চিলেকোঠা ওয়েবজিন আয়োজিত এক সারস্বত সন্ধ্যা
পঁচিশে
জানুয়ারি ২০১৫
শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়
এবারে শেখরদা, সুশান্ত, আহুতি – এরা ধরেছিল বেশ চেপেচুপেই,
আমায় থাকতেই হবে। বিষয়টা হল, আমি উপস্থিত থাকতে পারি না চিলেকোঠা আয়োজিত এমন হরেক
অনুষ্ঠানে, নানান কারণে। কিন্তু এবার একে তো রবিবারের সন্ধ্যা, উপরি পরের দিন একদম
গেজেটেড হলিডে। পাজামার ওপর পাঞ্জাবি গলিয়ে, অতএব, চললাম অবনীন্দ্র সভাগৃহে।
রবীন্দ্রসদন-নন্দন চত্বরে তো গেট অনেক, একটা দিয়ে ঢুকে একটু
কনফিউজড হব-হব, পকেট থেকে মোবাইল বের করে সুশান্তর নম্বরটা ধরব-ধরব, ওই তো
অলোকদা-কুশল হাত নেড়ে ডাকছে আমায়, নিশ্চিন্তি।
ভেতরে ঢোকা মাত্রই আমায় মঞ্চে উঠে কী করতে হবে, এবং আমি
প্রস্তুত কি না, এইসব এক ঝাঁক কথাবার্তা নিয়ে এগিয়ে এল সুশান্ত-আহুতি, এবং
শ্রীরূপা, “আমায় চিনতে পারছ তো? আমি শ্রীরূপা”, তাকে বলতে যাচ্ছি, অনেককেই চিনি
না, তবে তুমি সে দলে না, বলার আগেই শ্রীরূপা একটি তালিকা নিয়ে বলল, “এই নামগুলোও
তোমায় পড়ে দিতে হবে মঞ্চে”, এবং বেশ ঝটপট নামগুলো আমার চিরকুটে উঠে এল নূপুরদির
সহায়তায়।
এসবই হচ্ছিল সভাকক্ষের বাইরে। একের পর এক চিলেকোঠার সদস্যরা
আসছেন, হাসমতদা, মৈত্রেয়ীদি, বৈজয়ন্তদা,
অদিতিদি, গার্গীদি, পিয়ালি, ইন্দ্রানীদি, নন্দিনী-লাহাদি, তমালীদি, রাজ, মিসমিদি,
অরবিন্দ, মহুয়াদি ও তার মেয়ে... যাঁদের চিনি, দেখে হাসছি। খবর পেলাম চিলেকোঠার
আরেক প্রাচীন সদস্য ত্র্যম্বকেশ্বর সমাদ্দার ওরফে তন্ময়দা নাকি রাজ্যের বাইরে,
বিশেষ কাজে, ফলে আসবেন না। এমন সময়ে নারায়ণদা এলেন, হাসলাম, কিন্তু ঠিক চোখাচোখি
হল না, উনি ভিতরে ঢুকে গেলেন, আর পরে পরেই এলেন তাপসদা, আমি হেসে, হাত নেড়ে বলে
ফেললাম, “আরেঃ নারায়ণদা”, তাপসদা ঢুকেই যাচ্ছিলেন, বেরিয়ে এসে অবাক, “কি!
নারায়ণ!!” মনে মনে ‘হে নারায়ণ, বাঁচাও’, বলে তাপসদাকে বললাম, নারায়ণদার সাথে
চোখাচোখি না হবার কথা। হল খানিক হাহাহিহি, এবং শেখরদা প্রবেশ করলেন।
প্রদীপ জ্বালিয়ে সভার আনুষ্ঠানিক শুরুয়াৎ করিয়ে দিলেন
মাননীয় সাহিত্যিক ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংস্কৃতি সচিবের
স্ত্রী মাননীয়া নন্দিনী চক্রবর্তী। এক এক করে এগিয়ে চলল অনুষ্ঠানের প্রতিটি
অধ্যায়, নান্দনিকতার সাথে। মঞ্চে উঠে আমিও যাহোক উৎরে দিলাম, একটু বেশি গম্ভীর হয়ে
গেছিলাম, মনে হয়। এর পর আমার কাজ একটা আসন নেওয়া, ও চুপচাপ দেখে যাওয়া। মিলিদিকে
চিনতে পারলাম, উনি পারেননি মনে হল, বললাম, “রূপচর্চা শুধু নারীর জন্য লেখা হবে
কেন? আপনি লেখেন, আর আমি দু’এক শব্দ-বাক্যাংশ পালটে লেখাটাকে জেন্ডার-ফ্রি করে
দিই, খেয়াল করেছেন?” এবার উনি চিনলেন আমায়, “হ্যাঁ! ব্যাপারটা আমারও চোখে পড়েছে,
২-৩ বার, কিন্তু...”, আবার সামান্য হাহাহিহি, সামান্য, কারণ তখন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে
গেছে পুরোদমে। নন্দিনীদি-তন্ময়-শ্রীরূপা-দেবাশীষ মিলে
শুরু করে দিয়েছে মধুর সঞ্চালনা।
শেখরদা বলছেন, এই চিলেকোঠা শুরুর কথা, ওয়েবজিন শুরুর কথা,
এইসব বলতে বলতে উনি মঞ্চে ডেকে নিলেন আমাদের, অলোকদা, মিত্রাদির তরফে প্রদীপদা,
সুশান্ত, আহুতি এবং এই অধমকে। আমাদের সম্মানিত করলেন চিলেকোঠার প্রবীণ সদস্য
নারায়ণ রায়। কী-ই বা করতে পেরেছি এ জীবনে, এ পর্যন্ত? আমার কাছে ওই সন্ধ্যার সব
থেকে আবেগঘন মুহূর্ত রচিত হল যখন নারায়ণদার হাত থেকে আমার হাতে আসছিল ওই
সম্মান-পুরস্কার।
সুশান্তর সঙ্গে চা-শিঙাড়া খেতে বাইরে গেলাম, এবং মিস করলাম
তাপসদাদের শ্রুতিনাটক। তবে হ্যাঁ, সব স্তরকে ছুঁয়ে গেছে বৈজয়ন্তদাদের শ্রুতিনাটকখানি।
সব স্তরের কথা কেন লিখলাম? দেখবেন, এই ধরনের অনুষ্ঠানে সব থেকে ব্যাজার মুখে থাকেন
সাউন্ডসিস্টেম-অপারেটর, ওমা কোথায় কি! সকলের চোখের আড়ালে, মঞ্চের পিছনের কোণে বসে
ভদ্রলোক বৈজয়ন্তদাদের শ্রুতিনাটক শুনে ফিকফিক হেসে খুব মজা নিচ্ছেন যে!
শ্রুতিনাটকের আগে হচ্ছিল কবিতাপাঠ, আর ছোট্ট মেয়েটি আপনমনে
নিজের মা-কে ঠেশ দিয়ে ঘুমিয়ে নিচ্ছিল দিব্যি। ও তিতাসের মেয়ে, আদৃতা। শ্রুতিনাটকের
সময় ভূতের চরিত্রে যিনি তাঁর স্বরক্ষেপণ এবং মুখ ও মাইকযন্ত্রের অধিক নৈকট্য খোনা
ভূতুড়ে স্বরকে লাগামছাড়া মাত্রায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল মাঝেমধ্যেই, আর আমি ঈষৎ ঘাড়
ঘুরিয়ে সেই মেয়ের ঘুমিয়ে থাকা দেখে নিশ্চিন্ত হচ্ছিলাম, গান তুমি হও...
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় ভাগে ছিল “একদিন” পত্রিকার সম্পাদক
শ্রীঋতব্রত ভট্টাচার্যর সঞ্চালনায় বিতর্কসভা, বিষয়ঃ ফেসবুক কি নিছকই নারী পুরুষের
অবাধ মেলামেশার মৃগয়াক্ষেত্র? শুরু হতে হল কিছু দেরি, তবে শেষমেশ সব পুষিয়ে গেল।
প্রথমেই বলি এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের কথা। চিলেকোঠা ওয়েবজিন-এর আয়োজনে বিতর্কসভা, সেই
বিতর্কসভায় প্রশ্ন রাখা হচ্ছে, ফেসবুক কি নিছকই নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার
মৃগয়াক্ষেত্র? বিতর্কে চিলেকোঠা থেকে যে দুজন অংশগ্রহণ করলেন, তমালী রায় ও সৈয়দ
হাসমত জালাল, তাঁরা দুজনেই বলবেন বিপক্ষে! বিপক্ষে ছিলেন আরও একজন, বিশিষ্ট
চিত্রশিল্পী বলাকা দাস (গুপ্ত)। পক্ষে বললেন অঞ্জন গুপ্ত ও তরুণ কবি কিশোর ঘোষ।
অর্থাৎ খেলা শুরুর আগেই ৩-২!
ঋতব্রতর দক্ষ সঞ্চালনায় দ্রুত জমে গেল পরিবেশ। সকলের
বক্তব্যই যুক্তিতে অটল। কেবল কিশোর ছিল শিবরঞ্জনী রাগের ওপর, চড়া তো খুব চড়া, কোমল
তো বেশ কোমল, এবং তা-ই কিশোরই শ্রোতাদের সহজ টার্গেট হয়ে যায়, বয়সেও সে নবীন।
বিপক্ষদলের যুক্তির কাছে ক্রমেই ধার কমে আসে পক্ষের বক্তাদের। ঋতব্রত শ্রোতাদের
অংশগ্রহণে আমন্ত্রণ জানান। বলেন বৈজয়ন্ত রাহা, আহুতি ভট্টাচার্য, শ্রীরূপা
চট্টোপাধ্যায়, গৌতমকুমার কর, তবে সবাইকে ছাপিয়ে গেলেন রাণী সিংহ। ওঁর বক্তব্য এবং
তার প্রকাশভঙ্গী আমাকে বাংলা সিনেমায় ছায়াদেবীর দাপুটে উপস্থিতির কথা মনে করিয়ে
দিল, চুপিচুপি ঋতব্রতদার কানে সে কথা তুলে দিতেই, উনি উপসংহারে পৌঁছনোর আগে বললেন,
“শৌভিক বলছেন, রাণী সিংহ হলেন ২০১৫-র ছায়াদেবী”।
সেভাবে আগে আলাপ হয়নি, সেদিন হল দেবাশিস মিত্র, তন্ময়
গুপ্ত, অনুপম দাসশর্মা এইরকম কয়েকজনের সঙ্গে। আবার কি আশ্চর্য, আগে আলাপ পরিচয়
যথেষ্ট আছে, অথচ সেদিন সামান্য কথা বা দেখে হাসি এমনটা হল না কয়েকজনের সাথে, যেমন
উষসী ভট্টাচার্য, তনুশ্রী মিত্র, মিতা নন্দন, জয়া বসু ইত্যাদি।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি মিলেমিশে এক হয়ে রয়ে গেল শুধু অনন্য সেই
সারস্বত সন্ধ্যা।