোলা থেকে কিষাণগঞ্জ হয়ে ইসলামপুরের পথে দুই দুবার। সারা পৃথিবীর যত ট্রাক, টেম্পো, ঠেলাগাড়ী – সব দাঁড়িয়ে থাকে বর্ডার চেকপোস্টে – লাইন দিয়ে নয়, জট পাকিয়ে। সেই যানজট দুবার করে ঠেলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি সবে, এমন সময় “রেডিওয়াটার লীক হোগয়া।” এটা অবশ্য অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য রোগ। রেডিয়েটর লিক করে জল সব বেরিয়ে গেছে। তা মাঝরাস্তায় রেডিয়েটর ঝালাইমিস্ত্রী কোথায় পাই? জোরা সিংএর জীপটাকে ট্রেলারমুক্ত করে মিস্ত্রী আনতে পাঠাবো নাকি? তিওয়ারীজী পরম আশ্বাসে বললেন, “হজৌর, ঘাবড়াইয়ে মত, অভী দুরুস্ত কর দেতে হেঁ।”
নিজের কালো রঙের একটা টয়লেট ব্যাগ থেকে ঝপ করে বের করলেন একটা কাপড় কাচার ৫০১ বার সাবান। ছুরি দিয়ে তার একটা টুকরো কেটে নিয়ে, অল্প জল দিয়ে টিপেটুপে সেটাকে একটা নরম পুট্টি বানিয়ে ফেলে যেখানে যেখানে লিক বলে সন্দেহ ছিল সেখানে নিপুণ হাতে তাপ্পি দিয়ে দিলেন। আমি তাজ্জব! তারপর একটা জেরিক্যানে এইরকম সম্ভাবনার কথা ভেবেই বোধহয় জমিয়ে রাখা জল দিয়ে “রেডিওয়াটার” আবার শূন্য হতে পূর্ণ হল, এবং অচল গাড়ী আবার সচল হোলো। কিন্তু দশ-বারো কিলোমিটার যেতে না যেতেই আবার লিক, আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। এই উপর্যূপরি যন্ত্রনার হাত থেকে মুক্তি শিলিগুড়ি পৌঁছে, ফাটা রেডিওয়াটার ঝালাই করিয়ে।
শিলিগুড়ি থেকে গোঁসাইগাঁও তিওয়ারীজীর গাড়ী কোনোরকম বেগড়বাঁই করে নি। রাস্তায় গুচ্ছ গুচ্ছ নদী, আমি মনে মনে স্কুলের ভূগোল বইএর পাতায় ডুব দিয়ে মহানন্দা, তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, রায়ডাক গুণতে গুণতে চলেছিলাম। কিন্তু তখনই এল জোরা সিংএর পালা। তার জীপের ট্রেলার টানার হূক-ব্লকটার “রিপিট” গেল কেটে, হাসিমারার কাছাকাছি। এটার আর কোন টোটকা দাবাই হয় না। ট্রেলার খুলে জোরা সিং ভুট্টিকে সাথে নিয়ে গিয়ে রিভেট করিয়ে আনল কোথার থেকে যেন, ঠিক মনে নেই। আমার যা মনে আছে তা হোলো গভীর জঙ্গলের মধ্যে থেকে হঠাৎ হঠাৎ কানফাটা শব্দ তুলে জোড়ায় জোড়ায় যুদ্ধবিমান মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো, আর আমি হাঁ করে তাদের ডেলটা উইং আর নোজকোন দেখে এরা মিগের কোন প্রজাতী বোঝার চেষ্টামাত্র করছিলাম।
রিভেট করে আসতে আসতে দেরী হয়ে গেল, আর তাই আমরাও মেরেকেটে বড়পেটা ডাকবাংলো পর্যন্ত পৌঁছলাম রাত আটটায়। মাঝখানে গোঁসাইগাঁওএ আসামের সীমানা শুরু। সেখানে সব কাজও হয় লাহে লাহে (মানে আস্তে ধীরে)। জীপের সামনে “ভারত সরকার” লেখাটা আবার ওই মুল্লুকে ব্যাকফায়ার করতো সেই যুগে। সে যাইহোক, বড়পেটা জায়গাটা বড়ই মনোরম। একবার ভেবেছিলাম শেষজীবনে বড়পেটায় একটা ছোট্ট কাঠের বাড়ি বানিয়ে থাকব। পাশে নদী, পেছনে ভুটানের হিমালয় পাহাড় আর নীল জঙ্গল, সামনে সবুজ মাঠ। ভাগ্যিস আজকাল আর ভাবি না!
পরদিন বড়পেটা ছেড়ে গৌহাটীর পথে রঙ্গিয়ায় দেখা হলো ব্রহ্মপুত্রের সাথে। আর জীপ তাই দেখে চিত্রার্পিতের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। তিওয়ারীজীর কম্পাউন্ডারি বিদ্যেতে এবার আর কুলালো না। ভালো জীপটা প্রথমে খারাপটাকে টেনে নিয়ে গেলো গৌহাটীতে মাহিন্দ্রা ওয়ার্কশপএ, তারপর একে একে দুটো ট্রেলারকে টেনে নিয়ে এলো গৌহাটীর একটা হোটেলে। রাত কাটলো দুশ্চিন্তায় আর বদহজমে।
পরদিন সক্কালবেলা ভগ্নদূতের মতো তিওয়ারীজী এলেন হোটেলে, জানালেন যে জীপের “ইলিক্ট্রিক ফায়ার ফুঁক গয়া”... ইলেকট্রিকের আগুণ, মানে স্পার্ক প্লাগের কো্নো গন্ডগোল? আরে নহী সাহাব, তিওয়ারীজী আমাকে বোঝানোর আশা অনেক আগেই ত্যাগ করেছেন বোঝা গেল, পকেট থেকে একটা ছোট্ট তেঁতুলেবিছে টাইপের দাঁড়াওয়ালা কি যেন বের করে আমার হাতে দিলেন। তখন বয়েস কম, চোখের তেজ বেশী, দেখলাম ক্ষুদে ক্ষুদে হরফে লেখা আছে লুকাস আরসিটি ১২ভি এসি। বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে একটা প্রশ্ন এল, বললাম, এটা কি অলটারনেটারের রেক্টিফায়ার? এক প্রশ্নে আমার হৃত সম্মান পুনরূদ্ধার হয়ে গেলো। সসম্ভ্রমে তিওয়ারীজী বললেন, জী হজৌর!
সেই যে গাড়ী ঠিক হলো, তারপর গৌহাটী থেকে জোড়াবাট, উমস্নিং, শিলং, জোয়াই হয়ে বদরপুর টপকে নীলমবাজার থেকে ধর্মনগর যাবার পথে আর কোন ঝামেলা হয় নি। সেটা হতে হোল শেষমেশ এই উগ্রপন্থীদের আড্ডা বারোমূড়ায়? আগরতলা আর মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার দূর, জানাচ্ছে আমার নীচে থেকে এই মাইলস্টোনটা!
কি করে পার পেলাম সে যাত্রা? কিভাবে পৌঁছলাম কাঁঠালিয়া? আদৌ পৌঁছলাম কি? আর না পৌঁছালেই বা ক্ষতি কি? সে সব প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসলে রাত কাবার হয়ে যাবে। অন্য কোনোদিন হবে, যদি আপনারা সত্যিই জানতে চান। কিন্তু একটা কথা আজ বলা দরকার, সেটা হোল এই গল্পের নামের সাথে গল্পটার সম্পর্কের কথা।
এই ঘটনার সাত বছর পরে আমি ফিরেছি তিওয়ারীজীর সাথে, মিজোরাম থেকে। ফিরেই হাতে পেলাম ট্রান্সফার অর্ডার। যেতে হবে বোম্বে উপকূলে, আরব সাগরের মাঝে তেলের সন্ধানে। সেই সময়ে বোম্বে হাই দৈত্যপ্রায় তেলের খনী, দেশবাসী মাত্রেই এর নাম জানেন। সেই অঞ্চলে কাজ করতে পাওয়া ভাগ্যের কথা। সহকর্মীরা সবাই ব্যাজার, ফিল্ডপার্টীর কাজে সবাই এক পরিবারভুক্ত হয়ে কাজ করেন, তাই কারুর যাওয়াটাই সহজে মেনে নেন না। কিন্তু বোম্বে হাই বলে কথা!
বিদায়ী অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। সবাই একে একে ভাষণ দিলেন, আমার নিজের গুণপনার কথা নিজের কানে শুনতে শুনতে আমার মত নির্লজ্জেরও কান লাল হলো। আমাকে যিনি এতদিনে সবচেয়ে ভাল করে চিনেছেন, সেই তিওয়ারীজী বলতে উঠলেন সবার শেষে। পাত্থর থেকে ইঞ্জিন পর্যন্ত সব ব্যাপারে আমার জ্ঞানের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি জানালেন যে আমি যেরকম আসাম থেকে ত্রিপুরা, সর্বত্র সুনাম অর্জন করেছি, তিনি আশা করছেন যে বোম্বে হাইওয়েতেও আমি ততটাই কর্মদক্ষতা দেখাতে পারব!
অভিজ্ঞ ড্রাইভার মানুষ, বোম্বে হাই কে বোম্বে হাইওয়ে করে নিয়েছিলেন নিজগুণে!
বয়োজ্যেষ্ঠ তিওয়ারীজীর আশীর্বাদে আর আপনাদের শুভেচ্ছায় আমি কিন্তু পেরেছি!ওই কর্মদক্ষতা দেখাতে, আর কি!
সাহাব, ই তো কারবুরেটর ওভারফালোট হ্যায়...
এক সপ্তাহ ধরে তিওয়ারীজীকে যতোটা চিনেছি, গাড়ীর আভ্যন্তরিক ব্যাপারে ইনি সাঙ্ঘাতিক রকম সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলে থাকেন। কিন্তু কারবুরেটার ওলোট পালোট মানে কি? ভেঙ্গেচুরে গেল নাকি ইঞ্জিনটা? জীপের বনেট খুললে সেটা এসে উইন্ডস্ক্রীনের ওপর চেপে বসে, ভেতরে বসে কিছুই বোঝা যায়না বাইরে কি হচ্ছে। তড়াক করে নেমে এসে তিওয়ারীজীর পাশ দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আড়ে আর বহরে জীপের প্রায় সমমাপের তিওয়ারীজীর পাশ দিয়ে কিছু দেখা সহজ নয়। শুধু এইটুকু বুঝলাম যে তিনি অভিমানিনী প্রিয়ার মানভঞ্জন করার জন্য একটা স্প্যানারের উলটো দিকটা দিয়ে ইঞ্জিনের প্রত্যন্ত প্রদেশে কোথাও আলতো করে ঠোনা মেরে যাচ্ছেন একমনে। কোনো কথায় কান দিচ্ছেন না। হতাশ হয়ে বিকল জীপটার সঙ্গ ছেড়ে রাস্তার পাশের একটা মাইলস্টোনের ওপর চেপে বসে গত সপ্তাহের ঘটনাবলী মনে মনে রোমন্থন করতে লাগলাম।
একটা তেলের কম্পানিতে জিওলজিস্টের চাকরী করি, দেশের ঈশান কোণের পাহাড় আর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই তেলের সন্ধানে, হাতে হাতুড়ি আর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে। ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং তাম্বুমন্দিরে। হঠাৎ হেডকোয়ার্টারে তলব।
পিনাকী, তোমাকেই গাড়ীদুটো নিয়ে যেতে হবে ভাই কাঁঠালিয়া পর্যন্ত। বলবিন্দর সিং রানাওয়াত, আমার পার্টী চীফ এবং বন্ধু, অনুরোধের সুরে বলেছিলো আমাকে। হাবেভাবে মনে হচ্ছিল ‘সিধে রাস্তা, সোয়া ঘন্টার পথ, গেলেই হল’ – এইরকম কিছু একটা বোঝাচ্ছে আমাকে। পার্টীচীফ যখন বলছে, সেটা তো আর অনুরোধ নয়, হুকুম, সুতরাং যেতেই হবে। কিন্তু, সত্যি করে তো আর কিছু সোয়া ঘন্টার পথ নয়, কলকাতা থেকে ত্রিপুরার দক্ষিণপ্রান্ত, হিসেব মত দু হাজার কিলমিটারের ওপর। দুই দুটো জীপ, পেছনে ট্রেলারে ভর্তি যন্ত্রপাতি, তাঁবু, খাটিয়া মায় বিছানা পর্যন্ত, মাক্সিমাম স্পীড উঠবে চল্লিশ। দিনে দুশো কিলোমিটার গেলে মোট লাগবে দশ এগারো দিন, তাও যদি গাড়ী ঠিকঠাক চলে। নাহলে খোদায় মালুম কবে পৌঁছাবো।
তাও নাহয় হলো, কিন্তু সঙ্গে যাবে কে? ড্রাইভার তিওয়ারীজী আর জোরা সিং এবং অ্যাটেন্ডেন্ট ভুট্টিপ্রসাদ। অন্য একজন অফিসার কই? আর কেউ নেই, তোমাকেই সামলাতে হবে দুটো গাড়ী। যাব্বাবা! রাস্তাঘাটে কিছু বিপদ আপদ হলে কি হবে? আপদ বিপদ কিছু হবে না, গাড়ী দুটো টনাট্টন সারানো আছে। প্লীস্ পিনাকী, আর কেউ নেই আমার হাতে!
মানে? আমি ওর হাতে আছি? আহ্লাদের ঘনঘটা আর কি! আমাকে পেয়েছে কি ও? আর, এই তো গাড়ী সারানোর নমুনা! প্রথম দিনে বারাসাত পৌঁছতেই দুপুর গড়িয়ে গেল। তিওয়ারীজীর গাড়ী “মৌসম পাকড়তিহী নহী।” অনেক হাঁচোড়পাঁচোড় করে বুঝলাম মৌসম মানে মোশন, সাদা বাংলায় গাড়ী পিকআপ নিচ্ছে না। আমরা যতক্ষণ চাঁপাডালির মোড়ে পাইস হোটেলে ডালভাত খেলাম, তিওয়ারীজী গাড়ীর মৌসম ঠিক করলেন। তারপর সন্ধ্যেবেলা মধ্যাহ্নভোজন করলেন তিনি। বহু কষ্টে বহরমপুর পৌঁছলাম মাঝরাতে।
প্রথম দিনের ধাক্কায় পরের দিন দেরী হয়ে গেল বেরোতে বেরোতে। বহরমপুর থেকে লালগোলা, ফরাক্কা, মালদা হয়েরায়গঞ্জ এসে সব্বাই ক্লান্ত। থেকে গেলাম রায়গঞ্জ ডাকবাংলোতে। পরের দিন রায়গঞ্জ থেকে বেরিয়ে ইসলামপুর সবে পেরিয়েছি আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে, এমন সময়ে ঘটংঘট করে গাড়ী ফুলস্টপ। আশীর্বাদের ব্যাপারটা হাল্কাভাবে নেবেন না। যাঁরা রাস্তাঘাটে যাতায়াত করেন তাঁরা বুঝবেন ইন্টারস্টেট বাউন্ডারি একবার এপার একবার ওপার করা কি যন্তর জিনিস! আর এই ঘটনাটা ঘটে ডালখোলা থেকে কিষাণগঞ্জ হয়ে ইসলামপুরের পথে দুই দুবার। সারা পৃথিবীর যত ট্রাক, টেম্পো, ঠেলাগাড়ী – সব দাঁড়িয়ে থাকে বর্ডার চেকপোস্টে – লাইন দিয়ে নয়, জট পাকিয়ে। সেই যানজট দুবার করে ঠেলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি সবে, এমন সময় “রেডিওয়াটার লীক হোগয়া।” এটা অবশ্য অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য রোগ। রেডিয়েটর লিক করে জল সব বেরিয়ে গেছে। তা মাঝরাস্তায় রেডিয়েটর ঝালাইমিস্ত্রী কোথায় পাই? জোরা সিংএর জীপটাকে ট্রেলারমুক্ত করে মিস্ত্রী আনতে পাঠাবো নাকি? তিওয়ারীজী পরম আশ্বাসে বললেন, “হজৌর, ঘাবড়াইয়ে মত, অভী দুরুস্ত কর দেতে হেঁ।”
নিজের কালো রঙের একটা টয়লেট ব্যাগ থেকে ঝপ করে বের করলেন একটা কাপড় কাচার ৫০১ বার সাবান। ছুরি দিয়ে তার একটা টুকরো কেটে নিয়ে, অল্প জল দিয়ে টিপেটুপে সেটাকে একটা নরম পুট্টি বানিয়ে ফেলে যেখানে যেখানে লিক বলে সন্দেহ ছিল সেখানে নিপুণ হাতে তাপ্পি দিয়ে দিলেন। আমি তাজ্জব! তারপর একটা জেরিক্যানে এইরকম সম্ভাবনার কথা ভেবেই বোধহয় জমিয়ে রাখা জল দিয়ে “রেডিওয়াটার” আবার শূন্য হতে পূর্ণ হল, এবং অচল গাড়ী আবার সচল হোলো। কিন্তু দশ-বারো কিলোমিটার যেতে না যেতেই আবার লিক, আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। এই উপর্যূপরি যন্ত্রনার হাত থেকে মুক্তি শিলিগুড়ি পৌঁছে, ফাটা রেডিওয়াটার ঝালাই করিয়ে।
শিলিগুড়ি থেকে গোঁসাইগাঁও তিওয়ারীজীর গাড়ী কোনোরকম বেগড়বাঁই করে নি। রাস্তায় গুচ্ছ গুচ্ছ নদী, আমি মনে মনে স্কুলের ভূগোল বইএর পাতায় ডুব দিয়ে মহানন্দা, তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, রায়ডাক গুণতে গুণতে চলেছিলাম। কিন্তু তখনই এল জোরা সিংএর পালা। তার জীপের ট্রেলার টানার হূক-ব্লকটার “রিপিট” গেল কেটে, হাসিমারার কাছাকাছি। এটার আর কোন টোটকা দাবাই হয় না। ট্রেলার খুলে জোরা সিং ভুট্টিকে সাথে নিয়ে গিয়ে রিভেট করিয়ে আনল কোথার থেকে যেন, ঠিক মনে নেই। আমার যা মনে আছে তা হোলো গভীর জঙ্গলের মধ্যে থেকে হঠাৎ হঠাৎ কানফাটা শব্দ তুলে জোড়ায় জোড়ায় যুদ্ধবিমান মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো, আর আমি হাঁ করে তাদের ডেলটা উইং আর নোজকোন দেখে এরা মিগের কোন প্রজাতী বোঝার চেষ্টামাত্র করছিলাম।
রিভেট করে আসতে আসতে দেরী হয়ে গেল, আর তাই আমরাও মেরেকেটে বড়পেটা ডাকবাংলো পর্যন্ত পৌঁছলাম রাত আটটায়। মাঝখানে গোঁসাইগাঁওএ আসামের সীমানা শুরু। সেখানে সব কাজও হয় লাহে লাহে (মানে আস্তে ধীরে)। জীপের সামনে “ভারত সরকার” লেখাটা আবার ওই মুল্লুকে ব্যাকফায়ার করতো সেই যুগে। সে যাইহোক, বড়পেটা জায়গাটা বড়ই মনোরম। একবার ভেবেছিলাম শেষজীবনে বড়পেটায় একটা ছোট্ট কাঠের বাড়ি বানিয়ে থাকব। পাশে নদী, পেছনে ভুটানের হিমালয় পাহাড় আর নীল জঙ্গল, সামনে সবুজ মাঠ। ভাগ্যিস আজকাল আর ভাবি না!
পরদিন বড়পেটা ছেড়ে গৌহাটীর পথে রঙ্গিয়ায় দেখা হলো ব্রহ্মপুত্রের সাথে। আর জীপ তাই দেখে চিত্রার্পিতের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। তিওয়ারীজীর কম্পাউন্ডারি বিদ্যেতে এবার আর কুলালো না। ভালো জীপটা প্রথমে খারাপটাকে টেনে নিয়ে গেলো গৌহাটীতে মাহিন্দ্রা ওয়ার্কশপএ, তারপর একে একে দুটো ট্রেলারকে টেনে নিয়ে এলো গৌহাটীর একটা হোটেলে। রাত কাটলো দুশ্চিন্তায় আর বদহজমে।
পরদিন সক্কালবেলা ভগ্নদূতের মতো তিওয়ারীজী এলেন হোটেলে, জানালেন যে জীপের “ইলিক্ট্রিক ফায়ার ফুঁক গয়া”... ইলেকট্রিকের আগুণ, মানে স্পার্ক প্লাগের কো্নো গন্ডগোল? আরে নহী সাহাব, তিওয়ারীজী আমাকে বোঝানোর আশা অনেক আগেই ত্যাগ করেছেন বোঝা গেল, পকেট থেকে একটা ছোট্ট তেঁতুলেবিছে টাইপের দাঁড়াওয়ালা কি যেন বের করে আমার হাতে দিলেন। তখন বয়েস কম, চোখের তেজ বেশী, দেখলাম ক্ষুদে ক্ষুদে হরফে লেখা আছে লুকাস আরসিটি ১২ভি এসি। বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে একটা প্রশ্ন এল, বললাম, এটা কি অলটারনেটারের রেক্টিফায়ার? এক প্রশ্নে আমার হৃত সম্মান পুনরূদ্ধার হয়ে গেলো। সসম্ভ্রমে তিওয়ারীজী বললেন, জী হজৌর!
সেই যে গাড়ী ঠিক হলো, তারপর গৌহাটী থেকে জোড়াবাট, উমস্নিং, শিলং, জোয়াই হয়ে বদরপুর টপকে নীলমবাজার থেকে ধর্মনগর যাবার পথে আর কোন ঝামেলা হয় নি। সেটা হতে হোল শেষমেশ এই উগ্রপন্থীদের আড্ডা বারোমূড়ায়? আগরতলা আর মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার দূর, জানাচ্ছে আমার নীচে থেকে এই মাইলস্টোনটা!
কি করে পার পেলাম সে যাত্রা? কিভাবে পৌঁছলাম কাঁঠালিয়া? আদৌ পৌঁছলাম কি? আর না পৌঁছালেই বা ক্ষতি কি? সে সব প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসলে রাত কাবার হয়ে যাবে। অন্য কোনোদিন হবে, যদি আপনারা সত্যিই জানতে চান। কিন্তু একটা কথা আজ বলা দরকার, সেটা হোল এই গল্পের নামের সাথে গল্পটার সম্পর্কের কথা।
এই ঘটনার সাত বছর পরে আমি ফিরেছি তিওয়ারীজীর সাথে, মিজোরাম থেকে। ফিরেই হাতে পেলাম ট্রান্সফার অর্ডার। যেতে হবে বোম্বে উপকূলে, আরব সাগরের মাঝে তেলের সন্ধানে। সেই সময়ে বোম্বে হাই দৈত্যপ্রায় তেলের খনী, দেশবাসী মাত্রেই এর নাম জানেন। সেই অঞ্চলে কাজ করতে পাওয়া ভাগ্যের কথা। সহকর্মীরা সবাই ব্যাজার, ফিল্ডপার্টীর কাজে সবাই এক পরিবারভুক্ত হয়ে কাজ করেন, তাই কারুর যাওয়াটাই সহজে মেনে নেন না। কিন্তু বোম্বে হাই বলে কথা!
বিদায়ী অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। সবাই একে একে ভাষণ দিলেন, আমার নিজের গুণপনার কথা নিজের কানে শুনতে শুনতে আমার মত নির্লজ্জেরও কান লাল হলো। আমাকে যিনি এতদিনে সবচেয়ে ভাল করে চিনেছেন, সেই তিওয়ারীজী বলতে উঠলেন সবার শেষে। পাত্থর থেকে ইঞ্জিন পর্যন্ত সব ব্যাপারে আমার জ্ঞানের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি জানালেন যে আমি যেরকম আসাম থেকে ত্রিপুরা, সর্বত্র সুনাম অর্জন করেছি, তিনি আশা করছেন যে বোম্বে হাইওয়েতেও আমি ততটাই কর্মদক্ষতা দেখাতে পারব!
অভিজ্ঞ ড্রাইভার মানুষ, বোম্বে হাই কে বোম্বে হাইওয়ে করে নিয়েছিলেন নিজগুণে!
বয়োজ্যেষ্ঠ তিওয়ারীজীর আশীর্বাদে আর আপনাদের শুভেচ্ছায় আমি কিন্তু পেরেছি!ওই কর্মদক্ষতা দেখাতে, আর কি!
দুরন্ত স্মৃতিচারণ, মন ছোঁয়া আর মন ভালো করা লেখা...
উত্তরমুছুনপিনাকি চক্রবর্তীর তূণে অনেক তীর । এবং এই তীরন্দাজের কোনও তীরই ব্যর্থলক্ষ্য হয় না । আগামীতে আরও চাই ।
উত্তরমুছুনতোমার সাফল্য আমার গর্ব......নিজের ই পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে করছে এখন......thank you, go.......
উত্তরমুছুন