ছোটগল্প - হিরণময় মজুমদার

ব্যাধি
হিরণময়  মজুমদার


দুলি সাঁওতাল মেয়ে আঠাশ তিরিশ বয়েস । নিঠোল কর্মঠ যৌবন । তেল পিছলানো কালো গায়ের রঙ । দুলি যখন অ্যাঁটো করে খোপা বেঁধে তাতে পলাশ গুঁজে হাটেবাজারে যায় । গায়ের পুরুষগুলো হাঁ করে তাকিয়ে থাকে । দুলির কোমর যেন জল ভর্তি কলসি । ছলাৎ ছলাৎ করে । অল্প বয়েসে শিবুর সাথে বিয়ে হয় দুলির । রঙ করে বিয়ে । গাঁয়ের সেরা পুরুষ ছিল শিবু । পাথরে খোদাই করা মূর্তি ।সাহসী এক পুরুষ । দিনের শেষে মহুয়া খেয়ে যখন দুলির কোমর জড়িয়ে ধরতো তখন মাতাল হতো দুলি । ভালবাসত মরদটা ওকে । তিন কূলে কেউ ছিল না শিবুর । একদিন দুলি ঘরণী হয়ে এলো শিবুর অগোছালো ভাঙ্গা ঘরে , দুলির হাতের স্পর্শে সেই ভাঙা ঘর হয়ে উঠল পরিপূর্ণ সংসার । নিকানো উঠান , মাটির দেওয়ালে নক্সা , সামনের একফালি জমিতে সবজি আর ফুলের গাছ ।

বীরভূমের এক সাঁওতাল গ্রামে বাস তাদের ।দুলির কোলে এলো চন্দ্রা । অনেক সখ করে নাম রাখল শিবু । সব যেন সাজান স্বপ্ন । বছর পাঁচেক ঘুরতে না ঘুরতে শিবু মারা গেল দিন সাতেকের জ্বরে । অনেক সেবা করেছিল দুলি । কিন্তু ভবিতব্য , বিধবা হল সে ,স্বপ্ন ভাঙল । তারপর থেকে চন্দ্রাকে নিয়ে সংসার । গাঁয়ের মরদগুলো রঙ করতে চায় তার সাথে । ভাগিয়ে দেয় ওদের বেশ কঠোর ভাবেই । মাতব্বর রা বলে আবার সাঙ্গা কর । দুলি এরিয়ে যায় । সে গ্রামের মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য । আঁচার পাঁপড় বানায় বেতের ঝুড়ি বোনে ।তার বানানো আঁচার পাঁপড় যে খায় সেই বলে বেশ । তার হাতে তৈরী বেতের ঝুড়ি সবার আগে বিকোয় । তার একমাত্র স্বপ্ন চন্দ্রা, স্কুলে যাবে , বড় হবে । চন্দ্রার বয়স আট বছর ।



পরেশ সোরেন , বছর চল্লিশেক বয়েস । কাঁচাপাকা চুল । পরিণত অবিবাহিত মুখ । মুখে স্মিত হাসি সবসময় । গায়ের রং টা প্রায় ফরসার দিকে । শোনা যায় পরেশের মায়ের সাথে পরেশের জন্মের আগে এক শহুরে বাবুর প্রেম পিরীত হয়েছিল । পরেশের ব্যবহার শিক্ষা বুদ্ধি এসবের জন্য গ্রামের অনেকেই তাকে মানেগোনে । অনেকেই তার কাছে শলাপরামর্শ নেয় । পরেশ গ্রামের স্বনির্ভর গোষ্ঠী চালায় । সেই সূত্রে কলকাতায় যায় । অনেক উপরতলার মানুষের সাথে তার সখ্যতা ।



দুলি মাঝে মাঝেই গোষ্ঠীতে আসে । পরেশ পছন্দ করে দুলিকে একটু বেশী । দুলির মুখের হাসির সাথে সুক্ষ বিষাদ তার ব্যক্তিত্বকে বাড়িয়েছে ।দুলি আর পাঁচটা সাধারণ সাঁওতাল মেয়ে হয়েও যেন সাধারণ নয় । দুলির কাছে পরেশ যেন ভগবান । তার কথা বেদবাক্য । শিবু মরার পর সেই দুলিকে নতুন জীবনের আলো দেখিয়েছে । পরেশের স্মিত হাসি আর উজ্জ্বল চোখে দুলি খুঁজে পায় পরম নির্ভরতা । ঐ চোখ অন্য পুরুষদের মত তার শরীরের আনাচে কানাচে ঘোরে না । পরম মমতা নিয়ে পরেশ দুলির চোখে চোখ রাখে । মিতে পাতায় তারা । কুলোকে কুকথা বলে । এসব দুলিকে ছোঁয় না ।



অমিত মুখার্জী বয়স ৪০ - ৪২ নামকরা চিত্র পরিচালক । সিনেমাপ্রেমীরা তার একনিষ্ঠ ভক্ত । একের পর এক ভিন্নধর্মী ভিন্নস্বাদের ছবি উপহার দিয়ে বাংলা সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছে । বড় রুক্ষ স্বভাবের ইনি । কাট কাট কথাবার্তা । পরোয়া করেনা কোন কিছু । থাকেন বালিগঞ্জ প্লেসে । সুবিশাল ফ্ল্যাট , একলা মানুষ , বড় অগোছালো । যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েসন শেষ করে ফিল্ম নিয়ে পড়াশুনা শুরু করে পুনে ফিল্ম ইন্সিটিউটে । পুনেতে দেখা হয় মৈত্রেয়ীর সাথে ।প্রথম দর্শনেই প্রেম । তারপর তুমুল প্রেম । কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে । বিয়ের ছমাসের মধ্যে মৈত্রেয়ী ছেড়ে চলে যায় অমিতকে । যাওয়ার সময় বলে যায় তুমি কোনদিন কাউকে ভালবাসবে না । তারপর থেকে অমিতের জীবন শুধুই সিনেমা আর সিনেমা । জীবনে বহু নারী সংসর্গ করেছে কিন্তু বোধহয় কাউকেই ভালবাসেনি । মৈত্রেয়ী কথাটা এখনো কানে লেগে আছে । আপাত দৃষ্টিতে ভীষণ রুক্ষ এই মানুষটি । কিন্তু ভেতরে একটা নরম মন আছে । বিভিন্ন সেবাপ্রতিষ্টান এবং স্কুলগুলোতেই প্রতি বছর একটা মোটা অঙ্কের টাকা দান করেন । কিছু গরিব শিশুর ভরনপোষণের দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন ।সেই সুত্রেই পরেশের সাথে আলাপ । তবে এই বিষয়ে প্রচার বিমুখ মানুষ অমিত মুখার্জী । অমিত আর পরেশের মধ্যে এর গভীর হৃদ্যতা আছে ।



অমিত মুখার্জী অসুস্থ । পরীক্ষা নিরীক্ষায় জানা গেল উনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত । ওষুধ পথ্য এবং সেবার প্রয়োজন । উনি উচ্চবিত্ত, পয়সার অভাব নেই । কিন্তু একজন নিজের মানুষ যে নিজের মত করে একটু সেবা করবে তার বড় অভাব । নার্স দিয়ে অসাব কাজ হয় না । খবর পেয়ে পরেশ এলো দেখা করতে । গুণী মানুষটাকে এই অবস্থায় দেখে বড় কষ্ট পেল পরেশ । ফিরে এসে পরেশ দুলিকে বলে অমিত মুখার্জীর শুশ্রষার দায়িত্ব নিতে । পরেশ সোরেন এর একটি অবৈতনিক স্কুল আছে , সেখানে গ্রামের বাচ্চারা পড়ে ।স্কুলটি চলে সরকারি এবং কিছু মানুষের অনুদানে । পরেশ দুলিকে বলে চন্দ্রার এযাবৎ পড়াশোনার খরচের দায়িত্ব নিয়েছেন অমিত মুখার্জী । দুলি রাজী হয় । কয়েকদিনের মধ্যে দুলি তার ছোট্ট পুটুলি নিয়ে পরেশের সাথে রওনা দেয় । পরেশ অমিত মুখার্জীর বাড়িতে দুলিকে রেখে চলে আসে ।



দুলির হাতের স্পর্শে একটু একটু করে ভাল হয়ে উঠতে থাকে । দুলির হাতের ছোঁয়ায় অগোছালো বাড়িটা ঘর হয়ে যায় । প্রতিটা মুহূর্তে দুলি আগলে থাকে অমিত মুখার্জীকে । তার সন্তানের এই পালকপিতাকে , অনেকদিন পর দুলির খুব মনে পড়ছে শিবুকে । শিবুর মৃত্যুর পরে সে আর কোন পুরুষের কাছাকাছি আসেনি । দুলি ভালবাসল এই আপাত রুক্ষ মানুষটাকে । আর অমিত মুখার্জী খুব অভ্যস্ত ভাবে দুলির সেবাটুকু নেয় যেন সেতা তার পাওনা । কয়েকমাসের মধ্যে অমিত ভাল হয়ে উঠে । সম্পূর্ণ সুস্থ । এবার নিজে থেকে বিদায় দেয় দুলিকে অমিত । ধন্যবাদ দিয়ে বেশকিছু টাকা দিতে চায় দুলিকে । বড় অভিমান হয় অমিতের উপর , নিজের উপর । মরে যাওয়া স্বামীর উপর , সারা পৃথিবীর উপর । ম্লান হেসে টাকা ফিরিয়ে দেয় এবং ফিরে আসে গ্রামে ।



দুলি ফিরে আসে নিজের পুরোন জীবনযাত্রায় ফেরে । চন্দ্রা এতদিন পরেশের কাছে ছিল । চন্দ্রা আর দুলির সংসার চলে আগের মতই । কিন্তু দুলির মনে বড় বিষাদ । কিছুদিন পর দুলির জ্বর হয় । কোনকিছুতেই জ্বর সারে না । স্বাস্থকেন্দ্রে গিয়ে রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় দুলি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছে । অমিত মুখার্জী ভাল হয়ে উঠেছে কিন্তু এই ছোঁয়াচে রোগের শিকার হল দুলি । ভালবাসার বিষ এসে বাধা বেঁধেছে দুলির গরিব ঘরে । ওতো দামী পথ্য পাবে কোথায় । তবুও সেই ভাবেই চললো চিকিৎসা । পরেশ চায় অমিত মুখার্জীকে খবর দিতে । দুলি না করে দেয় । পরেশ পাশে থাকে দুলির ।



ওদিকে অমিত মুখার্জী পুনরায় ফিরে গেছে role sound camera action র জগতে । চূড়ান্ত ব্যস্ততা । কিন্তু বাড়ি ফিরে নিজের মনের ভুলেই দুলিকে ডেকে ফেলে । পরে বুঝতে পারে নিজের মনের ভুল । চুপচাপ বসে থাকে study room র easy চেয়ারটায় । অনেক ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে অমিত । ঠিক মনে নেই । তারপর মৈত্রেয়ী র চলে যাওয়া । এরপর তার জীবনে যত নারী এসেছে কেউই শরীরের বাইরে আসতে পারিনি । কিন্তু দুলির গভীর কালো নীরব চোখ অক্লান্ত সেবা সবকিছুই তার মাকে মনে করাতে থাকে । নারীর এই মাতৃমূর্তির স্বাদ সে কক্ষনও পায়নি । অমিতের কাছে দুলি নেই এখন । দুলির অনুপস্থিতি তাকে কুরে কুরে খেতে থাকে । দিন যায় মাস যায় বছর ঘোরে অমিতের চঞ্চলতা বাড়তে থাকে । কিন্তু আশ্চর্য অমিত দুলিকে ভালবেসেছে ।

ভালবাসার বোধের সাথে সাথে অমিত আর এক মুহূর্ত টিকতে পারল না ছুটে চলে গেল বীরভূমের সেই গ্রামে যেখানে দুলি থাকে ।

পাগলের মত ছুটে চলেছে সে । যেভাবেই হোক দুলিকে ফিরিয়ে আনবে , সস্মানে প্রতিষ্ঠা করবে নিজের বাড়িতে । গ্রামে গিয়ে সবার আগে দেখা করল হরেনের সাথে ।দুলির ঠিকানা জানার জন্য । চমকে উঠল , হরেন জানায় দুলি মারা গেছে অমিতের কাছ থেকেই রাজরোগে আক্রান্ত হয়ে । নিবিড় অভিমানে অমিতকে জানাতে চাইনি দুলি । তার মেয়ে চন্দ্রাকে দিয়ে গেছে তার হেফাজতে । পাথরের মত বসে থাকে অমিত । অনেকক্ষণ পর অমিত দেখতে চায় চন্দ্রাকে । হরেন চন্দ্রাকে ডেকে পাঠায় , অমিত দেখে ঠিক যেন ছোট্ট দুলি দাঁড়িয়ে আছে , অমিত চন্দ্রাকে ভিক্ষা চায় হরেনের কাছে । অমিত বলে চন্দ্রাকে নিজের নাম দিয়ে সন্তানস্নেহে বড় করে তুলবেন । দুলির স্বপ্নকে সত্যি করে তুলবে । হরেন স্মিত হেসে বলে নিয়ে যাও ওর উপর একমাত্র তোমার অধিকার ।






2 মতামত: