আমার বাবা রামানন্দ সেনগুপ্ত
নন্দিনী সেনগুপ্ত চক্রবর্তী
১৯১৬’র ৮ মে (২৫ বৈশাখ) ঢাকা শহরে বাবার জন্ম হয়। ছোটবেলা কেটেছিল মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই)। আমার ঠাকুরদা সতীশ চন্দ্র সেনগুপ্ত, ছিলেন রেলের ইঞ্জিনীয়র। তাই চাকরি সুত্রে তাকে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হত। ছোট বয়স থেকেই মাদ্রাজে থেকে বেড়ে ওঠার জন্য, স্বাভাবিক ভাবেই তামিল ও তেলেগু ভাষায় সাবলীল আমার বাবা, কিন্তু তার ছেলেবেলায় বাংলাতে কথা বলতে পারতেন না। ১৯২৬ সালে বাবাকে আমার ঠাকুরদা শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের শিশু বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেন। এই বিদ্যালয়েই উনি বাংলা শেখেন, এবং গুরুদেবের স্নেহচ্ছায়ায় প্রতিপালিত হতে থাকেন। শান্তিনিকেতনের প্রভাবে তার মনে যে শিল্প ও সংস্কৃতি বোধ জন্ম নিয়েছিল এবং ধীরে ধীরে তা সম্পূর্ণতা পেয়েছিল, সেই বোধই ছিল তাঁর পরবর্তী কালের অনন্য শিল্পচেতনার, পরিশীলিত রুচিবোধের অন্যতম ভিত্তি। গুরুদেব তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন নৃত্যনাট্য গীতিনাট্যের মহড়া দিতেন। অন্যান্য বিভাগের মত শিশু বিভাগের ছাত্রছাত্রীদেরও সেই মহড়া দেখার ও তাতে অংশ নেবার পূর্ণ অধিকার ছিল। এই মহড়া গুলিতেই বাবার মনে ভারতীয় ও বঙ্গ সংস্কৃতির এক সুদৃঢ় ভিত রচিত হয়েছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল গুরুদেবকে খুব কাছে থেকে দেখার এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। ১৯২৮ সালে আমাদের পরিবারে নেমে আসে এক বিরাট দুর্যোগ। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে আমার ঠাকুরদা‘র মৃত্যু হয়। এই বিপদ সামলাতে, আমার ঠাকুরমা তাঁর তিন ছেলেকে নিয়ে ফিরে যান নিজের ভিটে ঢাকা শহরে। এখানে উল্লেখ্য, বাবার বড় ভাই, আমার বড় জেঠু, ডঃ জে সি সেনগুপ্ত ছিলেন এক নামকরা শিক্ষাবিদ, যিনি পরবর্তী কালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন।
আমার বাবা রামানন্দ সেনগুপ্তের আজ ৯৭ বছর বয়স। আমার বাবা ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম বয়ঃজ্যেষ্ঠ এবং স্বনামধন্য আলোকচিত্রী বা সিনেম্যাটোগ্রাফার। প্রকৃত অর্থেই বাবা ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের একজন পথিকৃত। কারিগরী বহু বিষয় আছে যা নাকি বাবাই প্রথম এই শিল্পে শুরু করেছিলেন। এদেশে বাবাই প্রথম আলোকচিত্র শিল্পী যিনি ‘টেকনিকালার’ এ ছবি তুলেছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এ ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর পেছনে আছে এক ইতিহাস। বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি চিত্রকর অগুস্ত রেনোঁয়া’র সুপুত্র অসাধারণ চলচ্চিত্রকার জ্যাঁ রেনোঁয়া ১৯৪৯-৫০ সালে ভারতে আসেন, তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘দ্য রিভার’ পরিচালনা করবার জন্য লোকেশন দেখতে। সেই সময়ে তখনকার নবীন চলচ্চিত্র প্রেমিকদের কাছে এই আগমন ছিল এক বিশাল ব্যাপার। তাঁরা অনেকেই সে সময় জুটে যান রেনোঁয়া’র সাথে, এদেরই মধ্যে ছিলেন তরুণ সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত প্রমুখ বিখ্যাত ব্যাক্তিত্বরা। এদের মধ্যে ছিলেন তরুণ সুপুরষ যুবা রামানন্দ সেনগুপ্ত। বাবা তাঁর মিশুকে সপ্রতিভ স্বভাবের জন্য সহজেই রেনোঁয়া’র নজরে পড়ে যান। ১৯৩৮ সালে, বাবা ‘ফিল্ম করপোরেশন’ এ যোগ দেন, এবং তখন থেকেই ওনার ফিল্মের ক্যারিয়ারের শুরু। রেনোঁয়া আধুনিক প্রযুক্তির কাজ শিখতে উৎসাহী যুবক রামানন্দ কে ইংলন্ডে পাঠান ‘টেকনিকালার’ প্রযুক্তি শিখে আসার জন্য। বিলেতে গিয়ে ওই আধুনিক চলচ্চিত্র প্রযুক্তি আয়ত্ত করে বাবা যখন দেশে ফিরে এলেন তখন, রেনোঁয়া সাহেব তাঁর ‘দ্য রিভার’ শ্যুটিং শুরু করতে চলেছেন। বাবা ওই ছবিতে ‘অপারেটিভ ক্যামেরাম্যান’ হিসেবে কাজ করেন।
অর্ধেন্দু মুখার্জি পরিচালিত ‘পূর্বরাগ’ বাবার প্রথম বাংলা ছবি। এই ছবিতে বাবার সহকারি ছিলেন পরর্বতী কালের বিখ্যাত পরিচালক অসিত সেন। চলচ্চিত্র জগতের আজকের দিনের ও অতীতের বহু বিখ্যাত কারিগরদের হাতেখড়ি হয়েছিল বাবার কাছেই। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন দীনেন গুপ্ত ও সৌমেন্দ্যু রায়। আজ এদের পরিচয় আপনাদের কাছে আর আলাদা করে দেবার কিছুই নেই। স্বনামধন্য আলোকচিত্রী সৌমেন্দ্যু পরবর্তিকালে সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত হন এবং দীনেন গুপ্ত পরিচালক হিসেবে তাঁর পদচিহ্ন রেখে গেছেন বাংলা ছবির ইতিহাসে। নানা কারণে ‘পূর্বরাগ’ ছবিটি কিন্তু বাংলা ছবির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। রামানন্দ সেনগুপ্তের সাথে এই ছবিতে আরো কয়েকজন বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন চলচ্চিত্র জগতে, এদের মধ্যে ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, গীতিকার হিসেবে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও অভিনেতা হিসেবে জহর রায়।
আলোকচিত্র শিল্পী হিসেবে রামানন্দের ছবির সংখ্যা ৬৪। এদের মধ্যে তারপর নিশীথে, কান্না, শিল্পী, হেড মাস্টার, ডাক হরকরা, নাগরিক, কঙ্কাবতীর ঘাট, বোবা সানাই, তিন ভুবনের পারে, জয় মা তারা, হংস মিথুন, চারণ কবি মুকুন্দদাস, অভিশপ্ত চম্বল, রূপসী ইত্যাদি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা ছাড়াও, ওড়িয়া, অসমীয়া, ইতালিয় (ডকুমেন্টারি), ভাষার নানা ছবিতে, রামানন্দ তাঁর শিল্প সত্বার উজ্জ্বল সাক্ষর রেখেছেন। তাঁর তোলা ছবি গুলি বিশেষ ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এই অসামান্য আলোকচিত্রীর কাজের বৈশিষ্ঠ গুলো পরিস্কার হয়ে ওঠে। তাঁর কাজের ছিল এক নিজস্ব স্টাইল, যার অন্যতম মূল উপাদান ছিল ন্যাচারল লাইট, বা স্বাভাবিক আলো। এ ছাড়া ছবির বিভিন্ন দৃশ্যর মেজাজের সাথে খাপ খাইয়ে ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল, তাঁর ফ্রেম, আলোর বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার করে এবং প্রয়োজন মত তাকে পরিবর্তন করে ছবিতে এক অদ্ভুত ‘মুড’ সৃষ্ঠি করে রামানন্দ এক অনন্য চলচ্চিত্র ভাষার সৃষ্ঠি করতেন। নাটকীয় আলো-আধাঁরির রাতের দৃশ্যের লাইট করতে উনি সবচেয়ে ভালবাসতেন, এবং তাঁর তোলা ছবিগুলি দেখলেই বোঝা যায় এ বিষয়ে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা কোন মাত্রায় পৌঁছেছিল। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে রামানন্দ সেনগুপ্তের অবদান শুধু আলোকচিত্রী হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়। সামগ্রিক ভাবে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের যাতে উন্নতি সাধন হয়, যাতে আরো উন্নতমানের ছবি এখানে তৈরি হয়, সে বিষয়ে উনি সারা জীবন নিরলস ভাবে প্রয়াস চালিয়েছেন। এই লক্ষেই বাবা এবং তাঁর কিছু বন্ধুরা মিলে কলকাতার টলিগঞ্জে বিখ্যাত টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োটি স্থাপন করেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর বিখ্যাত ‘পথের পাঁচালী’ ছবির কিছু অংশ শ্যূট করেছিলেন এই স্টুডিয়ো তে। এই স্টুডিয়ো স্থাপনের জন্য, তাকে সুষ্ঠু ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য, বাবাকে নিরলস পরিশ্রম করতে হয়েছে এবং প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আজও যখন আমরা তাঁর সাথে কথা বলি, তখন বুঝতে পারি এই স্টুডিয়ো’র প্রতি এখনো তাঁর কি অপরিসীম ভালবাসা রয়ে গেছে।
ফিল্ম জগতের মানুষদের এক অন্য গ্ল্যামার হয়, সাধারণের চোখে স্বভাবিক ভাবেই তারা হয়ে ওঠেন এক অন্য জগতের মানুষ। তাই চলচ্চিত্রের সাথে জীবনভর জড়িয়ে থেকে রামানন্দ সেনগুপ্ত, আসল মানুষ হিসেবে কেমন, তাঁর কিছু কথা আপনাদের বলি। আমার বাবার যে দুটি গুণ আমাকে সবচেয়ে আকৃষ্ঠ করে, মুগ্ধ করে, তা হলো তাঁর রুচিবোধ ও জীবনযাত্রায়, পোশাকে, আচারে ব্যবহারে পরিমিতি বোধ। বরাবর মুগ্ধ হয়ে দেখেছি এক অসাধারণ সুপুরুষ চেহারার অধিকারী বাবার পোশাক নির্বাচন তাঁর যে অনন্য রুচির পরিচয় দিত, আজও ৯৭ বছরেও তা বর্তমান। আমাদের একটা কথা উনি সবসময় বলেন “এমন কোনও পোশাক পড়বে না, যাতে তুমি সামনে এলেই, তোমার আগে তোমার পোশাকটি চোখে পড়ে!”।
গুণী শিল্পী হিসেবে, একজন সৎ মানুষ হিসেবে, তাঁর নিজস্বতা বোধ, বিনীত স্বভাব ও নিয়মানুবর্তিতা’র জন্য ইন্ডাস্ট্রির সবার শ্রদ্ধার মানুষ, কাছের মানুষ, ‘রাম’দা’ তাঁর দীর্ঘ কর্ম জীবনে বরাবর সবারই অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ও সম্মান পেয়ে এসেছেন। কাজের মানের ব্যপারে, তার উৎকর্ষের ব্যপারে কোনদিনও কারোর সাথে আপোষ করেননি শিল্পী রামানন্দ। সে হিসেবে তিনি এক ‘পারফেকশনিস্ট’। আর তাঁর এই গুণের জন্যই বিখ্যাত নায়িকারা চাইতেন, তাঁদের প্রিয়, ‘রাম’দা’ যেন তাঁদের ছবির ক্যামেরাম্যান থাকেন। কারণ তারা জানতেন ক্যামেরায় রামানন্দ সেনগুপ্ত থাকলে, ছবিতে একেবারে নিখুঁত লাইট করে, তাঁদের চেহারার এক নিখুঁত রুপ ফুটিয়ে তুলবেন রামানন্দ, সেই সব নায়িকাদের করে তুলবেন আরো বেশী সুন্দর।
খুব রসিক মানুষ আমার বাবা। ঠিক সময়ে মজাদার রসাল মন্তব্যে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এব্যপারে ছবির জগতের অনেকের কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি। একদিন, এক শ্যূটিং এর অবসরে সবাই মিলে গেছেন এক রেস্তোঁরায় খেতে, অনেকের সাথে অভিনেত্রী অপর্ণা সেনও আছেন সেদিন। যেখানে খেতে গেছেন, সেখানেই পাশের টেবিলে এক বিদেশী পরিবার খেতে বসেছেন। তাঁদের সাথে একটি শিশুও আছে। কোনো কারণে বাচ্চাটি খুব কান্নাকাটি করছিল। সেই হট্টগোলে সবাই যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন বাবা’র সরেস মন্তব্য “ওরে বাবা, সাহেবের বাচ্চাও কাঁদে নাকি?” সেই শুনে সবার সাথে রিনা’দিও (অপর্ণা সেন) হেসে লুটোপুটি। পরে অনেক বার রিনা’দি বাবার কথা উঠলেই, হাসতে হাসতে সেদিনের সেই মজার কথা বলতেন। এরকম আরো কত টুকরো স্মৃতি, কত গল্প... সে সব বলতে গেলে আজ এই লেখা শেষই হবে না।
আমার মতে, একজন শিল্পী হিসেবে বাবার সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হল তাঁর আধুনিক-মনস্কতা। নূতন কে বরাবর বাবা স্বাগত জানিয়েছেন। এমন একটা মাধ্যমে বাবা কাজ করতেন, যেখানে প্রতিনিয়ত নানা নূতন কারিগরি প্রযুক্তি, নানা ধরণের ক্যামেরা, লাইট সব এসেছে, বাবা সব আগ্রহের সাথে শিখেছেন, জেনেছেন। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলে নিজেকে এবং চলচ্চিত্র শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। এই জন্যেই। কি চেহারায়, কি মনে, তিনি এক ‘চির যুবক’। তাঁর জীবন শুরু রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে, পরবর্তীকালে জ্যাঁ রেনোয়াঁ, সত্যজিৎ রায়, এবং আরো অনেক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বের সাহচর্য লাভ করেও, বাবা কিন্তু তাঁর কাজে, মননে জীবনযাত্রায় ভীষণ ‘অরিজিন্যাল’ নিজস্ব। এই নিজস্বতাই তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ। এখন ভারতীয় চলচ্চিত্রের শততম বর্ষে, ৯৭ বছরের আধুনিক যুবক, প্রবাদপ্রতিম আলোকচিত্রী রামানন্দ সেনগুপ্তের চলচ্চিত্র জগতে অনস্বীকার্য অবদানের কথা স্মরণ রেখেই, গত ১৬ তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন বাবাকে দিয়েই করানো হয়েছিল। সারা জীবনে তাঁর কাজের জন্য বহু সম্মান পুরস্কার বাবা পেয়েছেন, এর তাঁর সুনামের জন্য আজও পেয়ে আসছেন।
আমরা সবাই এই চিরনবীন যুবকের শততম জন্মদিনের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ। উনি সুস্থ থাকুন, ঈশ্বরের কাছে এই কামনা। চিলেকোঠার অনলাইন ম্যাগাজিনে পূজোসংখ্যা উপলক্ষে, এই ছোট্ট লেখাটি আমার বাবা’র প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং ভালবাসার উপহার।