মূলধন
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
আমার হাতের মাসলগুলো কতটা শক্ত সমর্থ আর ফুলো সেটা হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আয়নায়
পরীক্ষা করছিলাম। পরীক্ষা করতে করতে আমার মুখে খুশির বন্যা বয়ে চলেছিল। আমার
সহকর্মীরা আমাকে বলে পুরুষ-শ্রেষ্ঠ। ওরা অবশ্য অত লেখাপড়া জানে না তাই বলে,
মরদ-কা-বাচ্চা। আর যেগুলো বলে সেগুলো নাকি সভ্য মানুষরা লেখার ভাষায় প্রকাশ করতে
পারে না। আমিও পারি না। কারণ আমি বলতে পারলেও লিখতে পারি না। কারণ শিক্ষাদীক্ষায়
আমিও আমার সহকর্মীদের সমান সমান।
কিন্তু ওদের ভাষায় আমি মরদ-কা-বাচ্চা। আমি অবশ্য কোন মায়ের দুধ খেয়েছি তা আমি
জানি না। জন্মে অব্দি কোনও মায়ের মুখ আমি দেখি নি। শুনেছি আমার নাকি জন্মেরই ঠিক
নেই তো মা কোথা থেকে থাকবে। আমি ডাস্টবিন থেকে তুলে আনা এক শিশু। আমার বাবা মানে
এখনকার রঘু নাকি এক চর্মকার ছিল। জুতোয় লোহার পেরেক ঠুকে ঠুকে ওর মনটা হয়ত লোহার
মত শক্ত আর পুরোন জুতোর মত ময়লা হয়ে গিয়ে থাকবে। তাই তার মুখ দিয়ে কোনও ভাল কথা আজ
অবধি কেউ শোনে নি। ঝট ঝট করে কতগুলো অক্ষর সাজিয়ে কি সুন্দর ভাবে গালাগালগুলো
বানাতো যে কি বলব।
ছোটলোকগুলো হাততালি দিয়ে সেগুলো উপভোগ করত আর বড়লোকগুলো বাড়ি গিয়ে তারিয়ে
তারিয়ে। আসলে আমার মনে হত ছোটলোক আর বড়লোকের মধ্যে একমাত্র বানানের তফাৎ ছাড়া আর
কোনও তফাৎ নেই। বড়লোকেরা পরদা ব্যবহার করতে ভালবাসে আর ছোটলোকেরা হাওদা। ছোটলোকেরা
হাওদার হাওয়ায় যা ভাসিয়ে দেয় সেগুলোকেই বড়লোকেরা পর্দার মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে উপভোগ
করে। জিনিসটা সেই উপভোগই যে যেমন ভাবে কর।
ডাস্টবিন থেকে একজন নাকি আমাকে নিয়ে সটকে পড়েছিল। তার কাছ থেকেই আবার আমার
বাবা আমায় কেনে। লাখ লাখ টাকায় নয়, মাত্র কয়েক শ’ টাকায়। আসলে
টাকা দিয়ে যে আলু-পটলের মত মানুষও কেনা যায়, তা বাবার মুখ থেকে আমাকে কেনার কাহিনী
জানার আগে আমিও জানতে পারতাম না।
বাবা আমার পরিচয় দিত তার ছেলে বলে। কিন্তু মা ছাড়া ছেলে কি করে হয় কেউ জানতে
চাইত না। কারণ বাবাকে সবাই খুব ভয় করত। একবার রেগে গিয়ে একজনকে খুনও করেছিল। কিন্তু
পুলিশ প্রমাণ করতে পারে নি বা চায় নি বা করে নি। যা হোক কিছু একটা।
ছেলেবেলায় বাবা একটা ছুরি আর একটা কলম আমার কাছে রেখেছিল। আমি খেলতে খেলতে
কলমটা হাতে তুলে নিতেই বাবা আমায় কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল। বড়বেলায় সে গল্প
আমায় বলেছিল। আমার মুখে একটা কৌতূহল ভাসতে দেখে হেসে বলেছিল,
ছেলেবেলায় মানুষ যা থাকে বড় হয়ে হয় তার ঠিক উল্টো। আমার খুব ভয় ছিল তুই না আবার
ছুরি তুলে বসিস।
তাই এখন আমি হাতে তুলে নিয়েছি একটা ধারাল ছুরি। ওটা এমন গোপন অথচ প্রকাশ্যে
থাকে যে শিবের বাবাও ওর অস্তিত্ব টের পায় না। তা না পেলেও দরকার হলে সাঁ করে ওতে
আমার হাত চলে যেত। কারোর গলা কাটা আমার বাঁ হাতের খেল। তাই কখনও ডান হাতটাকে
ব্যস্ত করার দরকারই হয় নি।
ছোটবেলায় আমাকে আধপেটা খাইয়ে রাখত বাবা। নিজে পুরো পেট খেত। আমার চোখের সামনে।
আমি খিদেতে কাঁদতে কাঁদতে তার খাবার কাড়তে যেতাম। বাবা আমায় মেরে বাড়ি থেকে বের
করে দেবার সময় বলত, যা কেড়ে খেগে যা। কেড়ে খাবার অনেক লোক আছে জগতে।
বাইরে বেরিয়ে প্রথম দুদিন আমি খাবার জোগাড় করতে পারি নি। তারপর আস্তে আস্তে
কেড়ে খেতে শিখলাম। তখন আমার বাবার কি আনন্দ। আমায় কোলে তুলে লুফতে লুফতে বলল,
বাপকা বেটা সিপাই কা ঘোড়া।
একদিন আবার কাঁদতে কাঁদতেই বাড়িতে ফিরে এলাম। বাবার চোখের কোঁচকানো ভুরুর দিকে
তাকিয়ে বললাম কেড়ে খেতে গিয়ে আমি কেমন মার খেয়েছি দেখো।
বাবা কিছু না বলে একটা ছুরি বাড়িয়ে ধরল আমার দিকে। তার ধার দেখে আমিই চমকে
উঠেছিলাম। কিন্তু তার থেকে বেশী চমকে উঠেছিলাম ভবিষ্যতে তার কেরামতি দেখে। এই
ছুরির দৌলতে আমি এখন বেশ নামকরা ছিনতাইবাজ। আমার নাম পরিচয় এমন কি ছবি সব পুলিশের
কাছে আছে। তবু ওরা আমায় ধরে না। বাবা যেন কি সব কায়দা করে রেখেছে। সে কায়দার কথা আমায়
বলে না অবশ্য। বলে, ওসব চিন্তা না করে কামকাজে মন দিতে।
কামকাজে আমি এমন মন দিয়েছি যে সম্প্রতি একটা প্রমোশন হয়েছে। মানুষ খুনের
ব্যাপারে আমার বেশ নামডাক হয়েছে। আমি একজন বিখ্যাত ছুরিশিল্পী হয়েছি। ঘোড়া বা দানা
কিছুরই খরচ হয় না। মাঝে মাঝে জটা কামারের কাছ থেকে শান দেবার জন্য কিছু ছোটখাটো
একটা টাকা ব্যাস।
কাকে সটকাতে হবে আর কাকে টপকাতে হবে বা কাকে শুধু চমকাতে বা সমঝাতে
হবে এসবের অর্ডার আসে বাবার কাছে। বাবা আবার আমাকে অর্ডারটা ফরোয়ার্ড করে দেয়। আর
আমি নিখুঁতভাবে কাজ করি। একদম নিখুঁত, একদম পরিপাটি।
ইতিমধ্যে আমি খেয়াল করেছি যে আমি যুবক হয়েছি। আমার শরীরে একটা পীড়ন জাগে
মাঝেমধ্যে। আমার বন্ধুরা বলে এজন্যেই নাকি লোকেরা বিয়ে করে। আমি বাবাকে একদিন
বলেছিলাম কথাটা। বাবা খুব একচোট হেসে নিয়ে এমন ভাষায় গালাগাল দিয়েছিল যেটা আমিও
উদ্ধার করতে পারি নি।
- বিয়ে? ও তো ভদ্দরলোকেরা করে রে। তুই আবার ভদ্দরলোক হলি কবে থেকে? তাছাড়া মাত্র
একটা মেয়েকে বিয়ে করে কি করবি বাপ? তুই
রেপ করবি - রেপ। রোজ একটা দুটো তিনতে যটা ইচ্ছে।
প্রথম রেপ করে আমার বেশ মজা লেগেছিল। একজন অসহায় মেয়ে আমার মত মরদ–কা-বাচ্চার
পায়ে ধরে তার ইজ্জত ভিক্ষে চাইছে এর থেকে সম্মানের আর কিছু হতে পারে? বাবা
গালাগালের ভাষায় আমাকে যেটা বলেছিল সেটা ভাল ভাষায় বললে দাঁড়ায়, বীরভোগ্যা
বসুন্ধরা। আমিও তো বীর– মরদ-কা-বাচ্চা! তবে এ পৃথিবীটা আমার মত ভোগ করার
অধিকার আমার কেন থাকবে না?
বাবার আরও কটা ছেলে ছিল। আমার মত বেশ কয়েকশ টাকা দিয়ে বাবা তাদের নিজের ছেলে
বানিয়েছিল। তাদের সঙ্গে নিয়ে আমি লেগে পড়েছিলাম এই মহৎ রেপ-উৎসবে।
প্রথম একটা দুটো কেসে ফেঁসে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবার কেরামতিতে সবাই আবার বেশ বহাল
তবিয়তে। একটা মিষ্টির দোকান চলছিল না। বাবা সেটা কম পয়সায় কিনে নিয়ে ছিল। ময়রা
রাখল আরও কমদামী। শেষে এমন হল যে রোজ কয়েকশ মাছি আর বোলতা ছাড়া খদ্দের পাওয়া
দুষ্কর।
তাহলেও সন্ধ্যেবেলা নাকি ভিড় বাড়তে লাগল। দুপুরে বোলতারা এলেও সন্ধ্যে বেলায়
মৌমাছিরা আসতে লাগল। একেবারে ঝাঁকে ঝাঁকে । প্রচুর লস্যি আর কোল্ড ড্রিংস বিক্রি হত।
কি জানি বাবা ওর মধ্যে কি যেন মশলাপাতি দিত তাই লোকের ভিড় লেগেই থাকত। বাবা মাঝে
মাঝে আমাকে বলত, ওরে ওটা একটা আই ওয়াশ।
মানে লোকের চোখে ধুলো দেওয়া।
বাবার দোকানের শো কেসে মিষ্টি সর্বদাই ভরতি থাকত।
কারণ মিষ্টি কেউ খেত না। পচা মিষ্টি কেই বা আর খায়। কিন্তু আলমারি ভরতি সাজানো
মিষ্টি দেখে লোকেরা দোকানটা খুব চালু দোকানের তখমা দিয়ে দিল।
বাবার বাড়িটা এখন বিশাল হয়েছে। সবাই বলে বাবা নাকি ব্যবসা করতে জানে। না হলে
সামান্য একটা মিষ্টির দোকান থেকে এত কিছু হয়?
এখন আমি জেলে বসে আছি। আমার সাতবছরের সশ্রম কারাদণ্ড নাকি তোমরা বল তাই
হয়েছে। অতসীকে আমি রেপ করতে পারি নি। বাবাই
এ অর্ডারটা পেয়ে আমাকে অর্ডারটা ফরোয়ার্ড করে দিয়েছিল। বিপিনবাবু বলে একজন
অর্ডারটা দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ব্যবসায়িক
শত্রু নৃপেনবাবুর ব্যবসাজীবনে ইতি টানার জন্যে তার মেয়ে অতসীকে রেপ করার সুপারি
দিয়েছিল।
বাবার অর্ডারে আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটা আমার পা ধরে কেঁদেছিল। বলেছিল, দাদা
হয়ে তুমি বোনের সর্বনাশ করবে?
আর তো কিছুই বলে নি ওই ক্লাস ইলেভেনে পড়া মেয়েটা? বিশ্বাস করুন আর একটিও বেশী
শব্দ সে খরচ করে নি। তবে হ্যাঁ, খরচ করেছিল সে তার চোখের জল। মেয়েদের চোখে এত জল
থাকতে পারে আমি তো প্রথম বিশ্বাসই করি নি। নিজের মাকেই জানি না তো অন্য মেয়েদের কথা কি করে
জানব বলুন?
কিন্তু সেই জল যখন আমার মত মরদ-কা-বাচ্চার মনের ওপর পড়ে তাকে ভিজিয়ে নরম করে দিল
তখন আমি নিজেই অবাক। ফ্যালফ্যাল করে খানিকক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে ভেবেছি
আমার মত একজনের মধ্যে ও ওর দাদাকে দেখতে পেল কি করে? আমার মত জন্মের ঠিক না থাকা
একটা ছেলে বোন বলেই আর কাকে জানবে?
এই আগাছা আর বুনো জন্তুভরা জঙ্গলে আমি কখনও মানুষ দেখিনি। দেখলেও হয়ত খানিকটা
স্বভাব-দোষে আর খানিকটা ভয়ে তাদের কামড়ে দিয়েছি। কিন্তু আজ এই প্রথম আমার মধ্যে
যেন আবিষ্কার করলাম গোটা একটা মানুষকে। রাখী পূর্ণিমার দিন দোকানে সার দিয়ে ঝুলতে থাকা
রাখীগুলোর মানে যেন এখন হঠাৎ আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। আমি মাথা নিচু করে ওর
জামাকাপড় পরিয়ে দিয়ে চলে এলাম।
বাবা তার ফেল করা মরদ-কা-বাচ্চাকে দেখে চোখ লাল করেছিল। তারপর আর কিছু বলেনি।
বলেছিল পুলিশ। কারণ বাবা নিজেই তার ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল। বাবা জানত যে
আইন কখনও নিজের হাতে নিতে নেই।
আমার নামে তো অনেক কেস ঝুলছিল। বাবার মায়ায় এতদিন সেগুলো ঝুলেই ছিল। এখন সেই
ঝুলন্ত কেসগুলোর বেশ কয়েকটা বাবার নির্দেশে নামিয়ে নিয়ে পুলিশ আমায় মালা করে পরিয়ে
দিল। মালাপরা সেই মরদ-কা-বাচ্চার করুণ মুখটা দেখে বাবার এমন তৃপ্তি হয়েছিল যে সে
সেটা কিছুতেই লুকোতে পারে নি।
থানায় নিয়ে আসার আগে আমার মহৎ বাবা নারকীয় গালাগালের ভাষায় যেটা বলেছিল সেটা
তোমাদের মত ভদ্দরলোকের ভাষায় বললে দাঁড়ায়, ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট। [ অপ্রকাশিত ও মৌলিক]
Arun Chattopadhyay
181/44 G.T.Road (Gantir Bagan)
P.O. Baidyabati Dist. Hooghly Pin 712222 Mob. 9339639108