ধারাবাহিক গল্প - ইন্দিরা দাশ



তর্পণ
ইন্দিরা দাশ

মন মেজাজ ভালো নয় রোহিণীর  শাশুড়ি মাকে বাড়িতে একা রেখে অফিস করাটা একেবারেই অসম্ভব কিংশুকের আর কি তিনি তো ব্যাঙ্গালোর ট্যুরে গিয়ে বসে রয়েছেন এই এক হয়েছে জ্বালা প্রাইভেট ফার্ম পয়সা যেমন দেয়, তেমনি উসুল করে নেয় খাটিয়ে আর ট্যুর করিয়ে করিয়ে না হয় বোঝা গেলো কিংশুকেরও সেখানে বিশেষ আরামে দিনাতিপাত হচ্ছে না কিন্তু একটু চেঞ্জ তো হয় বটে রোহিণীর কপালে তো সেটাও জোটেনা রোজকার থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়ের হিসাব, ঠিকে লোকের কামাইয়ের জন্য ইনিয়েবিনিয়ে ফিরিস্তি, পিপ্লু ইশকুল, হোম টাস্ক, পেরেন্ট-টিচার মিট, অফিসের কাজ, দিনের পর দিন একঘেয়ে ভাবে চলতে থাকে তার জীবন দুটো অন্য মানুষের মুখ দেখতে পাওয়া, একটু আলাদা ব্রেকফাস্ট, দুপুরের বা রাতের খাওয়া দাওয়া, অন্তত এটুকু অদলবদল তো জুটে যায় কিংশুকের জন্য ট্যুরের দিনগুলোয় শাশুড়ি মা স্ট্রোক থেকে সেরে সদ্য বাড়ি ফিরেছেন হাসপাতাল থেকে ভদ্রমহিলা যথেষ্ট স্নেহময়ী একমাত্র ছেলের বউকে অত্যন্ত ভালোবেসে ঘরে তুলেছিলেন তাঁকে তো একটু যত্ন-আত্তি করতেই হবে এখন চোখে চোখে রাখারও প্রয়োজন ছেলে বাড়িতে না থাকলে সে দায়িত্বের পুরোটাই রোহিণীর ওপরেই পড়ে তাও তো পাশের ফ্ল্যাটের মিস্টার আর মিসেস জোয়ারদার খুবই অমায়িক রোহিণীর মোবাইল নম্বর ওঁদের কাছে দিয়ে রাখা আছে, বলা আছে, বাড়িতে যে কোনও এমার্জেন্সি কিছু ঘটলে যেন চট করে রোহিণীকে খবর দেন মা যদিও একাই চলাফেরা করতে পারেন লাঠিটা নিয়ে, তবুও কানে কম শোনেন, চোখেও কম দেখেন
আজকাল রাতে খাবার টেবিলে ভুলে ভুলে যান দুপুরের রান্নায় কী কী খেলেন তাঁকে কি আর একা রাখা যায়! এবার একটা আয়া রাখতেই হবে যদিও বয়স্ক মানুষটার
কাছাকাছি থেকে নজর রাখা, সময়মত ওষুধটুকু খাইয়ে দাওয়া, চুলটা আঁচড়ে সানন্দাটা এগিয়ে দেওয়া ছাড়া আয়ার আর সত্যি বলতে কোনও কাজই নেই তার জন্য দৈনিক তিনশো টাকা গুণতে শুরু শুরুতে গা কড়কড় করত বইকি রোহিণীর
রোহিণীর চেয়ে বেশি বিরক্ত হত কিংশুক
এতগুলো টাকা এক প্রায়-নিরক্ষর মহিলা  এই কয় ঘন্টা শুধু বসে বসে থেকে নিয়ে চলে যাবে! দূরছাই, এতো পড়াশোনা করেও, দৈনিক অফিস-বাড়ি, মাসে দুটো থেকে তিনটে ট্যুর করে, টার্গেটের জন্য জীবনপাত করতে করতে মরছি এর থেকে তোমার নার্সিং ব্যুরোতে নাম লেখালেই তো ভালো করতাম কিংশুকই ঠিক করল যে রোববার রোববার আয়াকে আসতে মানা করে দেওয়া হবে অন্তত মাসে চারটে দিনের পয়সা তো বাঁচবে তাহলে প্রয়োজনও নেই দিনগুলোয় একটা বাড়তি মানুষ ঘরের মধ্যে বসিয়ে রাখার
শনিবার কিংশুকের ছুটি থাকে না, রোববার ছুটি  রোববার পিপ্লু ইশকুল ছুটি থাকবে রোহিণীর শনিবার হাফ-ডে হলেও রোববার ছুটি কিংশুকের কখনও ট্যুর থাকলেও তাই কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয় মা দেখাশোনার জন্যে তাঁর নিজের মানুষের অভাব হবে না এই ছুটির দিনগুলোয় রাজি হয়েছিল রোহিণী যুক্তি আছে কথাটায় মাও খুব একটা যে পক্ষপাতি ছিলেন আয়া রাখার ব্যাপারে তা নয় এমনিতে মহিলা বরাবরই শক্ত পোক্ত কর্তা মারা যাওয়ার পরই যা একটু অথর্ব হয়ে পড়েছেন তাই বলে অসুস্থ মানুষের মত কারও হাত তোলা হয়ে থাকতে তিনি একেবারেই পছন্দ করেন নাআমার হয়েছেটা কী, বৌমা? ওসব স্ট্রোক-টোক কিছু না, বয়স হলে ওরকম একটু আধটু হয় তাই বলে মেয়েটাকে সারাদিন টি-টি পক্ষীর মত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হবে! দরকারটা কি বলতো? তোমরা অফিস যাওয়ার পর আমি দিব্যি টা ঘন্টা দরজা বন্ধ করে বাড়িতে থাকতে পারব তিনটে পর পিপ্লু তো এসে যায় তারপর পাঁচটার পরই তিন্নী মা বাসন মাজবে এসে টার মধ্যে তুমি বাড়ি পৌঁছে যাও অথচ এই সময়সীমাটুকুর মধ্যেও তো বিপদ আসে কীভাবে বোঝায় রোহিণী, যে সেই মাসখানেক আগের শুক্রবারের বিকেলটা সে এখনও ভুলতে পারে না, ঠিক যেন একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন 
সেবারের দুর্ঘটনাটা সপ্তাহান্তের কাছাকাছি ঘটেছিল সারা সপ্তাহের ক্লান্তি জমাট বেঁধে রয়েছে সেদিন শরীরে আর মনে তাই শুক্রবার শেষ হলে এই শনিবার কিংশুক ছুটি নেবে কথা দিয়েছে রোহিণীর হাফ-ডে ছুটি পিপ্লুর শনিবার দেরি করে ঘুম থেকে উঠে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করবে রোহিণী এবার নতুন হেয়ার-ডাইটা পাড়ার ভালো পার্লারটাতে গিয়ে লাগাবে সে বাড়িতে সব সময়ে ভালো করে ম্যানেজ করা যায় না ব্যাপারটা সেদিন তো অর্ধেক চুলে ডাই লাগনোর পরই কুরিয়ার এসে হাজির হোল তিন্নী মা খ্যানখেনে গলার ডাক শুনতে শুনতে বাধ্য হয়ে রোহিণীকে ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছতে হোল সই করতে করতেই তার মধ্যে খটাস করে সামনের ফ্ল্যাটের থেকে গেট খুলে দোরগোড়া থেকে দুধের প্যাকেট তুলতে এলেন মিসেস
গুজরাল নতুন বিয়ে হয়েছে পাঞ্জাবী মহিলার বয়েস কম করে বছর তিরিশেক তো হবেই তবুও দেহের বাধঁন চুলের ছাঁটকাট দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে যৌবনকে বছর পঁচিশেক করে চালিয়ে দেবার চেষ্টা সবসময়ে ট্রাকপ্যান্ট আর টি-শার্টে শরীর দুলিয়ে,হাই, গুড মর্নিং, বললেও অপাঙ্গে রোহিণীর ঢলঢল নাইটির তলায় থলথলে পেট, কোমর আন্দাজ করে বিশ্রীভাবে তাকালো আধখানা কালো ডাই করা মাথার চুলের দিকে তারপর ফিচেল গা-জ্বালানো হাসি হেসে বলে উঠল, ‘আপনাকে হেয়ার ডাই করলে বেশ ইয়াং লাগে তো আন্টি! কিপ ডুইং ইট, বা--
আন্টি!!

ক্রমশঃ


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন