বিজ্ঞানের প্রবন্ধ
রঙের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের রং
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
রং জিনিসটার প্রতি মানুষের আকর্ষণ দুর্নিবার । আমরা যখন খুব ছোট ছিলাম তখন একটা ভাঁজ করা কাগজের লাল ফুল আমাদের বুকের ওপর চোখের সামনে টাঙিয়ে রাখা হত । আর তাই দেখে দেখে আমরা খুব হাত-পা ছুঁড়ে খেলতাম । এই রঙিন কাগজের ফুলটা নিশ্চয় আমাদের শিশুমনে পুলক জাগাতো । যেমন নানা রঙের রবারের বেলুন শিশুদের মনে কি আনন্দের জোয়ার আনে তা সহজেই অনুমেয় । আর তাই তো ছোটদের অন্নপ্রাশন, জন্মদিন বা অন্য কোনও অনুরূপ অনুষ্ঠানে রঙিন বেলুন দিয়ে সাজসজ্জা করা হচ্ছে আজকাল ।
শৈশব থেকে কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব এমনকি বার্ধক্য পর্যন্ত মানুষের জীবনে রঙের প্রভাব অতি প্রবল । যৌবনের রং বড় মধুর । এ সময় মানুষ রোমান্সের বাতাসে
ডানা মেলে দেয় – ভাবী ভালবাসার ছবি এঁকে মানুষ তাতে রং দেয় । প্রৌঢ়ত্বের তাকিয়া ঠেস দিয়ে মানুষ সংসারের রোজনামচায়
রঙের তুলি বুলোয়। বার্ধক্যের ইজি চেয়ারে শুয়ে শুয়ে গোধূলির রং দেখতে দেখতে মনটাকে ভরিয়ে তোলে
সীমাহীন প্রসন্নতায় ।
রং মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে অকল্পনীয় ভাবে । লাল রং আনে ভালবাসার গভীরতা । সেই জন্যেই বোধহয় প্রেমিক
প্রেমিকাকে লাল গোলাপ দিয়েই প্রপোজ করে । অবশ্য লাল রং ভয়ের চিহ্নও হতে পারে । কারণ রক্তের রং লাল । সেজন্যে খুন জখম এসব দেখানোর সময়ও এ রঙের ব্যবহার
প্রচলিত । হরর ফিল্মগুলোতে লাল আর কালোর ব্যবহার সর্বাধিক । লাল রং
বিপদের সংকেত বহন করে । তাই খেলোয়াড়কে মাঠে চূড়ান্ত অসভ্যতা বা নিয়ম ভঙ্গের শাস্তি হিসেবে লাল কার্ড
দেখানো হয় । ট্র্যাফিক সিগনালে লাল আলো দেখা মানে গাড়ি আপাতত আর যাবে না । চলন্ত ট্রেনকে থামানোর জন্যে লাল
পতাকা বা লাল সিগন্যাল ব্যবহার করা হয় । হলুদ রং মাঝারি রকমের স্নিগ্ধ । ট্র্যাফিক সিগন্যালে এই রং ব্যবহার করে গাড়িকে
প্রস্তুত হতে বলে বা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেয় ।
সবুজ রং আনে মানসিক স্নিগ্ধতা । তাই বারবার আমাদের কেরলে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে সেখানের
সবুজ প্রকৃতি, গাছপালা, সমুদ্র এসব দেখতে । অবশ্য কেরল ছাড়াও সবুজের সমারোহ আছে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে । তবে আজকাল ভ্রমণ রসিকদের কাছে
কেরল বড় প্রিয় হয়ে উঠেছে বলেই বললাম ।
আকাশী নীল রং আনে আলস্যে হারিয়ে যাবার অনুভূতি । নীল আকাশে সাদা মেঘগুলোকে ভেসে
যেতে দেখে আমরাও যেন আলস্যের উন্মাদনায় ভেসে চলতে চাই সে মেঘের সঙ্গে । সেই রকম গোলাপি, হলুদ, বেগুনি প্রতিটি রঙেরই আবেদন রয়েছে তাদের স্বকীয়তায় । বিশেষ রঙের প্রতি আকর্ষণ কিন্তু
মানুষের ক্ষেত্রে নিতান্ত ব্যক্তিগত । কেউ লাল রং পছন্দ করে আবার কেউ সে রঙে ভয়ে কেঁপে ওঠে । বাদামি রং কারোর প্রিয় তো বেগুনি
আর একজনের । অবশ্য এই পছন্দ আবার বস্তুর ওপর নির্ভর করে খানিকটা । যেমন পাকা আপেল লাল হলে সবাই খুশি হলেও পাকা পেয়ারায়
কিন্তু হলুদ রংটিই চাই । বেদানা যদি টুকটুকে লাল বা জাম যদি গাঢ় বাদামী রঙের না হয় তো খেতে কি ইচ্ছে
করে কারও ?
রং একক বা সমন্বিত ভাবে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এমনকি
করে তোলে প্রলুব্ধ। এইজন্যে খাবারেও থাকে রঙের ব্যবহার । রঙিন খাবার শুধু মাত্র ছোটদেরই নয় বড়দেরও ভীষণ ভাবে দৃষ্টি
আকর্ষক । রঙিন আইসক্রিম, কাস্টারড, পুডিং, কেক বা পেস্ট্রি এমন কি মিষ্টান্ন পর্যন্ত মানুষের স্যালিভারি সিক্রিশন বাড়িয়ে
তোলে ভীষণ ভাবে । যদিও এ কথা মনে রাখতে হবে ব্যবহারযোগ্য রং ছাড়া খাদ্যে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা
প্রবল, তাই কিছু রং খাদ্যে ব্যবহার নিষিদ্ধ ।
সাদাকালোর তুলনায় রঙিন ফোটো কমবেশী সকলের কাছেই প্রিয় । রঙিন টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি তো বাজারে দুরন্ত
বিকোচ্ছে।
শীতকালে বাড়ীর ছাদে রঙিন গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকার সারি সারি টবে ফুটে থাকতে দেখে কার না মন
প্রসন্ন হয় বলুন ? মন আরও প্রসন্ন হয় যখন বাহারে রঙিন ডানা মেলে মধুলোভী প্রজাপতিরা উড়ে যায় ফুল
থেকে ফুলে । আর এ সময় রঙিন দিগন্তের দর্শন – রঙিন মেঘের বিছানায় ভানুদেবের আসন্ন নিদ্রার দৃশ্য? সে যেন ঈশ্বর দর্শনের সমতুল । আমাদের মোহমুগ্ধ দৃষ্টি যেন ফেরেই
না অন্য কোনও দিকে ।
রং কী?
রং কোনও বস্তু নয় এমনকি কোনও শক্তিও নয় । কিন্তু প্রশ্ন হল বস্তুও নয় আবার
শক্তিও নয় তবে জিনিসটা কী? । রং হল মানুষের দর্শন অনুভূতি মাত্র । মানুষের মস্তিষ্কে কতগুলি স্নায়ু
আছে (১২ জোড়া), যার মধ্যে একটি মস্তিষ্কে দর্শন অনুভূতি জাগায় । চোখের মধ্যে দিয়ে কোনও আলো ভেতরে
প্রবেশ করে পড়ে রেটিনায় । এই রেটিনার পেছনে থাকে গোছা গোছা অপটিক নার্ভ যারা মস্তিস্কে আলোর অনুভূতি ও
উপস্থিতি জানায় । কিন্তু আলোর অনুভূতি মানেই রঙের অনুভূতি নয় । আগেই বলেছি রং কোনও বস্তু বা শক্তি নয় । কিন্তু আলো অবশ্যই একটি শক্তি ।
পদার্থবিদ্যায় রং - আলো একটি শক্তি এবং অবশ্যই গতিমান
শক্তি অর্থাৎ সর্বদাই প্রবাহিত হয়ে চলেছে । এমনকি বাধা পেলেও বিপরীত দিকে ছিটকে যায়, যার নাম আলোকের
প্রতিফলন । আবার বস্তুর ভেতর দিয়েও চলে যেতে পারে, যার নাম আলোকের প্রতিসরণ । এক একটি রং আসলে এক একটি
নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট আলোক রশ্মি । আলো কিন্তু সর্বদাই অদৃশ্য কিন্তু কোনও বস্তুর ওপর পড়ে
তাকে আলোকিত ও দৃশ্যমান করে তোলে । অর্থাৎ আমরা আলো দেখি না, দেখি আলোকিত বস্তুকে । তেমনি রং আমরা দেখি না । দেখি রঙিন একটি বস্তুকে ।
দৃশ্যমান ও অদৃশ্য আলো - বিষয়টা ভারি মজার আর স্ববিরোধী মনে হতে পারে। কোনও আলোই যখন দেখা যায় না তখন আবার দৃশ্যমান আলো
বলে কিছু হয় নাকি ? আসলে সমস্ত আলোই অদৃশ্য, কিন্তু এর মধ্যেই কিছু আলো কোনও বস্তুর ওপর পড়ে তাকে
দৃশ্যমান করে তোলে । যেমন বেগুনি আলো, লাল আলো এইসব । এদের দৃশ্যমান আলো বলা হয়। যেমন কোনও বেগুনি রঙের আলো বস্তুর ওপর পড়ে তাকে বেগুনি করে দেখায় । কিন্তু যে সমস্ত আলোর এই ক্ষমতা
নেই (কিংবা তার থেকেও বেশি ক্ষমতা আছে) তাদের বলে অদৃশ্য আলো । এই আলোগুলি কোনও বস্তুর ওপর পড়লেও
বস্তুকে দেখা যায় না । যেমন অতিবেগুনী (ultra violet) বা অতি লাল (infra red) আলো। এগুলি কোনও বস্তুকে দৃশ্যমান করে তোলে না বটে তবে বস্তুর মধ্যে এদের ভেদন
ক্ষমতা (penetrating power) অত্যন্ত বেশি এবং এরা বিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে
সহায়তা করে ।
সাধারণত 4000 থেকে 7500A (A=Angstrom একক, ১ A = ১ সেন্টিমিটারের ১০ কোটী ভাগের এক ভাগ) তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট আলোগুলি বস্তুকে
দৃশ্যমান করে তোলার ক্ষমতা রাখে আর তাই এই সীমাটি হল দৃশ্যমান আলোকের সীমা । বর্ণালীর ( বোঝার সুবিধের জন্য
ধরি রামধনু) সাতটি রং অর্থাৎ বেগুনি থেকে লাল (বে-নী-আ-স-হ-ক-লা বা VIBGYOR) এই সীমা দ্বারা সীমায়িত । অদৃশ্য আলোকের সীমা 4000A অপেক্ষা আরও নীচে অর্থাৎ আরও
সূক্ষ্ম । তাই তাদের ভেদন ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা আরও অনেক বেশী । কিন্তু তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম হওয়ার জন্য এরা মস্তিষ্কে
দর্শন অনুভূতি আনতে পারে না। তাই বস্তুর ওপর এই আলোগুলি পড়লেও বস্তু দৃশ্যমান হয়
না । তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হল কোনও তরঙ্গ বা
ঢেউয়ের দুইটি মাথা বা শীর্ষের মধ্যে দূরত্ব ।
সূর্যের সাদা আলোর প্রকৃত রূপ - মহাবিজ্ঞানী নিউটন তাঁর বিখ্যাত বর্ণ চাকতির সাহায্যে প্রমাণ করেছেন সূর্যের
সাদা আলো আসলে একটি রং-এর আলো নয় । এটি হল রামধনুর সাতটি রঙের মিলিত ফল । প্রিজম নামে আর একটি স্বচ্ছ বস্তুর মধ্যে দিয়ে সাদা আলো
পাঠিয়েও এর প্রমাণ মিলেছে ।
রামধনুর সৃষ্টি - রামধনু
একটি প্রাকৃতিক বিষয় যা কেবল মাত্র দেখাই যায়, ধরা ছোঁয়া যায় না । কারণ এটির সৃষ্টি সূর্যের সাদা
আলোর বিশ্লেষণে । সাদা আলো কোনও প্রিজমের মধ্যে দিয়ে যাবার ফলে তার বিশ্লেষণ ঘটে তাকে সাতটি
রঙে শোভিত করে । প্রকৃতিতে বৃষ্টির ফোঁটাগুলি প্রিজমের কাজ করে থাকে । মনে রাখতে হবে রামধনু সৃষ্টির জন্য রোদ এবং বৃষ্টি
দুইই দরকার । আকাশের একদিকে বৃষ্টি ও অন্যদিকে রোদ
উঠলে সাধারণত এই প্রাকৃতিক ঘটনাটি ঘটে থাকে আর সকাল বা বিকালের দিকে দিগন্তের
আকাশে এই সুমধুর দৃশ্য দেখা যায় । মনে রাখতে হবে প্রাকৃতিক হলেও এই দৃশ্য কিন্তু খুবই বিরল আর কতগুলি প্রাকৃতিক
শর্তপূরণ সাপেক্ষে ঘটে থাকে ।
বস্তু কখন রঙিন হবে ?
আমরা বলেছি বস্তুর ওপর আলো পড়লে বস্তু দৃশ্যমান হবে কিন্তু
কোন বস্তু কখন রঙিন হবে এটা ভাল করে বোঝা দরকার । কোনও বস্তুর ওপর আলো (দৃশ্যমান আলো) পড়লে চারটি ঘটনা
ঘটতে পারে । এক, সমস্ত আলো বস্তু কর্তৃক শোষিত হতে পারে এবং কোনও আলোই (বিশেষ রং যুক্ত)
প্রতিফলিত বা ঠিকরে ফিরে আসবে না । এক্ষেত্রে বস্তুটিকে কালো দেখাবে । অর্থাৎ কালো মানে হল সমস্ত রঙের
অভাব বোঝাবে । দুই, সমস্ত আলোই ঠিকরে বেরিয়ে আসতে পারে অর্থাৎ প্রতিফলিত হতে পারে । সেক্ষেত্রে বস্তুকে সমস্ত রঙের
মিলিত রূপে অর্থাৎ সাদা হিসেবে দেখা যাবে। তিন, কোনও একটি নির্দিষ্ট রঙের আলো ফিরে এসে বাকিগুলি সব শোষিত হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে যে রংটি ফিরে আসবে
সেটিই হবে বস্তুর রং । যেমন সাদা আলোর লালটি ফিরে এসে বাকি সব যদি বস্তু দ্বারা শোষিত হয়ে যায় তবে
বস্তু লাল হবে । তেমনি বেগুনি, গোলাপি, হলুদ, সবুজ ইত্যাদি । চার, সাতটি আলোর মধ্যে কেবল মাত্র একটি রং শোষিত হয়ে বাকিগুলি ফিরে আসতে পারে । সেক্ষেত্রে বস্তুর রং হবে ফিরে
আসা রংগুলির মিলিত ফল । যেমন যদি বস্তু কেবল মাত্র বেগুনি রঙটিকে শোষণ করে বাকি ছয়টিকে ছেড়ে দেয় তবে
বস্তুর রং হবে হলুদাভ সবুজ বা yellowish green, কেবল হলুদ আলো শুষে নিয়ে বাকিগুলো ছেড়ে দিলে বস্তুর রং
হবে নীল ইত্যাদি ।
মূল রঙের ধারণা - রামধনুতে সাতটি রং পাশাপাশি অবস্থান করলেও এই সাতটি রং কিন্তু মূল বা মৌলিক রং
(Fundamental colour) নয় । মৌলিক রং হল প্রকৃতির আদত রং যার বিশ্লেষণে আর কোনও রং পাওয়া যায় না । প্রকৃতিতে মৌলিক রং হল মাত্র
তিনটি – লাল, নীল আর সবুজ । রামধনুর অন্য চারটি রং সৃষ্টি হয় এই মূল তিনটি রঙের বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে । প্রকৃতিতে হলে প্রকৃতি নিজেই
মিশিয়ে নেয় আর কৃত্রিম হলে মানুষকেই সেই অনুপাতে মিশিয়ে নিতে হয় । রামধনুর সাতটি রং ছাড়াও আরও অজস্র
রং কিন্তু প্রকৃতিতেই পাওয়া যায় । যেমন ধরা যাক গোলাপের পাতাও সবুজ আবার তার ডাঁটাও । কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে এই দুই সবুজের কিন্তু
ভিন্নতা আছে । তরমুজের ভেতরে যে লাল থাকে সেটা কি সর্বদাই রামধনুর লাল ? এ ছাড়াও বিভিন্ন ফুলে বিভিন্ন স্থানে
আছে বিভিন্ন রং যেগুলির কোনটাই হয়ত রামধনুর রং নয় । প্রকৃতি এই মিশ্র রংগুলি নিজের উদ্যোগে নিজেই মিশিয়ে
তৈরি করে নেয় ।
আজকাল কম্পিউটারে নিমেষ ফেলার আগেই হাজার হাজার রং তৈরি হয়ে
যায় । এগুলির মাত্র তিনটি মৌলিক রং আর
বাকি সবগুলি হল মিশ্র রং । মনে রাখতে হবে এক একটি রং মানে হল এক একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের আলো । অর্থাৎ এক একটি রং হল এক একটি
আলোকশক্তি বা আরও ভাল করে বললে বলতে হয় দৃশ্যের অনুভূতি উৎপাদনের শক্তি ।
অনুপূরক রং (complementary colour) - প্রকৃতিতে মূল রং মাত্র তিনটি হলেও রামধনুতে মূল রং (সূর্যালোকের সাদা আলোর
বিশ্লেষণ ফল ) সাতটি । অর্থাৎ বেগুনি থেকে লাল । কোনও বস্তু যদি সাদা আলোর এক বা একাধিক রং শোষণ করে আর বাকিগুলিকে ছেড়ে দেয়
তবে বস্তু ঐ ছেড়ে দেওয়া রংগুলির মিলিত রূপ পায় । যেমন বেগুনি আলো বা রং শোষণ করে বাকিগুলি ছেড়ে দিলে
বস্তুর রং হবে হলুদাভ সবুজ । এই হলুদাভ সবুজ রংটি হল অনুপূরক রং । একথা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে বস্তুর রং কী হবে সেটা নির্ভর
করছে মূলত দুটি জিনিসের ওপর । এক, বস্তু কোন রং শোষণ করছে এবং দুই, বস্তু কোন রং ছেড়ে দিচ্ছে । সাদা এবং কালো (Black and White) পেন্সিল স্কেচের কথা ভাবুন । সাদা পাতার ওপর পেন্সিলের কালো
দাগ দিয়ে তৈরি করা স্কেচ কি অপূর্ব হয় । যদিও উড-পেন্সিলের এই কালো আসলে কালো নয় । এটি ধূসর (grey), কারণ উড-পেন্সিলের (বর্তমানে
অবলুপ্তপ্রায়) শিস থেকে কালি বার হয় না । এই শিস তৈরি হয় গ্রাফাইট দিয়ে যেটি ধূসর রঙের। আমরা এর আগেই দেখলাম সাদা এবং
কালো আসলে কিন্তু কোনও রং নয় । কালো হল প্রকৃতপক্ষে আলোহীনতা আর সাদা হল সমস্ত বর্ণের মিশ্রণ । তার মানে এই দাঁড়ালো যে সাদার
কম্পাঙ্ক সবচেয়ে বেশি কারণ এটি দৃশ্যমান আলোকের শেষ সীমায় অবস্থান করছে । আবার কালোর কম্পাঙ্ক শূন্য । তাই সাদা এবং কালোর মধ্যে
কম্পাঙ্কের ব্যবধান সবচেয়ে বেশি । অর্থাৎ এই দুইটি রঙের মধ্যে বিভেদ বা contrast সর্বোচ্চ । তাই কালোর মধ্যে সাদা বা সাদার মধ্যে কালো মানুষের
চোখে সবচেয়ে বেশি করে ধরা পড়ে আর অনেক দূর থেকে তা দেখা যায় ।
জেব্রা সিম্বল আর জেব্রা ক্রসিং - জেব্রার গায়ে থাকে যে সাদা ও কালোর ডোরাটি যেটি সাদার মধ্যে
কালো না কালোর মধ্যে সাদা এই বিতর্কেরও উদ্রেক করে হয়ত মাঝে মাঝে, তা কিন্তু প্রকৃতির শিল্পকর্মের
অপূর্ব এক নিদর্শন । খেয়াল করে দেখবেন একটি জেব্রাকে বহু দূর থেকেও বেশ স্পষ্ট দেখা যায় । প্রকৃতির এই ধর্মকে কাজে ব্যবহার
করেছে মানুষ বহু ক্ষেত্রে । মানুষ পারাপার করার জন্য রাস্তায় যে ক্রসিং ব্যবহার করা হয় তাতে কালো পিচের
রাস্তায় সাদা ডোরা কাটা থাকে । জেব্রার গায়ের অনুরূপ ডিজাইন থাকে বলে এগুলিকে বলে জেব্রা ক্রসিং । বহুদূর থেকেই গাড়ির চালক এটি
দেখতে পায় ও গাড়ির গতিতে লাগাম পরায় । হাইওয়ের বাঁকে, বিশেষভাবে বিপজ্জনক বাঁকে (sharp turning) গাড়ির
চালককে সতর্ক করার জন্য বা রাস্তার ওপর বাম্প বা হাম্প তৈরি করেও এমন চিহ্ন দেওয়া
হয়, যাকে বলে জেব্রা সিম্বল।
রঙের রসায়ন - আলো একটি
শক্তি । বিশেষ বিশেষ কম্পাঙ্কযুক্ত আলোক
রশ্মি রঙের অনুভূতি জাগায় । আবার আমরা জানি বস্তুর উপস্থিতি ছাড়া শক্তির অস্তিত্ব বোঝা সম্ভব নয় । অর্থাৎ যদি এমন কোনও জায়গায় আলো
এসে পড়ে যেখানে কোনও বস্তুই নেই সেখানে কিছুই দেখা যাবে না অর্থাৎ আলো থাকা
সত্ত্বেও দেখাবে সম্পূর্ণ অন্ধকার । এইজন্যে মহাকাশ কালো দেখায় । কারণ লক্ষ কোটি জ্যোতিষ্ক বিদ্যমান থাকলেও প্রতিফলিত হবার মত বস্তু যেখানে
নেই সেখানে সে আলোর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না । তাই বস্তুর রং হয় বস্তুর শোষণ বা প্রতিফলন ক্ষমতার
জন্য । আর এই শোষণ বা প্রতিফলন ক্ষমতা
আসে বস্তুতে উপস্থিত রাসায়নিক পদার্থের জন্য । আমরা জানি বস্তু মাত্রই রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা গঠিত
।
যে সমস্ত রাসায়নিক বস্তুকে রঙ্গিন করে তুলতে সাহায্য করে
তাদের মধ্যে অজৈব বস্তুগুলিকে পিগমেন্ট (Pigment) আর জৈব বস্তগুলিকে ডাই বলা হয় । জৈব বা অজৈব যাই হোক না কেন তার
ওপর আলো পড়লে রাসায়নিক পদার্থগুলির গঠন ও প্রকৃতির ভিন্নতার জন্য কোনও রং শোষণ বা
প্রতিফলিত করে । অর্থাৎ বস্তুর রং কী হবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে বস্তুতে উপস্থিত রাসায়নিক
পদার্থের ওপর ।
রসায়নের রং - প্রথমে
প্রাকৃতিক রংগুলির আলোচনায় আসা যাক । আমরা সকলেই জানি গাছের পাতার রং সবুজ । এই সবুজ রংটি আসে পাতায় ক্লোরোফিল নামক রাসায়নিকের উপস্থিতির
জন্য । পাতার সমস্ত অংশ সব সময় সমান সবুজ
হয় না কারণ পাতার বিভিন্ন অংশে এই ক্লোরোফিলের পরিমাণের ভিন্নতার জন্য । ঠিক যেমন মানুষের চামড়ার রং সব
জায়গায় সমান হয় না । এক্ষেত্রে চামড়ায় থাকে মেলানিন (Melanin) নামক রাসায়নিকটি । বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পরিমাণে সজ্জিত থাকার জন্য চামড়ার
রং-এর এই ভিন্নতা । তেমনি ফুলের পাপড়ি, প্রজাপতির পাখনা, বাঘের গায়ের ডোরা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই বিভিন্ন জৈব ও অজৈব রাসায়নিক পদার্থের
উপস্থিতি, পরিমাণ ও বিন্যাসের ফলেই রঙের এই বিশাল সমারোহ ।
কৃত্রিম রং - বিভিন্ন
বস্তু, আসবাব, বাড়ির দেওয়াল, বাড়ি সাজানোর উপকরণ ইত্যাদিতে এই রং লাগানো হয় । এগুলি কৃত্রিম ভাবে কারখানায় তৈরি করা হয় । যেমন কিউপ্রিক অক্সাইড (কুচকুচে
কালো), কিউপ্রাস অক্সাইড (টুকটুকে লাল), লেড বা পটাশিয়াম আয়োডাইড বা ক্রোমেট (হলুদ), জিংক অক্সাইড বা সালফেট (সাদা), কোবাল্ট অক্সাইড বা ক্রোমিক
অক্সাইড বা ফেরাস সালফেট (সবুজ), খনিজ জিপসাম থেকে উৎপন্ন প্লাস্টার অফ প্যারিস (সাদা), এন্টিমণি পেন্টা সালফাইড (কমলা) ইত্যাদি ।
আবার জামাকাপড় বা ফ্যাব্রিক গুলি রঙিন করা হয় জৈব ডাই
দ্বারা । নাইলন, টেরিকটন, প্লাস্টিক, পলিথিন, পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি নামে সুপরিচিত), উল, সিল্ক প্রভৃতি ডাই দ্বারা রঞ্জিত করা হয় । ডাইগুলির মধ্যে আবার ভাগ আছে যেমন এসিড ডাই আবার
বেসিক ডাই । কৃত্রিম পদার্থ অর্থাৎ প্লাস্টিক পলিথিন জাতীয় জিনিসগুলি সাধারণত এসিড ডাই
দ্বারা আর উদ্ভিজ্জ যেমন তুলো, সিল্ক, সুতো, উল এগুলিতে বেসিক ডাই ব্যবহৃত হয় । মিথাইল অরেঞ্জ, ম্যালাকাইট গ্রিন, কঙ্গো রেড, ইন্ডিগো ইত্যাদি অজস্র রং বিভিন্ন
আসবাবপত্র, ঘরের দেওয়াল, সিন্থেটিক ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয় । মনে রাখতে হবে রঙের স্থায়িত্ব, বিশেষভাবে জৈব রঙের
স্থায়িত্ব আবহাওয়া, জলবায়ু, যে বস্তুর ওপর তা ব্যবহৃত হবে ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে । এগুলি উচ্চ রসায়নের বিষয় বলে
সাধারণ পাঠকের বোঝার ক্ষেত্রে অসুবিধে হতে পারে বলে এখানে তা পরিহার করা হল ।
নীলিমার নীল ও সাগর জলের নীল রং - নীলিমা বলে কিছুই থাকত না এবং আকাশ সম্পূর্ণ অন্ধকার দেখাত
যদি না বাতাসে ভাসমান প্রচুর পরিমাণ ধূলিকণা উপস্থিত থাকত। এইসব ভাসমান ধূলিকণার ওপর সূর্যের সাদা আলো পড়ে তার
বিক্ষেপণ (Scattering) ঘটে নীল আলোটি চোখে এসে পড়ে । তেমনি সাগরের জল যতই লোনা হোক অর্থাৎ সাধারণ পরিশ্রুত জলের তুলনায় তার ঘনত্ব
যতই বেশি হোক না কেন রং কিন্তু তার স্বচ্ছ আর সাদা (বর্ণহীন বলা হয়) । এক্ষেত্রেও সাগরের গভীরতা হেতু
সাদা আলোর বিক্ষেপন ঘটে চোখে কেবল নীল আলোটিই এসে পড়ে । তাই গভীর সমুদ্র নীল । খেয়াল রাখবেন রাতের অন্ধকারে যারা সাগরের দিকে
তাকিয়েছেন তারা কিন্তু সাগরের কালো রূপটিই দেখেছেন কারণ এক্ষেত্রে সাদা আলোর
অনুপস্থিতিতে বিক্ষেপণের কোনও সুযোগই নেই । বিচে বসে যারা দিঘা বা পুরী বা কোভালামের সমুদ্রে
তাকিয়েছেন তাদের নিশ্চয় এ অভিজ্ঞতা হয়েছে ।
বুদবুদের চাকচিক্য - ঝরণা, সাগরের ঢেউয়ের ফেনা বা সাধারণ বুদবুদ চকচক করতে দেখা যায় । এর কারণ আর কিছুই নয় বুদবুদ আকারে
হয় একটি গোলকের মত আর এই আকারের জন্য তার ওপর পড়া আলোর পূর্ণ প্রতিফলন (Total Reflection) হয়। ফলে সাদা আলোর সবখানিই চোখে এসে
পড়ে।
গোটা কাচ, গুঁড়ো কাচ আর ঘষা কাচ - আমরা সকলেই জানি কাচ একটি স্বচ্ছ পদার্থ । মানে হল এর মধ্যে দিয়ে বেশির ভাগ আলোই চলে যায় । ফিরে আসে খুব অল্প পরিমাণ । কিন্তু কাচের একটি প্লেট ঘষে দিয়ে
দেখুন সেটি অর্ধস্বচ্ছ হয়ে গেছে । এর কারণ আলোক রশ্মিগুলি সব এলোমেলো হয়ে যাওয়া । পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে বিক্ষিপ্ত প্রতিফলন (Diffused Reflection) । তেমনি গুঁড়ো কাঁচ অস্বচ্ছ ও চকচকে । সেক্ষেত্রে আলাদা আলাদা বা একসঙ্গে
দুটি জিনিস ঘটতে পারে । অর্থাৎ আলোকের বিক্ষিপ্ত ও পূর্ণ প্রতিফলন । বিক্ষিপ্ত প্রতিফলনের জন্য ঈষৎ অস্বচ্ছ দেখায় আর
পূর্ণ প্রতিফলনের জন্য চকচক করে । তবে কাচগুঁড়োর মধ্যে একটু জল ফেলে
দেখবেন এগুলি আবার স্বচ্ছ হয়ে গেছে । এর কারণ জল এই গুঁড়ো কাচের ওপরের পিঠ সমতল করে দেয় আর তখন বিক্ষিপ্ত
প্রতিফলনের বদলে নিয়মিত প্রতিফলন (Regular
reflection) হয় । কাচ আর জলের মধ্যে প্রতিসরাঙ্কের (Refracting index) খুব বেশি
ফারাক না হওয়ায় এটি আরও বেশি করে সম্ভব হয় ।
দিগন্তের রং ও রঙিন দিগন্ত – প্রত্যুষে ও গোধূলি বেলায় (Dawn and Twilight) ভোরে যখন জানলার রঙিন পর্দা তুলে রবিদেব উঁকি পাড়েন আকাশে
কিংবা সন্ধ্যার আগে যখন পশ্চিম আকাশের রঙিন মেঘেরা বিশ্রাম করতে যান তখন আমাদের মন
ভরে ওঠে অসীম আনন্দে । কবি কিংবা চিত্রকরের কলম আর তুলি কাগজে বা পটে ভরিয়ে দেয় সে সৌন্দর্যকে । আসলে কিন্তু ভোরের আগেই ভোর হয়
এবং সন্ধ্যার অনেক পরেও সন্ধ্যা হয় না । এর কারণ আকাশে ধূলিকণার উপস্থিতি আর তার কারণে আলোকের
বিক্ষেপণ । বাতাসের বিভিন্ন স্তরের তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্য স্তরগুলির প্রতিসরাংকের
ভিন্নতা । এক্ষেত্রে ভোরের অনেক আগে যখন সূর্য দিগ্বলয়ের অনেক নীচে তখন সূর্যকে আমাদের
না দেখতে পাওয়ারই কথা । কারণ দিগন্তরেখা আমাদের দৃষ্টিসীমার নীচে রাখে সূর্যকে । কিন্তু এক্ষেত্রে আলোক প্রতিসরণের বিশিষ্টতার জন্য
আকাশে সূর্য দেখা যায় । অনেক বড় আকারে দেখা যায় আর বিক্ষেপনে লাল আলোর উৎপাদনের জন্য পূর্ব আকাশ লাল
দেখায় । গোধূলির ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা
ঘটে । সূর্য ডুবে যাবার অর্থাৎ
দিগন্তরেখার নীচে চলে যাবার পরেও প্রতিসরণে উৎপন্ন সূর্যের একটি প্রতিকৃতি আকাশে
বিদ্যমান থাকে । তাই সন্ধ্যার বহু পরেও সূর্যকে আমরা আকাশে দেখি । এক্ষেত্রেও বিক্ষেপণে উৎপন্ন লাল রং সারা পশ্চিম
আকাশ ভরিয়ে তোলে । আর মেঘের কোলে কোলে অর্থাৎ ভাঁজে ভাঁজে সে রং বারংবার প্রতিফলিত হয়ে আমাদের
দৃষ্টিকে নন্দিত করে, কবির কলম আর চিত্রকরের তুলিকে সমৃদ্ধ করে।
রঙের কথা শেষ করব বলেও শেষ করা যায় না । কিন্তু কলমের কালি যে এক সময় শেষ
হয়েই আসে, এটা তো ঠিক ।
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন