তর্পণ
ইন্দিরা দাশ
সপ্তাহ শুরু হলেই তার নিজস্ব গতিবেগে দৌড় শুরু করে। বাসন্তি থাকায় শাশুড়িকে
নিয়ে আর অতটা দুশ্চিন্তা করতে হয় না রোহিণীর। পিপলুর গরমের ছুটি পড়ে গেছে।
হলিডে হোমওয়র্কের বোঝা থাকলেও দৈনন্দিন হোম ওয়র্কের থেকে আপাতত কিছুদিনের নিষ্কৃতি। কিংশুকের কাকার বাড়ি, চন্দননগরে বেড়াতে যাওয়া হবে এই শনিবার। কিংশুক একটা গাড়ি ভাড়া করেছে ড্রাইভার শুদ্ধু। মাও যাবেন সঙ্গে। কাকা-কাকিমা রাতটা ওখানে থেকে আসতে বলেছেন অনেক করে। শনিবার তাড়াতাড়িই একটা ছোট কিটব্যাগে অল্প জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়েছে রোহিণী। মায়ের ওষুধগুলো ছোট একটা প্যাকেটে গুছিয়ে হাজির করেছে বাসন্তি। আস্তে আস্তে, আমতা আমতা করে একবার কী যেন সে বলল, তাদের সঙ্গে সঙ্গে নিজের চন্দননগর যাওয়ার কথা, রাস্তায় মোহিনীবালাকে দেখাশোনা করার সুবিধা হতে পারে। তখনকার মত রোহিণী কিছু জবাব না দিলেও বলল যে কিংশুককে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে, সে রাজি হলে তবে জানাবে বাসন্তীকে। কিন্তু ফোনে কথাটা কিংশুককে বলতে সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। “কী বলছ কী তুমি, একটু হাত-পা ছড়িয়ে যাব বলেই তো অত টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করলাম। এক্সট্রা একটা মানুষ হাজির হলে ভালো লাগবে নাকি গাদাগাদি করে বেড়াতে যেতে! তাছাড়া কাকার বাড়িতে
গিয়ে এই অতিরিক্ত মানুষটার খাওয়া-শোয়ার ব্যাবস্থা করে দিতে বলাটা কি অন্যায় জুলুম হবে না? কাকিমা ঠিক ভেবে বসবেন নিজেদের বড়লোকিপানা দেখাতে এসেছে এরা”। বাসন্তিকে মানা করে দিল রোহিণী। শনিবার বিকেলে সবাই মিলেই বেরোলো ওরা ফ্ল্যাটে তালা চাবি মেরে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ হাত নাড়ছিল বাসন্তি। মুখখানা কেন যেন অজানা আশঙ্কায় খুব মলিন।
উইকএন্ড কাটিয়ে রোববার বাড়ি ফিরে এসেই এক গাদা কাজকর্ম সারতে হয়। জামাকাপড় সব কাচতে দিয়ে চটপট রাতের ভাতটা বসিয়ে দিলো রোহিণী। পৌঁছতে দেরি হয়ে গেছে, তাই তিন্নির মাও বোধ হয় এসে ফিরে গিয়েছে। কাল আবার সময়মত এলে হয়। ক্লান্ত শরীরে রাতে বিছানায় গা দিয়ে, ঘুমকে আর ঠেকিয়ে রাখা গেল না।
সোমবার সকালে সাদা শাড়ি-চন্দন টিপ আর এসে পৌঁছল না। ফোন এলো নার্সিং ব্যুরোর থেকে। মিস্টার দাশগুপ্ত জানালেন, চিন্তার কিছু নেই, দিন দুয়েকের মধ্যে আবার নতুন আয়ার ব্যাবস্থা করে দেবেন উনি। এবার হয়ত বাঙালি মেয়েই পাওয়া যাবে। রবিবার রাতে, কাউকে কিছু না বলে, হঠাৎই বাসন্তি ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিজের বাড়ি থেকে কেরালা চলে গিয়েছে। তার দিদি রাত আটটায় বাড়ি ফিরে কারণ জানতে চেষ্টা করে কারও থেকে সদুত্তর পায়নি। বাসন্তি প্রতিবেশীর কাছে
দিদিকে বলতে বলে গিয়েছে তার কেরল যাত্রার কথা, আর মুখবন্ধ খামে একটি চিঠি রেখে
গেছে শুধু তার মালকিন, অর্থাৎ রোহিণীর জন্য। বাসন্তির দিদির বর বলেছে সে গরমে কাহিল হয়ে বিয়ার খেয়ে ঘুমোচ্ছিল। সে জানে না কখন মেয়েটা বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে। মিস্টার দাশগুপ্ত বাসন্তির চিঠিখানা কোনও এক সময়ে রোহিণীকে নিয়ে যেতে বললেন।
অফিস ফেরতাই চিঠিটা তুলে নিল রোহিণী। সারা দিন কী এক অচেনা কারণে মন ভার হয়ে রয়েছে। দমচাপা গরম পড়েছে। তাই বোধ হয় আকাশের কোণে কালবোশেখির ঝিলিক দেখা দিচ্ছে। নার্সিং ব্যুরোর অফিসের বাইরের ছোট ঘরটাতে বসেই চিঠিটা খুলে ফেলল সে। একটু ভুলভাল ইংরিজিতে যে কথা লিখেছে বাসন্তি সে এক যন্ত্রণার কাহিনী। তার জামাইবাবুর তার শরীরটার ওপর নজর পড়েছিল শুরুর থেকেই। দিদির অনুপস্থিতিতে ছোট বাচ্চাদুটোকে এক ঘরে টিভি চালিয়ে খাবার দাবার দিয়েথুয়ে বন্ধ রেখে, মাঝেমাঝেই সে হামলা করত বাসন্তির ওপর। বহুকষ্টে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করত মেয়ে। কখনও সক্ষম হোত, কখনও আত্মসমর্পণ করতে হোত। বদনাম আর তাড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখাত লোকটা। বাসন্তির চোখে অসুস্থ স্বামী আর অসহায় ছেলেমেয়েগুলোর নিরুপায় মুখ তখন ছবি হয়ে ভাসে। প্রতি রবিবার পাশবিক
নির্যাতন চলত তার ওপর, প্রায় সারাদিন ধরেই সুযোগের ফাঁক ফোকরে থাবা পড়ত শরীরে। সুমালী দিদির তো বিশেষ ছুটিছাটা নেই, রবিবারও নয়। অথচ রবিবার সমস্ত দিন রাত আটটা অবধি রাস্তায় বেরিয়ে অজানা শহরে কোথায় সময় কাটাবে বাসন্তি? রোহিণী-কিংশুকের সুখের সংসারে সপ্তাহান্তের বিশ্রাম আর আনন্দের মাঝখানে তার জায়গা হয় না। গত রোববার জুলুমবাজিতে বাধা দেওয়ার সময় মুখে জোর থাপ্পড় মেরে দেওয়ালে মাথা ঠুকে দিয়েছিল তার। রোহিণী বোধ হয় হাঁটাচলার অসুবিধেটা দেখেও চূড়ান্ত অসম্মানের আর লজ্জার পরিস্থিতিটা আন্দাজ করতে পারেনি। এই রোববারও সারা দিন বিয়ার চড়িয়ে বাসন্তীর শরীর ঘাঁটাঘাঁটি করেছে লোকটা। দিদিকে জানালে বাসন্তির নিজের ওপরেই দোষটা পড়বে সে কথা বলে আবার মাঝেমাঝেই ধমক দিয়েছে। বাসন্তি নিজেও সে কথা আন্দাজ করতে পেরেছে। আশ্রয়দাত্রীকে আর কতই বা বিব্রত করবে সে। সন্ধের পর নেশার ঝোঁকে যখন পশুটা ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন ছোট ব্যাগখানা তাড়াতাড়ি গুছিয়ে একে তাকে জিজ্ঞেস করে হাওড়া স্টেশন রওনা দিয়েছে বাসন্তি। জমিয়ে রাখা সামান্য টাকা সম্বল করেই চোখ মুছতে মুছতে ট্রেন ধরতে ছুটেছে সে। চিঠিতে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে, যেটুকু সম্মান সে রোহিণীর সংসারে পেয়েছে তার জন্য।
বাড়ি ফিরে সেদিন কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলতে পারল না আর রোহিণী। দুদিন ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে থেকেছে সে। তৃতীয় দিন সকালে দরজার কলিং বেল বাজল। একটু ফ্যাকাশে,
রোগাটে মেয়েটা দরজায় দাঁড়িয়ে, হাতে নার্সিং ব্যুরোর কার্ড। ‘আমি মিনতি, দিদি। দাশগুপ্ত দাদাবাবু আমায় পাঠিয়েছে কাজের জন্য’। শাশুড়ি মায়ের কাজকর্মটুকু বোঝাতে শুরু করল রোহিণী। মোহিনীবালা শুরু শুরুতে চোখ ছোট করে একটু সন্দেহর চোখে দেখলেও বাঙালি মেয়েটাকে মেনে নিলেন তাড়াতাড়ি। এতদিনে আয়ার পরিচর্যায় তাঁর বয়স্ক শরীরও যে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কাজ বুঝে নিলো মিনতি চটপট। বাসন্তীর মত অতিরিক্ত কাজ খুঁজে খুঁজে না করলেও
এ মেয়েও মোটামুটি কর্মঠ। স্বামী তাকে ছেড়েছুড়ে অন্য মেয়েমানুষ খুঁজে নিয়েছে, তাই
ছোট নয় বছরের মেয়েটাকে নিয়ে সে ভাড়াতে থাকে, এন্টালির বস্তিতে। রোববারের
ছুটির কথা শুনে সে বেশ খুশি।
তবুও এক কান্ড ঘটলো। শুক্রবার সকালে যখন সে কাজে এলো, তখন তার মুখখানা ভীষণ কাঁচুমাচু। তার পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে কোঁকড়াচুলো একটা ছোট্ট মাথা। ছোট মেয়েটার পরনে আধময়লা একটা স্কুলের পোশাক।
‘বউদি,
আজ মাসের শুরু। হাতে কাজ ছিল না, তাই কুসুমের স্কুলের মাইনে দিতে পারিনি গত মাসে। স্কুল থেকে মেয়েটাকে বের করে দিলো গো আজ। কী করি বল, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।
বাড়িওয়ালা বুড়োটাকে দাদু দাদু বলে ডাকলেও ইস্কুল না থাকলে ওকে নিজের ঘরে ডেকে হাত-পা টেপায়,
বুকে হাত দেয়। ইস্কুলে থেকে ফিরলে তাই ওকে বলে রাখি খাওয়াটুকু সেরেই বেরিয়ে যেতে। পাশের বুটিকের বউদি একটু বসতে দেয়। ব্লাউজের হুক-বোতাম সেলাই করা, শাড়ির ফল্ লাগানো এইসব কাজ করতে পাঠাই। ঘুমে ঢুলে পড়লে সেদিনের পয়সাটা কাটা যায়। তবুও তো মেয়েটা কুমারীই থাকে। কিন্তু এই এখন যে কী করি ভেবে পাচ্ছি না’।
রোহিণীর এবার আর বেশি সময় লাগলো না। দরজার থেকে বাচ্চাটাকে হাত ধরে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে এলো সে। দুটো মুড়ি-বাদাম-বিস্কুট তার হাতে দিয়ে নিজের আলমারি থেকে নিয়ে এলো বাসন্তির জন্য রেখে দেওয়া মাইনেটা। ‘আপাতত এটা স্কুলে জমা দিয়ে কাল আবার ওর নাম লিখিয়ে আসবে মিনতি। আর চারটের সময় স্কুল শেষ হয়ে গেলে এ বাড়িতে চলে আসতে বলবে ওকে। দুটো ভাত রেখে যাব ওর জন্যে না হয়। ছ’টা,
সাড়ে-ছ’টায় তুমি যখন বাড়ি যাবে, তখনই বাড়ি যাবে ও। তার আগে নয়। কিন্তু বিকেলে যেন ঘুম থেকে উঠে পড়াশোনা করে’।
পা দুটো ভারী লাগছে কেন রোহিণীর! মাটিতে বসে পড়ে দু-হাত দিয়ে সে দুটো চেপে ধরেছে মিনতি। এই কদিন পর, পাথর হয়ে জমে থাকা কিছু চোখের জল আপনিই বয়ে গিয়ে বুক ভাসাচ্ছে রোহিণীর । ছোট মাথাটা তুলে একমনে দেখছে তাকে বাচ্চা মেয়েটা। দুটো নিরুপায় চোখ কোঁকড়া চুলে ঘেরা মুখটার থেকে প্রায় প্রভুভক্ত পোষা জীবের মত কৃতজ্ঞতায় তাকিয়ে আছে তার দিকে।
বারান্দায় সুন্দর ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। বৃষ্টি হবে আজ। বেলফুলের গন্ধ ভেসে আসছে টবের গাছগুলোর থেকে। কখনও তো কোনও কুঁড়ি ফুল হয়ে ফুটুক। কখনও তো কোনও ফুল আপন সৌন্দর্যের মহিমায়, আনন্দে বিরাজ করুক।
......সমাপ্ত
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন