ছোটগল্প - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

মনড্রাইড
অরুণ চট্টোপাধ্যায়

কেউ বলেছে হতাশা, কেউ বলেছে সামাজিক অবক্ষয়ের ফল । কারণ যাই হোক, ফল তো একটাই । স্বামী-স্ত্রীর অশান্তির পরিণতিতে ডিভোর্স । ব্যর্থ প্রেমিক প্রেমিকার বা বাবা মায়ের বকুনি সহ্য করতে না পারা ছেলেমেয়েদের আত্মহত্যা । বাবার কথায় ঠোক্কর খাওয়া বেকার ছেলের ব্যোম মেরে যাওয়া কিংবা মায়ের ঠোকরানিতে বিপর্যস্ত মেয়ের অঝোর কান্না । পেনশন পাওয়া বাবা কিংবা ভবিষ্যতের এক চিলতে ফ্যামিলি পেনশনের আশায় চিন্তিত মায়েদের অনিদ্রা, বদহজম, খিটখিটে মেজাজ । মন ভেঙ্গে যাওয়া নিশুতি রাতে ঘন ঘন ঘড়ি দেখা, জল খাওয়া আর বাথরুমে যাওয়া যেন প্রতি রাতের রুটিন চিত্র ।

এক সকালে দেবদূতের আবির্ভাব একটা কাগজের বিজ্ঞাপন হয়ে । এক হাজার এক টাকায় এক ফাইল । খাবার পিল নয় – লাগানোর মলম । তাও আবার শরীরে নয় – মনে । সুদৃশ্য ছবি লাগানো অদ্ভুত এই মলমটির মধুর মত নাম – মনড্রাইড । ভাঙ্গা মন জোড়া দেবার মধুর কল্পনার ততোধিক মধুর বাস্তবায়ন । মাল্টিন্যাশন্যালের চাপে দমবন্ধ আবহাওয়ায় উঁকি পাড়া এক ন্যাশন্যাল কোম্পানীর অনবদ্য আধুনিক এক আবিষ্কার । রোগের যেমন অনেক কারণ থাকে, মন-ভাঙ্গা রোগেরও অনেক কারণ থাকতে পারে । এক এক কারণে কিন্তু এক এক রকম মলম ।

দীপু একটা পেন ড্রাইভ কিনবে বলে টাকা জমিয়েছিল । দীঘায় বাবা মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল নভেম্বরে । সাগরে স্নান করতে করতে ছবি তুলেছিল । উত্তুঙ্গ ঢেউয়ের মত তার উত্তুঙ্গ যৌবনের কিছু ছবি তুলেছিল প্রেমিক অসীমের জন্যে । পেন ড্রাইভে করে সেই ছবি প্রেজেন্ট করবে তাকে। কিন্তু পেন ড্রাইভ নয়, এখন তো তার ডেনড্রাইড কেনার ইচ্ছা । অসীম পালটি খেয়েছে । কোথায় যেন শুনেছিল দীপু ডেনড্রাইড খেয়ে নাকি আত্মহত্যা করা যায় ।

মনড্রাইডের বিজ্ঞাপন পড়ে ভাবল জিনিসটা যখন আবিষ্কার হয়েইছে তখন দেখাই যাক না একবার চেষ্টা করে । তিনবারের চেষ্টায় ফোন ধরল অসীম । জায়গা ঠিক হল । ঝালমুড়ি আর এগরোল অসীমকে দীপুই খাওয়াল । তারপর বলল, আমাকে বিয়ে করার কথা তোমায় আমি বলছি না । সে তুমি অলকাকেই কর । আর সুন্দরী সে তো বটেই । খুব ম্যাচ করবে তোমাদের । কংগ্রাচুলেশন অসীম । ফুচকা খাবে ?

দীপু বলল সেটাই আর করল সেটাই যেটা মনড্রাইডের পুরিয়ার কাগজে লেখা ছিল ।

-দেখ ডার্লিং, অসীম বলল, সে তো তুমি আমায় বিয়ে বিয়ে করে ব্যতিব্যস্ত করেছিলে তাই । বল তো এই বাজারে চাকরি কি জয়নগরের মোয়া ? তাই তো আমি অলকাকে – ওর বাবা একটা চাকরি দেবে বলেছে বলেই তাই । কিন্তু দিল না তো এখনও । আর সুন্দরী ফুন্দরী ওসব রাখ তো। আমার চোখে তুমিই খুব সুন্দর । প্লিজ ডার্লিং আর একটু ওয়েট যদি কর ।

রাত জেগে কম্পিটিটিভ পরীক্ষার পড়া করল । তিন মাসের মধ্যে চাকরি পেল অসীম । সাত মাসের মাথায় দীপুকে নিয়ে মন্দারমনি চলে গেল মধুচন্দ্রিমা সারতে ।

দীপু-অসীমের বিয়েতে মনড্রাইডের কোনও কর্মকর্তা নেমন্তন্ন খেয়েছিল কিনা জানা নেই । কিন্তু মলমটার দ্বিতীয় সাফল্য এল দীপেন আর তার বাবার হাত ধরে । চার দিন কথা বলে নি দীপেন তার বাবার সঙ্গে । আর দুজনেই ঘুমোয় নি তিন রাত । এই ইয়ার এন্ডিং-এর সময়ও বাবা অফিসে সিক লিভের দরখাস্ত পাঠিয়েছে । গোমড়ামুখো হোমড়াচোমড়া ম্যানেজারের কলমে তার স্যাংশন কঠিন জেনেও ।

সোফায় মুখ গুঁজে পড়ে ছিল দীপেন । ওর মা তো রাগ করে চিরাচরিত প্রথা অনুসরণ করে বাপের বাড়ী চলে গেল । বাবা মেঝেয় গড়াচ্ছে । নির্ঘুম নির্জলা নি-বাথরুম উপবাস । কিন্তু পাশ তো ফিরতেই হয় দুয়েকবার । সেই পাশ ফিরতে গিয়েই কাগজে বিজ্ঞাপন দর্শন ।

তড়াক করে উঠে এক ফাইল কিনে ফেলল বাবা । সোফায় দীপেনের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি স্বরে বলল, চোখ খোল বাবা রাগ করে না । আর তোকে আমি চাকরি খুঁজতে বলব না সোনা মাণিক যাদু আমার । আমার পি-এফ, গ্র্যাচুইটি সব তো থাকবেই রিটায়ার করার পর । আমি মরলেও তোর আর তোর মায়ের চলে যাবে কোনোমতে ।

বাবা বলল আর করল তেমনটাই যেমনটা লেখা ছিল মলমের কাগজটায় । তড়াক করে লাফিয়ে উঠল দীপেন, তোমার পি-এফ গ্র্যাচুইটি ? সে আর কত ? ব্যাংকের ইন্টারেস্ট গ্লোবাল ওয়ারমিং-এর দাপটে আবহাওয়ার মত রোজ ওঠা পড়া করছে সে খবর রাখ ? তাছাড়া তোমার টাকায় খাব আমি – বড় হচ্ছি না বুঝি ? আমার কম্পিউটার গেমসগুলো সব সাত্যকিকে দিয়ে দিয়ো তো বাবা। ও এলে বল আমার সময় নেই ।

ছেলে উঠে পড়ল । হাতে কত কাজ । কম্পিটিটিভ পরীক্ষার পড়া করতে হবে । একেবারে নব উদ্যমে । বাবা মাকে ফোন করল, ফিরে এস গো । ছেলে পরীক্ষা দিতে যাবে আর আমি অফিস যাব । রাঁধতে হবে তো ? ইলিশের কাল গেছে অন্তত একটু ভাপা চিংড়ি –

চার মাস পরের খবর । সরকারী চাকরি পেয়েছে দীপেন । আর ওর মা মনড্রাইডের নামে পুজো দিয়েছে বেশ বড় করে । এক বছর পরে বাবা পি-এফ গ্র্যাচুইটির টাকায় একটা গাড়ী কিনে ফেলেছে – একেবারে চার চাকা ।



তিনবছরের মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা শোভনের । বউ নীলার সঙ্গে ডিভোর্সটা হয়ে গেলে বেচারি মেয়েটার কি হবে ? হয়ত কোর্ট মায়ের সঙ্গেই থাকতে দেবে তাকে । কিন্তু তাই কি সে থাকতে পারবে ? বাবা অন্ত প্রাণ যে মেয়েটার । এক দিকে মেয়ের চিন্তা আর অন্য দিকে নীলার । খিটিমিটির অন্ত নেই । ডিভোর্স ছাড়া আর উপায় নেই ।

-যাও যাও । তোমাকে ছাড়াও আমার চলবে । খুব বীরত্বের সঙ্গে কথাটা বললেও পরে ভেবেছিল শোভন । মাকে না হয় দরকার নেই কিন্তু মেয়ে ? তাকে ছেড়ে থাকা আর চুঁচড়ো থেকে কলকাতায় হেঁটে অফিস করা একই মানে একই রকম কষ্টের । পিতৃমুখী কন্যা কিনা তাই সোহাগটা একেবারে লাগামছাড়া ধরণের ।

ডিভোর্সটা নাকি তেমন কিছু ব্যাপারই নয় । তার এক বন্ধু বলল, জানিস তো বৌ আর বই একটু পুরোন হলে আর ভাল লাগে না । তাই তুই যা করছিস তা ঠিক করছিস । আর বৌদিও তো তোর ওপর বীতশ্রদ্ধ নাকি ? মানে তোর কথায় যা মনে হল আর কি ।

বন্ধু বললেও মনের মধ্যে ঝড় আর যায় না । আহা একবার যদি অন্তত তাকে বলত । একটু নরম করে যদি বলত, ওগো আমি তোমায় –

শোভন এক ফাইল কিনে ফেলেছিল বিজ্ঞাপন দেখে । একটা সিমলা-কুলুর ই-টিকিট হাতে করে এল নীলার কাছে । নীলা নাক কোঁচকাল । আর ট্যারা চোখে শোভনের হাতের টিকিটটা দেখল । কিন্তু তবু কোঁচকান নাক আর সোজা হল না কিছুতেই ।

-যা গরম পড়েছে বুঝলে নীলু । সিমলা না গেলে আর চলছে না ।

শোভন বলল সেগুলোই যেগুলো লেখা ছিল মনড্রাইডের পুরিয়ার কাগজে । বলল খুব মিষ্টি করে । তার বাঁ হাতে ছিল কোয়ালিটি আইসক্রিমের বেশ বড় একটা প্যাকেট। ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল ।

নীলার নাকের কোঁচকানি একটু সমান হল । তার ওলটানো ঠোঁটে ট্যারা হাসির একটা চিহ্ন টের পাওয়া গেল । আর চোখে একটা ঔসুক্য ।

-আই লাভ ইউ নীলা, ডিয়ার । দরদ ভরা গলায় শোভন বলল, আই লাভ ইউ ভেরি মাচ।

ঠিক এ রকমটাই পুরিয়ার কাগজে লেখা ছিল । একেবারে হুবহু ।

পরের দৃশ্যটা কোর্টে নয় সিমলার হোটেলে দেখা গেল । মাঝরাতে ঘুমন্ত তিন বছরের মেয়ের পাশে নিদ্রাহীন এক বাঙ্গালী দম্পতির ভীষণ লড়াই – রোশের নয় খুশির ।

মিলনান্ত নাটকের পরিচালক মনড্রাইড তো ভারি খুশি ।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন