হিজাব
তপোব্রত মুখার্জি
তপোব্রত মুখার্জি
বিশ্বাস করে হাত বাড়ালেই যদি দূরটা কাছের হয়ে যেত তবে সেটুকু বিশ্বাস অবশ্যই
করত নাজমিনা। এখন দেওয়াল আর খোলা হাওয়ার মাঝে একটা দরজার আড়াল। হয়তো চাইলে সরানো যায় কিন্তু সেটা বেঁধে আছে এক আন্তরিক
অনীহায়। যেখানে প্রকাশ কুণ্ঠিত, সেখানে সবটুকুই আড়াল থাকা ভালো।
এক মানুষকে ভাবলে হয়তো অনেক কিছু মেনে নেওয়া যায় শুধু পারস্পরিক এক
সহাবস্থানের কথা ভেবে, অথবা তাকে বোঝানো যায় নিজের ভাবনার কথা। কিন্তু এই এক যখন গণের হাত ধরে, যখন রাস্তায় নেমে স্বাধীনতার
দাবিতে স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চায়, তখন? না, ধর্ম নয়। তাঁর ধর্ম কী, এ নিয়ে সে নিজেকে প্রশ্ন করেছে বারবার। উত্তর এসেছে, কোন ধর্মের সংকীর্ণ গণ্ডির মাঝে নারী বাঁধা নয়, থাকতে পারে না। সে রমণী, সে নারী - ব্যস। এর পর কোনও ধর্ম তাকে আর কিছু দিতে পারে না।
অথচ তার সেই স্বাধীন হৃদয়ও বাঁধা পড়তে চেয়েছিল। চেয়েছিল জাল হোক, খাঁচা হোক কিংবা সংসার, সেখানে নিজের মতো করে কিছু পেতে। তার দুঃখ, তার কষ্ট, সব তার -- তবু তার। সেখানে মান থাকবে, অভিমান আরও, কিন্তু সেসব তো তার। সে কথা দেশ জানবে না, কাল জানবে না। তারা তাকে স্বাধীন বলে জানবে।
কি একটা ভুল ছিল বুঝি। মানুষটা দেশের নাম বলে, সমাজের নাম বলে কেমন করে স্বাধীনতার এক মানে করেছিল যাকে বিশ্বাস করতে বাধে, তবু সে বলছে বলেই হয়তো...
সে বেরিয়েছিল। মানুষটা তারপর আর ফিরে তাকায়নি। যে বন্ধন সে নিজের করবে বলে মাথা পেতে সব নিতে প্রস্তুত ছিল, সে বন্ধন আর কেউ দেশের নাম করে
চাপিয়ে দিতে চাইলে সে তা ঝেড়ে ফেলতে দু’বার ভাববে না। একার মাঝে হারিয়ে যাবার সুযোগ হয়তো বারবার ফেরে না, কিন্তু ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যেতে
যেতে সমস্ত মন একটা সময় মরিয়া হয়ে ওঠে।
সে চেয়েছিল আপন করে পেতে। তার মানুষটা এক জালের আড়ালে ঢেকে তাকে দেশের কাছে কেন চাইল দেখাতে? একা বসে ভাবতে ভাবতে নাজমিনা
খেয়ালই করে না, সকাল গড়িয়ে যাচ্ছে কি না। সমস্ত সন্ধেগুলো হিজাবের অন্ধকার আড়াল থেকে কেমন যেন এক রকম লাগে।
নাজমিনা বাঁধায় বন্ধ হতে চেয়েছে কারো একার হয়ে। দেশের মিথ্যে চোখরাঙানিকে সে ভয় করে না। কে তার দেশ? কার দেশ? কী দিয়েছে তার দেশ? জন্ম? মৃত্যু? নাম? পরিচয়? আর সে? তার সত্তা? তার মূল্য দিতে জানে না দেশ?
নাজমিনা প্রশ্ন করেছিল। তারপর নিজেকে পেয়েছিল ঘরের উঠোনে। দেশের রং লাল হয়ে তার চোখের কোণে ঝরছিল। সে কারো একার হয়ে আড়াল হতে চায় তবু
যে দেশের কথা সে ভালো জানে না, তাকে মেনে সে আড়াল নিতে চায়নি -- একথা তার দেশের মন, মনের মানুষ কেন বুঝতে পারেনি তা সে বোঝেনি। চেষ্টা করতে করতে ক্রমশ ক্লান্ত
হয়েছে শুধু।
বিশ্বাস করে হাত বাড়ালে শুধু দরজার আগলখানা হাতে আসে। এখানে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ তাকে কিছু চাপিয়ে দেবে
না। খোলা জানলা বিকেলের হাওয়া আনে। নাজমিনার খোলা চুল সামান্য উড়ে এসে
আলগোছে মুখের উপর থেকে আগল সরিয়ে নেয়।
তার দেশ তাকে চেনে। মানুষ কেন পারল না?
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন