মায়ার বাঁধন
পূজা মৈত্র
চলে যাওয়া কথাটা বলতে যতটা সহজ প্রকৃতপক্ষে চলে যাওয়া তত সোজা নয়। চলে যাওয়ার পথে আসে অনেক বাধা, অনেক পিছুটান। শ্রীময়ীর ক্ষেত্রেও ঠিক এক-ই রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যদিও ও জানে, ওর আর এখানে থাকা চলে না, তবুও চলে যাওয়ার বেলায় মন কেমন করছে। মন শক্ত করেছে ও। সান্যালবাবুর প্রস্তাবে রাজি হওয়া সম্ভব নয়। যা সম্ভব নয় তাকে স্বীকার করে মিথ্যা জীবন যাপন করা ওর দ্বারা হবে না। শিলিগুড়ি ফিরে যাবে তাই। কালই। আজকেই যেত, কিন্তু আকাশের কথা ভেবে আজ যেতে পারল না। শরীর খারাপ ছেলেটার। ওকে কাঁদিয়ে চলে যেতে একটুও ভাললাগবে না শ্রীময়ীর, কিন্তু এর পরে এই বাড়িতে আর থাকাও যাবে না। নয় নয় করে প্রায় দুই বছর এই বাড়িতে কাটিয়ে ফেলল। নীতিশ মারা যাওয়ার পর একটা চাকরির খুব দরকার ছিল। শ্রীময়ী তখন প্রেগন্যান্ট। দুমাসের বাচ্চা পেটে রেখে বাস দুর্ঘটনায় মারা যায় নীতিশ। সম্বল বলতে দমদমে ভাড়ার ফ্ল্যাট আর বিমার সামান্য টাকা। নীতিশ কিছুই জমিয়ে যেতে পারেনি। সাধারণ বেসরকারি চাকরি করত। বীমার দরুণ পাওয়া লাখ খানেক টাকা দিয়ে জীবন চলবে না। বেশ বুঝেছিল শ্রীময়ী। তার উপর তিনকুলে কেউ নেই। নীতিশ অনাথ আর শ্রীময়ীর মামা বাড়ি ছাড়া কাছের কেউ নেই।তাও তারা থাকেন সেই শিলিগুড়ি। শোক করার মত বাহুল্য তাই শ্রীময়ীর ছিল না। আগুপিছু না ভেবে, কারখানায় কাজ নিয়ে নিল। হাড় ভাঙ্গা খাটনি। সইল না। পেটের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল। নীতিশের উত্তরাধিকারি রইল না। মাস দুয়েক কাজ ছেড়ে বাড়ি বসে ছিল। কিন্তু খিদে বড় বালাই। কাজ খুঁজতে নামতেই হল। শ্রীময়ীর নামকরণ সার্থক ছিল।বাপ-মা মরা মেয়ের কে এমন সঠিক নাম দিয়েছিল জানা না গেলেও, তার বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়। চেহারায় একটা শ্রী আছে ওর, আভিজাত্যও আছে চেহারার মধ্যে। পিতৃকুল নাকি জমিদার ।মামাদের কাছ থেকে শোনা। তবে সেই জমিদারির কানাকড়িও শ্রীময়ী পায়নি।পাবেই বা কি করে? জমিদারি বাংলাদেশে আর বাবা ছিলেন উদ্বাস্তু।শ্রীময়ীর জন্মের সময় মা মারা যান।বছর দুয়েকের যখন তখন বাবাও মায়ের পিছু নেন। বাপ-মা মরা শ্রীময়ী মামাবাড়ি মানুষ। অনাদরে। অপয়া অপবাদ মাথায় নিয়ে।শ্রীময়ী কিছুটা পড়াশুনাও জানে। উচ্চমাধ্যমিক অবধি পড়েছে।ভালই রেজাল্ট করত। ধীর , স্থির, বুদ্ধিমতী বলে শিক্ষিকাদের প্রিয়পাত্রী ছিল। যেবার পরীক্ষা দেবে, সেবারই নীতিশের সাথে পালিয়ে আসতে হল। না হলে মামারা অন্যত্র বিয়ের ঠিক করেছিল। পরীক্ষাটা তাই দেওয়া হয়নি। একটু আক্ষেপ থাকলেও নীতিশকে পেয়ে সব কিছু ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু নীতিশ আর নীতিশের সন্তান যখন কেউই ওর পাশে রইল না তখন দু এক বার মরার কথা যে ভাবেনি শ্রীময়ী তা নয়। অথচ মরতে পারেনি। মরতে যখন পারলই না তখন কাজ করেই খেতে হবে। কাজের সন্ধানেই ওর কাগজ লক্ষ্য করা আর গভর্নেস চাই এমন অ্যাড দেখে এ বাড়িতে আসা। সান্যাল ভিলায় এসে শ্রীময়ী খুব অবাক হয়েছিল। এত বড় বাড়ি যে হয়, তা ওর ধারণার বাইরে ছিল। চাকরিটা হবে না ভেবেই ইন্টারভিউ দিয়েছিল, কিন্তু চাকরি ওরই হয়েছিল। সান্যালবাবু মানে অপরেশ সান্যালের একমাত্র পুত্র আকাশের গভর্নেসের চাকরি। সারাদিনের ডিউটি। থাকা খাওয়া সমেত মোটা মাইনে। শ্রীময়ী হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলার ভুল করেনি। আকাশের বয়স তখন চার। সদ্য মা হারা ছেলেটাকে দেখাশোনা করার জন্য বাড়িতে পর্যাপ্ত চাকর বাকর ছাড়া আপনার বলতে কেউ ছিল না। সান্যাল বাবুরও কাছের আত্মীয় বলতে তেমন কেউ নেই। সেই থেকে দু বছর আকাশের সব দায়িত্ব নিখুঁতভাবে পালন করেছে শ্রীময়ী। শুধু কাজ বলে নয়, মনের টানেও আকাশকে আপনার করে নিয়েছিল শ্রীময়ী। যে এসেও এল না, তার কথা আকাশকে দেখলেই মনে পড়ে যেত। প্রথম প্রথম ঐ টানেই ভালবেসেছিল। এখন আকাশকে, আকাশের জন্যই ভালবাসে। তবুও কাল আকাশকে ছেড়ে চলে যাবে ও। গোছ গাছ হয়েই এসেছে। আকাশ বুঝতে পারলে অনেক করে মানা করবে শ্রীময়ীকে। অথচ শ্রীময়ী নিরুপায়।
সন্ধ্যাবেলা আকাশের টিউটর আসেন। উনি পড়িয়ে চলে গেলে শ্রীময়ী নিয়ম করে পড়াগুলো দেখে নেয়। আজও সেই রুটিনের অন্যথা হলনা। আকাশ ভেবেছিল আনটি আসবে না। শ্রীময়ীর আসায় অবাক হল তাই। বাবার কথায় আনটি রাগ করেছে, এত রাগ করেছে যে চলেই যাবে। কিন্তু বাবার তো কোন দোষ নেই। আকাশই তো বাবাকে অনেক করে বলেছিল, আনটিকে মা হয়ে আসার কথা বলতে। কয়েকদিন ধরেই বলে। বাবা বলত না। বাবা ঠিক জানতো যে, আনটি রাগ করবে। পরশুর জ্বরের পর বাবাও আর না করতে পারেনি। জ্বরের ঘোরে আকাশ নাকি অনেক বার ‘মা’ বলে ডেকেছিল। আনটিকেই। আনটি মানা করেনি। রাতে আনটির ঘরে আনটিকে শুতে যেতে দেয়নি আকাশ।জেদ করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। আনটি ওর কোন জেদ, কোন আব্দার ফেলেনি। এইসব দেখেই তো বাবা ভেবেছিল, আনটিকে বললে রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু... আকাশ জানে আনটি ওকে খুব ভালবাসে। একদম মায়ের মতই ভালবাসে। মায়ের কথা আবছা মনে পরে আকাশের। মায়ের জন্য আগে খুব মন খারাপ হত। আনটি আসার পর থেকে সেই মনখারাপগুলো কমতে কমতে এখন ভ্যানিশ হয়ে গেছে। মা যেভাবে ওকে ভালবাসত, নিজে হাতে খাওয়াত, স্নান করাতো, ঘুম পারাত, পড়া দেখত আনটিও ঠিক সেভাবেই সব কিছু করে। আকাশের মন খারাপ হলে সবার আগে বুঝে ফেলে। আকাশের আনন্দে সবচেয়ে আনন্দ পায়। আকাশ দুষ্টুমি করলে বকে, পরে মায়ের মত নিজেই কষ্ট পায়। আকাশের শরীর খারাপ হলে মায়ের মতই রাত জাগে। আদর করে। কোথাও যায় না। তাহলে আকাশ যে আনটিকেই মা বলে ভাবে, মনে মনে মা বলে ডাকে, মা করতে চায়- তাতে আকাশের দোষ কোথায়? বাবা তো আকাশের জন্য মা চেয়েছে। বাবারই বা দোষ কোথায়? আনটি মায়ের সব কাজ করে কিন্তু মা হতে চায় না। বাবা বলছিল, আনটি কাল চলে যাবে। ইস। গেলেই হল! যে করেই হোক আটকাবে আকাশ।
____ এত কেয়ারলেস মিসটেক কেন, তুতান?
আনটি আকাশকে তুতান বলেই ডাকে। আকাশের ডাকনাম। শুধু বাবা আর আনটি- ই ডাকে।
_____ মন দিসনি একদম। মন কোথায় থাকে?
পড়ায় আজ একদম মন ছিল না আকাশের। থাকবেই বা কি করে? আনটি জানে না যেন, মন কোথায় ছিল। একে নিজে চলে যাবে, তার উপর আকাশকে বকছে। আকাশের মন তো আনটির কাছেই ছিল।
_____ মন ছিল না।
শ্রীময়ী থমকাল। কড়া চোখে তাকাল তারপর। ও বেশ জানে আকাশের মন কেন ছিল না।কিন্তু নরম হলে চলবে না। বকে ঝকে রাগ দেখিয়ে চলে যেতে চায় শ্রীময়ী। আকাশের কষ্ট কম হবে।
_____ মন ছিল না? বাহ। পড়তে বসলেই মন থাকে না। আর সব কাজেই খুব মন। বাঁদর হচ্ছ দিনেদিনে। ড্রয়িংগুলো হয়েছে? কাল স্কুলে জমা দিতে হবে, খেয়াল আছে?
আকাশ বুঝল আনটি ইচ্ছা করেই বকছে। কিন্তু আকাশ রাগবেই না। অভিমানও করবে না।
_____ তুমি আঁকিয়ে না দিলে আমি পারি?
শ্রীময়ী দেখল চলে যাওয়ার কথা পারার এটাই উপযুক্ত সময়। কাল আকাশ যখন স্কুলে যাবে, তখনি চলে যাবে শ্রীময়ী। কিন্তু একদম না বলে গেলে ঠিক হবে না। ওর বাবার মুখ থেকে শুনেছে হয়ত... সান্যাল বাবু বলছিলেন যে তুতানের আবদারেই উনার শ্রীময়ীকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া... বিশ্বাস হয়নি শ্রীময়ীর। শুধু তুতানের আব্দার? নিজের ইচ্ছা নেই? তা কি করে হয়? সান্যালবাবুর মত মানুষ চাইলেই কত ভাল মেয়ে বিয়ে করতে পারেন। তা না করে শ্রীময়ীকে এই প্রস্তাব দেওয়া কেন? নিজের অতীত কাল সান্যালবাবুকে খুলে বলেছে শ্রীময়ী। অথচ নীতিশের কথা জেনে, শ্রীময়ীর সন্তানের কথা জেনেও অপরেশ সান্যালের বিন্দুমাত্র যায় আসে না! তা কেমন করে হয়? শ্রীময়ীর মধ্যে এমন কি আছে? শ্রীময়ী কাল স্পষ্ট বলে দিয়েছে নীতিশের জায়গায় কাউকে বসাতে ও পারবে না। উত্তরে অপরেশ বলেছেন উনি ঐ জায়গা চান না, শুধু তুতানের মাকে চান। এতটা মহান কি কেউ হতে পারে? নাকি এসবই মন জয় করার নাটক মাত্র।
____ আমি না থাকলে আঁকবি কি করে?
_____ তুমি থাকবে না কেন?
______ বাবা কিছু বলেনি? আমি কাল চলে যাচ্ছি।
_____ গেলেই হল। আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে তুমি? একবার গেছ, এবার যেতেই দেব না।
আকাশের কথায় অবাক হল শ্রীময়ী। একবার গেছ বলতে তুতান ওর মায়ের কথা বলতে চাইছে। গত কয়েকদিনে দুবার জ্বর হয়ে গেছে ওর। আগেরবার বাড়াবাড়ি হয়েছিল। সান্যালবাবুও ছুটি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেরে উঠে পরশু আবার জ্বর। একদিনই ছিল। কি যে হচ্ছে! ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে, কথাটা পরশুদিনই ওর বাবাকে বলেছে শ্রীময়ী। ডাক্তার কাকার ওষুধে জ্বর পুরোপুরি সারছে না। জ্বরের ঘোরে অনেকবার শ্রীময়ী তুতানের মুখে মা ডাক শুনেছে। অন্যান্যদিনও রাতে তুতান ঘুমিয়েছে কিনা দেখতে এলে, আধো ঘুমে তুতান মা বলে ডেকে জড়িয়ে ধরেছে। এসব কিছুকেই ভ্রম বলে ভাবত শ্রীময়ী। মা হারা ছেলের স্বাভাবিক মা চাওয়া। অথচ আজকে নিজে মুখে তুতান সেই রকমই ইঙ্গিত দিল। তাহলে ওর বাবার কথাই কি ঠিক? তুতানের একান্ত আবদার আর জেদ অপরেশ বাবুকে বাধ্য করেছে, শ্রীময়ীকে প্রস্তাবটা দিতে?
____ একবার গেছি মানে?
____ গিয়েছিলেই তো। তারপর আবার এলে, আর যেও না মা।
মা! জ্বর বা ঘুমের ঘোর নয়, সামনাসামনি শ্রীময়ীর আদরের ধন প্রথমবার মা বলে ডাকল। শ্রীময়ীর কি ভাল লাগলো না? বেশ ভাল লাগল। জ্বরের ঘোরে শুনতে যত ভাললাগে, তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভাল লাগল।
____ কে বলল আমি তোর মা? বাবা?
_____ ধুর! বাবা বলবে কেন? আমি-ই বলেছি। আমি-ই তো বাবার কাছে জেদ করেছি তোমাকে মা করে এনে দেওয়ার জন্য।
____ তুই? তোর কেন মনে হল আমি তোর মা?
জানতে চায় শ্রীময়ী।তুতানের চাওয়ার হদিশ যখন পেয়েছে, তখন তার কুল কিনারা করতে চায়।
_____ কেন আবার? তুমি মা, তাই মা। এর আবার কেন কি? সব্বার মা তাদের যেমন ভালবাসে তুমিও আমায় তেমনি ভালোবাস। সবার মা তাদের জন্য যা যা করে আমার জন্য তুমি-ই সব কর, তাই।
শ্রীময়ীর চোখে জল চলে এসেছিল। স্বামী, সন্তানের মৃত্যুর পর মা ডাক শোনার আশা এ জীবনে আর ছিলনা। অথচ সব মেয়ের মত শ্রীময়ীও একান্ত ভাবেই এই ডাক শুনতে চাইত। আজ তুতানের ডাকে ওর সেই ইচ্ছা পূর্ণ হল।
_____ বেশ ভাল ভেবেছিস তো...
_____ আমি ভালই ভাবি। এবার বল তুমি চলে যাবে?
তুতানের মুখের হাসিটাকে ম্লান করতে ইচ্ছা হল না শ্রীময়ীর। চলে ওকে যেতেই হবে। অপরেশ বাবুর যোগ্য ও নয়। তুতানের মা হওয়ার যোগ্যতাও ওর নেই। আজ অবধি যে সম্পর্কেই জড়িয়েছে তাদের মৃত্যু গ্রাস করেছে। তুতান আর তুতানের বাবার ক্ষতি চায় না শ্রীময়ী।
____ না। যাব না। তোকে ফেলে কোথায় যাবো?
আকাশ খুশিতে লাফিয়ে উঠল। মাকে জড়িয়ে ধরল।
___ সত্যি মা? প্রমিস?
__ প্রমিস। তুতানের গালে আলতো আদর করে বলল শ্রীময়ী।
অপরেশ আজকাল অন্যান্য দিনের চেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছেন। আগে যখন ফিরতেন তখন তুতান ঘুমে ঢুলছে, না হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আগেরবারের জ্বরের পর থেকে অপরেশ ইচ্ছা করেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসছেন। জ্বরটা মারাত্বক হয়েছিল। ওষুধ খাওয়ালে ঘণ্টা খানেক কমছিল, তারপর আবার যে কে সেই। ঘাবড়ে গিয়েছিলেন অপরেশ। তুতানের কিছু হয়ে গেলে কি হবে নিজেই ভাবতে পারছিলেন না। একে নন্দিতাকে হারিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। বেঁচে থাকাটাই তুতানের জন্য। তাও তুতানের কাছে কতটুকুই বা আসতেন অপরেশ? সারাদিন কাজ আর কাজ। কাজে ডুবে থেকে নন্দিতাকে ভুলতে চাওয়া। খাওয়াদাওয়া ঘুম সব কিছুতেই অনিয়ম। তুতানের কাছে ইচ্ছা করেই বেশি আসতেন না অপরেশ। ওকে দেখলেই ওর মায়ের কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে যায়। আর শ্রীময়ীর উপর সম্পূর্ণ আস্থা ছিল বলে ছেলের ভারটা ওর উপরে দিয়ে নিজে নিজের মত থাকতেন, আর কষ্ট পেতেন। খুব ভুল করতেন। এই কয়েকদিনে এটুকু বুঝেছেন অপরেশ। জ্বরের ঘোরে ছেলের ভুল বকাগুলো নিজের কানে শুনেছেন আর বুঝতে পেরেছেন, তুতান বাবাকে কতটা কাছে চায়। শ্রীময়ীকে সারারাত একটু ক্ষণের জন্যও ছাড়ত না তুতান। তাই ইচ্ছা থাকলেও তুতানের পাশে শোয়ার জো ছিল না। তাও সারারাতে অনেকবার সন্তর্পণে ঘুরে ফিরে তুতানকে দেখে যেতেন অপরেশ। শ্রীময়ী সারারাত জেগেই থাকতো। অপরেশ ওর কাছ থেকে জ্বরের খোঁজ খবর নিতেন। তুতানের মুখে শ্রীময়ীর জন্য মা ডাক তখন-ই প্রথম শুনেছিলেন অপরেশ। অবাক চোখে তাকাতেই শ্রীময়ী বলেছিল, এটা তুতানের জ্বর বা ঘুমের ঘোরের ডাক। আগেও ডেকেছে। ছেলের জ্বর ভাল হয়ে গেলে ইচ্ছা করেই দুটো দিন ছুটি নিয়েছিলেন অপরেশ। ছেলের কাছে আসার জন্য। ওকে ভাল করে চেনার জন্য। বাবাকে না পাওয়ার কষ্টটা কতটা মেপে দেখার জন্য। তুতান বাবা সারাদিন বাড়িতে দেখে অবাক হলেও খুশিও হয়েছিল খুব।বাবা ঘনঘন ওর ঘরে আসছে, ওর সাথে গল্প করছে, ওর পড়াশোনার খোঁজ নিচ্ছে, দেখে ভারি আনন্দ হয়েছিল ছেলেটা্র। অপরেশ তুতানকে প্রশ্ন করেছিলেন
__তুতান, এত খুশি যে?
__ তুমি আছ, তাই।
অপরেশ ছেলের গালে চুমু খেয়েছিলেন
___ এরকম রোজ থাকলে ভাল?
___ খুব ভাল। কিন্তু অফিস?
অপরেশ হেসে ফেলেছিলেন
__ তাই তো! তাহলে রোজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে এলে কেমন হয়?
___ বেশ হয়। সত্যি আসবে?
___ একদম। রোজ আসব।
___ খুব ভাল হবে। আমিও আর মিস করব না তোমায়।
অপরেশ ছেলের মনের কথা জানতে চেয়েছিলেন
___ মিস কর আমায়?
___ খুব। তুমি সানডে করেও বাড়ি থাকো না। আর সব্বার বাবারা থাকে।
অপরেশ নিশ্চিত হয়েছিলেন তুতানের জ্বরের ঘোরের কথাগুলো নেহাত ভুল বকা নয়। তাহলে কি তুতান শ্রীময়ীকে জেনে বুঝেই মা বলে ডাকে? তুতানের পাশে শুয়ে পড়ে ওকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়েছিলেন।
___ আর মাকে মিস কর না?
___ মা কে? কই না তো? আগে করতাম, এখন তো আনটি আছে।
অপরেশ অবাক হয়েছিলেন। তুতানের শিশু মন নিজের অজান্তেই শ্রীময়ীকে মায়ের আসনে বসিয়েছে।
___ আনটি মায়ের মত ভাল?
--- হ্যাঁ। মা যেমন আনটিও তেমন।
তুতানের সাথে সেদিন আর কথা বাড়ান নি অপরেশ। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই তুতানের মনের খুব কাছাকাছি চলে আসতে পেরেছিলেন। রোজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে, তুতানের সাথে খেলে,গল্প করে, বন্ধুর মত মিশে নিজেকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করছিলেন। নন্দিতা থাকতে পরিবারের যে বাঁধন ছিল, তা একটুও ঢিলে হয়নি, অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলেন। শ্রীময়ী কি অদ্ভুত দক্ষতায় সব দায়িত্ব একদম নন্দিতার মত করেই সামলায়, তা অপরেশের নজর এড়ায় নি। কেবল তুতানের যত্নের দায়িত্ব ওর বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকা শ্রীময়ীর ধাতে নেই। সংসারের প্রত্যেক দিকে ওর তীক্ষ্ণ নজর। শ্রীময়ীর ব্যক্তিত্ব এমন যে সমস্ত চাকর বাকর মায় অপরেশের ব্যক্তিগত সচিব অবধি শ্রীময়ীর কথা শোনে, মান্যও করে। শ্রীময়ীও ওদের সমস্ত সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে খেয়াল রাখে। মিনুদি খেল কিনা, রাখালদা এই গরমে বাজার করে এসে জল পেল কিনা, ড্রাইভার কাকার মাইনে হল কিনা থেকে শুরু করে বাড়ির সাজ সজ্জা,খাওয়ার মেনু সবেতেই শ্রীময়ীর ছোঁয়া লেগে থাকে। আগে না বুঝলেও এই কদিনে বেশ বুঝেছেন অপরেশ, তিনি চোখ বুজে থাকলেও কোন জাদুমন্ত্রবলে সংসার দিব্যি চলে যাচ্ছে। শুধু কি সংসার? অপরেশের জামাকাপড়, টিফিন, ব্রিফকেস, ফাইল সব কিছুই এত সুন্দর করে কে সাজিয়ে রাখে আগে লক্ষ্য না করলেও এখন টের পেয়েছেন অপরেশ। তবে শ্রীময়ী এত কিছু করেও তুতানের একফোঁটা অযত্ন হতে দেয় না। তুতানের কোন কাজ অন্য কেউ করবে, এটা শ্রীময়ীর না-পসন্দ। অন্য কেউ করালে তুতানও করবে না। অগত্যা সব ঝক্কি শ্রীময়ীর। অপরেশ যত দেখছিলেন, তত মুগ্ধ হচ্ছিলেন। শ্রীময়ীর চেহারা বলে, ও ভাল বংশের মেয়ে। ভাগ্যের ফেরে হয়ত আজ এই দশা। তবে এত দারিদ্র্যেও শ্রীময়ীর ঋজুতা অম্লান। স্বল্প অথচ স্পষ্টবাদী। তুতানের কোন প্রয়োজনের জিনিস একবার চেয়ে না পেলে অপরেশ ডিনার টেবিলে শ্রীময়ীর উষ্মার সম্মুখীন হয়েছেন অনেকবার। নিজের ভুলে যাওয়ার জন্য লজ্জা পেয়েছেন, আবার ভুলে গেছেন। তুতানকে সময় দেওয়ার কথাও শ্রীময়ীই প্রথম বলে। অপরেশ গা করেননি। এখন সময় দিতে শুরু করে শ্রীময়ীর কথার অর্থ বুঝতে পারছেন। এর থেকে দেরী করলে, তুতান বাবার থেকে অনেক দূরে চলে যেত। এখন বাবাকে নতুন করে ফিরে পেয়ে বেজায় খুশি ও। তার সাথে একটা আবদারও করে ফেলেছে। ওর মা চাই। যে কোন মা নয়। শ্রীময়ী আনটিকেই মা হিসাবে চায় ও।শ্রীময়ী রাজি হবে না, অপরেশ জানতেন। নিজে বলে অপমানিত হতে চাননি। যদিও তুতানের জন্য শ্রীময়ীর থেকে ভাল মা এনে দেওয়া অসম্ভব, আর এই সংসারেরও শ্রীময়ীর মত কর্ত্রী দরকার। তবুও তুতানের মা হতে বলা মানে শ্রীময়ীকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া। নন্দিতা চলে যাওয়ার পর অপরেশকে অনেকেই বিয়ে করে নিতে বলেছিল। কিন্তু নন্দিতার জায়গায় কাউকে বসাতে পারবেন না বলেই...কিন্তু শ্রীময়ীকে বসানো যায়, অপরেশের সন্তানের মায়ের আসনে শ্রীময়ীকে দিব্যি বসানো যায়, শুধু শ্রীময়ীকেই বসানো যায়। কিন্তু অপরেশ কি শ্রীময়ীকে ভালবাসেন? বিশ্বাস করেন নির্ভর করেন... কিন্তু ভালবাসা? উত্তরটা পুরোপুরি হ্যাঁ-বাচক নয় জেনেই শ্রীময়ীকে প্রস্তাবটা দিতে দ্বিধা ছিল। আরও ভয় ছিল, শ্রীময়ী যদি ভুল বোঝে? যদি ভাবে তুতানের বাহানায় অপরেশ নিজের কামনার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন? এতশত ভেবে বলতে চেয়েও বলেননি। কিন্তু পরশুদিন তুতানের আবার যখন জ্বর এলো, তারপর অপরেশ আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারেননি। মনের কথা বলে ফেলেছেন শ্রীময়ীকে। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে, শ্রীময়ী ভুল বুঝেছে ওনাকে। চলে যাবে, এমন অভিপ্রায়ও জানিয়েছে। মনটা ভাল নেই তাই। তুতান যাকে ঘিরে মা হারিয়েও আবার বেঁচে উঠেছে সে চলে গেলে তুতানকে সামলানো দায় হবে।
___ তুতান! কি করছিস? এখানে ব্লু হবে কালারটা। ভাল করে দেখে রং ভর।
অপরেশ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শ্রীময়ীর রাগত গলা শুনল। শ্রীময়ী এই সময় তুতানকে পড়ায়। আজ আঁকা শেখাচ্ছে তাহলে। ছেলেটার মন ভাল নেই, আঁকবে কি করে? আজ সকালেই অপরেশ তুতানকে জানিয়ে দিয়েছেন শ্রীময়ী চলে যাবে বলেছে। তুতান বলেছে যে ভাবেই হোক আটকাবে। যেতে দেবেই না। দেখা যাক। মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে কি করে যায় শ্রীময়ী, অপরেশ দেখতে চান। যে ছেলের জন্য রাতের পর রাত জেগেও ক্লান্তি আসে না, যার একটু অযত্ন সহ্য হয় না, যার প্রত্যেকটা কাজ নিজে হাতে না করলে শান্তি হয় না, তাকে শ্রীময়ী ভালবাসে না, একথা ও নিজে মুখে বললেও বিশ্বাস করবেন না অপরেশ। আর বাধাটা যদি অপরেশ হন তবে কাল অপরেশ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তুতানের জন্য মা চান উনি। এর অতিরিক্ত কিছু চাইবেন না।
___ সরি মা। দাঁড়াও, ঠিক করে ভরছি এবার।
মা! তুতান শ্রীময়ীকে সরাসরি মা বলল? শ্রীময়ী কি রাগ করবে এবার? নাকি শ্রীময়ী মেনে নিয়েছে?
___ এবার দেখে ভর। না হলে কানমলা খাবি।
উত্তর দিল শ্রীময়ী। বাহ। তাহলে তুতানের কথায় কাজ হয়েছে! মনটা খুশিতে ভরে গেল অপরেশের। ছেলেটার আবদার রাখতে পেরেছেন তাহলে। শ্রীময়ী চলে গেলে বেগতিক হত।
___ তুতান মন দিয়ে কাজ করছ না কেন?
বাবার গলা পেয়ে তাকাল তুতান
___ মা কানমলা দিলে ভাল হবে?
শ্রীময়ী বুঝল, অপরেশ তুতানের ডাক শুনেছেন।
___ কখন এলেন?
__ এই মাত্র।
___ চা করি?
__ না। তুতানকে পড়াচ্ছেন, পড়ান।
___ বাবা, মা যাবে না। প্রমিস করেছে আমায়।
আকাশের হাসির ঝিলিক অপরেশের মুখেও খেলে গেল।
___ আমি বললে কাজ হল না, আর তুমি বললেই কাজ হল। দেখলে তো? তাই বলতাম তুমি বল, তোমার মা তোমাকে খুব ভালবাসেন।
___ জানি তো। মা খুব ভালবাসে আমায়।
শ্রীময়ীর খারাপ লাগছিল। আজ তুতানের মন রাখার জন্য মিথ্যা বলেছে। চলে যাবে ও। কিন্তু তুতানকে কাঁদতে দেখলে যেতে পারবে না। তাই না বলে চলে যাবে।
___ আপনি ডাক্তারের খোঁজ নিলেন?
প্রসঙ্গ পরিবর্তনে চমকালেও মুখে প্রকাশ করলেন না অপরেশ
___ হ্যাঁ। পরশু শনিবার। তুতানকে নিয়ে যাব।
___ জ্বরটা ভাল ঠেকছে না...
অপরেশ শ্রীময়ীর উদ্বেগ বুঝলেন। শ্রীময়ী কেন আকাশকে এত ভালবাসে, কাল ওর জীবন ইতিহাস জেনে বুঝেছেন অপরেশ। শ্রীময়ী বিধবা, এটা আগে থেকেই জানা ছিল। ইনটারভিউ দিতে এসে গোপন করেনি।শ্রীময়ী কাল আবার নতুন করে বলল। ভেবেছিল হয়ত অপরেশ ভুলে গেছেন। কিন্তু অপরেশ সব জেনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শ্রীময়ীর সন্তান নষ্টের ব্যাপারটা অজানা ছিল। সন্তান হারিয়ে শ্রীময়ীর মমতা আকাশকে আঁকড়ে ধরে সার্থক হয়েছে। আকাশকে নিয়ে ওর খুব উদ্বেগ তাই।
__ নিশ্চিত থাকুন। আপনার ছেলের কোন বিপদ আসতে ওর বাবা দেবে না।
__ আমিও তাই-ই চাই। তুতানের বাবা যেন এখনকার মত রোজ তুতানকে সময় দেন।
শ্রীময়ী ওর অনুপস্থিতিতে তুতানের যত্নের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইছে। অপরেশ অন্য মানে করলেন। ভাবলেন শ্রীময়ী চায় উনি রোজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসুন।
__ অবশ্যই আসব। তুতান আর তুতানের মাকে যথেষ্ট সময় দেব। কোন অভিযোগ করতে দেব না আপনাকে।
শ্রীময়ী বুঝল অপরেশ ভুল বুঝছেন। ভুলটা তুতানের সামনে ভাঙ্গাল না।
রাতে তুতানকে ঘুম পারাতে পারাতে অনেক কিছু চিন্তা মাথায় ভিড় করছিল। সান্যাল বাবু সব কিছু জেনেও তুতানের কথা ভেবে শ্রীময়ীকে বিয়ে করতে চান, অথচ শ্রীময়ীর কাছে তার আর অন্য কোন দাবি নেই। কেন? ছেলেকে এতটাই ভালবাসেন? ভালবাসলে এই দুই বছর ছেলেকে শ্রীময়ীর ভরসায় ফেলে নিজে মুখ ঘুরিয়ে ছিলেন যে? সেটা কি কাজের চাপে? নাকি স্ত্রী হারাবার শোকে? নাকি ছেলের কাছে আসাটা অভিনয়। শ্রীময়ীর মন ভেজাবার চাল। না, না। তা কেন হবে? শ্রীময়ী এমন কি দুর্লভ মেয়ে যার জন্য অপরেশ সান্যালকে নাটক করতে হবে? আর তুতানকে মাঝে রেখে নোংরা নাটক উনি করবেন না বলেই মনে হয়।এই দুই বছরে অপরেশকে ভাল করে দেখেছে শ্রীময়ী। এত নামী বিজনেসম্যান অথচ কি আপনভোলা! ঘরের দিকে একটুও নজর নেই। নিজের জিনিসপত্রই গুছিয়ে রাখতে পারেন না। আবার কে গুছিয়ে রাখে জানার চেষ্টাও করেন না। মিনু মাসি বলে, স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। নাকচ করতে এক মুহূর্তও ভাবেন নি। আপনভোলা বলেই কি নিজের দুঃখটাকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন? তুতানের দিকে ফিরে চাইতেন না? আবার এই মানুষটাই তুতানের গা গরমের খবর পেলেই উতলা হয়ে যান। এই হেঁয়ালির অন্ত কোথায়? অপরেশকে জানাতেই হবে, শ্রীময়ী কাল চলে যাচ্ছে। আগে থেকে না জানলে তুতানকে সামলাতে পারবেন না। কাল সকালে তুতানের স্কুল আছে। আজ রাতেই বলে দিতে হবে।
___ জেগে?
___ আপনিও তো ঘুমাননি।
___ তুতান ঘুমিয়েছে?
___ ক- খ-ন।
___ কানমলা দিতে হল আপনার ছেলেকে?
শ্রীময়ী হেসে ফেলল। তুতানকে শাসন একমাত্র শ্রীময়ীই করে।অপরেশবাবুর ধাতে ওসব নেই। আকাশকে তুই বলেও কেবল শ্রীময়ীই ডাকে। বাবাও ছেলেকে তুমি ছাড়া বলেন না।
___ নাহ। আজ কানমলা খায় নি।
অপরেশ ফাইলের থেকে চোখ তুললেন।
__ বসুন না। আর ছেলেকে শাসন করার ভারটা কিন্তু একান্ত আপনার। আমার দ্বারা ওসব হবে না। জানেন নন্দিতা বলত ছেলে নাচাতে তোমার জুরি মেলা ভার।
বলেই থমকালেন অপরেশ। শ্রীময়ীর সামনে এই প্রথম নন্দিতার কথা বলে ফেলেছেন।
__ ছেলে নাচাতে আমি অন্তত আপনাকে কখনো দেখিনি। সময় দিতেই দেখিনি তো প্রশ্রয়।
শ্রীময়ীর গলায় খেদ ঝরে পড়লো। অপরেশ অনুভব করলেন।
__ তখন আর এখনের মধ্যে পার্থক্য অনেক শ্রীময়ী। নন্দিতা চলে যাওয়ায় জীবনটাই অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল আমার। নিজেকে নিজেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। আগে ও থাকতে তুতানকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া আমার প্রত্যেক সানডের অভ্যাস ছিল। অথচ আপনি কোনদিন দেখেননি। তুতানকে মাঝে নিয়ে আমরা দুজনে শুতাম। আর আপনি এসে থেকে দেখেছেন ওর আলাদা ঘর। ওর থেকে দূরে পালাতাম। কারন ওকে দেখলেই ওর মাকে মনে পড়ে যেত। খুব ভুল করেছি জানি। এর আগের বারের জ্বরের সময় ওকে হারাবার ভয় পেলাম। কিন্তু সব হারালেও তুতানকে কি করে হারাব? তাই ফিরতে চাইছি।
অপরেশের কথায় ওনার ছেলের থেকে দূরে থাকার কারণ স্পষ্ট হল।
__ আপনার সদিচ্ছা বজায় থাকলেই ছেলেটার ভাল। তবে এই কদিনে ভালই বন্ধুত্ব করে ফেলেছেন দেখছি।
___ বন্ধু না হলে দুরত্ব কমাতে দেরী হত। বন্ধু হলাম বলেই না জানতে পারলাম ছেলের মা চাই। তাই তো আপনাকে বলার সাহস করলাম। জানতাম আপনি ভুল বুঝবেন, না করবেন... ভাববেন ছেলের নাম করে আমি নিজের জন্য আপনার ভালবাসা চাইছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি শুধু ওর জন্য মা চেয়েই দরবার করেছিলাম। ব্যর্থ হলাম। কিন্তু জানতাম তুতান আপনাকে যেতেই দেবে না। ওকে আপনি যতটা ভালবাসেন, নন্দিতার ভালবাসার থেকে কিছুমাত্র আলাদা মনে হয় না আমার। যাক, আপনারা মা ছেলেতে খুশি। আমিও খুশি। আপনাদের ছোট্ট দুনিয়ার এক কোনে আমাকে অল্প জায়গা দিলেই চলবে।
অপরেশের অনাবিল হাসি শ্রীময়ীকে ছুঁয়ে গেল। মানুষটা সত্যিই খুশি আজ। নিজে মন খুলে বাঁচতে পেরে, ছেলের জন্য মা এনে দিতে পেরে...
___ আমাকে এতটা ভরসা করছেন, যদি আমি অযোগ্য হই?
___ আপনার যোগ্যতার কোন প্রমাণপত্রের প্রয়োজন আমার নেই। এতদিন মনের তাগিদে আমার সংসারটাকে যিনি ধরে রেখেছেন, তাকে ছাড়া আর কাউকে এই সংসারের কর্ত্রী মানায় না।আমি বাইরের জগৎ নিয়ে পড়ে থাকি। কিন্তু এতটা অন্ধও নই যে বুঝি না আমার সব জিনিসপত্র কোন মন্ত্রবলে এমন সুন্দর করে গোছানো থাকে। আমাকে এইটুকু যত্ন করে যাবেন, ব্যাস।
___ আমাকে আপনার স্ত্রীর স্থানে বসাতে পারবেন আপনি?
___ যার স্থান তারই থাকে শ্রীময়ী। সবাই আলাদা আলাদা করে স্থান করে নেয়। যেমনটা আপনি তুতানের মনে করেছেন। আমার মনে করেছেন, তুতানের মা হিসাবে। এখন তুতানের মা হতে হলে আমার স্ত্রী হতেই হয়। আপনাকে আমি বিশ্বাস, ভরসা, শ্রদ্ধা, সম্মান সব-ই করি। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে এগুলো প্রাথমিক প্রয়োজন। আর ভালবাসার কথা যদি বলেন, আমি হাত বাড়াবো না। যেদিন আপনার মনে হবে, সেদিন আপনি বলবেন।
তার মানে অপরেশ শ্রীময়ীকে ভালবাসেন?
___ আমার মধ্যে এমন কি আছে সান্যাল বাবু?
অপরেশ হাসলেন।
___ কি নেই তা বলুন? আপনার মনটা খাঁটি সোনার। আমি জানি না আপনি জানেন কিনা, তবে আমি স্থির নিশ্চিত আপনি কোন অভিজাত বংশীয় কন্যা।
শ্রীময়ী মাথা নাড়ল
___ শুনেছি আমার বাবাদের বাংলাদেশে জমিদারি ছিল।
___ বাহ। দেখেছেন,আমি সঠিক।
___ কিন্তু আমি যে নীতিশের স্থান কাউকে দিতে পারব না।
শ্রীময়ী পরীক্ষা করতে চাইল।
___ আমি জোর করেছি নাকি?
___ সান্যাল বাবু আমি কাল চলে যাচ্ছি।
চোখের জল চেপে উঠে দাঁড়িয়ে বলল শ্রীময়ী। অপরেশ চেয়ার থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন।
__ সে কি? কেন? প্লিজ এরকম করবেন না। আপনার ছেলের কি হবে?
___ আমি জানি তুতান সোনা কষ্ট পাবে। কিন্তু তাও আমার থাকা হবে না। আমি থাকলেই ও আরও কষ্ট পাবে।
___ কি যা তা বলছেন?
___ আমি ঠিকই বলছি। আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। কালই চলে যাব আমি। তুতানকে বলবেন ওর মা ওকে খুব ভালবাসে, আর সারাজীবন বাসবে।
___ আর তুতানের বাবার কি হবে? তারও যে তুতানের মাকে খুব দরকার।
অপরেশের কথায় বিহ্বল চোখে উনার দিকে তাকাল শ্রীময়ী।ভালবাসা খুঁজতে চাইল। পেয়েও গেল। সামলাল নিজেকে।
___ তুতানের বাবা তুতানকে বড় করবে।
___ একা হাতে পারবে না যে?
___ তুতানের মাকে ভালবেসে থাকলে, পারবে। নিশ্চয় পারবে।
অপরেশ বুঝলেন উনি ধরা পরে গেছেন। নিজের ভালবাসা লুকালেন না।
___ তুতানের বাবা তুতানের মাকে খুব ভালবাসে শ্রীময়ী। সব যুক্তি তর্কের বাইরে গিয়ে মন থেকে ভালবাসে।
___ তাহলে তিনি আমায় বুঝবেন। আমি আসি... আজ রাতটা তুতানের কাছে আমার শেষ রাত। ওকে প্রাণভরে আদর করে দিই গে যাই।
অপরেশ বুঝলেন শ্রীময়ী পালাতে চায়, অপরেশের কাছ থেকে, ওনার ভালবাসার কাছ থেকে। আটকালেন না।অথচ শ্রীময়ী পালাল নিজের কাছ থেকে। নিজের ভালবাসার কাছ থেকে। অপরেশ সান্যালকে ভালবেসে ফেলেছে ও। আরও কাছে থাকলে আরও ভালবেসে ফেলবে। আর শ্রীময়ীর ছায়ায় অপরেশ বা তুতানের কোন ক্ষতি হোক শ্রীময়ী চায় না।
তুতানকে চমকে দিয়ে অপরেশ স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিলেন। শ্রীময়ী এতক্ষণে চলে গেছে নিশ্চয়। বাড়ি ফিরে মাকে না পেলে তুতান বাড়ি মাথায় করবে। অপরেশ ছাড়া কেউ সামলাতে পারবে না। ভীষণ খুশি হয়েছিল তুতান। বাবা কোনদিন আনতে আসে না, আজ এসেছে বলে। বাড়ি ফেরার পথে বাবাকে আদরও করে দিয়েছে তাই। কানে কানে বলে দিয়েছে মার হাত থেকে বাঁচাতে। আজ তুতান স্কুলে পড়া পারেনি। মিস রেড বুকে লিখে দিয়েছেন। বাড়ি গেলেই মা আগে রেড বুকটা চেক করবে। তারপর তুতানের হবে। বাবা আছে, তাই ভরসা। কিন্তু মা কোথায়?
অপরেশ আশা করেছিলেন শ্রীময়ী মত বদলাবে। বাড়ি এসে শুনলেন ঘণ্টা খানেক আগে ব্যাগপত্র নিয়ে বেড়িয়ে গেছে। শ্রীময়ী কেন এরকম করল অপরেশ বুঝতে পারছিলেন না। তুতানকে ফেলে নিজে থাকতে পারবে না জেনেও... কি এমন বাধ্যবাধকতা ছিল? তুতানকে মিনু মাসি রাখতেই পারছে না। এত কান্নাকাটি করছে। এর বেশী কাঁদলে জ্বর আসবে যে! শ্রীময়ীর জন্যই তুতানের জ্বর আসবে। এতে শ্রীময়ীর কষ্ট হবে না? নাহ। ওর কাছে নিজের জেদটাই বড়। অপরেশ নিজের ঘরে এলেন। টেবিলের উপর চাপা দেওয়া একটা কাগজ। হাতে নিলেন। একি? এতো শ্রীময়ীর চিঠি। এক নিঃশ্বাসে পরে ফেললেন অপরেশ। পড়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। সম্বিৎ ফিরলেই মনে হল এখুনি ছুটতে হবে। হাওড়া খুব দূরে নয়। ট্রেন ছাড়তে অনেক দেরী। যে করেই হোক তুতানের মাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে।
শ্রীময়ীকে খুঁজতে গিয়ে প্রায় সব কামরা হাতড়ে ফেলেছিলেন অপরেশ। অবশেষে পাওয়া গেল। শ্রীময়ী চুপ করে বসে আছে।জানলার ধারে।অপরেশকে দেখেই চমকে উঠল। চোখ ভরতি জল। বসে বসে কাঁদছে। কষ্ট পাচ্ছে তাও আত্মত্যাগ।
___ নেমে আসুন।
___ কেন?
___ আমি বলছি, তাই। যত সব উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা। এই আপনি শিক্ষিত?
____ আমার চিঠি পড়েও...
__ ওটা চিঠি? যতসব! আপনাকে ভালবাসলে মরতে হবে, তাই তো? বেশ। আমি রাজি। নামুন এবার।
___ তুতানের ক্ষতি হবে যে!
অপরেশ রেগে গেলেন এবার। নিজে উঠে শ্রীময়ীর লাগেজ ট্রেন থেকে নামিয়ে নিলেন।
___ এবার চলুন। সিন ক্রিয়েট করবেন না।
___ সান্যাল বাবু ছেলের বিপদ হলে? এমনিতেই জ্বর সারছে না।
____ কাল দুজনে মিলে তুতানকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।সেরে যাবে। তবে আজ যা কাঁদছে, জ্বর চলে এসেছে বোধহয়। আপনি বোঝেন না, মা কাছে না থাকলে এমনিতেই মরে যাবে ও! আর ওর বাবাও বাঁচবে না তাহলে। কুসংস্কার ভুলে যান। বাবা, মা, নীতিশ, সন্তান সব হারিয়েছেন। জানি। সেক্ষেত্রে আপনার কোন দোষ ছিল না। কিন্তু তুতান বা তুতানের বাবাকে হারালে নিজের দোষে হারাবেন।
অঝোরে কাঁদছিল শ্রীময়ী। ওর মন খুব অশান্ত এখন।অপরেশ এক হাত দিয়ে শ্রীময়ীর চোখের জল মুছিয়ে দিলেন।
__ বাড়ি চলুন। আমি এসব পয়া অপয়া মানি না। শুধু মানি ভালবাসাকে। ভালবাসা সব ঠিক করে দিতে পারে। জানি না আমার আপনার নীতিশের মত ভালবাসার যোগ্যতা আছে কিনা কিন্তু আমি আমার মনের কাছ থেকে পরিষ্কার। আমার স্ত্রীকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। কারোর স্থানে বসিয়ে নয়, নিজের আলাদা স্থানে রেখেই আপনাকে ভালবাসি।
___ আমি...আমি আপনার...
__ হ্যাঁ। আমার স্ত্রী। তুতানের মা বলে চিঠিতে সই করেছেন। এদিকে আমাকে ফাঁকি দেবেন, তা হবে না। আবার এটা জানার পর যে আপনিও আমাকে ভালবাসেন, আপনাকে চলে যেতে দেব ভাবলেন কি করে? অস্বীকার করতে পারবেন না লিখিত প্রমান আছে।
শ্রীময়ী ভাবেনি এরকমটাও হতে পারে। ভেবেছিল শ্রীময়ীর মনের ভয় জানতে পেরে অপরেশ ওকে যেতে দেবেন। অথচ হল তার উল্টো।অপরেশের কথা বলার ঢঙে শ্রীময়ী হেসে ফেলল।
__ যাক। হাসলেন তাহলে। এবার চলুন। না হলে আপনাকেই পরের সাত রাত জাগতে হবে।
তুতান মাকে দেখেই খাট থেকে লাফিয়ে নেমে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল।
__ কোথায় গিয়েছিলে? চলে যাচ্ছিলে না? আমায় না বলে? একটুও ভালোবাসো না আমায় না? যাও, যেখানে যাবে চলে যাও।
অভিযোগে জর্জরিত শ্রীময়ীকে বাঁচাতে অপরেশ এগিয়ে এলেন।
__ ধুর বোকা! মা তোকে ফেলে কোথায় যাবে? তোর জন্য একটা জিনিস আনতে গিয়েছিল।
তুতানের মান ভাঙ্গাতে হবে জেনেই অপরেশ ফেরার পথে ক্যাডবেরি কিনে শ্রীময়ীর হাতে দিয়ে দিয়েছিল।
__ কি জিনিস?
__ এই যে...
শ্রীময়ী তুতানকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
___ বাবাও তো আনতে পারত, তুমি গেলে কেন?
___ ইচ্ছা হল। আচ্ছা বাবা, সরি।
__ না বলে আর যাবে না তো?
তুতানের কথায় অপরেশ হেসে ফেললেন।
__ একদম যাবে না। শ্রীময়ী আপনার ছেলে আজ স্কুলে...
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে তুতানের মন অন্য দিকে আনতে চাইলেন অপরেশ
__ না বাবা। মাকে বোলো না...
শ্রীময়ী বুঝল তুতান স্কুলে পড়া পারেনি।
__ বাবা না বললেও আমি তো রেড বুক দেখলেই জেনে যাব।
তুতানের মুখ শুকিয়ে গেল সাথেসাথেই। শ্রীময়ী লক্ষ্য করল
__ তবে আজকে তুতানের মন খারাপ।তাই নো পানিশমেন্ট।
তুতান মাকে জড়িয়ে ধরল, শ্রীময়ী বুঝল ওর আর রাগ নেই। অপরেশ কাছে এসে প্রথমে তুতানকে তারপর তুতানের মাকে একটু করে আদর করে দিলেন। মায়ার বাঁধন কাটা খুব শক্ত। আবারও সংসারের মায়ায় জড়িয়ে গেলেন অপরেশ।
চলে যাওয়া কথাটা বলতে যতটা সহজ প্রকৃতপক্ষে চলে যাওয়া তত সোজা নয়। চলে যাওয়ার পথে আসে অনেক বাধা, অনেক পিছুটান। শ্রীময়ীর ক্ষেত্রেও ঠিক এক-ই রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যদিও ও জানে, ওর আর এখানে থাকা চলে না, তবুও চলে যাওয়ার বেলায় মন কেমন করছে। মন শক্ত করেছে ও। সান্যালবাবুর প্রস্তাবে রাজি হওয়া সম্ভব নয়। যা সম্ভব নয় তাকে স্বীকার করে মিথ্যা জীবন যাপন করা ওর দ্বারা হবে না। শিলিগুড়ি ফিরে যাবে তাই। কালই। আজকেই যেত, কিন্তু আকাশের কথা ভেবে আজ যেতে পারল না। শরীর খারাপ ছেলেটার। ওকে কাঁদিয়ে চলে যেতে একটুও ভাললাগবে না শ্রীময়ীর, কিন্তু এর পরে এই বাড়িতে আর থাকাও যাবে না। নয় নয় করে প্রায় দুই বছর এই বাড়িতে কাটিয়ে ফেলল। নীতিশ মারা যাওয়ার পর একটা চাকরির খুব দরকার ছিল। শ্রীময়ী তখন প্রেগন্যান্ট। দুমাসের বাচ্চা পেটে রেখে বাস দুর্ঘটনায় মারা যায় নীতিশ। সম্বল বলতে দমদমে ভাড়ার ফ্ল্যাট আর বিমার সামান্য টাকা। নীতিশ কিছুই জমিয়ে যেতে পারেনি। সাধারণ বেসরকারি চাকরি করত। বীমার দরুণ পাওয়া লাখ খানেক টাকা দিয়ে জীবন চলবে না। বেশ বুঝেছিল শ্রীময়ী। তার উপর তিনকুলে কেউ নেই। নীতিশ অনাথ আর শ্রীময়ীর মামা বাড়ি ছাড়া কাছের কেউ নেই।তাও তারা থাকেন সেই শিলিগুড়ি। শোক করার মত বাহুল্য তাই শ্রীময়ীর ছিল না। আগুপিছু না ভেবে, কারখানায় কাজ নিয়ে নিল। হাড় ভাঙ্গা খাটনি। সইল না। পেটের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল। নীতিশের উত্তরাধিকারি রইল না। মাস দুয়েক কাজ ছেড়ে বাড়ি বসে ছিল। কিন্তু খিদে বড় বালাই। কাজ খুঁজতে নামতেই হল। শ্রীময়ীর নামকরণ সার্থক ছিল।বাপ-মা মরা মেয়ের কে এমন সঠিক নাম দিয়েছিল জানা না গেলেও, তার বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়। চেহারায় একটা শ্রী আছে ওর, আভিজাত্যও আছে চেহারার মধ্যে। পিতৃকুল নাকি জমিদার ।মামাদের কাছ থেকে শোনা। তবে সেই জমিদারির কানাকড়িও শ্রীময়ী পায়নি।পাবেই বা কি করে? জমিদারি বাংলাদেশে আর বাবা ছিলেন উদ্বাস্তু।শ্রীময়ীর জন্মের সময় মা মারা যান।বছর দুয়েকের যখন তখন বাবাও মায়ের পিছু নেন। বাপ-মা মরা শ্রীময়ী মামাবাড়ি মানুষ। অনাদরে। অপয়া অপবাদ মাথায় নিয়ে।শ্রীময়ী কিছুটা পড়াশুনাও জানে। উচ্চমাধ্যমিক অবধি পড়েছে।ভালই রেজাল্ট করত। ধীর , স্থির, বুদ্ধিমতী বলে শিক্ষিকাদের প্রিয়পাত্রী ছিল। যেবার পরীক্ষা দেবে, সেবারই নীতিশের সাথে পালিয়ে আসতে হল। না হলে মামারা অন্যত্র বিয়ের ঠিক করেছিল। পরীক্ষাটা তাই দেওয়া হয়নি। একটু আক্ষেপ থাকলেও নীতিশকে পেয়ে সব কিছু ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু নীতিশ আর নীতিশের সন্তান যখন কেউই ওর পাশে রইল না তখন দু এক বার মরার কথা যে ভাবেনি শ্রীময়ী তা নয়। অথচ মরতে পারেনি। মরতে যখন পারলই না তখন কাজ করেই খেতে হবে। কাজের সন্ধানেই ওর কাগজ লক্ষ্য করা আর গভর্নেস চাই এমন অ্যাড দেখে এ বাড়িতে আসা। সান্যাল ভিলায় এসে শ্রীময়ী খুব অবাক হয়েছিল। এত বড় বাড়ি যে হয়, তা ওর ধারণার বাইরে ছিল। চাকরিটা হবে না ভেবেই ইন্টারভিউ দিয়েছিল, কিন্তু চাকরি ওরই হয়েছিল। সান্যালবাবু মানে অপরেশ সান্যালের একমাত্র পুত্র আকাশের গভর্নেসের চাকরি। সারাদিনের ডিউটি। থাকা খাওয়া সমেত মোটা মাইনে। শ্রীময়ী হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলার ভুল করেনি। আকাশের বয়স তখন চার। সদ্য মা হারা ছেলেটাকে দেখাশোনা করার জন্য বাড়িতে পর্যাপ্ত চাকর বাকর ছাড়া আপনার বলতে কেউ ছিল না। সান্যাল বাবুরও কাছের আত্মীয় বলতে তেমন কেউ নেই। সেই থেকে দু বছর আকাশের সব দায়িত্ব নিখুঁতভাবে পালন করেছে শ্রীময়ী। শুধু কাজ বলে নয়, মনের টানেও আকাশকে আপনার করে নিয়েছিল শ্রীময়ী। যে এসেও এল না, তার কথা আকাশকে দেখলেই মনে পড়ে যেত। প্রথম প্রথম ঐ টানেই ভালবেসেছিল। এখন আকাশকে, আকাশের জন্যই ভালবাসে। তবুও কাল আকাশকে ছেড়ে চলে যাবে ও। গোছ গাছ হয়েই এসেছে। আকাশ বুঝতে পারলে অনেক করে মানা করবে শ্রীময়ীকে। অথচ শ্রীময়ী নিরুপায়।
সন্ধ্যাবেলা আকাশের টিউটর আসেন। উনি পড়িয়ে চলে গেলে শ্রীময়ী নিয়ম করে পড়াগুলো দেখে নেয়। আজও সেই রুটিনের অন্যথা হলনা। আকাশ ভেবেছিল আনটি আসবে না। শ্রীময়ীর আসায় অবাক হল তাই। বাবার কথায় আনটি রাগ করেছে, এত রাগ করেছে যে চলেই যাবে। কিন্তু বাবার তো কোন দোষ নেই। আকাশই তো বাবাকে অনেক করে বলেছিল, আনটিকে মা হয়ে আসার কথা বলতে। কয়েকদিন ধরেই বলে। বাবা বলত না। বাবা ঠিক জানতো যে, আনটি রাগ করবে। পরশুর জ্বরের পর বাবাও আর না করতে পারেনি। জ্বরের ঘোরে আকাশ নাকি অনেক বার ‘মা’ বলে ডেকেছিল। আনটিকেই। আনটি মানা করেনি। রাতে আনটির ঘরে আনটিকে শুতে যেতে দেয়নি আকাশ।জেদ করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। আনটি ওর কোন জেদ, কোন আব্দার ফেলেনি। এইসব দেখেই তো বাবা ভেবেছিল, আনটিকে বললে রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু... আকাশ জানে আনটি ওকে খুব ভালবাসে। একদম মায়ের মতই ভালবাসে। মায়ের কথা আবছা মনে পরে আকাশের। মায়ের জন্য আগে খুব মন খারাপ হত। আনটি আসার পর থেকে সেই মনখারাপগুলো কমতে কমতে এখন ভ্যানিশ হয়ে গেছে। মা যেভাবে ওকে ভালবাসত, নিজে হাতে খাওয়াত, স্নান করাতো, ঘুম পারাত, পড়া দেখত আনটিও ঠিক সেভাবেই সব কিছু করে। আকাশের মন খারাপ হলে সবার আগে বুঝে ফেলে। আকাশের আনন্দে সবচেয়ে আনন্দ পায়। আকাশ দুষ্টুমি করলে বকে, পরে মায়ের মত নিজেই কষ্ট পায়। আকাশের শরীর খারাপ হলে মায়ের মতই রাত জাগে। আদর করে। কোথাও যায় না। তাহলে আকাশ যে আনটিকেই মা বলে ভাবে, মনে মনে মা বলে ডাকে, মা করতে চায়- তাতে আকাশের দোষ কোথায়? বাবা তো আকাশের জন্য মা চেয়েছে। বাবারই বা দোষ কোথায়? আনটি মায়ের সব কাজ করে কিন্তু মা হতে চায় না। বাবা বলছিল, আনটি কাল চলে যাবে। ইস। গেলেই হল! যে করেই হোক আটকাবে আকাশ।
____ এত কেয়ারলেস মিসটেক কেন, তুতান?
আনটি আকাশকে তুতান বলেই ডাকে। আকাশের ডাকনাম। শুধু বাবা আর আনটি- ই ডাকে।
_____ মন দিসনি একদম। মন কোথায় থাকে?
পড়ায় আজ একদম মন ছিল না আকাশের। থাকবেই বা কি করে? আনটি জানে না যেন, মন কোথায় ছিল। একে নিজে চলে যাবে, তার উপর আকাশকে বকছে। আকাশের মন তো আনটির কাছেই ছিল।
_____ মন ছিল না।
শ্রীময়ী থমকাল। কড়া চোখে তাকাল তারপর। ও বেশ জানে আকাশের মন কেন ছিল না।কিন্তু নরম হলে চলবে না। বকে ঝকে রাগ দেখিয়ে চলে যেতে চায় শ্রীময়ী। আকাশের কষ্ট কম হবে।
_____ মন ছিল না? বাহ। পড়তে বসলেই মন থাকে না। আর সব কাজেই খুব মন। বাঁদর হচ্ছ দিনেদিনে। ড্রয়িংগুলো হয়েছে? কাল স্কুলে জমা দিতে হবে, খেয়াল আছে?
আকাশ বুঝল আনটি ইচ্ছা করেই বকছে। কিন্তু আকাশ রাগবেই না। অভিমানও করবে না।
_____ তুমি আঁকিয়ে না দিলে আমি পারি?
শ্রীময়ী দেখল চলে যাওয়ার কথা পারার এটাই উপযুক্ত সময়। কাল আকাশ যখন স্কুলে যাবে, তখনি চলে যাবে শ্রীময়ী। কিন্তু একদম না বলে গেলে ঠিক হবে না। ওর বাবার মুখ থেকে শুনেছে হয়ত... সান্যাল বাবু বলছিলেন যে তুতানের আবদারেই উনার শ্রীময়ীকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া... বিশ্বাস হয়নি শ্রীময়ীর। শুধু তুতানের আব্দার? নিজের ইচ্ছা নেই? তা কি করে হয়? সান্যালবাবুর মত মানুষ চাইলেই কত ভাল মেয়ে বিয়ে করতে পারেন। তা না করে শ্রীময়ীকে এই প্রস্তাব দেওয়া কেন? নিজের অতীত কাল সান্যালবাবুকে খুলে বলেছে শ্রীময়ী। অথচ নীতিশের কথা জেনে, শ্রীময়ীর সন্তানের কথা জেনেও অপরেশ সান্যালের বিন্দুমাত্র যায় আসে না! তা কেমন করে হয়? শ্রীময়ীর মধ্যে এমন কি আছে? শ্রীময়ী কাল স্পষ্ট বলে দিয়েছে নীতিশের জায়গায় কাউকে বসাতে ও পারবে না। উত্তরে অপরেশ বলেছেন উনি ঐ জায়গা চান না, শুধু তুতানের মাকে চান। এতটা মহান কি কেউ হতে পারে? নাকি এসবই মন জয় করার নাটক মাত্র।
____ আমি না থাকলে আঁকবি কি করে?
_____ তুমি থাকবে না কেন?
______ বাবা কিছু বলেনি? আমি কাল চলে যাচ্ছি।
_____ গেলেই হল। আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে তুমি? একবার গেছ, এবার যেতেই দেব না।
আকাশের কথায় অবাক হল শ্রীময়ী। একবার গেছ বলতে তুতান ওর মায়ের কথা বলতে চাইছে। গত কয়েকদিনে দুবার জ্বর হয়ে গেছে ওর। আগেরবার বাড়াবাড়ি হয়েছিল। সান্যালবাবুও ছুটি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেরে উঠে পরশু আবার জ্বর। একদিনই ছিল। কি যে হচ্ছে! ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে, কথাটা পরশুদিনই ওর বাবাকে বলেছে শ্রীময়ী। ডাক্তার কাকার ওষুধে জ্বর পুরোপুরি সারছে না। জ্বরের ঘোরে অনেকবার শ্রীময়ী তুতানের মুখে মা ডাক শুনেছে। অন্যান্যদিনও রাতে তুতান ঘুমিয়েছে কিনা দেখতে এলে, আধো ঘুমে তুতান মা বলে ডেকে জড়িয়ে ধরেছে। এসব কিছুকেই ভ্রম বলে ভাবত শ্রীময়ী। মা হারা ছেলের স্বাভাবিক মা চাওয়া। অথচ আজকে নিজে মুখে তুতান সেই রকমই ইঙ্গিত দিল। তাহলে ওর বাবার কথাই কি ঠিক? তুতানের একান্ত আবদার আর জেদ অপরেশ বাবুকে বাধ্য করেছে, শ্রীময়ীকে প্রস্তাবটা দিতে?
____ একবার গেছি মানে?
____ গিয়েছিলেই তো। তারপর আবার এলে, আর যেও না মা।
মা! জ্বর বা ঘুমের ঘোর নয়, সামনাসামনি শ্রীময়ীর আদরের ধন প্রথমবার মা বলে ডাকল। শ্রীময়ীর কি ভাল লাগলো না? বেশ ভাল লাগল। জ্বরের ঘোরে শুনতে যত ভাললাগে, তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভাল লাগল।
____ কে বলল আমি তোর মা? বাবা?
_____ ধুর! বাবা বলবে কেন? আমি-ই বলেছি। আমি-ই তো বাবার কাছে জেদ করেছি তোমাকে মা করে এনে দেওয়ার জন্য।
____ তুই? তোর কেন মনে হল আমি তোর মা?
জানতে চায় শ্রীময়ী।তুতানের চাওয়ার হদিশ যখন পেয়েছে, তখন তার কুল কিনারা করতে চায়।
_____ কেন আবার? তুমি মা, তাই মা। এর আবার কেন কি? সব্বার মা তাদের যেমন ভালবাসে তুমিও আমায় তেমনি ভালোবাস। সবার মা তাদের জন্য যা যা করে আমার জন্য তুমি-ই সব কর, তাই।
শ্রীময়ীর চোখে জল চলে এসেছিল। স্বামী, সন্তানের মৃত্যুর পর মা ডাক শোনার আশা এ জীবনে আর ছিলনা। অথচ সব মেয়ের মত শ্রীময়ীও একান্ত ভাবেই এই ডাক শুনতে চাইত। আজ তুতানের ডাকে ওর সেই ইচ্ছা পূর্ণ হল।
_____ বেশ ভাল ভেবেছিস তো...
_____ আমি ভালই ভাবি। এবার বল তুমি চলে যাবে?
তুতানের মুখের হাসিটাকে ম্লান করতে ইচ্ছা হল না শ্রীময়ীর। চলে ওকে যেতেই হবে। অপরেশ বাবুর যোগ্য ও নয়। তুতানের মা হওয়ার যোগ্যতাও ওর নেই। আজ অবধি যে সম্পর্কেই জড়িয়েছে তাদের মৃত্যু গ্রাস করেছে। তুতান আর তুতানের বাবার ক্ষতি চায় না শ্রীময়ী।
____ না। যাব না। তোকে ফেলে কোথায় যাবো?
আকাশ খুশিতে লাফিয়ে উঠল। মাকে জড়িয়ে ধরল।
___ সত্যি মা? প্রমিস?
__ প্রমিস। তুতানের গালে আলতো আদর করে বলল শ্রীময়ী।
অপরেশ আজকাল অন্যান্য দিনের চেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছেন। আগে যখন ফিরতেন তখন তুতান ঘুমে ঢুলছে, না হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আগেরবারের জ্বরের পর থেকে অপরেশ ইচ্ছা করেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসছেন। জ্বরটা মারাত্বক হয়েছিল। ওষুধ খাওয়ালে ঘণ্টা খানেক কমছিল, তারপর আবার যে কে সেই। ঘাবড়ে গিয়েছিলেন অপরেশ। তুতানের কিছু হয়ে গেলে কি হবে নিজেই ভাবতে পারছিলেন না। একে নন্দিতাকে হারিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। বেঁচে থাকাটাই তুতানের জন্য। তাও তুতানের কাছে কতটুকুই বা আসতেন অপরেশ? সারাদিন কাজ আর কাজ। কাজে ডুবে থেকে নন্দিতাকে ভুলতে চাওয়া। খাওয়াদাওয়া ঘুম সব কিছুতেই অনিয়ম। তুতানের কাছে ইচ্ছা করেই বেশি আসতেন না অপরেশ। ওকে দেখলেই ওর মায়ের কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে যায়। আর শ্রীময়ীর উপর সম্পূর্ণ আস্থা ছিল বলে ছেলের ভারটা ওর উপরে দিয়ে নিজে নিজের মত থাকতেন, আর কষ্ট পেতেন। খুব ভুল করতেন। এই কয়েকদিনে এটুকু বুঝেছেন অপরেশ। জ্বরের ঘোরে ছেলের ভুল বকাগুলো নিজের কানে শুনেছেন আর বুঝতে পেরেছেন, তুতান বাবাকে কতটা কাছে চায়। শ্রীময়ীকে সারারাত একটু ক্ষণের জন্যও ছাড়ত না তুতান। তাই ইচ্ছা থাকলেও তুতানের পাশে শোয়ার জো ছিল না। তাও সারারাতে অনেকবার সন্তর্পণে ঘুরে ফিরে তুতানকে দেখে যেতেন অপরেশ। শ্রীময়ী সারারাত জেগেই থাকতো। অপরেশ ওর কাছ থেকে জ্বরের খোঁজ খবর নিতেন। তুতানের মুখে শ্রীময়ীর জন্য মা ডাক তখন-ই প্রথম শুনেছিলেন অপরেশ। অবাক চোখে তাকাতেই শ্রীময়ী বলেছিল, এটা তুতানের জ্বর বা ঘুমের ঘোরের ডাক। আগেও ডেকেছে। ছেলের জ্বর ভাল হয়ে গেলে ইচ্ছা করেই দুটো দিন ছুটি নিয়েছিলেন অপরেশ। ছেলের কাছে আসার জন্য। ওকে ভাল করে চেনার জন্য। বাবাকে না পাওয়ার কষ্টটা কতটা মেপে দেখার জন্য। তুতান বাবা সারাদিন বাড়িতে দেখে অবাক হলেও খুশিও হয়েছিল খুব।বাবা ঘনঘন ওর ঘরে আসছে, ওর সাথে গল্প করছে, ওর পড়াশোনার খোঁজ নিচ্ছে, দেখে ভারি আনন্দ হয়েছিল ছেলেটা্র। অপরেশ তুতানকে প্রশ্ন করেছিলেন
__তুতান, এত খুশি যে?
__ তুমি আছ, তাই।
অপরেশ ছেলের গালে চুমু খেয়েছিলেন
___ এরকম রোজ থাকলে ভাল?
___ খুব ভাল। কিন্তু অফিস?
অপরেশ হেসে ফেলেছিলেন
__ তাই তো! তাহলে রোজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে এলে কেমন হয়?
___ বেশ হয়। সত্যি আসবে?
___ একদম। রোজ আসব।
___ খুব ভাল হবে। আমিও আর মিস করব না তোমায়।
অপরেশ ছেলের মনের কথা জানতে চেয়েছিলেন
___ মিস কর আমায়?
___ খুব। তুমি সানডে করেও বাড়ি থাকো না। আর সব্বার বাবারা থাকে।
অপরেশ নিশ্চিত হয়েছিলেন তুতানের জ্বরের ঘোরের কথাগুলো নেহাত ভুল বকা নয়। তাহলে কি তুতান শ্রীময়ীকে জেনে বুঝেই মা বলে ডাকে? তুতানের পাশে শুয়ে পড়ে ওকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়েছিলেন।
___ আর মাকে মিস কর না?
___ মা কে? কই না তো? আগে করতাম, এখন তো আনটি আছে।
অপরেশ অবাক হয়েছিলেন। তুতানের শিশু মন নিজের অজান্তেই শ্রীময়ীকে মায়ের আসনে বসিয়েছে।
___ আনটি মায়ের মত ভাল?
--- হ্যাঁ। মা যেমন আনটিও তেমন।
তুতানের সাথে সেদিন আর কথা বাড়ান নি অপরেশ। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই তুতানের মনের খুব কাছাকাছি চলে আসতে পেরেছিলেন। রোজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে, তুতানের সাথে খেলে,গল্প করে, বন্ধুর মত মিশে নিজেকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করছিলেন। নন্দিতা থাকতে পরিবারের যে বাঁধন ছিল, তা একটুও ঢিলে হয়নি, অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলেন। শ্রীময়ী কি অদ্ভুত দক্ষতায় সব দায়িত্ব একদম নন্দিতার মত করেই সামলায়, তা অপরেশের নজর এড়ায় নি। কেবল তুতানের যত্নের দায়িত্ব ওর বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকা শ্রীময়ীর ধাতে নেই। সংসারের প্রত্যেক দিকে ওর তীক্ষ্ণ নজর। শ্রীময়ীর ব্যক্তিত্ব এমন যে সমস্ত চাকর বাকর মায় অপরেশের ব্যক্তিগত সচিব অবধি শ্রীময়ীর কথা শোনে, মান্যও করে। শ্রীময়ীও ওদের সমস্ত সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে খেয়াল রাখে। মিনুদি খেল কিনা, রাখালদা এই গরমে বাজার করে এসে জল পেল কিনা, ড্রাইভার কাকার মাইনে হল কিনা থেকে শুরু করে বাড়ির সাজ সজ্জা,খাওয়ার মেনু সবেতেই শ্রীময়ীর ছোঁয়া লেগে থাকে। আগে না বুঝলেও এই কদিনে বেশ বুঝেছেন অপরেশ, তিনি চোখ বুজে থাকলেও কোন জাদুমন্ত্রবলে সংসার দিব্যি চলে যাচ্ছে। শুধু কি সংসার? অপরেশের জামাকাপড়, টিফিন, ব্রিফকেস, ফাইল সব কিছুই এত সুন্দর করে কে সাজিয়ে রাখে আগে লক্ষ্য না করলেও এখন টের পেয়েছেন অপরেশ। তবে শ্রীময়ী এত কিছু করেও তুতানের একফোঁটা অযত্ন হতে দেয় না। তুতানের কোন কাজ অন্য কেউ করবে, এটা শ্রীময়ীর না-পসন্দ। অন্য কেউ করালে তুতানও করবে না। অগত্যা সব ঝক্কি শ্রীময়ীর। অপরেশ যত দেখছিলেন, তত মুগ্ধ হচ্ছিলেন। শ্রীময়ীর চেহারা বলে, ও ভাল বংশের মেয়ে। ভাগ্যের ফেরে হয়ত আজ এই দশা। তবে এত দারিদ্র্যেও শ্রীময়ীর ঋজুতা অম্লান। স্বল্প অথচ স্পষ্টবাদী। তুতানের কোন প্রয়োজনের জিনিস একবার চেয়ে না পেলে অপরেশ ডিনার টেবিলে শ্রীময়ীর উষ্মার সম্মুখীন হয়েছেন অনেকবার। নিজের ভুলে যাওয়ার জন্য লজ্জা পেয়েছেন, আবার ভুলে গেছেন। তুতানকে সময় দেওয়ার কথাও শ্রীময়ীই প্রথম বলে। অপরেশ গা করেননি। এখন সময় দিতে শুরু করে শ্রীময়ীর কথার অর্থ বুঝতে পারছেন। এর থেকে দেরী করলে, তুতান বাবার থেকে অনেক দূরে চলে যেত। এখন বাবাকে নতুন করে ফিরে পেয়ে বেজায় খুশি ও। তার সাথে একটা আবদারও করে ফেলেছে। ওর মা চাই। যে কোন মা নয়। শ্রীময়ী আনটিকেই মা হিসাবে চায় ও।শ্রীময়ী রাজি হবে না, অপরেশ জানতেন। নিজে বলে অপমানিত হতে চাননি। যদিও তুতানের জন্য শ্রীময়ীর থেকে ভাল মা এনে দেওয়া অসম্ভব, আর এই সংসারেরও শ্রীময়ীর মত কর্ত্রী দরকার। তবুও তুতানের মা হতে বলা মানে শ্রীময়ীকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া। নন্দিতা চলে যাওয়ার পর অপরেশকে অনেকেই বিয়ে করে নিতে বলেছিল। কিন্তু নন্দিতার জায়গায় কাউকে বসাতে পারবেন না বলেই...কিন্তু শ্রীময়ীকে বসানো যায়, অপরেশের সন্তানের মায়ের আসনে শ্রীময়ীকে দিব্যি বসানো যায়, শুধু শ্রীময়ীকেই বসানো যায়। কিন্তু অপরেশ কি শ্রীময়ীকে ভালবাসেন? বিশ্বাস করেন নির্ভর করেন... কিন্তু ভালবাসা? উত্তরটা পুরোপুরি হ্যাঁ-বাচক নয় জেনেই শ্রীময়ীকে প্রস্তাবটা দিতে দ্বিধা ছিল। আরও ভয় ছিল, শ্রীময়ী যদি ভুল বোঝে? যদি ভাবে তুতানের বাহানায় অপরেশ নিজের কামনার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন? এতশত ভেবে বলতে চেয়েও বলেননি। কিন্তু পরশুদিন তুতানের আবার যখন জ্বর এলো, তারপর অপরেশ আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারেননি। মনের কথা বলে ফেলেছেন শ্রীময়ীকে। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে, শ্রীময়ী ভুল বুঝেছে ওনাকে। চলে যাবে, এমন অভিপ্রায়ও জানিয়েছে। মনটা ভাল নেই তাই। তুতান যাকে ঘিরে মা হারিয়েও আবার বেঁচে উঠেছে সে চলে গেলে তুতানকে সামলানো দায় হবে।
___ তুতান! কি করছিস? এখানে ব্লু হবে কালারটা। ভাল করে দেখে রং ভর।
অপরেশ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শ্রীময়ীর রাগত গলা শুনল। শ্রীময়ী এই সময় তুতানকে পড়ায়। আজ আঁকা শেখাচ্ছে তাহলে। ছেলেটার মন ভাল নেই, আঁকবে কি করে? আজ সকালেই অপরেশ তুতানকে জানিয়ে দিয়েছেন শ্রীময়ী চলে যাবে বলেছে। তুতান বলেছে যে ভাবেই হোক আটকাবে। যেতে দেবেই না। দেখা যাক। মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে কি করে যায় শ্রীময়ী, অপরেশ দেখতে চান। যে ছেলের জন্য রাতের পর রাত জেগেও ক্লান্তি আসে না, যার একটু অযত্ন সহ্য হয় না, যার প্রত্যেকটা কাজ নিজে হাতে না করলে শান্তি হয় না, তাকে শ্রীময়ী ভালবাসে না, একথা ও নিজে মুখে বললেও বিশ্বাস করবেন না অপরেশ। আর বাধাটা যদি অপরেশ হন তবে কাল অপরেশ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তুতানের জন্য মা চান উনি। এর অতিরিক্ত কিছু চাইবেন না।
___ সরি মা। দাঁড়াও, ঠিক করে ভরছি এবার।
মা! তুতান শ্রীময়ীকে সরাসরি মা বলল? শ্রীময়ী কি রাগ করবে এবার? নাকি শ্রীময়ী মেনে নিয়েছে?
___ এবার দেখে ভর। না হলে কানমলা খাবি।
উত্তর দিল শ্রীময়ী। বাহ। তাহলে তুতানের কথায় কাজ হয়েছে! মনটা খুশিতে ভরে গেল অপরেশের। ছেলেটার আবদার রাখতে পেরেছেন তাহলে। শ্রীময়ী চলে গেলে বেগতিক হত।
___ তুতান মন দিয়ে কাজ করছ না কেন?
বাবার গলা পেয়ে তাকাল তুতান
___ মা কানমলা দিলে ভাল হবে?
শ্রীময়ী বুঝল, অপরেশ তুতানের ডাক শুনেছেন।
___ কখন এলেন?
__ এই মাত্র।
___ চা করি?
__ না। তুতানকে পড়াচ্ছেন, পড়ান।
___ বাবা, মা যাবে না। প্রমিস করেছে আমায়।
আকাশের হাসির ঝিলিক অপরেশের মুখেও খেলে গেল।
___ আমি বললে কাজ হল না, আর তুমি বললেই কাজ হল। দেখলে তো? তাই বলতাম তুমি বল, তোমার মা তোমাকে খুব ভালবাসেন।
___ জানি তো। মা খুব ভালবাসে আমায়।
শ্রীময়ীর খারাপ লাগছিল। আজ তুতানের মন রাখার জন্য মিথ্যা বলেছে। চলে যাবে ও। কিন্তু তুতানকে কাঁদতে দেখলে যেতে পারবে না। তাই না বলে চলে যাবে।
___ আপনি ডাক্তারের খোঁজ নিলেন?
প্রসঙ্গ পরিবর্তনে চমকালেও মুখে প্রকাশ করলেন না অপরেশ
___ হ্যাঁ। পরশু শনিবার। তুতানকে নিয়ে যাব।
___ জ্বরটা ভাল ঠেকছে না...
অপরেশ শ্রীময়ীর উদ্বেগ বুঝলেন। শ্রীময়ী কেন আকাশকে এত ভালবাসে, কাল ওর জীবন ইতিহাস জেনে বুঝেছেন অপরেশ। শ্রীময়ী বিধবা, এটা আগে থেকেই জানা ছিল। ইনটারভিউ দিতে এসে গোপন করেনি।শ্রীময়ী কাল আবার নতুন করে বলল। ভেবেছিল হয়ত অপরেশ ভুলে গেছেন। কিন্তু অপরেশ সব জেনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শ্রীময়ীর সন্তান নষ্টের ব্যাপারটা অজানা ছিল। সন্তান হারিয়ে শ্রীময়ীর মমতা আকাশকে আঁকড়ে ধরে সার্থক হয়েছে। আকাশকে নিয়ে ওর খুব উদ্বেগ তাই।
__ নিশ্চিত থাকুন। আপনার ছেলের কোন বিপদ আসতে ওর বাবা দেবে না।
__ আমিও তাই-ই চাই। তুতানের বাবা যেন এখনকার মত রোজ তুতানকে সময় দেন।
শ্রীময়ী ওর অনুপস্থিতিতে তুতানের যত্নের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইছে। অপরেশ অন্য মানে করলেন। ভাবলেন শ্রীময়ী চায় উনি রোজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসুন।
__ অবশ্যই আসব। তুতান আর তুতানের মাকে যথেষ্ট সময় দেব। কোন অভিযোগ করতে দেব না আপনাকে।
শ্রীময়ী বুঝল অপরেশ ভুল বুঝছেন। ভুলটা তুতানের সামনে ভাঙ্গাল না।
রাতে তুতানকে ঘুম পারাতে পারাতে অনেক কিছু চিন্তা মাথায় ভিড় করছিল। সান্যাল বাবু সব কিছু জেনেও তুতানের কথা ভেবে শ্রীময়ীকে বিয়ে করতে চান, অথচ শ্রীময়ীর কাছে তার আর অন্য কোন দাবি নেই। কেন? ছেলেকে এতটাই ভালবাসেন? ভালবাসলে এই দুই বছর ছেলেকে শ্রীময়ীর ভরসায় ফেলে নিজে মুখ ঘুরিয়ে ছিলেন যে? সেটা কি কাজের চাপে? নাকি স্ত্রী হারাবার শোকে? নাকি ছেলের কাছে আসাটা অভিনয়। শ্রীময়ীর মন ভেজাবার চাল। না, না। তা কেন হবে? শ্রীময়ী এমন কি দুর্লভ মেয়ে যার জন্য অপরেশ সান্যালকে নাটক করতে হবে? আর তুতানকে মাঝে রেখে নোংরা নাটক উনি করবেন না বলেই মনে হয়।এই দুই বছরে অপরেশকে ভাল করে দেখেছে শ্রীময়ী। এত নামী বিজনেসম্যান অথচ কি আপনভোলা! ঘরের দিকে একটুও নজর নেই। নিজের জিনিসপত্রই গুছিয়ে রাখতে পারেন না। আবার কে গুছিয়ে রাখে জানার চেষ্টাও করেন না। মিনু মাসি বলে, স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। নাকচ করতে এক মুহূর্তও ভাবেন নি। আপনভোলা বলেই কি নিজের দুঃখটাকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন? তুতানের দিকে ফিরে চাইতেন না? আবার এই মানুষটাই তুতানের গা গরমের খবর পেলেই উতলা হয়ে যান। এই হেঁয়ালির অন্ত কোথায়? অপরেশকে জানাতেই হবে, শ্রীময়ী কাল চলে যাচ্ছে। আগে থেকে না জানলে তুতানকে সামলাতে পারবেন না। কাল সকালে তুতানের স্কুল আছে। আজ রাতেই বলে দিতে হবে।
___ জেগে?
___ আপনিও তো ঘুমাননি।
___ তুতান ঘুমিয়েছে?
___ ক- খ-ন।
___ কানমলা দিতে হল আপনার ছেলেকে?
শ্রীময়ী হেসে ফেলল। তুতানকে শাসন একমাত্র শ্রীময়ীই করে।অপরেশবাবুর ধাতে ওসব নেই। আকাশকে তুই বলেও কেবল শ্রীময়ীই ডাকে। বাবাও ছেলেকে তুমি ছাড়া বলেন না।
___ নাহ। আজ কানমলা খায় নি।
অপরেশ ফাইলের থেকে চোখ তুললেন।
__ বসুন না। আর ছেলেকে শাসন করার ভারটা কিন্তু একান্ত আপনার। আমার দ্বারা ওসব হবে না। জানেন নন্দিতা বলত ছেলে নাচাতে তোমার জুরি মেলা ভার।
বলেই থমকালেন অপরেশ। শ্রীময়ীর সামনে এই প্রথম নন্দিতার কথা বলে ফেলেছেন।
__ ছেলে নাচাতে আমি অন্তত আপনাকে কখনো দেখিনি। সময় দিতেই দেখিনি তো প্রশ্রয়।
শ্রীময়ীর গলায় খেদ ঝরে পড়লো। অপরেশ অনুভব করলেন।
__ তখন আর এখনের মধ্যে পার্থক্য অনেক শ্রীময়ী। নন্দিতা চলে যাওয়ায় জীবনটাই অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল আমার। নিজেকে নিজেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। আগে ও থাকতে তুতানকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া আমার প্রত্যেক সানডের অভ্যাস ছিল। অথচ আপনি কোনদিন দেখেননি। তুতানকে মাঝে নিয়ে আমরা দুজনে শুতাম। আর আপনি এসে থেকে দেখেছেন ওর আলাদা ঘর। ওর থেকে দূরে পালাতাম। কারন ওকে দেখলেই ওর মাকে মনে পড়ে যেত। খুব ভুল করেছি জানি। এর আগের বারের জ্বরের সময় ওকে হারাবার ভয় পেলাম। কিন্তু সব হারালেও তুতানকে কি করে হারাব? তাই ফিরতে চাইছি।
অপরেশের কথায় ওনার ছেলের থেকে দূরে থাকার কারণ স্পষ্ট হল।
__ আপনার সদিচ্ছা বজায় থাকলেই ছেলেটার ভাল। তবে এই কদিনে ভালই বন্ধুত্ব করে ফেলেছেন দেখছি।
___ বন্ধু না হলে দুরত্ব কমাতে দেরী হত। বন্ধু হলাম বলেই না জানতে পারলাম ছেলের মা চাই। তাই তো আপনাকে বলার সাহস করলাম। জানতাম আপনি ভুল বুঝবেন, না করবেন... ভাববেন ছেলের নাম করে আমি নিজের জন্য আপনার ভালবাসা চাইছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি শুধু ওর জন্য মা চেয়েই দরবার করেছিলাম। ব্যর্থ হলাম। কিন্তু জানতাম তুতান আপনাকে যেতেই দেবে না। ওকে আপনি যতটা ভালবাসেন, নন্দিতার ভালবাসার থেকে কিছুমাত্র আলাদা মনে হয় না আমার। যাক, আপনারা মা ছেলেতে খুশি। আমিও খুশি। আপনাদের ছোট্ট দুনিয়ার এক কোনে আমাকে অল্প জায়গা দিলেই চলবে।
অপরেশের অনাবিল হাসি শ্রীময়ীকে ছুঁয়ে গেল। মানুষটা সত্যিই খুশি আজ। নিজে মন খুলে বাঁচতে পেরে, ছেলের জন্য মা এনে দিতে পেরে...
___ আমাকে এতটা ভরসা করছেন, যদি আমি অযোগ্য হই?
___ আপনার যোগ্যতার কোন প্রমাণপত্রের প্রয়োজন আমার নেই। এতদিন মনের তাগিদে আমার সংসারটাকে যিনি ধরে রেখেছেন, তাকে ছাড়া আর কাউকে এই সংসারের কর্ত্রী মানায় না।আমি বাইরের জগৎ নিয়ে পড়ে থাকি। কিন্তু এতটা অন্ধও নই যে বুঝি না আমার সব জিনিসপত্র কোন মন্ত্রবলে এমন সুন্দর করে গোছানো থাকে। আমাকে এইটুকু যত্ন করে যাবেন, ব্যাস।
___ আমাকে আপনার স্ত্রীর স্থানে বসাতে পারবেন আপনি?
___ যার স্থান তারই থাকে শ্রীময়ী। সবাই আলাদা আলাদা করে স্থান করে নেয়। যেমনটা আপনি তুতানের মনে করেছেন। আমার মনে করেছেন, তুতানের মা হিসাবে। এখন তুতানের মা হতে হলে আমার স্ত্রী হতেই হয়। আপনাকে আমি বিশ্বাস, ভরসা, শ্রদ্ধা, সম্মান সব-ই করি। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে এগুলো প্রাথমিক প্রয়োজন। আর ভালবাসার কথা যদি বলেন, আমি হাত বাড়াবো না। যেদিন আপনার মনে হবে, সেদিন আপনি বলবেন।
তার মানে অপরেশ শ্রীময়ীকে ভালবাসেন?
___ আমার মধ্যে এমন কি আছে সান্যাল বাবু?
অপরেশ হাসলেন।
___ কি নেই তা বলুন? আপনার মনটা খাঁটি সোনার। আমি জানি না আপনি জানেন কিনা, তবে আমি স্থির নিশ্চিত আপনি কোন অভিজাত বংশীয় কন্যা।
শ্রীময়ী মাথা নাড়ল
___ শুনেছি আমার বাবাদের বাংলাদেশে জমিদারি ছিল।
___ বাহ। দেখেছেন,আমি সঠিক।
___ কিন্তু আমি যে নীতিশের স্থান কাউকে দিতে পারব না।
শ্রীময়ী পরীক্ষা করতে চাইল।
___ আমি জোর করেছি নাকি?
___ সান্যাল বাবু আমি কাল চলে যাচ্ছি।
চোখের জল চেপে উঠে দাঁড়িয়ে বলল শ্রীময়ী। অপরেশ চেয়ার থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন।
__ সে কি? কেন? প্লিজ এরকম করবেন না। আপনার ছেলের কি হবে?
___ আমি জানি তুতান সোনা কষ্ট পাবে। কিন্তু তাও আমার থাকা হবে না। আমি থাকলেই ও আরও কষ্ট পাবে।
___ কি যা তা বলছেন?
___ আমি ঠিকই বলছি। আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। কালই চলে যাব আমি। তুতানকে বলবেন ওর মা ওকে খুব ভালবাসে, আর সারাজীবন বাসবে।
___ আর তুতানের বাবার কি হবে? তারও যে তুতানের মাকে খুব দরকার।
অপরেশের কথায় বিহ্বল চোখে উনার দিকে তাকাল শ্রীময়ী।ভালবাসা খুঁজতে চাইল। পেয়েও গেল। সামলাল নিজেকে।
___ তুতানের বাবা তুতানকে বড় করবে।
___ একা হাতে পারবে না যে?
___ তুতানের মাকে ভালবেসে থাকলে, পারবে। নিশ্চয় পারবে।
অপরেশ বুঝলেন উনি ধরা পরে গেছেন। নিজের ভালবাসা লুকালেন না।
___ তুতানের বাবা তুতানের মাকে খুব ভালবাসে শ্রীময়ী। সব যুক্তি তর্কের বাইরে গিয়ে মন থেকে ভালবাসে।
___ তাহলে তিনি আমায় বুঝবেন। আমি আসি... আজ রাতটা তুতানের কাছে আমার শেষ রাত। ওকে প্রাণভরে আদর করে দিই গে যাই।
অপরেশ বুঝলেন শ্রীময়ী পালাতে চায়, অপরেশের কাছ থেকে, ওনার ভালবাসার কাছ থেকে। আটকালেন না।অথচ শ্রীময়ী পালাল নিজের কাছ থেকে। নিজের ভালবাসার কাছ থেকে। অপরেশ সান্যালকে ভালবেসে ফেলেছে ও। আরও কাছে থাকলে আরও ভালবেসে ফেলবে। আর শ্রীময়ীর ছায়ায় অপরেশ বা তুতানের কোন ক্ষতি হোক শ্রীময়ী চায় না।
তুতানকে চমকে দিয়ে অপরেশ স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিলেন। শ্রীময়ী এতক্ষণে চলে গেছে নিশ্চয়। বাড়ি ফিরে মাকে না পেলে তুতান বাড়ি মাথায় করবে। অপরেশ ছাড়া কেউ সামলাতে পারবে না। ভীষণ খুশি হয়েছিল তুতান। বাবা কোনদিন আনতে আসে না, আজ এসেছে বলে। বাড়ি ফেরার পথে বাবাকে আদরও করে দিয়েছে তাই। কানে কানে বলে দিয়েছে মার হাত থেকে বাঁচাতে। আজ তুতান স্কুলে পড়া পারেনি। মিস রেড বুকে লিখে দিয়েছেন। বাড়ি গেলেই মা আগে রেড বুকটা চেক করবে। তারপর তুতানের হবে। বাবা আছে, তাই ভরসা। কিন্তু মা কোথায়?
অপরেশ আশা করেছিলেন শ্রীময়ী মত বদলাবে। বাড়ি এসে শুনলেন ঘণ্টা খানেক আগে ব্যাগপত্র নিয়ে বেড়িয়ে গেছে। শ্রীময়ী কেন এরকম করল অপরেশ বুঝতে পারছিলেন না। তুতানকে ফেলে নিজে থাকতে পারবে না জেনেও... কি এমন বাধ্যবাধকতা ছিল? তুতানকে মিনু মাসি রাখতেই পারছে না। এত কান্নাকাটি করছে। এর বেশী কাঁদলে জ্বর আসবে যে! শ্রীময়ীর জন্যই তুতানের জ্বর আসবে। এতে শ্রীময়ীর কষ্ট হবে না? নাহ। ওর কাছে নিজের জেদটাই বড়। অপরেশ নিজের ঘরে এলেন। টেবিলের উপর চাপা দেওয়া একটা কাগজ। হাতে নিলেন। একি? এতো শ্রীময়ীর চিঠি। এক নিঃশ্বাসে পরে ফেললেন অপরেশ। পড়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। সম্বিৎ ফিরলেই মনে হল এখুনি ছুটতে হবে। হাওড়া খুব দূরে নয়। ট্রেন ছাড়তে অনেক দেরী। যে করেই হোক তুতানের মাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে।
শ্রীময়ীকে খুঁজতে গিয়ে প্রায় সব কামরা হাতড়ে ফেলেছিলেন অপরেশ। অবশেষে পাওয়া গেল। শ্রীময়ী চুপ করে বসে আছে।জানলার ধারে।অপরেশকে দেখেই চমকে উঠল। চোখ ভরতি জল। বসে বসে কাঁদছে। কষ্ট পাচ্ছে তাও আত্মত্যাগ।
___ নেমে আসুন।
___ কেন?
___ আমি বলছি, তাই। যত সব উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা। এই আপনি শিক্ষিত?
____ আমার চিঠি পড়েও...
__ ওটা চিঠি? যতসব! আপনাকে ভালবাসলে মরতে হবে, তাই তো? বেশ। আমি রাজি। নামুন এবার।
___ তুতানের ক্ষতি হবে যে!
অপরেশ রেগে গেলেন এবার। নিজে উঠে শ্রীময়ীর লাগেজ ট্রেন থেকে নামিয়ে নিলেন।
___ এবার চলুন। সিন ক্রিয়েট করবেন না।
___ সান্যাল বাবু ছেলের বিপদ হলে? এমনিতেই জ্বর সারছে না।
____ কাল দুজনে মিলে তুতানকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।সেরে যাবে। তবে আজ যা কাঁদছে, জ্বর চলে এসেছে বোধহয়। আপনি বোঝেন না, মা কাছে না থাকলে এমনিতেই মরে যাবে ও! আর ওর বাবাও বাঁচবে না তাহলে। কুসংস্কার ভুলে যান। বাবা, মা, নীতিশ, সন্তান সব হারিয়েছেন। জানি। সেক্ষেত্রে আপনার কোন দোষ ছিল না। কিন্তু তুতান বা তুতানের বাবাকে হারালে নিজের দোষে হারাবেন।
অঝোরে কাঁদছিল শ্রীময়ী। ওর মন খুব অশান্ত এখন।অপরেশ এক হাত দিয়ে শ্রীময়ীর চোখের জল মুছিয়ে দিলেন।
__ বাড়ি চলুন। আমি এসব পয়া অপয়া মানি না। শুধু মানি ভালবাসাকে। ভালবাসা সব ঠিক করে দিতে পারে। জানি না আমার আপনার নীতিশের মত ভালবাসার যোগ্যতা আছে কিনা কিন্তু আমি আমার মনের কাছ থেকে পরিষ্কার। আমার স্ত্রীকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। কারোর স্থানে বসিয়ে নয়, নিজের আলাদা স্থানে রেখেই আপনাকে ভালবাসি।
___ আমি...আমি আপনার...
__ হ্যাঁ। আমার স্ত্রী। তুতানের মা বলে চিঠিতে সই করেছেন। এদিকে আমাকে ফাঁকি দেবেন, তা হবে না। আবার এটা জানার পর যে আপনিও আমাকে ভালবাসেন, আপনাকে চলে যেতে দেব ভাবলেন কি করে? অস্বীকার করতে পারবেন না লিখিত প্রমান আছে।
শ্রীময়ী ভাবেনি এরকমটাও হতে পারে। ভেবেছিল শ্রীময়ীর মনের ভয় জানতে পেরে অপরেশ ওকে যেতে দেবেন। অথচ হল তার উল্টো।অপরেশের কথা বলার ঢঙে শ্রীময়ী হেসে ফেলল।
__ যাক। হাসলেন তাহলে। এবার চলুন। না হলে আপনাকেই পরের সাত রাত জাগতে হবে।
তুতান মাকে দেখেই খাট থেকে লাফিয়ে নেমে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল।
__ কোথায় গিয়েছিলে? চলে যাচ্ছিলে না? আমায় না বলে? একটুও ভালোবাসো না আমায় না? যাও, যেখানে যাবে চলে যাও।
অভিযোগে জর্জরিত শ্রীময়ীকে বাঁচাতে অপরেশ এগিয়ে এলেন।
__ ধুর বোকা! মা তোকে ফেলে কোথায় যাবে? তোর জন্য একটা জিনিস আনতে গিয়েছিল।
তুতানের মান ভাঙ্গাতে হবে জেনেই অপরেশ ফেরার পথে ক্যাডবেরি কিনে শ্রীময়ীর হাতে দিয়ে দিয়েছিল।
__ কি জিনিস?
__ এই যে...
শ্রীময়ী তুতানকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
___ বাবাও তো আনতে পারত, তুমি গেলে কেন?
___ ইচ্ছা হল। আচ্ছা বাবা, সরি।
__ না বলে আর যাবে না তো?
তুতানের কথায় অপরেশ হেসে ফেললেন।
__ একদম যাবে না। শ্রীময়ী আপনার ছেলে আজ স্কুলে...
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে তুতানের মন অন্য দিকে আনতে চাইলেন অপরেশ
__ না বাবা। মাকে বোলো না...
শ্রীময়ী বুঝল তুতান স্কুলে পড়া পারেনি।
__ বাবা না বললেও আমি তো রেড বুক দেখলেই জেনে যাব।
তুতানের মুখ শুকিয়ে গেল সাথেসাথেই। শ্রীময়ী লক্ষ্য করল
__ তবে আজকে তুতানের মন খারাপ।তাই নো পানিশমেন্ট।
তুতান মাকে জড়িয়ে ধরল, শ্রীময়ী বুঝল ওর আর রাগ নেই। অপরেশ কাছে এসে প্রথমে তুতানকে তারপর তুতানের মাকে একটু করে আদর করে দিলেন। মায়ার বাঁধন কাটা খুব শক্ত। আবারও সংসারের মায়ায় জড়িয়ে গেলেন অপরেশ।
besh misti....
উত্তরমুছুন