ধারাবাহিক (২য় পর্ব) - ইন্দিরা দাশ

তর্পণ
ইন্দিরা দাশ (দ্বিতীয় পর্ব)

তিরিশ-পঁয়ত্রিশের মহিলার আন্টি যদি হতে হয় তাহলে বয়সটাকে তো পঞ্চাশের ঠায় ঠেলে তুলতে হবে রোহিণীর অথচ কিংশুকই এখনও সে বয়েসে পৌঁছল না, রোহিণী তো তার থেকে পাক্কা চার বছরের ছোট সেদিনের বিচ্ছিরি ব্যাপারটার পর থেকে পার্লারে গিয়ে হেয়ার ডাই করাটাই পছন্দ করে রোহিণী শুধু তিন্নির মা, বা রিয়ারই নয়, বেছে বেছে এই একান্ত নিজস্ব সময়টাতেই পিপলু ইরেজার হারায়, শাশুড়ির চোখের চোখের ওষুধটা খুঁজে পাওয়া যায় না ইত্যাদি ইত্যাদি কার ভালো লাগে এই ঝামেলা 
শুক্রবার অফিস যাওয়ার পথে প্ল্যানটা তাই দানা বাঁধছিল রোহিণীর মনে এছাড়া কিংশুককে পাকড়ে ধরে বিকেলে গড়িয়াহাটা এক চক্কর ঘুরে আসতে পারলে আগামী পুজোর আগেই শাড়ির ফ্যাশান-ট্রেন্ডটা বুঝে আসা যাবে অফিসে মোনালি আর অজন্তা সেদিন যা বুকনি ঝাড়ছিল এই ব্যাপারে রিসার্চ করে এসে! পাশের মলটায় হুইলচেয়ার ফেসিলিটি হয়েছে, জানালেন সেদিন প্রতিবেশিনী মিসেস জোয়ারদার মার বয়স হয়েছে, বেশি হাঁটতে পারেন না, তাই তাঁকে নিয়ে বিশেষ কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না অন্তত চেয়ারে বসিয়ে মলের লিফটে চড়ে ওপর-নীচের দোকানগুলোও দেখা যাবে ওঁর মনটা ভালো লাগবে পিপলুটারও খুব শখ ওখানেকিডিস্কিংডম’-এ গিয়ে দু’চারটে অ্যাকশন ভিডিও গেম খেলে আসার সমস্ত মিঠে চিন্তাই মাথায় ঘুরছিল রোহিণীর যখন ফোনটা বাড়ি থেকে এলো
পিপলুর ভিতু ভিতু কথাগুলো এতটাই তোতলা শোনাচ্ছিল, যে বেশ কিছুক্ষণ তো কিছু বুঝতেই পারল না রোহিণী বিরক্ত হয়ে মৃদু ধমকই মারল সে ছেলেকেতারপরই হাঁউ-মাউ করে কেঁদে ফেলল পিপলু, কোনমতে বোঝালো যে তার ঠাম্মা বাথরুমে মেঝেতে পড়ে রয়েছে পিপলুর ডাকে সাড়া দিচ্ছে না, তাঁকে উঠে বসাতেও পারছে না পিপ্লু
শিগগিরই পাশের ফ্ল্যাটের জেঠু-জেঠিমাকে খবর দাও আমি যত তাড়াতাড়ি পারি আসছিতাড়াতাড়ি বলল রোহিণী পিপলু তখনও কাঁদছে আর কাঁপা কাঁপা গলায় বলার চেষ্টা করছে, ‘মা, তু-তুমি তা-তাড়াতাড়ি -এসো ম্‌-মা আমার -বড্ড ভয় ক্‌-করছে একা একা শাশুড়ির জন্য দুশ্চিন্তা ছাড়াও সাড়ে সাত বছরের অসহায় মুখখানায় চোখভরা জলের ছবিটা আকুল করে ফেলেছিল একেবারে রোহিণীকে সেদিন কিংশুক অফিস মিটিং-এ ফোন সাইলেন্ট করে রাখে তাই তার ফোনে মেসেজটা ছেড়ে, বড়বাবুর কাছে কোনমতে জানিয়ে দৌড়ল বাড়ির পথে রোহিণী বিচ্ছিরি একটা তর্কাতর্কি বাধিয়ে ফেলল তাড়াহুড়োয় ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে বাড়ি পৌঁছে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে উঠতে তার নিজেরই হৃদপিন্ডটা ধড়াস্করে বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে খসে পড়ে যাবে মনে হচ্ছিল জোয়ারদার দম্পতি লোকাল ডাক্তারকে কল করে ডেকে এনেছেন আপতকালীন ব্যবস্থা হিসেবে তিনটে সেলাই মা মাথায় লাগিয়েছেন তিনি রক্ত পড়াটা বন্ধ হয়েছে, কিন্তু নার্সিংহোম বা হাসপাতালে ভর্তি করতেই হবে একহাতে পিপলুকে বুকে টেনে নিয়ে চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে কিংশুককে আবার ফোনটা করলো রোহিণী, এবার পেয়েও গেলো তাকে
ঘটনাটা এই, পিপলু দুপুরে ইশকুল থেকে ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলঘুম ভেঙে সাড়ে-চারটে নাগাদ নীচে খেলতে যাবে কি না জিজ্ঞেস করতে ঠাম্মির ঘরে গিয়েছিল সে ঘর খালি দেখে অ্যাটাচড বাথরুমে উঁকি মেরেই ঠাম্মিকে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছে কোমডে বোধহয় মাথা ঠুকে গিয়েছিল মোহিনীবালার বাথরুমের সাদা মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত পিপলুকে আরও ভয় পাইয়ে দিয়েছে
সে যাত্রা সময়মত সি-টি স্ক্যান, এম-এর-আই, ওষুধ-পথ্য ভালো চিকিৎসার গুণে  হপ্তাখানেকের মধ্যে মোহিনীবালা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেও, ছোট্ট পিপলুর ভীতি কাটতে অনেকদিন সময় লেগেছিল আর রোহিণীর মনে সে ঘটনার আতঙ্ক তো আজও বিস্মৃতির তলায় তলিয়ে যায়নি তাই বাড়িতে নিয়ে আসার পর শাশুড়িকে কিছুতেই আর একা রাখা হবে না, এই সিদ্ধান্তটা রোহিণীই নিল 
অফিসে মন্দিরার বাবা প্যারালিসিস হওয়ার পর তারও বাড়িতে একজন পুরুষ নার্স রাখতে হয়েছে আয়া-অ্যান্ড-নার্সিং ব্যুরোর ফোন নম্বরটা ওর থেকেই জোগাড় করলো রোহিণী নার্সিং ব্যুরোর অফিসটাও বেশিদূর নয়, আনোয়ার শাহ্রোডের কাছাকাছি প্রায় সব রকম রুগি-রোগিণীর দেখাশোনার জন্য ট্রেনড অ্যাটেনড্যান্টের ব্যবস্থা করে দেয় ওঁরা রোহিণীর প্রয়োজনটা শুনে ব্যুরোর মিস্টার দাশগুপ্ত দু’মিনিট চুপ করে ভাবলেন তারপর বললেন, “মিসেস বসু, আপনার দরকার আসলে একজন কেয়ারটেকারের, ইউ রিয়ালি ডোন্ট নিড নার্স তারও ব্যবস্থা করে দেব, কিন্তু খরচাটা পড়বে একই, মানে ওই থ্রি-হান্ড্রেড পার ডে, আর বিকেলের চা-স্ন্যাক্সটা রোহিণী ততক্ষণে মনে মনে মোটামুটি অঙ্ক কষে মাসে নয় হাজার টাকার খেসারত গুণে ফেলেছে কিন্তু উপায়ই বা কী অফিসের চাকরিটা ছেড়ে বাড়িতে বসে থাকাটাআদৌ অর্থকরী হবেনা রাজি হয়ে গেলো সে
দু’দিন পরেই প্রথম আয়াটি এসে হাজির হল মেয়েটা একটু ফ্যাসফেসে গলার স্বরে হিন্দিতে, ‘নমস্তে ভাবিজি, বলতেই প্রমাদ গুনল রোহিণী এই সেরেছে, তো হিন্দুস্থানি জুটল একজন ব্যুরোর ভদ্রলোক অবশ্য বলেই দিয়েছিলেন অবাঙালি মেয়েও কাজের জন্য জুটতে পারে, যদিও তিনি চেষ্টা করবেন বাঙালিই দিতে নানা প্রদেশের অভাবী মানুষ তো তার কাছে কাজের খোঁজে আসে কিন্তু রোহিণীর বরাতে প্রথমেই যে অবাঙালি জুটবে তা কে জানত! মা কীভাবে এই মেয়ের সঙ্গে কথোপকথন করবে, এই নিয়ে চিন্তা করতে করতেই মেয়েটাকে প্রশ্ন করে জানল রোহিণী, যে এসেছে বিহারের কাটিহার থেকে মোহিনীবালা বিরক্ত তো বটেই, অস্বস্তিতে পড়লেন তার সাথে সময় কাটাতে একটা কথা বললে হাঁ করে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে মেয়েটা তাছাড়া আরও একটা অপছন্দের ব্যাপার ঘটেছে সেদিন রোহিণী বিকেলে বাড়ি ফেরার পর  সে এসে দরজা খুলে দিল ঠিকই কিন্তু নিজের ঘর থেকে ঘুরে এসে রোহিণী দেখেছে মা যখন ঘুমোচ্ছেন, তখন সে মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোঁৎ ফোঁৎ করে নাক ঝেড়ে, মুছছে নিজের আধময়লা ওড়নাটার কোণ দিয়েই দেখেই এমন একটা বিতৃষ্ণা এলো রোহিণীর মনে যে সে ঠিক করল পরদিনই সে লোক বদলে দিতে বলবে ব্যুরোতে ফোন করে  
কিন্তু ভাবলে আর সিদ্ধান্ত নিলেই তো আর সব হয় না পাওয়া যাচ্ছে না আর কোনও আয়া এই মুহুর্তে পুরুষ অ্যাটেনড্যান্ট রয়েছে ব্যুরোর হাতে, কিন্তু তাকে দিয়ে কোন কাজ করানোটা সম্ভব হবে! তাই হপ্তাখানেক ডেটল হ্যান্ড ওয়াশের শ্রাদ্ধ করে, নিজের পুরনো দুই সেট সালোয়ার-কামিজ পরিয়ে পরিয়ে এই মেয়েটাকে দিয়েই কাজ চালাতে হল রোহিণীকে এর মধ্যে শাশুড়ি মায়ের অসহিষ্ণুতাও সহ্য করে চলতে হয়দু-এক কথায় আজকাল কিংশুকের সঙ্গেও কথা-কাটাকাটি হয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যেমোদ্দা কথা সংসারে এখন একটাই আয়া বদলাতে হবে ভাগ্যিস এরই মধ্যে ফোন এলোহ্যাঁ, মিসেস বসু, আপনার জন্য আর একটি ক্যান্ডিডেট কাজ করতে রাজি হয়েছে মেয়েটি নতুন এসেছে, কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর ভদ্র ভাঙা ভাঙা হিন্দি আর ইংরিজিতে কাজ চালিয়ে নিতে পারবে আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে রোহিণীর কথাগুলো শুনে কী উৎপাত আবার এসে হাজির হবে  রে বাবা! শোনা গেল কোনও দক্ষিণী তনয়া কাজ খুঁজতে খুঁজতে এই কলকাতায় এসে নার্সিং ব্যুরোতে নাম লিখিয়েছেন নিজের ভাগ্যটা দেখে নিজেরই রাগ হতে শুরু করল রোহিণীর মন্দিরার বাড়িতে ছেলেটি বাঙালি বেশ ভালো কাজ করে অবশ্য বার দুয়েক বদল করতে হয়েছে ওকেও তবে এগুলো বোধ হয় এক একজনের কপাল রোহিণীর এই দিকের ভাগ্যটা বেশ খারাপ, তাই এতো গেরো
(ক্রমশ)


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন