ধারাবাহিক (২য় পর্ব) - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

থিম
অরুণ
চট্টোপাধ্যায় (দ্বিতীয় পর্ব)

- এরকম অনেক কিছু দেখবি তুই সারা শহর জুড়ে ক্রমে দেখবি হয়ত কোথাও অজন্তা-ইলোরার গুহা কি কোথাও ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান, কোথাও মাউণ্ট আবুর দিলওয়ারা টেম্পল আবার কোথাও হয়ত বরোদার মন্দির কিংবা প্যাগোডা কি তাজমহল নে, নে হাঁট ভিড় বাড়ছে এবার না তোকে মাড়িয়ে তোর ওপর দিয়ে লোক চলে যায়

একটা প্যান্ডেলে ঢুকল তারা গেট দিয়ে ঢুকতেই অন্য এক জগৎ মাটির এবড়ো খেবড়ো রাস্তা, খড়ের চালের বাড়ি, গোবর দিয়ে নিকোনো উঠোন, বড় বড় আম-জাম-জামরুল গাছ, মেঠো রাস্তা, আশপাশে ছোট ছোট ঝোপ, ধানের মরাই মাঠে কাজ করছে চাষীরা, কামারশালায় হাপর টানছে কামার, পাড়ার বউগুলো ভিজে লালপাড় শাড়ি গায়ে জড়িয়ে পুকুর ঘাট থেকে উঠে আসছে নিজেদের উঁকিপাড়া উদ্ধত যৌবনের ইঙ্গিত অন্যকে দিতে পারার আনন্দে উচ্ছ্বল তাদের মুখ

রজত মুগ্ধ হয়ে দেখছিল শোভন খুশি হয়ে তার অবাক হওয়া বন্ধুর মুখের দিকে তাকাল

- এটা হল একটা গ্রামের ছবি ধর তোদের গ্রাম শোভন বলল, গ্রাম এখানে মানে

এই পুজোর থিম বুঝলি কিছু?

মন্ত্রমুগ্ধের তাকিয়ে ছিল রজত যেন ধ্যান ভেঙে গিয়ে বলল, এগুলো সত্যি নয়?

একেবারেই সত্যি নয় সব সাজানো তো একটা শিল্প মানে আর্ট শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় নিষ্প্রাণ প্রাণ পেয়েছে এখানে

- বুঝেছি, রজত বলল, ওই যে চাষীগুলোর দুঃখ, কামারদের কষ্ট, পুকুর থেকে চান করে উঠে আসা মেয়েগুলোর লজ্জা সব নকল সব সাজানো?

- একজ্যাক্টলি! বলে বন্ধুর পিঠ চাপড়াল শোভন যা দেখছিস সব শিল্পীর কীর্তি
সব প্রাণহীন এরা কত বড় মাপের শিল্পী বল তো? এই থিমের পেছনেই আমরা কত লক্ষ লক্ষ টাকা ঢালছি বল

রজত কতকটা যেন নিজের মনেই বলল, লক্ষ লক্ষ টাকা ভাবা যায়!

- তা গুড় না ঢাললে আর মিষ্টি কেমন করে হবে চাঁদু?

- এত টাকা জোগাড় হয়? রজত বিস্ময় প্রকাশ না করে পারল না

- খুব সহজেই ভাল কাজে কে আর টাকা দেবে না বল? আমাদের জাতীয় উৎসব বলে কথা আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে কেমন বাঁচিয়ে রেখেছি বল? বিশ্বায়নের বেনো জোয়ারে দেশীয় সংস্কৃতিকে বেরিয়ে যেতে দিইনি 

- হ্যাঁ অন্তত জাতীয় উৎসবের সময় সেগুলো বেশি করে মনে পড়ে যায় রজত অন্যমনস্কভাবে বলল শোভন অতটা কানই দিল না সেটায় নিজের আগের কথাটার রেশ টেনে নিয়ে বলল, আর এগুলো যে ভাল কাজ তা তো তুই স্বীকার করবিই

সপ্তমীর সকালে তাকে চেপে ধরে রজত তার সঙ্গে গ্রামে যেতে হবে শোভনকে সেখানে অষ্টমী আর নবমী কাটিয়ে দশমীর সকালে তাকে স্টেশনে দিয়ে আসবে রজত

- ওই ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে? না না ভাই শোভনের খুব আপত্তি, এখানের পুজোই আমার প্রাণ তাছাড়া কলকাতার এই থিমের পুজো ছেড়ে বাইরে কোথাও এখন আমার যাওয়া হবে না

- আরে আমাদের ওখানেও তো পুজো হয় নাকি?

- তোদের পুজো? ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে শোভন বলল, ওখানে কি আর এমন থিম পাব নাকি? তুই জানিস এই পুজোর কটা দিন গ্রাম ছেড়ে কত লোক আসে এখানে পুজো দেখতে?

- পাবি পাবি আশ্বস্ত করে রজত

- কি পাগলের মত বলছিস? এমন শিল্পী পাবি কোথায়? এমন বাজেট? এত লোক, এত আলো, এত হাসি, এত মজা, এত আনন্দ? তাছাড়া ঢাক? তোদের গাঁয়ের সব ঢাকিই তো এখন শহরে ওরাও তো পুজোর এই কটা দিন আমাদের এখানে আনন্দ লুটতে আর দু পয়সা কামাতে আসে নাকি?

- পাবি পাবি সব পাবি আমি কথা দিচ্ছি রজত বলে, আমি গোড়াতে একটু না জানার ভান করে তোর সঙ্গে জোক করছিলাম ভাই নাহলে থিম আমাদের দোরগোড়াতেও ঢুকে পড়েছে

- কী থিম তোদের বল তখন ভেবে দেখব

- মৃদু হেসে রজত বলল, সে তুই গেলেই বুঝবি অমন প্রাণবন্ত থিম আর কোথাও তুই পাবি না তোর অনুরোধে আমি শত কাজ হাতে নিয়েও দুদিন এখানে থেকে গেলাম আর আমার অনুরোধে মাত্র দুদিন আমার ওখানে থাকতে পারবি না? ভাল না লাগলে পরের দিনই না হয় চলে আসিস আমি আর জোর করব না

ছেলেবেলার বন্ধু বলে কথা এই অনুরোধটুকু না রাখলে চলে?

ট্রেনবাসে কিছুটা যাবার পর আটকে গেল তাদের যাত্রা চারিদিকে জল থৈ থৈ করছে বাড়ি ঘরদোরের চিহ্ন নেই শুধু জল আর জল খানিক হেঁটে, খানিক ভ্যানরিকশোয় করে খানিক বুকজলে প্রায় সাঁতার কেটে তারা রজতের বাড়ি যখন পৌঁছল তখন ময়লা আকাশের এক ফাঁকে ক্লান্ত চাঁদ একটু উঁকি পেড়েছে

- আজ তো দুজনেই ক্লান্ত রজত বলল, তোকে বরং কাল নিয়ে যাব পুজো দেখাতে

থিমের পুজো বন্ধুর মস্তিস্কের সুস্থতায় একটু সন্দেহ আসেনি যে তা নয় তবু চুপ

করে রইল শোভন যদি সত্যি তেমন কিছু হয় তো এই দ্বীপের মত জায়গায় এই

রাতবিরেতে চুপ থাকাই নিরাপদ তবু একটা কিছু যেন শোনার অপেক্ষায় ছিল কান খাড়া করে শোনার চেষ্টাও করল কয়েকবার

- কিন্তু ঢাকের আওয়াজ!

- পাচ্ছিস না? রজত বলল, ভাল করে কান পাত না

একটা জোর কলকল, ছলছল শব্দ ভেসে আসছে কোথা থেকে রজত বলল, নদীর পাড় ভাঙল জল ঢুকে পড়ল আর একটা গ্রামে আমাদের ঢাকের সুরটা বড়ই করুণ  কী করবি, বেহালায় যে কান্নার সুর উঠবেই

ক্লান্ত শোভন ঘুমিয়ে পড়ল একটু পরেই ঘুম ভাঙল খুব ভোরে কত পাখির মিষ্টি সুর মাঝ আশ্বিনের প্রথম এক সোনালি আলো ঢুকে পড়েছে জানলা দিয়ে একটা আমেজ এসে গিয়েছিল উঠতে ইচ্ছে করছিল না তবু তাকে ঠেলে তুলে দিল রজত

- পুজো দেখতে যাবি না শোভন? থিমের পুজো?   
                                                            (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন