থিম
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
ধড়মড় করে উঠে বসল শোভন। কালকের আনা সেই বড় বড় ব্যাগগুলো হাতে আর কাঁধে নিয়ে রজত বলল, চল। আর একবার হাই তুলে আড়ামোড়া ভেঙে শোভন বলল, এত সকালে?
পুজো কি পালিয়ে যাচ্ছে নাকি?
- আমাদের এখানে একটু সকাল সকাল পুজো হয়। নে চ’
- এ কি! কোথায় পুজো? চারিদিকে শুধু জল আর জল। তাছাড়া প্যান্ডেল? লোকের আনন্দ? আবালবৃদ্ধবনিতার চোখেমুখে সেই আনন্দের ঝিলিক? তুই আমার সঙ্গে মজা করছিস?
- আছে আছে,
সব আছে। রজত আশ্বস্ত করে বলল, আমাদের এখানে প্যান্ডেল হয় না। ঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় পুজোর আগে মা-ই হয়ত সব প্যান্ডেল নিজের হাতে ভেঙ্গে দেন। সবাইকে সমান করে দেন। মানুষ পশু দেবতা দানব সবাইকেই। অনেক জল পেরিয়ে একটু ডাঙা। এখানে অর্ধ উলঙ্গ মেয়ে পুরুষ বাচ্চার দল কিলবিল করছে। বুভুক্ষু মানুষের পাশে ঘুরছে কুকুর বেড়াল ছাগল গরু। চিল শকুনেরা মাঝে মাঝে আকাশে পাক খেয়ে যাচ্ছে।
অনেক দূরে একটা চড়ার মত জায়গা। বেশ কিছু লোক কাঠকুটো আর পাতা দিয়ে শুকনো অস্থায়ী ছাউনি বানিয়েছে। এক দঙ্গল মানুষের পোশাক এখন শুধুই কিছু ছেঁড়া প্যান্ট শার্ট অথবা ধুতি শাড়ি। মানুষ কুকুর গরু ছাগল সকলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। ব্যাগগুলো খুলল রজত। দুজন লোক এগিয়ে এল। রজতকে তারা প্রশ্ন করল, খিচুড়িটা তবে চাপিয়ে দিই রজতদা?
- দাও। কাঠকুটো কিছু পেয়েছ তো? নাকি সব গেছে জলের নিচেই?
- না দাদা। কিছু আমরা বলাইদার চালে মেলে রেখেছি। ভাগ্য ভাল এই দুদিন আর বিষ্টি হয়নি দাদা।
- ভাল। আমি বরং জামাকাপড়গুলো বিলি করে দিই।
রজতের ঢাউস ঢাউস ব্যাগ থেকে বেরোল চাল-ডাল-আলু-নুন। আর কিছু শুকনো জামাকাপড়। মনমরা শোভন একটু দূরে থেকে জল দেখে বেড়াচ্ছিল। খিচুড়ি হয়ে গেল। দূরে হাঁক দিয়ে সবাইকে ডেকে পাতায় পাতায় ধরিয়ে দেওয়া হল গরম গরম খিচুড়ি। যারা জল ঠেলে আসতে পারল না তাদের জল ঠেলে খাবার পৌঁছনোর ব্যবস্থা করে দিল এরাই। আর খাওয়ার শেষে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হল একটা করে ধুতি, শাড়ি, জামাপ্যান্ট বা ফ্রক।
সবাই চলে গেল। রজত আর শোভন দুজনে বসল সেখানে খিচুড়ি নিয়ে। এতক্ষণ খুব একটা কথা বলেনি শোভন। একটা প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। বলেই ফেলল কথাটা।
- তুই কি এখানে পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়াবি বলে...
হাসল রজত। আশপাশের জলসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, বল মা তারা দাঁড়াই কোথা? এই থই থই জলের মধ্যে আগে ওই লোকগুলো তো দাঁড়াক। আমার পুঁজিটুকু আমি সারা বছরের এই দিনগুলোর জন্যে জমিয়ে রাখি। আমার পুজো অ্যাডভান্সের টাকা এ ভাবেই গলে যায় ভাই। ওই নদীর পারের মাটির মতই। পুজোর মতই বন্যাও যে আমাদের জাতীয় উৎসবের মত বছরে একবার আসবেই ভাই। তোরা পুজোর জামাকাপড়, বেড়াতে যাওয়া এসবের জন্য বছর ভর টাকা জমাস প্ল্যান করে। আর আমরা কজন জমাই এই কটা দিন সামাল দেবার জন্যে। জানি এটুকুতে কিছুই হবে না। কিন্তু সারা বছরে কটা দিন অন্তত ওদের দুঃখের দিন কমাতে পারি এই ভেবে আনন্দ পাই।
শোভন কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। এই বন্ধুটাকে কাল রাত্রে পাগল ভেবে কি সাংঘাতিক ভয় না জানি পেয়েছিল। কিন্তু আজ দেখল ভয় নয়, সীমিত সামর্থ নিয়ে কতগুলো লোকের রীতিমত ভরসা রজত।
- আমাদের এই থিমের বাজেট লাখ নয় মাত্র কয়েক হাজার। অতিকষ্টে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে জোগাড় করি ভাই। আমাদের কোনও পতাকা নেই, প্রচারক বা প্রচারমাধ্যমও নেই। ভগবানের কাছে নিরন্তর প্রার্থনা কোথাও দাঁড়াতে নয়, অন্তত নিজের পায়ে যেন চিরকাল দাঁড়াতে পারি ভগবান।
শোভন চুপ করে ছিল। হঠাৎ রজত প্রশ্ন করল, আমাদের এই থিমের পুজো তোর কেমন লাগল শোভন? নিশ্চয় পছন্দ হয়নি? তা তোদের শহরের শিল্পীদের মত এখানে থিমটা অবশ্য করতে পারে না কেউ।
রজতের হাত জড়িয়ে ধরল শোভন, আমাকে আর লজ্জা দিসনি ভাই। এখানে এসে বুঝেছি প্রকৃতির থেকে বড় শিল্পী আর কেউ নেই। ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনও শিল্পেই তার জুড়ি একমাত্র সে নিজেই।
একটু থেমে খুব কুন্ঠার সঙ্গে বলল, পরের বছর থেকে আমাকেও কি এই থিম পুজোয় নিবি? সত্যি ভাই কতগুলো লোকের মুখে হাসি ফুটিয়ে যে এত আনন্দ হয় তা এখানে আসার আগে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
রজত শুধু মিটিমিটি হাসছিল। শোভন বলল, আমার মনে হয় হাজার নয় অন্তত লক্ষ টাকা বাজেট হওয়া উচিৎ ছিল এই থিমপুজোর। হো হো করে হেসে উঠল রজত। বলল, তাহলে লক্ষটা হয়ত ঘুরত অন্য পথে। পূরণ আর হত না।
...........সমাপ্ত...........
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন