গল্প - নারায়ণ রায়




প্রপিতামহ
নারায়ণ রায়

কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে এমন একটি স্থান স্বচক্ষে না দেখলে প্রত্যয় হবে না। এলাকাটির একদিকে পতিতোদ্ধারিনী গঙ্গা, অপর দিকে বৃক্ষরাজি আবৃত সবুজ নিজর্ন প্রান্তর। মধ্যখান বরাবর পথ চলার রাস্তা। এলাকায় কয়েকটি মাত্র শতাব্দী প্রাচীন অট্টালিকা বিরাজমান। আজও যেন স্থানটি উনবিংশ শতাব্দীতেই স্থবির হয়ে আছে। নিকটেই একটি ভগ্নপ্রায় ত্রিতল অট্টালিকার সিংহ দরজায় আজও মলিন ভাবে বিরাজমান একটি লিপি- ““THIS IS THE RESIDENCE OF THE FIRST DUTCH GOVERNOR GENERAL IN INDIA””গঙ্গার অপর প্রান্তে বেলুড় মঠের সুউচ্চ মিনার দৃশ্যমান। পথটির উত্তর দিক বরাবর হেঁটে গেলে বাগবাজার আর দক্ষিণে আলমবাজার হয়ে দক্ষিণেশ্বর।

ভাবলে অবাক হতে হয়, এই সেই পথ যাহা কিনা শত বৎসরেরও অধিক পূর্বে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামীজির পদধূলি দ্বারা স্নাত হয়ে ধন্য হয়েছে। আজও যেন এই পথে সেই মহাপুরুষদের পদধ্বনি শুনতে পাই, আজও যেন নরেন্দ্র আপন মনে হেঁটে চলেছেন, সন্ধ্যা নেমে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই, নিজর্ন এবং অন্ধকার রাস্তায় শুধু কিছু শার্দুল ও শ্বাপদের উচ্চরব এবং দুই একজন গেঁজেল কিম্বা মাতালের আনাগোনা। সেই যুগে কাশীপুরের এই দিকটায় রাস্তার দুই দিকে পাকা দালান-বাড়ি প্রায় ছিল না বললেই চলে, বেশিরভাগই মাটির বাড়ি, খড়ের চাল... সন্ধ্যার পর অধিকাংশ বাড়িই অন্ধকারে নিমজ্জিত, সামান্য একটু রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বালানোও ছিল তাদের কাছে বিলাসিতা। দুই একটি বাড়ির দরজা বা জানালার ফাঁক দিয়ে সামান্য প্রদীপের আলো হয়তো বা দৃষ্টিগোচর হত।

নরেনের সেসব দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে হেঁটেই চলেছে। গঙ্গাতীরে শ্মশানে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি কুণ্ডে একটি শবদেহ দগ্ধ হয়ে চলেছে। শবযাত্রীদের বেশীরভাগই অত্যধিক মদ্যপান করে বেসামাল হয়ে চিৎকার করে খেউড়ে গান ধরেছে, “কে মরেচে কে মরেচে ঘোষাল বাড়ির বউ মরেচে... ছেরাদে খাবো হাত ডুবিয়ে... আবার বাবুর বে-তে খাবো কবজি ডুবিয়ে, আহা আহা আহা।শ্মশানের ওই গানটা শুনে নরেনের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, নরেন ভাবলো - এদেশের প্রতিটা মানুষ যেদিন প্রকৃত শিক্ষিত না হচ্ছে তত দিন এদেশের মুক্তি নেই... নরেন তার হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিল। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর শুরুর আগেই তাকে দক্ষিণেশ্বর পৌঁছতেই হবে। ঠাকুর যে আজ তার গান শুনতে চেয়েছেন।

এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেলাম। আষাঢ় শ্রাবণ মাসে ভোর চারি ঘটিকায় সুনসান এলাকাটি প্রাতঃ ভ্রমণের পক্ষে খুবই উপযুক্ত। অন্যান্য দিনের ন্যায় সেদিনও আমি ভ্রমণে বেরিয়েছি, কিন্তু সহ-ভ্রমণকারীদের না পেয়ে একা একাই ঘুরছি । হঠাৎ এক ভদ্রলোক গঙ্গা-প্রান্ত থেকে এমনভাবে আমার সস্মুখে আবির্ভূত হলেন। যেন তিনি তখনই গঙ্গা থেকে নেয়ে উঠে এলেন, অথচ লোকটির শরীরে সিক্ততার লেশমাত্র চিহ্ন নাই। লোকটির পরণে হাঁটু অবধি চাপা খেটো ধুতি আর গায়ে ফতুয়ার ন্যায় একটি সাদা পরিধান, খালি পা এবং বেশ বলিষ্ঠ চেহারা, বয়স আন্দাজ ষাট বৎসর বলে আমার মনে হল।

লোকটি আমার মুখোমুখি হয়ে একগাল হেসে শুধালেন, “কি রায়বাবু, আপনার বাটির সকল খবর কুশল তো?” আমি অবাক হয়ে শুধাই, “আপনি আমাকে কীরূপে চিনলেন? আমি তো আপনাকে পূর্বে কদাপি দেখেছি বলেই স্মরণ হচ্ছে না।এই কথা শুনে ভদ্রলোক আমাকে খুবই অবাক করে দিয়ে বললেন, “শুধু আপনাকে নয় আপনার পিতা, পিতামহ এবং প্রপিতামহ এদের সকলের সঙ্গেই আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল, আপনার প্রপিতামহ তো আমার বাল্যকালের বিশেষ সাথী ছিলেন।এবং গড় গড় করে আমার সকল পূর্বপুরুষদিগের সঠিক নামও বলে দিলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম তাহা কীরূপে সম্ভব? আমার প্রপিতামহ জীবিত থাকলে আজ তাঁর বয়স হত প্রায় ১৬০/১৬৫ বৎসর। জিগ্যেস করলাম, আপনার নামটি দয়া করে বলবেন?” উত্তরে তিনি বললেন,“আমার নাম শ্রীযুক্ত ষোড়শীচরণ দেববর্মা, পিতা শ্রীযুক্ত ষোড়শাঙ্গ দেববর্মা, মাতা শ্রীমত্যা নগেন্দ্রবালা দেবী।

আর একটু সাহস করে আমি তাঁকে বলি, “আমার প্রপিতামহ কিরূপে আপনার সাথী হবেন, তিনি জীবিত থাকলে আজ তাঁর বয়স হত প্রায় ১৬০/১৬৫ বৎসর?” উত্তরে তিনি বললেন, “আসলে আমাদের সময়ে তো লোকের ঘরে ঘরে এত বছর, মাস বা দিনের হিসেব রাখা সম্ভব ছিল না, তবে পিতৃদেবের মুখে শুনেচি, তোমাদের রবি ঠাকুর আমার চেয়ে বৎসর দশেকের ছোট ছিল।তাঁর কথায় আমার কৌতুহলের সীমা থাকে না, আমি বলি, “তার মানে আপনি রবীন্দ্রনাথ, এবং বিবেকানন্দকে স্বচক্ষে দেখেছেন?” উত্তরে তিনি বলেন, “না না, তখন ঠাকুরবাড়ির ব্যাপারই ছিল আলাদা। ওরা ছিল কলিকাতার সত্যিকারের বনেদি পরিবার বলতে যা বোঝায় তাই, ওদের বাড়ির ছেলেরা সর্বদা পাইক, বরকন্দাজ, ভৃত্য পরিবেষ্টিত হয়েই থাকতো। তাহারা আমাদের মত সাধারণ লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করার কোন সুযোগই পেত না। তাই রবির সঙ্গে সেই ভাবে কোনদিন আলাপ হয়নি। তবে নরেন ছেলেটি সত্যিই খুব ভালো ছিল, অবশ্য একটু একরোখা গোঁয়ার ছিল, যেটা করবে মনে করত, সেটা করেই তবে ছাড়ত।” ,

আমি বলি, “আমি ভাগ্যবান তাই আপনার মত ব্যক্তির সাক্ষাত পেয়েছি। আপনার এমন সুঠাম চেহারা, আপনি কি সামরিক বাহিনীতেও ছিলেন ?” প্রশ্নটি শ্রবণ করে কিঞ্চিত আহ্লাদিত মুখে বললেন, “আপনার প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলতে পারলে খুবই খুশি হতাম। যুদ্ধে যাওয়ার আমার খুবই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বয়স বাধা হয়ে দাঁড়ালো। ঠিক ১০০ বছর আগে যখন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়, মনে করেছিলুম যুদ্ধে গিয়ে দেশ বিদেশ দেখব, কিন্তু ততদিনে আমি হয়ে গেছি একজন ৬৩ বছরের কিশোর। কিন্তু ওরা বললেন, ওই বয়সে আমাকে দিয়ে বাহিনীতে রাঁধুনীর কাজও হবে না। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তো আমি রীতিমত ৮৮ বছরের যুবক। যুদ্ধে যাব বলে নাম লিপিবদ্ধ করতে গড়ের মাঠে লাইনে দাঁড়িয়েও ছিলুম তবু আমাকে ওরা বাতিল করে দিলে, এমনকি ১৮/২০ বছরের ছোকরাগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় স্থান পাওয়া সত্বেও শুধু বয়সের কথা ভেবেই ওরা আমাকে নিল না।

ইতিমধ্যে ক্রমশ দিনের আলো প্রস্ফুটিত হচ্ছে, তবু এলাকাটিতে কাহারও দেখা নাই। ভদ্রলোকও বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, বললেন আচ্ছা আসি।এই কথা বলে, তিনি যেদিক থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন সেই দিকেই অর্থাৎ গঙ্গার দিকে একটি জঙ্গলাকীর্ন এলাকার ভিতর দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। এদিকে আমি লোকটির নিগর্মনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম এই দুনিয়ায় কত রকমের মানুষ থাকেন, কেউ নিজেকে রাজা-উজির ভাবেন, কেউ ভাবেন টাটা-বিড়লা, আর এই ভদ্রলোক ভাবেন ওনার বয়স ১৬০/৭০ বছর।

যাই হোক সকালটি আমার ভালই কাটলো, অভূতপূর্ব একটি অভিজ্ঞতা হ, এবার আমিও যখন বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই আমার নিত্য প্রাতভ্রমণের সঙ্গী রাধাকান্তবাবু হাপাঁতে হাপাঁতে এসে পৌঁছলেন। আমি কিছু শুধোবার আগেই তিনি বলতে শুরু করলেন, “আসলে, গতকাল আপনাকে বলতে ভুলে গেছি যে আজ সকালে আমার বাড়িতে একটি পুজো আছে, তাই আসতে দেরি হল।আমি কিছুটা অবাক হয়ে বলি, “আজকের দিনটা তো তেমন কোন বিশেষ দিন নয়, যেমন মাঘী পূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা ? তাহলে আপনার বাড়িতে কী এমন পুজা ছিল?” এ কথার উত্তরে রাধাকান্তবাবু বললেন, “প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশীর দিন ভোর বেলায় আমাদের বাড়িতে শান্তিস্বস্ত্যয়ন সহ পুণ্যার্হ গঙ্গা পূজা করা হয়ে থাকে।আমি বললাম, “আসলে আমি সর্বত্র নাস্তিক বলেই পরিচিত, তাই এইসব পূজার্চনার খবর রাখি না। এমন কি ভগবান বা ভূত উভয়েই আমার ঘোরতর অবিশ্বাস।

সে যাই হোক আপনি যেন আপনার বাড়ির পূজার ব্যাপারে কী বলতে চাইছিলেন?” তখন রাধাকান্তবাবু এক নিমেষে বলে গেলেন, “আমার এক পূর্বপুরুষ তাঁর দান-ধর্ম, এলাকার উন্নয়ন এইসব কারণে এলাকায় খুবই জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। আজকের মত এমনই এক শ্রাবণ মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশীর দিন ভোর বেলায় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে ঠিক এই জায়গাটিতে তিনি গঙ্গায় পড়ে যাওয়া এক ডুবন্ত শিশুকে উদ্ধার করার জন্য গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। শিশুটিকে বাঁচাতে পারলেও তিনি নিজে তলিয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যেহেতু তাঁর কোনও মৃতদেহ পাওয়া যায়নি, আমাদের আজও বিশ্বাস তিনি বেঁচে আছেন এবং নিশ্চয়ই একদিন ফিরে আসবেন। আর সেই জন্যই প্রতি বছর এই দিনে আমরা তাঁর প্রত্যাবর্তন প্রার্থনা করে গঙ্গা মায়ের পূজা করি।এই কথা শ্রবণ করে আমি রাধাকান্তবাবুকে শুধাই, “ভদ্রলোক আপনার কে ছিলেন?” উত্তরে রাধাকান্তবাবু বললেন, “তিনি ছিলেন আমার প্রপিতামহ। নাম শ্রীযুক্ত ষোড়শীচরণ দেববর্মা


3 মতামত:

  1. আপনারেও ভূতে ধরেচে দাদা ! সাবধানে থাকেন । অদ-ভূত ব্যাপার স্যাপার ।

    উত্তরমুছুন
  2. আবার ভূত !!!!!! আমি যে কবে দেখবো !!!

    উত্তরমুছুন
  3. আবার ভূত !!!!!! আমি যে কবে দেখবো !

    উত্তরমুছুন