গল্প - সৌম্য বন্দোপাধ্যায়



পিতৃঋণ
সৌম্য বন্দোপাধ্যায়

     "গঙ্গার জল বয়ে যাচ্ছে কূল থেকে কূল ৷গঙ্গাপাড়ের চুল্লীতে পুড়ছে আমার সুজন, পৃথিবীতে আমার ভগবান ৷কয়েকঘন্টা  আগেও মানুষটার একটা পরিচয় ছিলো

     
হাসপাতাল থেকে শ্মশানঘাট সর্বত্রই মানুষের status এর অদ্ভুত একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সেখানে সে শুধুই patient অথবা body

     
প্রিয় মানুষের দেহ চলে গেলে পড়ে থাকে একমুঠো ছাই, সেটাও
ভাসিয়ে আসতে হয় গঙ্গার জলে "

     
গঙ্গার ঘাটে বসে বসে সব কথাই ভাবছিল শান্ত মানে ডাঃ
শান্তশীল বটব্যাল পেশায় শিশু শল্যচিকিৎসক। স্বল্প রোগভোগের পর তাঁর পিতা ইন্দ্রনাথ বটব্যাল আজই কলকাতার  একটি নামকরা নার্সিংহোমে পরলোকগমন করেছেন  এখানকার  ডাক্তারবাবুরা চেষ্টার ত্রুটি করেননি

গঙ্গার ঘাট থেকে শ্মশান একটু দূরে মাঝে মাঝে সেখান থেকে হরিধ্বনি শোনা যাচ্ছে শান্তর চোখ ঢুলে আসে

------
বাবা, তোমার লিখে দেওয়া 'গঙ্গানদীর আত্মকথা' লিখে এবারের পরীক্ষায় highest পেয়েছি,এবারের পরীক্ষার রচনাগুলো তুমি লিখে দিয়োনা বাবা

------
নিজে লিখতে শিখতে হবে না বুঝি কোনদিন ???

------
পরীক্ষাটা হয়ে যাক,একটু একটু করে শিখে নেবো তোমার কাছে
 "
দাদা.... দাদা....চলো অস্থি নিতে ডাকছে " অরুনাংশুর ডাকে সম্বিত ফিরে
পায় শান্ত চিতাভস্ম রাখার কলসটা নিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়

"
ছাত্রজীবনে যার কাছ থেকে যেটুকু পাবে গ্রহণ করবে, দ্বিধা করবে না, একজন রিকশাওয়ালাও তার সততা,পরিশ্রম এই গুণগুলির জন্য তোমার কাছে গ্রহণীয় হতে পারেন, সেটা ভুলে যেয়ো না
      ''
শ্রদ্ধাবানঃ লভতে জ্ঞানম্ " ...ভগবদ্গীতার এই বাক্যটা মনে
রেখো, শিক্ষকদের অশ্রদ্ধা কোরো না কখোনো "
.......................................এক বুক গঙ্গার জলে দাঁড়িয়ে বাবার শেখানো এই উপদেশগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে বাবার পার্থিব
দেহের শেষ স্মৃতিচিন্হটুকু গঙ্গাবক্ষে নিবেদন করলো শান্ত তখন ভোর হয়েছে

বাবার কথায় বার বার ঘুরে ফিরে আসতো বলরামপুর, তাঁর প্রথম চাকুরীস্থল কোনদিন যায়নি শান্ত, কিন্তু বাবার চোখ দিয়ে দেখেছে বহুবার জীবনদার চায়ের দোকানে আড্ডা, 'টাকা কেজি দরে খাসীর মাংস, শীতকালে পাহাড়ের কুল নিয়ে
ভাইবোনেদের জন্য ৭০০ মাইল ট্রেনজার্নি করে সেই কুল মায়ের হাতে তুলে দেবার অনির্বচনীয় আনন্দানুভূতি বাবার মুখের বিবরণ শুনে চোখের উপর দেখতে পেতো শান্তশীল
      ছোটবেলা থেকে কোনদিন বাবাকে দুটোর বেশী শার্ট-প্যান্ট পরতে দেখেনি শান্ত, দেখেনি কোনো বিলাসসামগ্রী ব্যবহার করতে কালনার ঝাপানতলায় যখন তাদের জরাজীর্ণ পৈতৃক বাড়ীতে তার বাবা উঠলেন, তখন শান্ত মাত্র 'বছরের, শান্তর একমাত্র বোন লিপিকা তখন বড়জোর বছর তিনেকের
     
বর্ধমানে তাদের সাজানো গোছানো পৈতৃক বাড়ী ছিলো, কিন্তু সেখানে ফরমান জারি করা হয়েছিলো,"এখানে থাকতে গেলে ঘর করে নিয়ে থাকতে হবে "
অগত্যা ঝাপানতলার এক কামরার বাড়ীতে সাপ, বিছেদের সাথে বসবাস ধীরে ধীরে ওই বাড়িটারই রূপ সম্পূর্ণ বদল করেছিলেন ইন্দ্রনাথ

       
জীবনে কারো সাথে তার বাবাকে বিবাদ করতে দেখেনি শান্ত সেবারে যখন  "ভোরের আলো " ক্লাব তাদের জায়গা বলপূর্বক নিয়ে ক্লাবঘর তৈরি করলো বাবা নিশ্চুপ ছিলেন একদম শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, "তোরা আমায় একটা sweet approach করে দেখতে পারতিস " না, সেই ভালোমানুষীর দাম দেয়নি কেউ অশ্লীল ভাষা এবং ততোধিক অশ্লীল ভাবভঙ্গী নিয়ে আক্রমন করেছিলো

     
ভালোমানুষীর দাম দেয়নি ওঁ ভাইবোন, আত্মীয়পরিজনেরাও
নিজে মাইনের অতি সামান্য টাকা রেখে বাকি টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে যিনি ভাইবোনেদের মুখে হাসি ফোটাতে ওভারটাইম করে গেছেন রাতের পর রাত, তারাও অতি সুকৌশলে তাঁর সুযোগ নিয়েছে শুধু, প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়নি তাঁকে

     
আগে বুঝতো না শান্তশীল, এখন বেশ বোঝে এর পিছনে ক্রিয়াশীল family politics টাকে সুচতুর ভাবে ইন্দ্রনাথকে সংসারে অপ্রিয় করে তুলে তার ফয়দা তুলেছিল সংসারের দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব

গল্পটা তার মার কাছ থেকে শোনা আদর্শবান শান্তশীল বিয়েতে কানাকড়ি না নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলো   সেদিন মা শুনিয়েছিলেন, কেমন করে তাঁর পিতৃতুল্য বড় দাদাকে বাড়িতে ডেকে অপমান করা হয়েছিলো শুধুমাত্র কিছু ফলের
কোয়ালিটির অদল-বদল  হওয়ায়। আরো বলেছিলেন ইন্দ্রনাথ সেদিনও অদ্ভুত রকম চুপচাপ ছিলেন

     
কর্মজীবনে ইন্দ্রনাথ ছিলেন ডাক  বিভাগের একজন কর্মী ,সামান্য যা মাইনে জুটতো তাতে নিজের সংসার চালিয়ে প্রতি মাসেই কিছু কিছু ধার হয়ে যেতো এমনকি তাঁর কেনা সাইকেলটা চুরি হবার পর, একটা নতুন সাইকেল কেনার ক্ষমতা ছিলনা তাঁ, পুরনোতেই কাজ চালাতে হয়েছিল
     তবু শিক্ষার প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহের ফলে শান্ত একটা টিউশনি না করেও বাবার টাকায়  MBBS করেছিলো, লিপিকা Statistics- Masters করেছিলো

     
লোধাসুলিতে থাকাকালীন, পরোপকারের মহান ব্রত নিয়ে একদল শবরকে লেখাপড়া শেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়ে  প্রাণসংশয় হয়েছিলো একবার
অবসরকালে আবার সেই চেষ্টা তাঁকে করতে দেখা গিয়েছিলো

   কষ্টই নিত্য সঙ্গী ছিল যাঁর, এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে শেষ আঘাতটা দিয়েছিলো শান্তশীল নিজে, অনেকটা তার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে

       
রুমেলার উচ্চাকাঙ্খা শান্তকে অনেকটা বাধ্য করেছিলো গ্রামের হাসপাতালের চাকরী ছেড়ে USA তে গিয়ে  practice শুরু করতে এবং ওখানেই settle করতে

     
মার কাছে খবর পেতো, এরপর থেকে বাবা শুধু বলতো, "শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়ে ফেললুম গাছের ফল আর মিষ্টি লাগছে না, তাই অন্যগাছে চলে গেলো"

       
লিপিকা কাছাকাছির মধ্যে থেকে বাবা মার দেখাশুনো করে সুস্থ রেখেছিলো তাঁদের
খবরটা এসেছিলো বেলা সাড়ে এগারোটায় তার সামান্য আগেই ঘটে গেছে ঘটনাটা ঘটনা মানে বাবার massive cerebral  attack গোছগাছ করে রওনা হওয়ার সময় খবর পেলো শান্ত, বাবার বাম দিকটা paralysed হয়ে গেছে

      "
বয়সের স্ট্রো তো !জানিনা উঠবে কি না ! তবু আমরা কাল থেকে physiotherapy শুরু করছি " বলেছিল ডাক্তার না আর ওঠে নি বরং দিনে দিনে অবনতি হচ্ছিলো কাল বেলা দশটায় সব শেষ হয়ে গেলো

   বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে বেশ আজ অনেকদিন পর কলকাতার ভোর দেখলো শান্ত ভিজে কাপড়ে ডুব দিয়ে আসার সময় এক অভূতপূর্ব অপরাধবোধমিশ্রিত বিষন্নতা গ্রাস করছিলো তাকে সত্যিই কি সে বাবার মুখাগ্নির উপযুক্ত !!!!  বাবার মৃত্যুর জন্য সে কি কোনভাবেই দায়ী নয়!!  সে বাড়িতে থাকলে কি আরো আগে চিকিৎসা শুরু করা যেতো না! এইসব প্রশ্ন তাকে কুরে কুরে খেতে থাকে

   কয়েকদিন কেটে যায় আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে সুখ দুঃখের কথা বলে
ঘাটকাজের দিন রাত্রিবেলা রবিদা এসে হাজির "একবার চল না শান্ত, ছেলেটা কেমন করছে "
   মূহুর্তে কর্তব্য স্থির করে ফেলে শান্ত আগে duty,পরে ক্রিয়াকরম
স্টেথোটা নিয়ে পোশাকেই  বেরিয়ে পড়ে
   রবিদার ছেলেটা নীল হয়ে গেছে, রবিদার স্ত্রী মুখচোখ শুকিয়ে একপাশে বসে গুটিসুটি মেরে শান্তর অভিজ্ঞ চোখে বুঝতে ভুল হয়না যে এটা 'Blue baby syndrome', অর্থাৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় এর নাম 'persistent truncus arteriosus '
এ রোগ সেরে যায় কিন্তু অপরেশান করতে হয়, যা প্রচুর ব্যয়সাধ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন এই surgery সে অনেক করেছে কিন্তু কালনায় তেমন উপযুক্ত OT কোথায় পাবে !!!

     
আইডিয়া! গাড়িটা বের করে রবিদা আর ওর স্ত্রীকে পিছনে বসিয়ে নিজেই ড্রাইভ করে প্রায় উড়ে চলে কলকাতার দিকে

   ঠিক সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ ওরা বাইপাসের ধারে সেই নারসিংহোমটায় পৌঁছয়, যেখানে কিছুদিন আগে তার বাবা  ভর্তি ছিলো
   অপারেশন শেষ করে বাচ্চাটাকে বেডে দিতে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয় এতক্ষণ মোবাইলটা অফ্ রেখেছিল সে ইচ্ছে করেই মোবাইল অন্ করতেই রুমেলার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বরের জবাবে ঠান্ডা মাথায় "আসছি" বলে গাড়ি ঘোরায় শান্ত সে জানে আপাতদৃষ্টিতে তার বাবার পারলৌকিক কাজ ঠিক সময়ে তার করা হলো না, কিন্তু সে
এও জানে, তার বাবার আত্মা যদি থেকে থাকে, আজকের ঘটনায় তিনি চরম তৃপ্তি পাবেন
     বাইরের দিকে তাকালো শান্ত প্রকৃতিদেবী যেন হাসছে বেলা হয়েছে অনেকটাই গাড়ির কাচ নামিয়ে দিয়ে স্পিডোমিটারের কাঁটা তুলে দিল একশো
 গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে তখন  বেজে চলেছে ....
.     "
দয়া দিয়ে হবে গো
মোর জীবন ধুতে,
     
নইলে কি আর পারবো
তোমার চরণ ছুঁতে"










0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন