সাঁঝবাতি...
দেবযানী বিশ্বাস
আজ আমার শেষ কর্মদিবস। কাল থেকে অন্য জীবন, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না সেটা কেমনতরো। সেই কুড়িতে চাকরীতে ঢুকেছি; নিত্য অভাবের সংসারে যা হয় আর কি। তারপর এ ঘাট, ও ঘাট ঘুরে এক জায়গায় থিতু হওয়া। ভাই বোনের পড়াশোনা- বিয়ে, বিধবা মায়ের পাশে থাকা, নিজের সংসার, সন্তান আর কত কি। অনাস্বাদিত জীবনকে একটু একটু করে দেখা- চেনা- জানা।
বিয়ে করলাম সাঁঝবাতিকে। দেখতে যাইনি তাকে, নাম শুনেই তাক্ লেগেছিল। কিন্তু মানুষটাকে যেদিন সম্পূর্ণ আমার করে পেলাম, সেদিন জানলাম ভারি সাধারণ আটপৌরে মেয়ে সে। একটু চুপচাপ, ধীর স্থির, তবে চোখের কোণে হাসি খেলে তার। ওই হাসি দেখেই কেটে গেল দীর্ঘ কত বছর। তবে আজ যখন আপিসের ব্যাগটাকে কাঁধে নিলাম, সাঁঝবাতির চোখের দৃষ্টিতে কান্না দেখলাম মনে হল।
অনেক কিছু ভেবে রেখেছি; নতুন জীবনে কি কি করব আর কি কি মোটেও করব না। বছর দুয়েক হল মেয়েটাকে পাত্রস্থ করেছি। সু ঘরে সু বরে সে আজ হাসিমুখে থাকে। ছেলেটাও চাকরী পেল সদ্য। এখন রোজনামচায় একটু দম ফেলার অবকাশ পায় সাঁঝবাতি; আমার ভালো লাগে। কোথায় ই বা গেছে সে এতোদিন, একটু প্রাণ ভরে শ্বাস নেবার জন্য? পুরী, দীঘা, ঘাটশিলা আর জামসেদপুরে দিদির বাড়ি ছাড়া কোথাও ওকে নিয়ে যাওয়া হয় নি। 'আজ যাব, কাল যাব' করে সংসারের জালে আটকে ফেলেছি কেবল। হাসিমুখে সে জালে জড়িয়ে সাঁঝবাতি পালন করে গিয়েছে প্রতিটি কর্তব্য। যতবার সে মেনে নিয়েছে সব কিছু হাসিমুখে, আমি কষ্ট পেয়েছি, অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছে হৃদয়। আজ ওকে একটু বয়স্কা দেখায়; একটু ভারি। মাঝে মাঝে পায়ের ব্যথায় কষ্ট পায়। তার সাধের দার্জিলং এ গিয়ে আজ তার কতটা সাধ পূর্ণ হবে জানি না, তবে আমার মন খানিক শান্ত হবে। তাই দুদিন আগেই টিকিট কেটে রেখেছি, আজ বাড়ি ফিরে এসে ওর হাতে দেব বলে।
আপিসে আজ কাজ ছিল না, একটু এ টেবিল ও টেবিল ঘোরা, সৌজন্য আলাপের পরে বিদায়ী সংবর্ধনা। মনটা ভারি হয়ে এলো; বাড়ি ফিরলাম; একা নয়, দুই প্রাক্তন সহকর্মী- বন্ধুর সাথে। আর কিছু টুকিটাকি জিনিস এলো তাদের ভালোবাসার স্মারক হয়ে। আজ মনটা কেমন যেন করছে; কিঞ্চিত অস্থির। ভীষণ ইচ্ছে করছে, জানো সাঁঝবাতি, তোমায় একটু নিরালায় পেতে। ইচ্ছে করছে একান্ত আলাপনে সময় কাটাই তোমার সাথে। মন চাইছে, তোমার ইচ্ছে ভোমরারা আমার বুকে আজ গুন্গুন ভালোবাসায় গান শোনাক। আমি প্রাণ ভরে শুনি সেই গান, গাইবে তো?
জানো সাঁঝবাতি, তোমার আমার স্বপ্নের রঙীন সুতোয় তাঁত বোনার চেষ্টা করেছি জীবন ভর। কখনো মাকু ধরতে পারি নি ঠিক করে, কখনো বা সুতোই গেছে ছিঁড়ে। পারি নি তৈরী করতে এমন কোন আচ্ছাদন যা তোমার ছোট্ট ছোট্ট বাসনাগুলোকে সযত্নে আবৃত করতে পারে। তাই আজ আমার ভরা হাত আর আধবুনোট স্বপ্নগুলোকে তোমার হাতে তুলে দেব; তুমি তোমার খেয়ালে তাকে সাজিয়ে তুলো।
আমি আজ বড় ক্লান্ত, সাঁঝবাতি। তোমার কোলে একটু মাথা রাখতে চাই, চাই তোমার কোমল উষ্ণতা। আজ যে আমার জীবনে সাঁঝ নেমে এলো, সত্যি সত্যি, তুমি সেই সাঁঝে বাতি হয়ে জ্বলো।।
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন