ভ্রমণকাহিনী - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

সুন্দর যে বন সে-ই সুন্দরবন
অরুণ চট্টোপাধ্যায় 




বন্যেরা সুন্দর বনে / বাঘেরা সুন্দরবনে । অর্থাৎ বন্যদের যেমন বনেই বেশি মানায় তেমনি বাঘেদের মানায় সুন্দরবনে । সারা পৃথিবীর বহু অঞ্চলেই বাঘ পাওয়া যায় এটা যেমন সত্যি, তেমনি সারা পৃথিবীতে সুন্দরবনের বাঘই সবার শ্রেষ্ঠ এটাও সমান সত্যি ।

আর এই সবার শ্রেষ্ঠ সেই বাঘ অর্থাৎ “Royal Bengal Tiger” দেখতে সুন্দরবনের প্রতি মোহ মানুষের যে দুর্বার হবে তা তো বলাই বাহুল্য । বছরের পর বছর ধরে সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পর্যটক সুন্দরবনের পায়ে মাথা ঠুকে মরেছে, মরছে আর মরবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এই “রয়াল বেঙ্গল” দেখার বাসনায় ।

বলতে লজ্জা নেই এই আশা বুকে নিয়েই গত ১২ ডিসেম্বর দক্ষিণ কলকাতার একটি প্রখ্যাত ও প্রবীণ সংস্থার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিকে রাজা “দক্ষিণ রায়ের” রাজ্যপাট দেখার অভিলাষ নিয়ে । রাজ্যপাটের সঙ্গে রাজাকেও স্বয়ং দেখার পুলক যে আমার হৃদয়ে অনবরত দোলা দিয়ে গিয়েছিল সেটা অনস্বীকার্য নয় মোটেই ।

মনের উৎসাহ মানুষের শারীরিক বাধাকে অনায়াসে অতিক্রম করতে সাহায্য করে এমন উদাহরণ খুব একটা কম নয় । সেই উৎসাহের প্রবল শক্তিই আমাকে এই শীতের ভোর সাড়ে চারটেয় ঘর থেকে টেনে বার করতে সাহায্য করেছিল আর পৌঁছে দিয়েছিল টালিগঞ্জ ফাঁড়িতে যেটা ছিল যাত্রা শুরুর একটা গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক ।

প্রায় জনা চল্লিশ পর্যটককে নিয়ে বিশাল সাদা রঙের ভলভো বাসটি তার শুভ যাত্রা শুরু করল আমার ঘড়িতে ঠিক যখন সকাল আটটা বেজে চৌত্রিশ । আমার ঠিক পাশেই সহযাত্রী হিসেবে পেয়েছিলাম সংস্থার মাননীয় সহ-সভাপতি কমলবাবু অর্থাৎ কমল দত্তকে । হাওড়ার মাকড়দহ নিবাসী প্রায় ছিয়াত্তর বছরের সদাহাস্যময় ভদ্রলোককে পেয়ে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলাম । সেক্রেটারি দেবনারায়ণ ঠাকুর অর্থাৎ সকলের প্রিয় দেবুদার সঙ্গে আমার পরিচয় ও আলাপ ছিল কয়েক বছর আগে থেকেই । পরিচয় হয়েছিল মাননীয়া গৌরী মৈত্র এবং সংস্থার আরও কিছু সদস্য ও এই ভ্রমণের সহযাত্রীর সঙ্গেও ।

এগারো-বারো বছরের মিষ্টি “সৃষ্টি” র কথাও গোড়াতেই বলে রাখা ভাল । দেবুদার ভাগনি ক্লাস সিক্সে পড়া অত্যন্ত ছটফটে এই সুন্দর মেয়েটি ছিল এই ভ্রমণের এক আকর্ষণ । তার সুন্দর শিশুসুলভ চাঞ্চল্য মুগ্ধ শুধু আমাকেই করেনি, করেছিল সবাইকে । ভ্রমণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কখনও তাকে এতটুকু স্থির থাকতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না । সর্বদা সব জায়গায় তার গতিবিধি ছিল অবাধ আর অস্তিত্বপূর্ণ । তার সরল আর সক্রিয় উপস্থিতি আমাদের ভ্রমণকে গম্ভীর আর নীরস হতে দেয়নি এতটুকু । আমার যেন মনে হয়েছিল সুন্দরবনে বাঘ দেখতে পাই বা না পাই এমন একটি সচঞ্চলা হরিণশিশুকে যে দেখেছি তাতেই আমার অনেক কিছু দেখা হয়ে গেল ।

বাসের মধ্যেই আমরা সুস্বাদু ও সুসজ্জিত একটি টিফিনের প্যাকেট পেয়েছিলাম ।
সেটি শেষ করতে না করতেই ৯ টা ৫৫ নাগাদ ঘটকপুরে এসে বাস নিল ক্ষণিকের বিশ্রাম । তারপর আবার শুরু আনন্দের এক পথচলা । যেটা শেষ হল সোনাখালিতে গিয়ে দুপুর প্রায় সাড়ে ১২ টায়। এখানে হাইওয়ে প্রায় নেই বললেই চলে ।
আশপাশে জমি প্রচুর থাকা সত্বেও গাড়ি চলার পথ কিন্তু অপরিসর । অথচ এখানে বিভিন্ন স্থানে লোকালয় যা গড়ে উঠেছে বা উঠছে তা মোটেই উপেক্ষনীয় নয় । কলকাতা যে উত্তরে জায়গা না পেয়ে দক্ষিণে প্রসারিত হতে চাইছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে । কিন্তু তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাওয়া-আসা, বিশেষ ভাবে দূরপাল্লার গাড়িগুলির পথ কেন তেমন ভাবে প্রসারিত হচ্ছে না, সেটা বোঝা যাচ্ছে না । তাই পৌঁছনোর সময় দিয়ে স্থানের দূরত্ব মাপার চেষ্টা ঠিক হবে না বলেই মনে হল । কিছু কিছু জায়গায় অবশ্য রাস্তার দুপাশ কংক্রিটের স্ল্যাব ঢেলে চওড়া করার কাজ চলছে দেখা গেল, তবে হাইওয়ে বলতে যা বোঝায় এটা তা নয় ।

আমাদের ভ্রমণ এবার স্থল থেকে নেমে এল জলে । অর্থাৎ বাস থেকে লঞ্চে। সোনাখালি (যার বিপরীতে বাসন্তী দ্বীপ) থেকে যাত্রা শুরু তখন, যখন আকাশে সূর্যদেব লাঞ্চ করবেন কিনা ভাবছেন । আমার ঘড়ি বলল সময় এখন দুপুর ১২ টা ৫০ । কিন্তু আমাদের লাঞ্চ করতে তখনও একটু দেরি আছে কারণ তখনও পর্যন্ত আমরা আমাদের নবতর এই জলযানটির সম্পর্কে বিশেষ অভ্যস্তই হতে পারিনি ।

হোগল নদীর ওপর দিয়ে আমাদের যাত্রা হল শুরু, গন্তব্য গোসাবা দ্বীপ । হোগল, দুর্গাদোয়ানি নদীগুলির মধ্যে দিয়ে আমাদের লঞ্চ তার নিজস্ব ভঙ্গি আর গতিতে যখন ছুটে চলেছে, আমাদের লাঞ্চও তখন ছুটে চলেছে আমাদের উদরে রসনার তৃপ্তি পরিপূর্ণ করতে । আমরা কেউ নিরামিষাশী না হওয়ায় সুস্বাদু আমিষ আহার ভক্ষণ করে শরীর যখন চেয়েছে হয়ত একটু গড়াতে এমন সময় লঞ্চ এসে পড়ল বিদ্যা নদীর ওপর গোসাবার কাছাকাছি । ঘড়িতে তখন সোয়া ২টো।

গোসাবায় দেখার জিনিস দুটো। হ্যামিলটন বাংলো আর অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রম। নদীর ঠিক পাশে হওয়ায় আমাদের খুব একটা বেশি হাঁটতে হয়নি । বাগানে অনেক ফুলের মধ্যে দিয়ে পথ আর তার মধ্যেই বাংলো । তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশাল সুউচ্চ স্ট্যাচুটি কিন্তু বাইরে থেকেই সুস্পষ্ট । এখানেই সংস্থার সভাপতি মিঃ পুরির সঙ্গে সম্যক পরিচিত হলাম । সদাহাস্যময় সুদৃশ্য ষাটোর্ধ দিল্লী অধিবাসী পাঞ্জাবী এই ভদ্রলোক অত্যন্ত স্বভাব-রসিক । মিলিটারিতে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন দীর্ঘকাল, আর সেই সূত্রে শৃঙ্খলা জিনিসটিকে মজ্জাগত করে ফেললেও সেটা তাঁর মিশুক হওয়ার পথে সৃষ্টি করেনি কোনও অন্তরায় ।

অনুকূল ঠাকুরের মনোরম আশ্রম দর্শন করে বিকাল তিনটে নাগাদ আবার লঞ্চে উঠে চললাম পাখিরালয়ের উদ্যেশ্যে । এখানে আজকের মত সাময়িক যাত্রা বিরতি ।

না হলে “আপনজনের” স্নেহ-ভালোবাসা পাব কোথায় ? কোথায় বা পাব সারাদিনের ভ্রমণ-ক্লান্তির নিরসন ? কিংবা সান্ধকালীন অমন চমৎকার ভেজিটেবিল চপ ? দুটোর জায়গায় প্রিয় দেবুদার (সংস্থার সেক্রেটারি শ্রদ্ধেয় দেবনারায়ণ ঠাকুর) সৌজন্যে আরও গোটা দুয়েক উদরে দিব্যি কি করে আশ্রয় পেয়ে গেল তাই ভাবছি। আবার রাতে মুরগির মাংস দিয়ে ভাত । ভাবছি বাড়িতে কি এত সব এত অল্প সময়ের ব্যবধানে খেতে পারতাম ? ‘আপনজন হোটেল’ আপনজনের আন্তরিকতায় আশ্রয় দিল আমাদের সে রাত্রিতে ।

মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়াই ছিল । শুধু আমারই নয়, আমি আর যে দুজনের সঙ্গে রুম শেয়ার করেছিলাম সেই কমলবাবু আর সমরেন্দ্রবাবুও দিয়েছিলেন । ফলে শরীর ক্লান্ত থাকলেও বিছানা ছাড়তে অসুবিধা হয়নি । আমি ছাড়া বাকি দুজন এই ক্লাবের মাননীয় সদস্য । পাহাড়ে চড়েন দীর্ঘকাল ধরে । পাহাড়ে চড়ার উৎসাহ ওঁদের প্রৌঢ় থেকে যুবক করে তুলেছে । আমিও ভ্রমণ ভালবাসি ছেলেবেলা থেকেই। সমুদ্রকে সম-মর্যাদা দিলেও পাহাড় অবশ্যই আমার একটা আকর্ষণ । তবে পাহাড়ের পথে যেখানে গাড়ির শেষ সেখানে আমারও যাত্রা শেষ । ট্রেকিং আমি করিনি কারণ এতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না কখনও ।

সকাল সাড়ে আটটায় রওনা শুরু । গন্তব্য সজনেখালি । লঞ্চের মনোরম ডেকে ব্রেকফাস্টের স্বাদ নেবার অব্যবহিত পরেই আমরা এসে পৌঁছেছি এখানে । এখন সকাল প্রায় নটা । ওয়াচ টাওয়ার, রিভার টেরাপিং ব্রিডিং সেন্টার, বনবিবির মন্দির, ম্যানগ্রোভ ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার এসব দেখা হল । পরিচিত হওয়া গেল সুন্দরবনের বৈশিষ্ট সুন্দরী গাছের সঙ্গে । সম্ভবত এই সুন্দরী গাছের জন্যই বনটি সুন্দরবন নামে খ্যাত ।

৯টা ৪৫ মিনিটে যাত্রা করে ১০টা ১০ নাগাদ পৌঁছন গেল সুধন্যখালি দ্বীপে । এখানেও ওয়াচ টাওয়ার । আর এটা অবশ্যই উঁচু থেকে ভাল করে জঙ্গলের পথে বাঘের স্বাভাবিক চলাচল লক্ষ করার জন্য । কারণ এর চারপাশেই ঘন জঙ্গল, বাঘদের আস্তানা না হলেও আনাগোনার পথ তো বটেই । নদীর জল আর মাছ খেতে আসে বাঘেরা । কিন্তু তারাও নিশ্চয় চাইবে পর্যটকদের ভিড় এড়িয়ে চলতে । আর পর্যটকদের দেখা দেবার জন্যে তারা যে বারবারই র‍্যাম্পে হাঁটার মত করে এই পথ ধরে আসবে এটা ভেবে নেওয়াও ভাবনার ওপর একটু বেশি অত্যাচার করা । কারণ বাঘের গমনাগমন একান্তভাবেই তার নিজস্ব ইচ্ছা আর অভিরুচি আর প্রয়োজনের তাগিদে । পর্যটকদের ইচ্ছার মর্যাদা দিতে তার বয়ে গেছে । আমরা যারা বাঘ দেখতে পেলাম না কেন বলে হা-হুতাশ করছি তাদের এ কথাটা নিশ্চয় ভাবা উচিৎ । তবে বাঘ দেখতে পাই বা না পাই দেখা পেয়েছি দুটো গোসাপ, বেশ কটা হরিণ আর মাছরাঙার । আর অবশ্যই অফুরন্ত ছোট ছোট বানর । এটা আমাদের মনে উৎসাহ আর উদ্দীপনা বাড়িয়ে দিয়েছিল বেশ । দিয়েছিল হয়ত অচিরেই কিছু “প্রাপ্তি”র আশ্বাস ।

বেলা ১১ টায় লঞ্চের যাত্রা শুরু ডোবাঁকির উদ্যেশ্যে । দীর্ঘ সেই নদীপথ কখনও হয়নি ক্লান্তিকর । নদী কখনও হয়েছে সরু কখনও হয়েছে বিশাল চওড়া । তবে সরু বলে যে কথাটার সঙ্গে আমাদের বেশিমাত্রায় পরিচিতি আছে এখানে তা খাটবে না একেবারেই ।

এক একটি সরু নদীর দুপারে পাড় দেখাও বেশ একটু শক্ত । আর চওড়া যারা তাদের হয়ত সাগরের ছোট ভাই বললে সাগর হাসিমুখে মেনে নিতে পারে ।

বেলা দুটোয় আমরা যথারীতি বড় বড় পারশে মাছ দিয়ে আমাদের দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সারতে ব্যস্ত । ইতিমধ্যে দুপাশে পড়েছে অসংখ্য গরান, গর্জন, সুন্দরী আর হেতালের বন । যার ঘনত্ব ভেদ করা রোদের পক্ষে অসাধ্য । মাঝিদের মুখে শুনলুম এমন ঘন বনই নাকি বাঘেদের প্রিয় বাসভূমি । বাঘেদের শুধু থাকার জায়গাই নয় তাদের বিহার আর শিকার করার জায়গাও বটে । তবে এখানে যথেষ্ট পরিমাণে শিকার না পেয়ে তারা নদী পেরিয়ে দীপান্তরের মাটিতে দিব্যি পা রাখে । ভাবতে অবাক লাগে এই বিশাল সমুদ্র-স্বরূপ নদীগুলির এক পাড় থেকে অন্যপাড়ে আমাদের যেখানে চোখের দৃষ্টি পৌঁছতে চায় না সেখানে অনায়াসের পৌঁছে যায় বাঘেদের সাঁতার কাটা পা গুলো। বাঘেরা যে বিশাল লাফাতে পারে তাই নয় সাঁতার কাটতেও তাদের জুড়ি পাওয়া ভার। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘ এমনই চতুর যে কখন তারা এপার থেকে নদী পেরিয়ে ওপারে গিয়ে হামলা করবে শিকারের ওপর তা কারোর পক্ষেই আগাম, এমনকি ঠিক পূর্ব মুহূর্তেও জানা সম্ভব নয় । তাই বাঘের দেখা পাওয়া সত্যিই বড় কঠিন ।

আমাদের লঞ্চ এবার চলেছে একটু পাড় ঘেঁসে ঘেঁসে । বেলা আনুমানিক ২টো । সবে মাছপর্ব শুরু হতে যাচ্ছে এমন সময় লঞ্চের লোকেরা বলল পাড়ে নাকি একটা কুমির শুয়ে আছে । লঞ্চ এবার একটুও শব্দ না করে অতি ধীরে এগোতে লাগল । এর কারণ আর কিছুই নয় শব্দে আর লঞ্চের ঢেউয়ে কুমির বাবাজি বিরক্ত হয়ে স্থান না ত্যাগ করেন ।

বিশাল প্রায় সাত আট ফুট লম্বায় । পাড়ে শুয়ে শুয়ে রোদ খাচ্ছে । আমরা সব খাওয়া বন্ধ করে এক নিশ্বাসে দেখছি । পারস্পরিক আলোচনা সব বন্ধ । পাছে কুমির সরে পড়ে । একটু পরেই লম্বা একটা হাই তুলল । ভীষণ ভাল লাগল । মনে হল লঞ্চে বসে নয়, যেন আমরা বসে আছি আমাদের ড্রয়িংরুমের সোফাতে আর টিভির স্ক্রিনে অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট বা ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক চলছে ।

একটু পরেই সে নেমে পড়ল জলে । আমাদের মনে হল এই দীর্ঘ সুন্দরবন ভ্রমণে অন্তত মনে রাখার মত কিছু দেখলাম । সে যাওয়ার পরেও তার আলোচনা চলতেই লাগল । আর লঞ্চ চলতে লাগল আবার নদীর বুক দিয়ে । নদী তো নয় মনে হতে লাগল যেন সমুদ্রের ঠিক মাঝখানেই আমরা । দাড়ি কামানো মুখের সরু একফালি গোঁফের রেখার মত দেখা যেতে লাগল চারপাশে পাড়গুলো ।

বয়স কিংবা অন্য যে কোনও কারণে হোক ইদানিং আমার স্মরণ শক্তি বেশ একটু বিদ্রোহ করছে । জায়গার নাম বা অন্য কিছু আমার তেমন মনে থাকছে না । লঞ্চে দেখলাম একটি তরুণী খুব আগ্রহের সঙ্গে মন দিয়ে সব কিছু খাতায় লিখছে । ডায়রি পেন আমিও এনেছিলাম কিন্তু সেগুলো আকারের জন্য সর্বক্ষেত্রে ঠিক বহন যোগ্য নয়। শরণাপন্ন হলাম মিষ্টভাষী সেই তরুণীর । তিনি তাঁর ছোট্ট নোটবুক বার করে আমায় অনেক কিছু লিখে নিতে সাহায্য করলেন । পৌলমী নামের এই তরুণীর কাছে আমি সেজন্য আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ ।

লঞ্চে খুব ভাল করে আলাপ হল সুন্দর দেখতে আমাদের ট্যুর ম্যানেজার বিশ্বজিৎবাবু অর্থাৎ বিশ্বজিৎ দাস ভদ্রলোকের সঙ্গে । তাঁর সুপরিচালনায় আমাদের এই সুন্দরবন ভ্রমণ একটা সুন্দর সাফল্যের মুখ দেখেছিল । আলাপ হয়েছিল আরও অনেক মানুষের সঙ্গে । স্ব স্ব ক্ষেত্রে যারা সু-গুণের অধিকারী বা অধিকারিণী । যাঁদের উপস্থিতি ও সাহচর্য ছাড়া এই ভ্রমণ এত মধুর হয়ে উঠত না। কৃতজ্ঞ লঞ্চের সেই সব কর্মচারীদের প্রতি যারা প্রতিনিয়ত আমাদের সুখসাচ্ছ্বন্দের দিকে নজর রেখেছিলেন । মনে থাকবে আমাদের দেবুদা অর্থাৎ সংস্থার সেক্রেটারি দেবনারায়ণ ঠাকুরের কথা । মনে থাকবে তাঁর ছদ্ম গাম্ভীর্যের আড়ালে সুন্দর রসিকতাগুলি । মনে থাকবে এই ভ্রমণের সর্বজ্যেষ্ঠ সহযাত্রী প্রখ্যাত মুকাভিনয়ের প্রবাদ পুরুষ যোগেশ দত্ত মহাশয়ের কথা। ৮৪ বছর বয়সটা যার কাছে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি । সর্বদা লঞ্চ থেকে না নামলেও এই ভ্রমণ আমাদের সঙ্গেই সমান তালে যিনি উপভোগ করেছেন ।

মনে থাকবে বিএসএনএল-এ কর্মরত দেব চক্রবর্তী ও তাঁর ছটফটে ছোট্ট ছেলেটির কথা । মনে পড়বে আরও অনেকের কথা কিন্তু পরিসরের স্বল্পতা সকলের কথা বলার ক্ষেত্রে যে একটি বাধা তা নিশ্চয় সকলেই স্বীকার করবেন ।

একটু পরেই এসে পৌঁছেছি ডোবাঁকিতে । দেখার অবশ্য তেমন কিছু নেই । একটা ওয়াচ টাওয়ার আর চারপাশে জঙ্গল দিয়ে লোহার জালে ঘেরা দীর্ঘ বাঁধানো পায়ে চলার পথ এই ক্যানোপি-ওয়াকিং । এখানে যে ঘাটে লঞ্চ এসে ভেড়ে সে ঘাটে আর লঞ্চে ওঠা যায় না । উঠতে হলে উঠতে হয় প্রায় আধ কিলোমিটার এই ক্যানোপি-ওয়াকিং দিয়ে হেঁটে অন্য এক ঘাটে এসে ।

আজকের মত ভ্রমণ সাঙ্গ করার উদ্যেশ্যে লঞ্চ ছুটে চলল এবার পাখিরালয়ের দিকে । এখানেই আর একটি হোটেল মৈনাকে আমরা এসে পৌঁছলাম সন্ধ্যা তখন ৬টা । আজ এখানে একটি স্থানীয় সংস্থার যাত্রাপালা করার কথা । রাত আটটার একটু পরে শুরু হল সে অনুষ্ঠান । এটি সুন্দরবনের রাজা দক্ষিণরায় (অর্থাৎ বনের রাজা রয়েল বেঙ্গল) আর বনের দেবী বনবিবির এক উপাখ্যান । সংক্ষিপ্ত এই পালার মূল কথা হল বনবিবি আর দক্ষিণরায়ের দ্বৈরথ । সেই লক্ষ্যের মধ্যে উপলক্ষ হিসেবে আছে আট বছরের একটি শিশুর বাঘ কর্তৃক হামলা আর বনবিবি কর্তৃক উদ্ধার । কাহিনীটিকে ওই নাবালক বালকটির সাহায্যে যথেষ্ট করুণ ও মনোগ্রাহী করার চেষ্টা করা হলেও নেপথ্যের একটি করুণ সত্যও বেরিয়ে পড়েছে । কীভাবে সুন্দরবনের সরল শিশু ও নারীদের ব্যবসায়ীরা নির্মম ভাবে কাজে লাগিয়ে মধু, মোম ও অন্যান্য বহু বহুমূল্য বস্তু সংগ্রহ করছে আর নিষ্ঠুরভাবে এই নিরীহ দরিদ্র মানুষগুলিকে বাঘের মুখে নিশ্চিতভাবেই ফেলে দিচ্ছে তা সুন্দরভাবে প্রতিভাত হয়েছে এই পালার মধ্যে । আমরা পর্যটকরা বাঘ দেখতে পেলাম না বলে কেউ হা-হুতাশ করছি, কেউ বা করছি রঙ্গ রসিকতা, কিন্তু বাঘের দেখা যে বা যারা পেয়েছে তাদের দেখা যে ভবিষ্যতে আর কেউ পাবে সে গ্যারান্টি কই ? অর্থাৎ বাঘের দেখা মানে হল নিশ্চিত ভাবেই এক মৃত্যুর দেখা পাওয়া ।

বাঘ যে কত সংসার ভেঙেছে, কত মায়ের বুক খালি করেছে তা ভাবতেই করুণ হয়ে ভাবি বাঘের দেখা না পাই ক্ষতি নেই । বাঘ থাক তার নিজস্ব জগতের ঘেরাটোপে আর আমরাও থাকি নির্ভাবনায় ।

পরের দিন সকাল আটটায় যাত্রা শুরু ঝড়খালির দিকে । আমাদের ফেরার মুখে এটি হল সর্বশেষ দর্শনীয় স্থান । এখানে দেখা হল সুন্দর একটি পার্ক আর ব্যাঘ্র-প্রকল্প । বেড়াবার স্থান হিসেবে মনোরম ।

ফেরার পথে পড়ল পঞ্চনদীর এক বিশাল মোহানা । মাতলা, গোসাবা, বিদ্যা, ঠাকুরানী আর হেরোভাঙা - এই পাঁচ নদীর মিলনস্থল যেন বিশাল কুমিরের হাঁয়ের গহ্বর । চারপাশের গোঁফের সূক্ষ্ম রেখাগুলির মত পাড়গুলিকে এখন আর দেখা প্রায় যাচ্ছেই না। অবস্থা দেখে বেশ ভয় ভয় করতে লাগল । চারপাশে জল আর জল । বিশাল বিক্ষুব্ধ ঊর্মিমালা নেই এখানে ঠিক, কিন্তু বিশাল সেই পাড় খুঁজে না পাওয়া জলরাশিকে দেখে ভাবছি এর মধ্যে সত্যি যদি আমি কখনও একা হয়ে যাই তো কী হবে ? লঞ্চের সারেং কী করে দিক ঠিক করছে সেটা ভাবতে গিয়েও যেন শিউরে উঠি । আর ভাবি আমার মত সেও যদি দিকভ্রষ্ট হয় তবে কী হবে ?

সেই বিশালতা আবার হারিয়ে গিয়ে ক্ষুদ্রতায় মিশে গেল । চারপাশে নাম-না-জানা অসংখ্য দ্বীপের মধ্যে দিয়ে লঞ্চ ঠিক তার পথ করে নিয়ে এগিয়ে চলতেই লাগল । দ্বীপগুলো সব গভীর বন । গরান, গর্জন, সুন্দরী আর হেতালের বন । সারেং বলল এখানে যে বাঘ নেই এ গ্যারান্টি কেউ কি দিতে পারে ? কথাটা অবশ্যই ফেলে দেবার মত নয় । বাঘ যদি নাই বা থাকবে কিংবা বাঘ যদি এই পথে নদীর এপার থেকে ওপারের দ্বীপে সাঁতার কেটে নাই যাবে শিকারের সন্ধানে (এমন কি মানুষেও যে তাদের কোনও অরুচি নেই সেকথাও হয়ত জানেন আমার হয়ত প্রতিটি পাঠকই), তবে সরকারের বন দফতর কেন প্রচুর টাকা খরচ করে মোটা মোটা জালের ব্যারিকেড লাগাবে দ্বীপের সীমানায় ? আগেই বলেছি এই সাগর- সদৃশ নদী সাঁতরে পার হওয়া সুন্দরবনের বাঘের পক্ষে একটা ছেলেখেলারই নামান্তর । তাই ওপারের দ্বীপগুলির গ্রাম ও জনপদ রক্ষার জন্যই রয়েছে ঐ আট দশ ফুট উঁচু মোটা লোহার জাল । আমাদের মনে রাখতে হবে বাঘ লম্বায় লাফিয়ে যতটা যেতে পারে উঁচুতে কিন্তু ঠিক ততটা নয় । অর্থাৎ লং জাম্পে বেশ অভ্যস্ত হলেও হাই জাম্পে বিশেষ দক্ষ নয়। হয়ত আমার বেশিরভাগ পাঠক ছেলেবেলায় বাঘের ভয়ে উঁচু গাছে আশ্রয় নেবার কথা শুনে বা পড়ে থাকবেন ।

লঞ্চের এবার ফেরার পালা । আবার সেই সোনাখালি । যেখানে আমাদের বিশাল সেই সাদা ভলভো বাসটিকে আমরা অপেক্ষা করতে বলেছিলাম দিন দুয়েক আগে সেখানে সে আজও হাসিমুখে অপেক্ষা করছে আমাদের নেবার জন্যে । সব শুরুরই একটা শেষ আছে । শেষ না থাকলে আর একটা শুরুই বা হবে কি করে ? তাই সুন্দরবন ভ্রমণের পালা শেষ হয়ে এবার ফিরে চলার পালা হল শুরু ।

সুন্দরবনে পদচারণা করা, সাঁতার কাটা, শিকার করা, নিদ্রামগ্ন বা বিশ্রামরত কোনও বাঘকেই এ পর্যন্ত দেখিনি তাতে কোনও ক্ষোভ নেই । কারণ অসংখ্য নদীনালা ভরা, জঙ্গলে ভরা দ্বীপভূমি দেখেছি – মনে হয়েছে এমন সুন্দর মনোরম এই বন, তাই তো তার নাম সুন্দরবন ।

বিকেল চারটার আশপাশে বাসের ফেরার যাত্রা হল শুরু । মাথার মধ্যে বাঘ নেই – স্মৃতির সবটুকু দখল করে রেখেছে সুন্দর সেই সুন্দরবন । এই প্রকৃতির অসংখ্য আশ্চর্যের মধ্যে চমকপ্রদ মনোরম এক আশ্চর্য ।

[শেষ]













0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন