চণ্ডালিনী-রাধা : একটি আলেখ্য ...
অভিষেক চট্টোপাধ্যায়
হম, সখি দারিদ নারী
জনম অবধি হম পীরিতি করনু,
মোচনু লোচনবারি।
রূপ নাহি মম, কছুই নাহি গুণ,
দুখিনী আহির জাতি-
নাহি জানি কছু বিলাস-ভঙ্গিম
যৌবনগরবে মাতি-
প্রকৃতির শরীরে তবুও বসন্ত আসে। পিক কুহু কুহু গায়। মৃদুমন্দ বাতাস বয়।
বসন্ত আওল রে!
মধুকর গুন গুন অমুয়ামঞ্জরী কানন ছাওল
রে।
প্রকৃতির বুক ছুঁয়ে
দখিনার দাক্ষিণ্যে রভসরসগান। প্রাণের পালে নতুন দোলা। এর অর্থ কী ও জানে না। শুধু
‘ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার তিলে তিলে আইসে যায়’। উচাটন মন, নিশ্বাস সঘন। কানে ভেসে আসে গান।
প্রকৃতি চণ্ডালিকা চমকে চায়। ওর চেনা সেই কুয়োতলার গণ্ডি ছাড়িয়ে পথের পাশে দাঁড়ায়
চুপটি করে। চেয়ে দ্যাখে একদল ফুলওয়ালি নববসন্তের ডালি সাজিয়ে দ্বারে দ্বারে ফিরছে
আর গাইছে-
বনমাধুরী করিবি চুরি
আপন নবীন মাধুরীতে
সোহিনী রাগিনী জাগাবে যে তোদের
দেহের বীণার তারে তারে
আয় আয় আয়।।
আজন্ম অস্পৃশ্য
চণ্ডালিকা বন্ধুহীনা। ফুলপসারিনীদের এমন সুরেলা আহ্বানে ওর মুহূর্তে মনে হল এতদিনে
বুঝি ভগবান একদল সখিকে পাঠিয়েছেন তার জন্য। আর সে বন্ধুহীনা নয়। কিন্তু না, ক্ষণিকের ফোটা ফুলের মতোই ঝরে
পড়ল চণ্ডালিকার ভুল। ফুল চাইতেই ঘৃণা জুটল কপালে। ফুল ছোঁবার অধিকারও তার নেই।
কিন্তু কেন কে জানে, মন বলছে, তার ফুলের আজ বড়ো প্রয়োজন। কিছু নিবেদন আছে তার।
কাকে? ‘কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি, শ্যামচন্দ্র নাহি রে’। একে একে দইওয়ালা, চুড়িওয়ালা সকলের কাছ থেকেই
প্রত্যাখ্যাত হল চণ্ডালিনীর ঝি। এটাই কি ওর প্রাপ্য ছিল? এর জন্যেই কি সে প্রতিদিন
দেবতার পায়ে ফুল দেয়? পূজাদীপ জ্বালে মন্দিরদ্বারে? কেন দেবে ফুল? যে তাকে
সারাজীবন রেখে দিল অপমানের ধিক্কারে! কেবল নিচু জাতের দোহাই দিয়ে এ জগতের সকল কিছু
ভালোর থেকে সে বঞ্চিতা। তাকে মানতে হবে সে শুধুমাত্র এক চণ্ডালিনী রমণী। কোনও
চণ্ডালেরই সেবায় লাগতে পারে সে। তা ভিন্নে নয়।
শ্যাম রে, নিপট কঠিন মন তোর!
বিরহ সাথি করি দুঃখিনী রাধা
রজনী করত হি ভোর।
চণ্ডালিকার মতো
রাধিকাও নিযুক্ত ছিল তার স্বামী আইহনের সেবায়। সঙ্গে সমগ্র শ্বশুরকুলেরও একমাত্র
সেবাইত সে-ই। জগতের আর কোনও আকর্ষণেই তাকে মন দিতে নেই। তবুও শ্যামের জন্য অনন্ত
আকুল প্রতীক্ষা ঘোচেনি তার। যৌবনজ্বালার উর্ধ্বে উঠেছিল হৃদয়জ্বালা। মুক্তি চাইছিল
চণ্ডালিকা, মুক্তি খুঁজছিল রাধা...অন্তরে অন্তরে। এমন সময়...
২
যো সন্নিসিন্নো বরবোধিমূলে
মারসম্ সেনং মহতিং বিজেত্বা...
পথ বেয়ে চলে গেল
বৌদ্ধভিক্ষুগণ, চণ্ডালিকার জীবনে। ওদিকে যমুনার তীরে কদম্বতরুমূলে বাঁশি উঠল বেজে।
‘শুন সখি বাজই বাঁশি... শশীকর বিহ্বল নিখিল শূন্যতল এক হরষ রসরাশি’। আরও চঞ্চলতায় ব্যাকুল হয়ে উঠল দুটি দিকের দুটি হৃদয়।
একমনে কী যেন ভাবছে
প্রকৃতি। পথ বেয়ে বাতাসের মতো বয়ে যাওয়া বৌদ্ধমন্ত্রের সুর বেলা বাড়ার খবরটুকুও
পৌঁছোতে দেয়নি প্রকৃতির প্রাণে। রাজবাড়ির ঘণ্টা বেজে গেছে ঢং ঢং করে। তীক্ষ্ণ রোদে
শুকনো উঠোন পিপাসায় হা হা করছে।
বিরহ বিষে দহি বহি গেল রয়নী, নহি নহি আওল কালা
রাধিকার এই
অভিব্যাক্তির ছায়াতেই খুঁজে পাই চণ্ডালিকা বা প্রকৃতিকে। সেও বলছে, ‘আঁধার অঙ্গনে
প্রদীপ জ্বালিনি, দগ্ধ কাননে আমি যে মালিনী,/ শূন্য হাতে আমি কাঙালিনী করি
নিশিদিনযাপনা’।
প্রকৃতির মা মায়া তাড়া দিয়েও মেয়েকে কোনও কাজ করাতে পারে না। বিরক্ত হয়ে চলে যায়।
চণ্ডালিকাও ভীষণ আলস্যে ছলছল চোখে ওর চেনা কুয়োতলাতে স্নান করাতে থাকে মা মরা
বাছুরটিকে।
হঠাৎ এক সুর।
অনেকটা করুণ বাঁশির মন ভাসানিয়া ডাকের মতো। ‘জল দাও আমায় জল দাও। তাপিত পিপাসিত
আমায় জল দাও’।
কৃষ্ণও পিপাসার্ত ছিল রাধিকার তৃষ্ণায়। তাই সে বাঁশির সুরে রাধাকে রোজ ডাক পাঠাত।
রাধিকা ভয় পেয়েছিল শ্বশুরঘরে নিন্দা হবে বলে। সে যে একজনের অর্ধাঙ্গিনী,
সহধর্মিণী। সমাজ তাকে একপুরুষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রকৃতিও ভয় পেল। সেও যে চণ্ডালকন্যা। তাপিত শ্রান্ত বুদ্ধশিষ্য
আনন্দকে একপুট জলদানের পুণ্য থেকে সমাজ যে তাকে বঞ্চিত করে রেখেছে। ঠেলে দিয়েছে
অন্ধকারের আড়ালে। ‘ক্ষমা করো প্রভু’, ‘মোর কূপের বারি অশুচি’।
হলেই বা! স্বয়ং কৃষ্ণ দেবতার অবতার হয়েও রাধিকাকে
বুঝিয়েছিলেন, প্রেমে কোনও পাপ নেই। প্রেম সর্বদা নির্মল সুন্দর। প্রেমিকের আহ্বানে
প্রেমিকার সাড়া দেওয়া সর্বোপরি প্রেমের আহ্বানে সাড়া দেওয়া, সে তো পরোক্ষে
প্রেমেরই পুজো করা। রাধিকা তখন আর কেবলমাত্র রাধা নয়, সে এক মানবী। যার মন আছে,
প্রাণ আছে, ইচ্ছে আছে। সমাজ কেন? ব্রহ্মাণ্ডের কোনও নিষেধাজ্ঞাই মানুষের মনের ওপর
চলে না। মান আর হুঁশ নিয়েই মানুষ। সে সমাজবদ্ধ হতে পারে, তা বলে সমাজের সম্পত্তি নয়।
চণ্ডালিকাকে বলা আনন্দের কথাতেও এই মতেরই আভাস মেলে, ‘যে মানব আমি সেই মানব তুমি, কন্যা’। শুধু এই একটি কথাই সকল জীবনের সার। দুই
নারীই মেনেছিল সেই বচন। একটা কথাই চণ্ডালিকার অন্তরমহলের অস্পৃশ্য পর্দাটিকে
মুহূর্তে টেনে ছিঁড়ে ফেলে। জন্ম নেয় এক মানবী প্রকৃতি। উত্তরণ ঘটে তার। আনন্দকে
জলদান করে পরমমুক্তির লগ্নে গেয়ে ওঠে - ‘এ নতুন জন্ম নতুন জন্ম নতুন জন্ম আমার’। তরঙ্গ নেচেছিল হৃদয়ে, মনে, শরীরে। প্রকৃতির
অভিসার শুরু হয়েছিল সেই মুহূর্তে, চুপিসারে। আশঙ্কায় চণ্ডালিকার মায়ের বুক কেঁপে
উঠেছিল। বারংবার বলেছিল, ‘বেছে নিস মনের মতো বর- রয়েছে তো অনেক আপনজন। আকাশের
চাঁদের পানে হাত বাড়াস নে’। তবু কন্যা তার সে কথা শোনে না। যে ফুল তার কানন আলো করে
গেছে, যে তার চক্ষের তৃষ্ণা, বক্ষের পিপাসা সেই দীপ্ত সমুজ্জ্বল শুভ্র সুনির্মল,
সুদূর স্বর্গের আলোকে তার চাই-ই। মনমোহনের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে এমনি দশা হয়েছিল
বৃন্দাবিপিনের শ্রীমতীরও।
হেন রূপ কবহুঁ না দেখি।
যে অঙ্গে নয়ন থুই সেই অঙ্গ হৈতে
মুঞি
ফিরাইয়ে লইতে নারি আঁখি।।
অনুরাগিনী প্রকৃতি ঠিক
এমনই। শুধু তার চরিত্রে যোগ হয়েছিল প্রকৃত মানুষের সম্মান পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
সেই আকাঙ্খার হাত ধরেই প্রেম এসেছিল তার জীবনে নিঃশব্দ চরণে। পূর্বরাগ, অনুরাগ
তারপর অভিসার। ভানুঠাকুরের রাধা বলছে--
একলি যাওব তুঝ অভিসারে
তুঁহুঁ মম প্রিয়তম, কি ফল বিচারে-
ভয়বাধা সব অভয় মুরতি ধরি
পন্থ দেখায়ব মোর।
৩
রবিঠাকুরের চণ্ডালিকা
বা প্রকৃতির কথায়—
আমি ভয় করিনে মা, ভয় করিনে।।
প্রেম নির্ভয়। রাধা আর
চণ্ডালিকার অভিসারে যেন তারই প্রমাণ। একজনের সামনে ভয় দাড়িয়েছে অভয় মূর্তি ধরে।
‘মন্দির বাহির কঠিন কপাট’ ঠেলে সে একাই যেতে পারে মানস-সুরধুনীর ওপারে। আর অন্যজন
ভয়কে জয় করেছে আনন্দকে পেতে। কিন্তু কথা হল, রাধার অভিসারের কথা আমরা সকলেই জানি।
বলা ভালো, দেখতে পাই। কিন্তু প্রকৃতিতো অভিসারে যায়নি। সত্যি কি তাই?
অভিসারের অর্থ, প্রিয়মিলনের উদ্দেশ্যে সংকেতস্থানে গমন। পদাবলীতে আমরা স্পষ্ট
দেখতে পাই রাধা অভিসারিকার সাজে ঝড়-বাদল তুচ্ছ করে ঘন আঁধিয়ারে পথ চলেছে। আর প্রকৃতি...আনন্দকে পাওয়ার জন্য সমাজের
সকল বন্ধনকে তুচ্ছ করেছে (রাধিকার ঝড়-বাদলকে তুচ্ছ করার সাথে তুলনীয়) বলেছে, ‘
শ্রাবণের কালো যে মেঘ তারে যদি নাম দাও চণ্ডাল/ তা ব’লে কী জাত ঘুচিবে তার, অশুচি হবে কী তার জল’। অথবা ‘ রাজার বংশে দাসী জন্মায় অসংখ্য, আমি
সে দাসী নই। দ্বিজের বংশে চণ্ডাল কত আছে, আমি নই চণ্ডালী।।’ রাধা বলছে, ‘ঘর কৈলুঁ বাহির, বাহির কৈলুঁ ঘর। পর
কৈলুঁ আপন, আপন কৈলুঁ পর।।’ একজন নিজেকে খুঁজে পেয়েছে বৌদ্ধভিক্ষু
আনন্দের স্পর্শে। আর অন্যজন পরমাত্মা কৃষ্ণের সুরস্পর্শে মূর্ছিত ও প্রণয়াসক্ত হয়ে
আপনজন, ঘর সব ত্যাগ করেছে। দুজনেই উপেক্ষা করেছে আজন্ম লালিত হওয়া পরিচয়ের। খুঁজে
নিয়েছে আপন আপন পরিচয়। এক মানবীর পূর্ণ অধিকারে।
তবু আপাত দেখায় চণ্ডালিকার জীবনে রাধিকার মতো ঝড়ের রাত
আসেনি। বিপদসংকুল কণ্টকাকীর্ণ মেঘমন্দ্রিত পথ অতিক্রম করতে হয়নি। কিন্তু গভীরে
দেখলে এ সকল কিছুই ধরা পরে প্রকৃতি মানে চণ্ডালিকার জীবনে। স্বয়ং আনন্দই অশুচির
দ্বারে পৌঁছে দিয়েছে ঝড়ের বার্তা। যার প্রবল দাপটে প্রকৃতির জীবন থেকে খসে গেছে
নকল পরিচয়ের মুখোশ। তীব্র বাসনায় মা মায়াকে কালনাগিনীর মন্ত্র পড়তে বাধ্য করেছে
প্রকৃতি। কারণ মনে মনে আনন্দের অভিসারী হয়েছে প্রকৃতি। প্রিয়মিলনের উদ্দেশ্যেই
মায়াদর্পণে দেখতে চেয়েছে প্রিয়তম আনন্দের দিব্যমূরতি। একটা মানুষ যখন ঘর ছেড়ে
হেঁটে চলে যায়, তখন আমরা তার চলে
যাওয়াটা দেখতে পাই। কিন্তু যে মানুষটা ঘরের কোণে আনমনে বসে থাকে বা কোনও একটা
মানুষের প্রতীক্ষার বেদনা ভুলতে নিজগৃহকাজে মন সঁপে দেয়, ডাকলে সহজে সাড়া মেলে না,
তার মনও যে হারায় লোকচক্ষুর আড়ালে শতেক যোজন দূরে। সেও এক যাওয়া। শরীরের গণ্ডী
ছাড়িয়ে মনপবনের নাওয়ে ভেসে প্রিয়মিলনের উদ্দেশ্যে সংকেতস্থানে গমন। সেখানে
শরীর নয়, ঘটে মনের অভিসার।
চণ্ডালিকা তার কাজে, চঞ্চলতায়, আকুতিতে, হাহাকারে সেই পথেরই আভিসারিকা। পার্থক্য
শুধু একটাই। রাধা জানত তার কৃষ্ণের মানস-সুরধুনির খোঁজ, তাই সে নিজেই ছুটে গিয়েছিল রমণীমোহনের
কাছে। কিন্তু আনন্দ যে বৌদ্ধভিক্ষু। কোন পথে তার চলা তা কেউ জানে না। তাই
চণ্ডালিকা মন্ত্রবলে টেনে এনেছিল আনন্দকে তার নিজের কাছে। মোদ্দাকথা সেই ভালোবাসা।
সে পথও খুব সহজ নয়। ‘ কী ভয়ংকর দুঃখের ঘূর্ণিঝঞ্ঝা— মহান বনস্পতি ধূলায় কি লুটাবে,
ভাঙবে কি অভ্রভেদী তার গৌরব’। মায়ামন্ত্রবলে আনন্দ যন্ত্রণাদীর্ণ। দর্পণে ফুটে ওঠে আনন্দর
সেই বেদনার্ত পাংশু প্রতিমূর্তি। সহ্য করতে পারে না চণ্ডালকন্যা। আনন্দের যন্ত্রণা
যেন আরও দ্বিগুণ হয়ে তাকেই বেত্রাঘাত করছে। ‘আমি দেখব না, আমি দেখব না, আমি দেখব
না তোর দর্পণ’। এও যে এক ঝড়। বাইরের ঝড় আর অন্তরের ঝড় দুই দুরকম। কিন্তু কষ্টের সত্ত্বাটি যে
একই। যে দুঃখ সইছে যে দুঃখ দিচ্ছে দুজনেরই বুক ফাটে। তাইতো প্রকৃতি বলে, ‘ বুক
ফেটে যায়, যায় গো, বুক ফেটে যায়।’
বাকি রইল বিপদসংকুল
কণ্টকাকীর্ণ মেঘমন্দ্রিত পথ। আখ্যানে দেখতে পাই, মা মায়া প্রকৃতিকে বলছে, ‘বল
দেখি, বাছা, কী তুই দেখছিস আয়নায়।।’ উত্তরে প্রকৃতি বলছে –
ঘন কালো মেঘ তাঁর
পিছনে
চারিদিকে বিদ্যুৎ চমকে,
অঙ্গ ঘিরে ঘিরে তাঁর অগ্নির আবেষ্টন—
যেন শিবের ক্রোধানলদীপ্তি!
এই পথ আনন্দ পেরোলেও
মনে মনে ঠিক এমনই প্রলয়ংকর মরু পেরোচ্ছে প্রকৃতি। তাই সেও
এই একই কষ্টে জর্জরিত।
আনন্দকে সেই সর্বনাশের মধ্যে দেখে তারও বুক কাঁপছে। শিউরে উঠছে তাঁর সর্বাঙ্গ। তাই
কিছুটা ক্রুরবাক্যেই মাকে সে বিঁধছে—
তোর মন্ত্রবাণী ধরি কালীনাগিনীমূর্তি
গর্জিছে বিষনিশ্বাসে,
কলুষিত করে তাঁর পুণ্যশিখা।।
৪
তবু প্রকৃতির নিষ্ঠুর
পণ। হার সে কিছুতেই মানবে না। অলক্ষে সে ভয় পায়, পাছে আনন্দকে চিরতরে সে হারিয়ে ফেলে।
পরক্ষণেই তাই মাকে বলে—‘দুর্বল হোস নে, হোস নে। এইবার পড় তোর শেষনাগমন্ত্র-
নাগপাশবন্ধনমন্ত্র।।’ রাধাও হাতের কঙ্কণ পণ রেখে নাগবশীকরণ মন্ত্র শিখেছিল, ‘ কর
কঙ্কণ পণ ফণীমুখবন্ধন শিখই ভূজগগুরু পাশে’। রাধা নাগমন্ত্র শিখে প্রিয়তমের কাছে গিয়েছিল, চণ্ডালিকা
নাগমন্ত্রের বলে আনন্দকে নিজের কাছে টেনে এনেছিল।
হিয়ে হিয়ে অব রাখত মাধব সো দিন আসব
সখি রে—
আনন্দ এসেছে। ‘আহা, কী
ম্লান, কী ক্লান্ত- আত্মপরাভব কী গভীর’। এত যন্ত্রণা, এত কষ্ট, এত ঝড়ের পরে এবার দর্শন, মিলন।
প্রভু, এসেছ উদ্ধারিতে আমায়,
দিলে তার এত মূল্য,
নিলে তার
এত দুঃখ।
ক্ষমা করো, ক্ষমা করো—
প্রকৃতির রাধা-হৃদয়
অনুতাপে, আনন্দে, ভালোবাসায়, মিলনে অবনত। আরেক জীবাত্মা খুঁজে পেল তার পরমাত্মাকে।
পদাবলির রাধা ঝড়ের রাতে সেই যে ঘর ছেড়েছিল পরমাত্মা কৃষ্ণের জন্য, তারপর পৌঁছোতে
কি পেরেছিল? হয়েছিল কি মিলন? সে উত্তর দৈবের মতোই ধোঁয়াশা, মূর্তির মতোই কাল্পনিক,
ভক্তের মতোই আস্তিক। ভানুঠাকুর তার অস্পৃশ্য নায়িকাকে হতাশার ধোঁয়াশায় রাখেননি।
নিচ হয়েও উচ্চকে টেনে নামিয়ে আনার ক্ষমতা দিয়েছেন। প্রমাণ করিয়েছেন, ‘তাই তোমার
আনন্দ আমার ’পর/ তুমি তাই এসেছ নীচে/ আমায় নইলে ত্রিভূবনেশ্বর/ তোমার প্রেম হত যে
মিছে’। অবশ্য তার জন্য প্রকৃতি চণ্ডালিকা ক্ষমাপ্রার্থিনী ছিল। বলেছিল, ‘ ধূলি হতে
তুলি নাও আমায় তব পূণ্যলোকে।’ এইখানেই প্রকৃতি কোনও কবির ভাবাবেগে সৃষ্ট বঞ্চিতা
নায়িকা বা দয়িতের দয়িতা নয়, সে এক সাধারণ নারী। যার চাওয়া আছে, প্রার্থনা আছে আবার
মান-হুঁশের মিশ্রনে মাথা নোয়ানোর ক্ষমতাও আছে। সে তার সমগ্র জীবন দিয়ে দেবী নয়,
মানবী হতে চায়। রাধিকা যেমন ছিল। সেও মানবী সত্তার জোরেই বারবার কৃষ্ণের বংশিধ্বনি
শুনে নিলাজ যামিনীতে লাজহারা হয়ে ঘর ছেড়েছে। প্রকৃতিও লজ্জা ভুলে মাকে প্রতিনিয়ত
অনুরোধ করেছে মন্ত্রবলে তার মনের মানুষটিকে এনে দেওয়ার জন্য। প্রেম নির্লজ্জ।
প্রেম রাঙা পলাশের মতো নরম পাপড়ির আদরে ঢেকে রাখে সদ্য ফোটা ভালোবাসার কুসুমটিকে।
রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের দুটো সত্ত্বা। প্রকৃতি, অর্থাৎ চণ্ডালিকার হৃদয়ে রাধা বসেছিল। আনন্দ ছিল সেই রাধারই কৃষ্ণ। কৃষ্ণ ছিল কালো, রাধা গৌরবর্ণা। কিন্তু আনন্দ ছিল দীপ্ত সমুজ্জ্বল স্বর্গের গৌর আলো। আর চণ্ডালিকা কৃষ্ণবর্ণা। পদাবলিতে আলো ছুটেছে কালোর অভিসারে। ভানুঠাকুরের আখ্যানে কালো সেজেছে আলোর অভিসারিকা হয়ে। যুগে যুগে কালে কালে পদকর্তারা প্রেমকে শিখণ্ডি করে আলো-আঁধারের এমনই লীলার ক্ষেত্র রচিত করে চলেছেন... তাঁদের দেওয়া নামেই আমরা প্রেমকে চিনি নতুন করে... দৃশ্যপট পালটায়, পরিবেশের পরিবর্তন ঘটে... পথ কিন্তু সেই একটাই... পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মিলন...