ছোটগল্প - নারায়্ণ রায়

হাই ফাই বাবু
নারায়ণ রায়


এমন আন্তর্যাতিক নামের একটা অফিসের ভিতরে এই অবস্থা? ছাদ, দেয়াল অতীব ভাঙ্গাচোরা, সাধারণ ইট বিছানো মেঝে। চেয়ার টেবিল আলমারীর অবস্থা কহতব্য নয়। যে দুটি বহুতল বাড়ি আছে তাদেরও অবস্থা তথৈবচ, ছাজা, জানালার কাঁচ এবং পাল্লা বেশীর ভাগই ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে। আবার অন্যদিক দিয়ে চিন্তা করলে, কলকাতা শহরের উপকন্ঠে এমন গাছ-পালা, পুকুর, চারিদিকে এমন সবুজ প্রান্তর, এহেন একটা প্রকৃতিক পরিবেশের ভিতর অফিস? ভাবাই যায় না। আসলে শহররের এক প্রান্তে একটা পুরানোদিনের জমিদার বাড়িতে এই অফিস। প্লাবন মজুমদার আজ নিয়ে দুইদিন এই অফিসে এল। প্রথম দিন সংবাদ পত্রের বিজ্ঞাপন দেখে ওর নিজের চাকরীর একটা দরখাস্ত জমা দিতে এসে ছিল, আর আজ তার মাস দুই পরে ঐ চাকরীর পরীক্ষা দিতে আসা। একটা নোটিস দেয়া আছে, Candidates for the post of Junior Engineers are requested to……. কিন্তু পড়াটা শেষ করার আগেই এক বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোক হটাৎ যেন মাটি ফুড়ে উঠে এলেন, সৌম দর্শন ঐ ভদ্রলোক খুবই কায়দা করে নোটিশ বোর্ডে লেখা কথাগুলো গড় গড় করে নিজস্ব ভঙ্গিমার ইংরাজীতে মুখস্ত বলে গেলেন। প্লাবন ভাবলো ইনি নিশ্চই এই অফিসের কোন উচ্চ পদস্থ অফিসার হবেন। আর পাঁচজনের মত প্লাবনও তাঁর পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে বলে লাগলো , “স্যার, এই ১৪ নম্বর ঘরটি কোন দিকে ?” ভদ্রলোক খবই চটপটে, মুখে বাংলার চেয়ে ইংরাজী বলতেই বেশি পারঙ্গম বলে মনে হ’ল। তিনি মুখে যথেস্ট গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, “You just follow me.” দোতলায় পাশা পাশি দুটো ক্লাশ রুমে ১৪ ও ১৫ যথারীতি ১০টায় পরীক্ষা শুরু হল। পরীক্ষা চলার সময় পরীক্ষা তদারকির কাজে প্রায় দশ-বারো জন ব্যক্তি উপস্থিত থাকলেও পুরো ববস্থ্যাটাই ওই সৌম দর্শন ভদ্রলোক একাই নিয়ন্ত্রন করছিলেন। কখনও ডানদিক থেকে বাম দিকে দৌড়চ্ছিলেন তো কখনও বাম থেকে ডাইনে। মাঝে মাঝে বিনা কারনেই খানিক চিৎকার করে নিচ্ছিলেন, “You 2nd row pleaze don’t look behind” কখনওবা “Half an hour more….” অবজেকটিভ টাইপ কোশ্চেন, প্লাবনের পরীক্ষা ভালো হয়েছে বললে কম বলা হবে খুবই ভালো হয়েছে। অবশেষে সেই চুড়ান্ত মূহুর্ত…. ঠিক বেলা বারোটায় পরীক্ষার শেষ ঘন্টা বাজলো। “Canditates are request to submit their papers”….. “Attention please…and one important announcement… Result of this exam will be declared at 4 pm right today….hence interested candidates may wait for their result….Our office canteen will remain open for you only upto 4 pm. প্লাবনের সঙ্গে ওর এক কলেজ মেট-এর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, চাকরীর পরীক্ষাগুলো অনেক সময়েই বেশ রি-ইউনিয়নের কাজ করে দুজনে মিলে ভদ্রলোকের নাম দিল হাই-ফাই বাবু। ওই হাই-ফাইবাবু তখনও ইংরাজীতে বক বক করেই চলেছেন। আর ৪টে পর্যন্ত সময় কাটানোর জন্য দুজনে ঠিক করল …. পাশের অনন্যা বলে একটা হলে ১-৪টে সিনেমা দেখে সময়টা কাটাবে, আর যেমন ভাবা তেমনই কাজ। অফিস ক্যান্টিনে কিছু খাওয়া দাওয়া করে দুজনে গেল সিনেমা দেখতে। সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে ৪টের সময়ে রেজাল্ট দেখতে গিয়ে দেখলো ১ নম্বরের নামটাই প্লাবন মজুমদার।

সময়মত ইন্টারভিউ-ও হয়ে গেল। প্লাবন খবর পেল লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা মিলিয়েও প্লাবন এক নম্বরেই আছে। আর সেদিনও হাই-ফাই বাবু সমানে তাঁর উপস্থিতি জানান দিয়ে গেলেন। …. হটাৎ কোথা থেকে ভুঁইফোড়ের মত উদয় হয়ে হাই বলে চিৎকার করে উঠলেন, “You boys, wish your best of luck! See you soon.”

আজ প্লাবন এসেছে চাকরীতে জয়েন করতে। ইতিপূর্বে প্লাবন আরও দুটি সরকারী অফিসে চাকরী করছে কিন্তু সেইসব অফিসের পরিবেশ যেন অনেক উন্নত ছিল। তাহলে কি কোন ভূল সিদ্ধান্ত নিল প্লাবন? যাই হোক এ ঘর ওঘর ঘুরে শেষে পার্শোনেল ডিপার্টমেন্টে পৌছে এক ভদ্রলোককে প্লাবন অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার টা দেখিয়ে জিগ্যেস করলো, “এই ব্যাপারে কার সঙ্গে দেখা করতে হবে একটু বলবেন?” ভদ্রলোক তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন “ওই পাশের ঘরে দেখুন এক সুপুরুষ ভদ্রলোক বসে আছেন, ওনাকে জিগ্যেস করুন।” প্লাবন ওই ঘরটিতে ঢুকে তেমন কাউকে না দেখতে পেয়ে যখন ইতস্তত করছে তখন ওই ঘরে উপস্থিত একমাত্র ভদ্রলোক বেশ শীর্ণ, ঘোরতর কৃষ্ণ বর্ণের এক বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোক ওকে নিজে থেকে ডেকে ব্যাপারটা বুঝে নিলেন এবং তাঁর তরফের যেটুকু কাজ করার ছিল সেটা করে দিয়ে জানালার দিকে হাত বাড়িয়ে একটা ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “ওইটা ইন্জিনিয়ারিং অফিস, এবার ওখানে গিয়ে রিপোর্ট করুন।” ইন্জিনিয়ারিং অফিসে ঢুকেই প্লাবন অবাক, সেই হাই-ফাইবাবু! “Hallo, Mr. Majumder, we are waiting for you…. Don’t worry, you just give me your joining report and I will arrange everything.” এ কথা বলে হাই-ফাইবাবু অফিস থেকে সাঁ করে বেরিয়ে কোথায় চলে গেলেন। ইতিমধ্যে অফিসের বড়বাবুর সঙ্গে আলাপ হ’ল। তিনিই চাকরীতে জয়েন করতে যথেষ্ট সাহায্য করলেন এবং সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার জন্য প্লাবনকে সাহেবের ঘরে নিয়ে গেলেন। “স্যার, ইনি আমাদের নতুন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়র প্লাবন মজুমদার।” স্যার গম্ভীর ভাবে মুখটা তুলে বললেন, “হ্যা, ইন্টারভিউ বোর্ডে তো আলাপ হয়েছে।” প্লাবনেরও মনে পড়ল উনি ইন্টারভিউ বোর্ডে ঠিক ডানদিকের শেষ চেয়ারটায় বসেছিলেন এবং বেশ সহানুভুতি সম্পন্ন ব্যবহার করেছিলেন। এর পর সাহেব বড়বাবুকে বললেন, “আপনি, প্লাবনকে সজলবাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে সজলবাবুকে বলুন আজ ওনাকে আমাদের অফিস সাইটটা ভালো করে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিতে।” বড়বাবু প্লাবনকে তাঁর নিজের ঘরে নিয়ে বসতে বললেন। তারপর অফিসের এক কর্মীকে বললেন সজল বাবুকে ডাকতে। এরপর বড়বাবু তাঁর গলার স্বরটা বেশ কিছুটা নামিয়ে বললেন, “আপনাকে একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি, সজল গড়াই, আমাদের এই অফিসের একজন সুপারভাইজিং স্টাফ, তবে তার আগে আপনাকে একটা কথা বলে রাখি। সজলবাবু উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ নিউরোপ্যাথিক ব্লাড সুগারের রোগী, এই রোগীদের মস্তিস্ক সর্বদা চঞ্চল থাকে। ফলে বড্ড বেশী কথা বলেন, আর ওনার ব্যক্তিগত একটা প্রবলেম হচ্ছে ওনার ধারণা, উনি ইংরাজীতে কথা বললে সবার কাছে উনি বেশী গুরুত্ব পাবেন। তাছাড়া সম্প্রতি ওনার একমাত্র সন্তান চলে যাওয়ার পর উনি একটু বেশী রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।” আর ঠিক সেই সময়ে দরজার পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকে হাই-ফাই বাবু বললেন, “Hallo… all the formalities must be over, then lets have a move in the campus.”


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন