সুস্মিতা সিং
মধ্য এশিয়া থেকে খাইবার পাস হয়ে আর্যরা এই ঔপনিবেশিক ভূখণ্ডে আসতে থাকেন খৃষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৫০০ – এই সময় সীমার মধ্যে। খৃষ্টপূর্ব ১৭০০ থেকে ১১০০ সালের কাছাকাছি সময়টাই হল আদি বৈদিক যুগ। এই সময়ই রচিত হয় ঋক্বেদ। এরই সমকালীন ইতিহাস হল মহাভারত।
ঋক্বৈদিক যুগের সামাজিক বিন্যাসটি বেশ আকর্ষনীয়। সমাজে জাতিগত ভাবে মূলতঃ দুটি ভাগ – আর্য এবং অনার্য; আর্যরা বহিরাগত, কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁরাই শাসক। আর অন্যদল উপমহাদেশের আদি আধিবাসী, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই অন্তরিত হয়েছেন বিন্ধ্যপর্বতের অপরপ্রান্তের নিরাপদ আশ্রয়ে। যে অনার্যরা উপনিবেশের মূলখণ্ডে অর্থাৎ বিন্ধ্যপর্বতের এই প্রান্তে আর্যদের সঙ্গে রয়ে গেলেন, তাঁরা হয়ে গেলেন দাস, দস্যু এবং শূদ্র। ক্রমশঃ আর্য উপজাতিও উপজিবীকার নিরিখে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল; ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য। প্রাথমিক ভাবে একে বলা হত বর্ণ, যার আভিধানিক সমার্থক শব্দ হল রঙ বা রং। অর্থাৎ, সেই সময় বর্ণ বিভেদ ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে কোনও সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল না। আর্যরা ছিলেন দীর্ঘদেহী, উন্নতনাসা, গৌরবর্ণ; অন্যদিকে, অনার্যরা খর্বকায়, স্থূলাগ্রনাসা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।
মূলতঃ চার বর্ণে বিভক্ত সমাজ – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। সমাজে প্রথম তিন বর্ণের আধিপত্য সমাধিক। অনার্য শূদ্ররা অবদমিত , বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে বাঁধা নেই বটে, কিন্তু দৈনন্দিন সম্পৃক্ততায় প্রবল আপত্তি। তাই সূতপুত্র কর্ণকে দু-দুবার পরিপূর্ণ জনসভায় লাঞ্ছিত হতে হয়, এক বার রাজপুত্রদের অস্ত্রপরীক্ষার দিন এবং পরবর্তীকালে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায়।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মনোজ্ঞ পাঠক,অনুধাবন করুন, মহাভারতের গতিপ্রবাহ। এ কাহিনীর সুবিশাল ইতিহাস আদ্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয়েছে কয়েকজন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ নারী-পুরুষের অঙ্গুলিহেলনে। তাঁদের মধ্যে তিনজন প্রত্যক্ষভাবে শূদ্রবর্ণের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁরা হলেন যথাক্রমে, সত্যবতী, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, কৃষ্ণ, আর্জুন এবং দ্রৌপদী।
এই পাঁচজনের মধ্যে সাত্যবতী, ব্যাসদেব এবং অর্জুন একই বংশলতাসূত্রে আবদ্ধ। বাসবরাজ উপরিচর বসুর সপ্তম পুত্র মৎস্য বা মৎস্যকাল; তাঁরই পুত্রী সত্যবতী। আর, তাই তিনি মৎস্যগন্ধা এবং বাসবী-ও। এঁরা ছিলেন মৎস্যদেশ অর্থাৎ রাজপুতানার অধিবাসী। সত্যবতীর মা ছিলেন আর্যজনবিগর্হিতা রমণী, তাই মৎস্যরাজের অন্তঃসত্ত্বা পত্নী বিসর্জিতা হয়েছিলেন ধীবর পল্লীতে। সেখানেই পালিতা হয়েছেন সত্যবতী, তাই তাঁর গায়ে আঁশটে গন্ধ, যা বহুদূর থেকে থেকে পাওয়া যায়; আর তাই তিনি যোজনগন্ধা। সেই সূত্রে সত্যবতী অনার্যা – শূদ্রাণী।
মর্যাদাময়ী সত্যবতী নিজেকে দাস রাজার কন্যা বলে পরিচয় দিতে অধিক গর্ববোধ করেন। তিনি পিতার অনুপস্থিতিতে যমুনায় খেয়া পারাপার করেন। এমনই এক সায়াহ্নে ঋষিশ্রেষ্ঠ পরাশর খেয়া পারের জন্য যমুনার উপকূলে উপস্থিত হয়ে দেখলেন নৌকার প্রান্তদেশে এক নিষন্না কৃষ্ণবর্ণা রমনী চিত্রার্পিত মূর্তির মতো বসে । আসন্ন সন্ধ্যারাগে উদ্ভাসিত দিগন্তের অরুনাভাস এসে পড়েছে রমনীর চিক্কণ কৃষ্ণবর্ণ শরীরের উপর। ঘন কৃষ্ণ কেশরাশি মাথার উপর চূড়া করে বাঁধা। আতাম্র ওষ্ঠাধারে মুক্তাঝরা হাসি। রমণীর উত্তমাঙ্গের বস্ত্র পৃষ্ঠলম্বী সূত্রগ্রন্থিতে দৃঢ়নিবদ্ধ, অধমাঙ্গের পরিধান কিছু খাটো। প্রায় ঊরু পর্যন্ত অনাবৃত। এই অনাবরণ প্রকট লাবণ্য পরাশরের পৌরুষেয় দৃষ্টিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হল না।
ঋষিশ্রেষ্ঠ শরবিদ্ধ হলেন। মুগ্ধ মুনিবর এই উদ্ভিন্নযৌবনা রমণীর আসঙ্গলিপ্সা করলেন মনে মনে। কোনও ভণিতা না করে সত্যবতীর কাছে পুত্রার্থে মিলন কামনা করলেন পরাশর। আপন জন্মশোকাভিতপ্তা কুমারী সত্যবতী এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধান্বিতা হয়েছেন। পরক্ষণেই ঋষিপ্রবরের পরম আশ্বাসে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। এবং যমুনার মধ্যবর্তী এক দ্বীপে তাঁদের মিলন সাধিত হয়েছে। সেখানেই জন্ম হয়েছে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস-এর। তৃপ্ত পরাশরের আশীর্বাদে যোজনগন্ধার শরীর পদ্মসৌরভে সুগন্ধিত হয়ে উঠেছে।
এই শূদ্রাণী সত্যবতীকে পরবর্তী কালে বিবাহ করেছেন হস্তিনাপুররাজ শান্তনু। বিবাহের একমাত্র শর্তই ছিল সত্যবতীর গর্ভজাত পুত্রই হবেন হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী। অর্থাৎ , বিবাহের পূর্ব থেকেই সত্যবতী হস্থিনাপুরের ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রিত করতে শুরু করেছেন নিজহস্তে।
পরবর্তী কালে সত্যবতীপুত্র চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্যের নিঃসন্তান অবস্থায় অকালপ্রয়াণের পর সত্যবতীর কালীন পুত্র ব্যাসদেব কিভাবে মহারাজ শান্তনুর বংশলতায় পুনরায় প্রানপ্রবাহ সঞ্চালিত করেছেন, সে ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। সেই সূত্রে ধনঞ্জয় বীর সব্যসাচী অর্জুন হলেন ব্যাসদেবের পৌত্র এবং মাতা সত্যবতীর প্রপৌত্র।
সমগ্র মহাভারতের সুবিশাল পরিসরে মাতা সত্যবতী তাঁর সমকালীন সময়ের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন পেশাদারী নৈপুণ্যে ও দক্ষতায়। এই কাজে তাঁকে অনেকাংশে সাহায্য করেছেন তাঁর কালীন পুত্র ব্যাস। পরবর্তীকালে ধনঞ্জয় অর্জুনও একাধারে সামরিক রাজনীতির পরিকল্পক ও নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন স্বইচ্ছায়, স্বমহিমায় ও স্বকীয়তায়। নিপুণ পরিকল্পকের মতোই বারো বৎসর ব্রহ্মচর্য পালন কালে তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বিচরণ করেছেন এবং আর্য-অনার্য নির্বিশেষে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন একান্তই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার আকাঙ্খায়; কুরুক্ষেত্রের মহাসমর কালেও তিনিই সৈনাপত্য গ্রহন করেছেন ধনঞ্জয়সখা বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কে তো দেখা যায় সমগ্র মহাভারত জুড়েই তাঁর অবাধ বিচরণ। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই তিনি নিয়ামকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। এঁরা তিনজনই কিন্তু ছিলেন বর্ণসংকর শূদ্র সম্পর্কিত ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের নারী-পুরুষ।
মহাভারতের কথা অধিকাংশই অকথিত থেকে যায় যে পুরুষটির কথা না বললে, তিনি হলেন পুরাণ পুরুষোত্তম, কপট চূড়ামণি, বিশ্বমোহন বৃন্দাবনী লাম্পট্যে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল অথচ অত্যন্ত ধুরন্ধর , এক বিশাল মাপের রাজনৈতিক নেতা, পীতাম্বর শ্রীকৃষ্ণ; অসম্ভব তাঁর আকর্ষণী শক্তি। মহাকাব্য মতে, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্কন্যা দেবযানী ও নাহুষপুত্র যযাতির প্রথম পুত্র যদু থেকেই যদুবংশের সৃষ্টি। এই বংশেরই কুলতিলক কৃষ্ণকায় কৃষ্ণ। অর্থাৎ, এখানেও সেই বর্ণসংকর জন্মের ইতিহাস।
মহাভারতে বৃন্দাবনবিলাসী একনায়ক, মথুরা-দ্বারকার রাজাদের রাজা, কুরু-পাণ্ডবের ধর্মযুদ্ধের পুরোহিত, মহাভারতের মতো বিশাল জীবন-নাটকের সূত্রধার, কৃষ্ণকে প্রথম থেকেই আমরা দেখি এক কূটবুদ্ধি সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কর্মপ্রবাহ শুরু হয়েছে অত্যাচারী মাতুল কংসকে বধ করে এবং শেষ হয়েছে ভারতযুদ্ধ অন্তে সমগ্র উত্তর ও মধ্য ভারতের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। কৃষ্ণ যখন জন্মেছিলেন, সেই সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে ছিলনা। মগধরাজ জরাসন্ধ ছিলেন শ্রেষ্ঠতম পুরুষ; চেদিরাজ শিশুপাল, পুণ্ড্রবর্ধনের রাজা পৌণ্ড্র বাসুদেব, জরাসন্ধের জামাতা ও কৃষ্ণের মাতুল কংস, সকলেই জরাসন্ধের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
এমত পরিস্থিতি থেকে সমগ্র রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে অস্বাভাবিক দক্ষতায় নিজের অনুকূলে এনেছেন অত্যন্ত স্বল্প সময়ে। তার জন্য প্রয়োজনে কোথাও নিজে প্রত্যক্ষভাবে ছলনা ও কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন, কোথাও বা অন্যকে দিয়ে করিয়েছেন। একসময়, কুরু-পাণ্ডবের পারিবারিক বিবাদ আর পরিবারের সীমায় আবদ্ধ থাকেনি। এমনকি, সমগ্র ভারতযুদ্ধের দায়ও বর্তেছে তাঁরই উপর। এবং তার জন্যই, অবশেষে গান্ধারীর কাছ থেকে অভিশাপও গ্রহন করেছেন তিনি মাথা নত করে।
মহাভারতের রাজনৈতিক নেতা, কৃষ্ণকে ব্যাখ্যা করার জন্য এই পরিসর সত্যই বর স্বল্প। কিন্তু, যে কথাটি উল্ল্যেখ না করলে আখ্যানের বিষয়াভিলাষ অসম্পূর্ণ থেকে যায়, সেটি হল – মহাভারতের এই নায়ক পুরুষটিও ছিলেন একজন কালো মানুষ; বর্ণ বৈষম্যের শিলাভার তাঁকে অবদমিত করে রাখতে পারেনি কিছুমাত্র।
এই প্রসঙ্গে আমরা প্রবন্ধের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে যে বিদগ্ধা রমণীর কথা শুনবো, তিনি হলেন পঞ্চস্বামী গর্বিতা, কৃষ্ণসখী, যাজ্ঞসেনী পাঞ্চালী দ্রৌপদী। মহাভারতের এই চরমতমা নায়িকার জন্মও রহস্যাচ্ছন্ন। যজ্ঞবেদী থেকে উদ্ভূতা হয়েছেন কালো মেয়ে দ্রৌপদী। তাই তিনি কৃষ্ণা-ও। দ্রৌপদীর রূপের বর্ণনা করতে গিয়ে মহাকাব্যের কবি সচেতন হয়েছেন। “ সুকেশী সুস্তনী শ্যামা পীনশ্রোনীপয়োধরা “ - এই টুকুই মাত্র কৃষ্ণার শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনা পাওয়া যায় সমগ্র মহাভারতে। আসলে, কালো মেয়ে দ্রৌপদীর সৌন্দর্য তাঁর শরীরে নয়, সৌন্দর্য তাঁর বৈদগ্ধতায়; বৈদূর্যমণির মতো যা প্রতিভাত হয় স্বমহিমায়। আগুন তাঁর চরিত্রে, সে আগুনের সংস্পর্শে যারাই এসেছেন, হয় তাঁরা পুড়ে খাঁটি হয়েছেন , নয়তো জ্বলে রাখ্হয়েছেন।
এহেন নায়িকার কোন শৈশবকাল নেই। জন্মলগ্নেই তিনি উদ্ভিন্নযৌবনা এক কুমারী নারী। অলৌকিকতার আবরণ ছিন্ন করলে, ধরে নেওয়া যায় , রাজা দ্রুপদ ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদী কে দত্তক নিয়েছিলেন যজ্ঞাগ্নিকে সাক্ষী রেখে। এবং এই দত্তক গ্রহণও একান্ত ভাবেই রাজনৈতিক কারণেই। দ্রোণহত্যা তাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলেও, কন্যাকেও তিনি ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির স্বার্থেই। আর তাই, দত্তক নেওয়ার পরে পরেই তিনি দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেছেন। এর পরবর্তী থেকে শেষ পর্যন্ত মহাভারত আবর্তিত হয়েছে এই একতমা নায়িকা, কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে অবলম্বন করেই। এখানেও বর্ণবৈষম্য পরাভূত হয়েছে সমূলে।
মহাভারতীয় রঙ্গভূমিতে এই ক’জন কালো মানুষ সমগ্র লোককাহিনীটিকে মাতিয়ে রেখেছেন আগাগোড়া । গৌরবর্ণ শাসক জাতির উপর কৃষ্ণকায় মানুষগুলির এই আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণ বুঝিবা প্রকৃতিরই প্রতিশোধ। আর্যদের আগমনের পূর্বে এই উপমহাদেশীয় ভূখণ্ডে যে কৃষ্ণকায় মানুষগুলি একাধিপত্য করেছেন, তাঁদের যে এক মুহূর্তে অবদমিত ও নির্মূল করা যায়নি, মহাভারত তার সাক্ষ্য বহন করে।।
মধ্য এশিয়া থেকে খাইবার পাস হয়ে আর্যরা এই ঔপনিবেশিক ভূখণ্ডে আসতে থাকেন খৃষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৫০০ – এই সময় সীমার মধ্যে। খৃষ্টপূর্ব ১৭০০ থেকে ১১০০ সালের কাছাকাছি সময়টাই হল আদি বৈদিক যুগ। এই সময়ই রচিত হয় ঋক্বেদ। এরই সমকালীন ইতিহাস হল মহাভারত।
ঋক্বৈদিক যুগের সামাজিক বিন্যাসটি বেশ আকর্ষনীয়। সমাজে জাতিগত ভাবে মূলতঃ দুটি ভাগ – আর্য এবং অনার্য; আর্যরা বহিরাগত, কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁরাই শাসক। আর অন্যদল উপমহাদেশের আদি আধিবাসী, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই অন্তরিত হয়েছেন বিন্ধ্যপর্বতের অপরপ্রান্তের নিরাপদ আশ্রয়ে। যে অনার্যরা উপনিবেশের মূলখণ্ডে অর্থাৎ বিন্ধ্যপর্বতের এই প্রান্তে আর্যদের সঙ্গে রয়ে গেলেন, তাঁরা হয়ে গেলেন দাস, দস্যু এবং শূদ্র। ক্রমশঃ আর্য উপজাতিও উপজিবীকার নিরিখে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল; ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য। প্রাথমিক ভাবে একে বলা হত বর্ণ, যার আভিধানিক সমার্থক শব্দ হল রঙ বা রং। অর্থাৎ, সেই সময় বর্ণ বিভেদ ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে কোনও সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল না। আর্যরা ছিলেন দীর্ঘদেহী, উন্নতনাসা, গৌরবর্ণ; অন্যদিকে, অনার্যরা খর্বকায়, স্থূলাগ্রনাসা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।
মূলতঃ চার বর্ণে বিভক্ত সমাজ – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। সমাজে প্রথম তিন বর্ণের আধিপত্য সমাধিক। অনার্য শূদ্ররা অবদমিত , বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে বাঁধা নেই বটে, কিন্তু দৈনন্দিন সম্পৃক্ততায় প্রবল আপত্তি। তাই সূতপুত্র কর্ণকে দু-দুবার পরিপূর্ণ জনসভায় লাঞ্ছিত হতে হয়, এক বার রাজপুত্রদের অস্ত্রপরীক্ষার দিন এবং পরবর্তীকালে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায়।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মনোজ্ঞ পাঠক,অনুধাবন করুন, মহাভারতের গতিপ্রবাহ। এ কাহিনীর সুবিশাল ইতিহাস আদ্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয়েছে কয়েকজন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ নারী-পুরুষের অঙ্গুলিহেলনে। তাঁদের মধ্যে তিনজন প্রত্যক্ষভাবে শূদ্রবর্ণের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁরা হলেন যথাক্রমে, সত্যবতী, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, কৃষ্ণ, আর্জুন এবং দ্রৌপদী।
এই পাঁচজনের মধ্যে সাত্যবতী, ব্যাসদেব এবং অর্জুন একই বংশলতাসূত্রে আবদ্ধ। বাসবরাজ উপরিচর বসুর সপ্তম পুত্র মৎস্য বা মৎস্যকাল; তাঁরই পুত্রী সত্যবতী। আর, তাই তিনি মৎস্যগন্ধা এবং বাসবী-ও। এঁরা ছিলেন মৎস্যদেশ অর্থাৎ রাজপুতানার অধিবাসী। সত্যবতীর মা ছিলেন আর্যজনবিগর্হিতা রমণী, তাই মৎস্যরাজের অন্তঃসত্ত্বা পত্নী বিসর্জিতা হয়েছিলেন ধীবর পল্লীতে। সেখানেই পালিতা হয়েছেন সত্যবতী, তাই তাঁর গায়ে আঁশটে গন্ধ, যা বহুদূর থেকে থেকে পাওয়া যায়; আর তাই তিনি যোজনগন্ধা। সেই সূত্রে সত্যবতী অনার্যা – শূদ্রাণী।
মর্যাদাময়ী সত্যবতী নিজেকে দাস রাজার কন্যা বলে পরিচয় দিতে অধিক গর্ববোধ করেন। তিনি পিতার অনুপস্থিতিতে যমুনায় খেয়া পারাপার করেন। এমনই এক সায়াহ্নে ঋষিশ্রেষ্ঠ পরাশর খেয়া পারের জন্য যমুনার উপকূলে উপস্থিত হয়ে দেখলেন নৌকার প্রান্তদেশে এক নিষন্না কৃষ্ণবর্ণা রমনী চিত্রার্পিত মূর্তির মতো বসে । আসন্ন সন্ধ্যারাগে উদ্ভাসিত দিগন্তের অরুনাভাস এসে পড়েছে রমনীর চিক্কণ কৃষ্ণবর্ণ শরীরের উপর। ঘন কৃষ্ণ কেশরাশি মাথার উপর চূড়া করে বাঁধা। আতাম্র ওষ্ঠাধারে মুক্তাঝরা হাসি। রমণীর উত্তমাঙ্গের বস্ত্র পৃষ্ঠলম্বী সূত্রগ্রন্থিতে দৃঢ়নিবদ্ধ, অধমাঙ্গের পরিধান কিছু খাটো। প্রায় ঊরু পর্যন্ত অনাবৃত। এই অনাবরণ প্রকট লাবণ্য পরাশরের পৌরুষেয় দৃষ্টিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হল না।
ঋষিশ্রেষ্ঠ শরবিদ্ধ হলেন। মুগ্ধ মুনিবর এই উদ্ভিন্নযৌবনা রমণীর আসঙ্গলিপ্সা করলেন মনে মনে। কোনও ভণিতা না করে সত্যবতীর কাছে পুত্রার্থে মিলন কামনা করলেন পরাশর। আপন জন্মশোকাভিতপ্তা কুমারী সত্যবতী এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধান্বিতা হয়েছেন। পরক্ষণেই ঋষিপ্রবরের পরম আশ্বাসে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। এবং যমুনার মধ্যবর্তী এক দ্বীপে তাঁদের মিলন সাধিত হয়েছে। সেখানেই জন্ম হয়েছে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস-এর। তৃপ্ত পরাশরের আশীর্বাদে যোজনগন্ধার শরীর পদ্মসৌরভে সুগন্ধিত হয়ে উঠেছে।
এই শূদ্রাণী সত্যবতীকে পরবর্তী কালে বিবাহ করেছেন হস্তিনাপুররাজ শান্তনু। বিবাহের একমাত্র শর্তই ছিল সত্যবতীর গর্ভজাত পুত্রই হবেন হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী। অর্থাৎ , বিবাহের পূর্ব থেকেই সত্যবতী হস্থিনাপুরের ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রিত করতে শুরু করেছেন নিজহস্তে।
পরবর্তী কালে সত্যবতীপুত্র চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্যের নিঃসন্তান অবস্থায় অকালপ্রয়াণের পর সত্যবতীর কালীন পুত্র ব্যাসদেব কিভাবে মহারাজ শান্তনুর বংশলতায় পুনরায় প্রানপ্রবাহ সঞ্চালিত করেছেন, সে ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। সেই সূত্রে ধনঞ্জয় বীর সব্যসাচী অর্জুন হলেন ব্যাসদেবের পৌত্র এবং মাতা সত্যবতীর প্রপৌত্র।
সমগ্র মহাভারতের সুবিশাল পরিসরে মাতা সত্যবতী তাঁর সমকালীন সময়ের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন পেশাদারী নৈপুণ্যে ও দক্ষতায়। এই কাজে তাঁকে অনেকাংশে সাহায্য করেছেন তাঁর কালীন পুত্র ব্যাস। পরবর্তীকালে ধনঞ্জয় অর্জুনও একাধারে সামরিক রাজনীতির পরিকল্পক ও নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন স্বইচ্ছায়, স্বমহিমায় ও স্বকীয়তায়। নিপুণ পরিকল্পকের মতোই বারো বৎসর ব্রহ্মচর্য পালন কালে তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বিচরণ করেছেন এবং আর্য-অনার্য নির্বিশেষে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন একান্তই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার আকাঙ্খায়; কুরুক্ষেত্রের মহাসমর কালেও তিনিই সৈনাপত্য গ্রহন করেছেন ধনঞ্জয়সখা বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কে তো দেখা যায় সমগ্র মহাভারত জুড়েই তাঁর অবাধ বিচরণ। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই তিনি নিয়ামকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। এঁরা তিনজনই কিন্তু ছিলেন বর্ণসংকর শূদ্র সম্পর্কিত ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের নারী-পুরুষ।
মহাভারতের কথা অধিকাংশই অকথিত থেকে যায় যে পুরুষটির কথা না বললে, তিনি হলেন পুরাণ পুরুষোত্তম, কপট চূড়ামণি, বিশ্বমোহন বৃন্দাবনী লাম্পট্যে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল অথচ অত্যন্ত ধুরন্ধর , এক বিশাল মাপের রাজনৈতিক নেতা, পীতাম্বর শ্রীকৃষ্ণ; অসম্ভব তাঁর আকর্ষণী শক্তি। মহাকাব্য মতে, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্কন্যা দেবযানী ও নাহুষপুত্র যযাতির প্রথম পুত্র যদু থেকেই যদুবংশের সৃষ্টি। এই বংশেরই কুলতিলক কৃষ্ণকায় কৃষ্ণ। অর্থাৎ, এখানেও সেই বর্ণসংকর জন্মের ইতিহাস।
মহাভারতে বৃন্দাবনবিলাসী একনায়ক, মথুরা-দ্বারকার রাজাদের রাজা, কুরু-পাণ্ডবের ধর্মযুদ্ধের পুরোহিত, মহাভারতের মতো বিশাল জীবন-নাটকের সূত্রধার, কৃষ্ণকে প্রথম থেকেই আমরা দেখি এক কূটবুদ্ধি সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কর্মপ্রবাহ শুরু হয়েছে অত্যাচারী মাতুল কংসকে বধ করে এবং শেষ হয়েছে ভারতযুদ্ধ অন্তে সমগ্র উত্তর ও মধ্য ভারতের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। কৃষ্ণ যখন জন্মেছিলেন, সেই সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে ছিলনা। মগধরাজ জরাসন্ধ ছিলেন শ্রেষ্ঠতম পুরুষ; চেদিরাজ শিশুপাল, পুণ্ড্রবর্ধনের রাজা পৌণ্ড্র বাসুদেব, জরাসন্ধের জামাতা ও কৃষ্ণের মাতুল কংস, সকলেই জরাসন্ধের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
এমত পরিস্থিতি থেকে সমগ্র রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে অস্বাভাবিক দক্ষতায় নিজের অনুকূলে এনেছেন অত্যন্ত স্বল্প সময়ে। তার জন্য প্রয়োজনে কোথাও নিজে প্রত্যক্ষভাবে ছলনা ও কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন, কোথাও বা অন্যকে দিয়ে করিয়েছেন। একসময়, কুরু-পাণ্ডবের পারিবারিক বিবাদ আর পরিবারের সীমায় আবদ্ধ থাকেনি। এমনকি, সমগ্র ভারতযুদ্ধের দায়ও বর্তেছে তাঁরই উপর। এবং তার জন্যই, অবশেষে গান্ধারীর কাছ থেকে অভিশাপও গ্রহন করেছেন তিনি মাথা নত করে।
মহাভারতের রাজনৈতিক নেতা, কৃষ্ণকে ব্যাখ্যা করার জন্য এই পরিসর সত্যই বর স্বল্প। কিন্তু, যে কথাটি উল্ল্যেখ না করলে আখ্যানের বিষয়াভিলাষ অসম্পূর্ণ থেকে যায়, সেটি হল – মহাভারতের এই নায়ক পুরুষটিও ছিলেন একজন কালো মানুষ; বর্ণ বৈষম্যের শিলাভার তাঁকে অবদমিত করে রাখতে পারেনি কিছুমাত্র।
এই প্রসঙ্গে আমরা প্রবন্ধের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে যে বিদগ্ধা রমণীর কথা শুনবো, তিনি হলেন পঞ্চস্বামী গর্বিতা, কৃষ্ণসখী, যাজ্ঞসেনী পাঞ্চালী দ্রৌপদী। মহাভারতের এই চরমতমা নায়িকার জন্মও রহস্যাচ্ছন্ন। যজ্ঞবেদী থেকে উদ্ভূতা হয়েছেন কালো মেয়ে দ্রৌপদী। তাই তিনি কৃষ্ণা-ও। দ্রৌপদীর রূপের বর্ণনা করতে গিয়ে মহাকাব্যের কবি সচেতন হয়েছেন। “ সুকেশী সুস্তনী শ্যামা পীনশ্রোনীপয়োধরা “ - এই টুকুই মাত্র কৃষ্ণার শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনা পাওয়া যায় সমগ্র মহাভারতে। আসলে, কালো মেয়ে দ্রৌপদীর সৌন্দর্য তাঁর শরীরে নয়, সৌন্দর্য তাঁর বৈদগ্ধতায়; বৈদূর্যমণির মতো যা প্রতিভাত হয় স্বমহিমায়। আগুন তাঁর চরিত্রে, সে আগুনের সংস্পর্শে যারাই এসেছেন, হয় তাঁরা পুড়ে খাঁটি হয়েছেন , নয়তো জ্বলে রাখ্হয়েছেন।
এহেন নায়িকার কোন শৈশবকাল নেই। জন্মলগ্নেই তিনি উদ্ভিন্নযৌবনা এক কুমারী নারী। অলৌকিকতার আবরণ ছিন্ন করলে, ধরে নেওয়া যায় , রাজা দ্রুপদ ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদী কে দত্তক নিয়েছিলেন যজ্ঞাগ্নিকে সাক্ষী রেখে। এবং এই দত্তক গ্রহণও একান্ত ভাবেই রাজনৈতিক কারণেই। দ্রোণহত্যা তাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলেও, কন্যাকেও তিনি ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির স্বার্থেই। আর তাই, দত্তক নেওয়ার পরে পরেই তিনি দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেছেন। এর পরবর্তী থেকে শেষ পর্যন্ত মহাভারত আবর্তিত হয়েছে এই একতমা নায়িকা, কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে অবলম্বন করেই। এখানেও বর্ণবৈষম্য পরাভূত হয়েছে সমূলে।
মহাভারতীয় রঙ্গভূমিতে এই ক’জন কালো মানুষ সমগ্র লোককাহিনীটিকে মাতিয়ে রেখেছেন আগাগোড়া । গৌরবর্ণ শাসক জাতির উপর কৃষ্ণকায় মানুষগুলির এই আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণ বুঝিবা প্রকৃতিরই প্রতিশোধ। আর্যদের আগমনের পূর্বে এই উপমহাদেশীয় ভূখণ্ডে যে কৃষ্ণকায় মানুষগুলি একাধিপত্য করেছেন, তাঁদের যে এক মুহূর্তে অবদমিত ও নির্মূল করা যায়নি, মহাভারত তার সাক্ষ্য বহন করে।।
সেলাম..... কুর্নিশ.... হ্যাটস অফ....
উত্তরমুছুনআর কিছুই বলার নেই সুস্মিতা কে..
thnx, DS....
উত্তরমুছুনপৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি সাহিত্যকর্ম হিসাবে মহা ভারত পৃথিবী বিখ্যাত। একটা সাহিত্য কর্ম মানুষের উপর কতটা প্রভাব ফেললে সেটা ধর্ম গ্রন্থে পরিনত হয় তার একটি জলন্ত প্রমান এই মহা ভারত। সুস্মিতা সিং সেই মহাভারত এর বিভিন্ন চরিত্রের উপর ধারাবাহিক ভাবে আলকপাত করেচলেছেন , তা দলিল হয়ে থাকবে।
উত্তরমুছুনTHANK YOU, SEKHAR DA
মুছুনlekha ta bishesh bhabe bhalo laglo
উত্তরমুছুন