ছোটগল্প - দেবাশিস কাঞ্জিলাল

সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে
দেবাশিস কাঞ্জিলাল



হাঁপাতে হাঁপাতে অমলবাবু অফিসে এসেই ঢুকলেন আমার ঘরে । খুব লজ্জিতভাবে বললেন, আজও বড্ড দেরী হয়ে গেল স্যার, আসলে এতদিক সামলে আসতে হয়, কিছুতেই পেরে উঠি না ! ঘর্মাক্ত ভদ্রলোককে দেখে মায়া হচ্ছিল, বসতে বললাম । দ্বিধা করে বসলেন সামনের চেয়ারে ।

আমার জলের বোতলটা এগিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক কুন্ঠিত হয়ে জল খেলেন। এবারে উঠতে যাচ্ছেন,বললাম,আপনি আমাকে একটু বলুন তো, সংসারের সব কাজ কি আপনাকে একাই সারতে হয় ?

-- না না, আমার স্ত্রীই তো স্যার সবদিক সামলান সংসারের, আমি শুধু সব বাইরের কাজ, এই যেমন বাজার-হাট, ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, তাকে পড়ানো,এইসব করি ! সংসারের আসল সব ঝক্কি-ঝামেলা সবই আমার স্ত্রীই সামলান!'

-- শুনুন অমল বাবু, আপনাকে কয়েকটি কথা বলি ! মহিলারা সংসার সামলাবেন, এ' এক স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা ! এ যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে, চলবেও ! সব সময়ে মনে রাখবেন, গৃহিনীরাই গৃহকে শোভিত করেন ! এ সংসার-রাজ্যে তাঁরা হলেন গৃহমন্ত্রী, স্বগৃহে-স্বরাট ! আর আমরা হলাম সেখানে বিদেশ ও প্রতিরক্ষা-মন্ত্রী ! আমাদের কাজ হল, বাইরের সব জটিল ব্যাপারে ভালোভাবে নিজেদের অবহিত রেখে সম্ভাব্য প্রতিকূলতা থেকে গৃহিনীদের রক্ষা করা !

যেমন ধরুন, আমাদের পরবর্তী সংস্কৃতি-মন্ত্রীর ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক হলে চলবে কিনা, সৌরভকে ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত করার কুশীলবেরাই তাকে ফুটবলের দল বানাতে প্ররোচিত করছে কিনা,কবি জয়দেব আসলে বাঙ্গালী না ওড়িয়া ছিলেন,চাঁদে জমির দাম কত, মঙ্গলে জলের আনবিক গঠন কি, সাহারা-মরুভূমিতে যে আবাসন প্রকল্প হবে তাতে ফ্ল্যাট নিতে হলে সেই মরু-শ্রী লোকটিকে টাকা কোর্টের মাধ্যমে দিতে হবে কিনা, এই সব জরুরী বিষয়ে সচেতন থাকা যাতে আমাদের গৃহিনীদের এইসব বড়ো ব্যাপারে বিব্রত না হতে হয় ।

আমি তাই সারা সকালে ধরে কাগজ পড়ে এইসব বিষয়ে নজর রাখি, তারপরে ধীরে সুস্থে ওই সব জটিল সমস্যাগুলি কোনমতে সামলে অফিসে চলে আসি। তাই আমার কখনো দেরী হয় না !

আর এই ভাবে সব বড়ো জটিল সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য নিজেরা মাথা ঘামিয়ে, তাঁদের ওই সব ছোট ছোট সাংসারিক কাজগুলি করতে দিলেই তাঁদের ভার আমরা যথেষ্ট কমাতে পারি ! তাই আপনিও বাজার-হাট, ছেলে-পড়ানো, সহায়িকা না এলে ঘর মোছা, রান্না করা,আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ, এইসব অকিঞ্চিৎকর তুচ্ছ কাজ থেকে দূরে থাকবেন, দেখবেন আর সময়ের কোন অভাব হবে না ।

এই আমাকে দেখুন না, আমার স্ত্রী সরকারের দায়িত্বপূর্ণ কাজ করেন। সকাল ন'টার আগেই চলে যান, কিন্তু ভোর চারটেতে উঠে সংসারের সব কাজ সারেন, আমাকে এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে ঢুকতেই দেন না ! তাঁর অফিস অভিমন্যুর ব্যূহের মত, প্রবেশের ঠিক আছে, কিন্তু নির্গমন অনিশ্চিত ! তবে মোটামুটি রাত ন'টার মধ্যেই ফেরেন সেখানে সব সামলে !

সেই রাত নটায় ফিরে তারপর আবার সংসারের তুচ্ছ সব কাজ সামলান। আর এই সময়ে আমি ফেসবুক বা মেল নিয়ে সবার সাথে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগে ব্যস্ত থাকি। আমি সংসারের কোন ব্যাপারেই নাক গলাই না ! শুধুমাত্র তিনি যা বলেন তাই শুনে চলি । আপনিও এই ভাবে চলুন, শান্তিতে থাকবেন !

আর একটি কথা বলি নারীজাতি হলেন দেবীর অংশ, তাঁদের ক্ষমতা অসীম, তাঁদের স্থিতিস্থাপকতা আমাদের চিন্তার অতীত । তাই তাঁদের দেবীর মত সম্মান দিয়ে তাঁদের মাথায় করে রাখবেন, তাঁতে তাঁরাও খুসি, আপনিও নিশ্চিন্ত ! ম্যানেজমেন্টের ভাষায় একেই বলে উইন-উইন সিচ্যুয়েসন !

মনে রাখবেন ,তাঁরা মানবাতীত শক্তি, সেখানে তাঁদের দেবীর মত মাথায় করে রাখাই আমাদের একমাত্র কাজ ! আপনি সত্যজিত রায়ের 'দেবী' সিনেমাটি আরেকবার দেখলে আরো ভালো করে ব্যাপারটি বুঝবেন । সাধে কি আর সেই প্রাচীনযুগ থেকে মুনি-ঋষিরা বলে এসেছেন সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে ! এ কথার অনেক গ্যূঢ়ার্থ আছে ! আচ্ছা এখন আসুন, আবার পরে কথা হবে !

অমলবাবু আমার দিকে এক বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলেন ! মনে হয় তাঁর অপরাধ বোধের বিব্রততার মাত্রা একটু কমানো গেল ।

আচ্ছা, সত্যি কি কমানো গেল ? নাকি আরো গুলিয়ে গেল ! কে জানে !


1 মতামত:

  1. এ শুধু গল্প নয়, এক শিক্ষাও বটে। ছোট ছোট ব্যাঙ্গ গুলো বড্ড ভালো, মনে দাগ কেটে যায়। সুন্দর ভাষা আর শব্দ প্রয়োগ করে যা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা দাদা করেছেন, তা সার্থক হয়েছে।

    নিজেকে এখন অমল ভেবে দেখছি যে কিছু অন্তত আমার গুলিয়ে যায়নি।

    উত্তরমুছুন