ফিরে দেখা
গৌতম সেন
গৌতম সেন
হঠাৎই দেখা রিনি
ও অতীনের। প্রায় বছর তিরিশ-পয়ত্রিশেক হবে,
রিনি বিয়ে করে চলে এসেছে তার স্বামী বিশ্বদেবের
সাথে কলকাতায়,
আর অতীন দূর্গাপুর ছেড়ে চাকরি নিয়ে কোখায় যে চলে
গেছিল, সে খবর রিনি অনেক চেষ্টা করেও জোগাড় করতে পারে নি, বিয়ের পর বারকয়েক বাপের বাড়ি আসলেও।
অতীন আর রিনি কেবল একপাড়াতেই যে থাকত তা নয়, কলেজও ছিল এক। অতীন ছিল দু-বছরের সিনিয়র। অতীন রিনিকে পাড়ার আর
পাঁচটা পাড়ার মেয়ের মতই দেখত। কিন্তু রিনি একই কলেজে অ্যাডমিশন্ নেবার পর থেকে
অতীন তাকে যেন একটু অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছিল। এ ব্যাপারটা রিনির যে ভাল লাগত
না তা নয়, তবে সহজ হতে তার একটু সময় লেগেছিল।
একদিন কলেজে
কোনও একটা কারণে ছাত্র ধর্মঘট। সেদিনের মত সমস্ত ক্লাস বন্ধ। রিনি তার কয়েকজন
বন্ধুর সাথে আড্ডা মেরে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে, একটু দূরেই দেখে গাছতলায় অতীন গভীর মনোযোগ দিয়ে কি যেন লিখছে। রিনির
মনে কেমন যেন একটা শিহরণ লাগে... ভাবে অতীনদা একা একা বসে কি করছে। তবে
কি তার জন্যেই...
“হ্যাঁ, তোর জন্যই আমি এখানে বসে আছি। একটা কথা বলব বলে।” – রিনি কাছে আসতেই অতীন উঠে কথাগুলো বলে।
“কেন অতীনদা, কি কথা?”
– রিনির মনে একটু অন্যরকম ভাবনা নাড়া দেয়। সে ভাবে পাড়াতেই
তো তাকে যা বলার,
বলতে পারত।
“শোন আমি তোকে
নিয়ে একটা কবিতা লিখেছি আজ, শোনাব,” – কেমন যেন অদ্ভুত এক জোর মেশানো কথাগুলো, একটা গভীর আত্মবিশ্বাসের সুর। রিনি এ কথা অন্য কারো কাছ থেকে শুনলে
একটু গায়ে পড়া বলেই মনে হত তাকে। কিন্তুঅতীনদা তো সে ধাতুর লোক নয়। অতীনকে সে বলে
– “এখানেই শোনাবে, শোনাও।“
“তুই তো ছিলি, আমার পাড়ার মেয়ে / তেমন করে দেখিনি তো চেয়ে / আজকে কেন মনের অন্য কথা / তুই তবে কি ছোট্ট নেই আর নেয়ে?
“ইচ্ছে করে- বন্ধু হয়ে যাই/ যে বয়সে যেমনটা ঠিক সাজে /তোকে নিয়ে উধাও হতেচাই /নীরব কথার তেপান্তরের মাঝে।
“একটুখানি সময়
দিলাম তোকে /
নতুন ক’রে দেখনা আমায়
চেয়ে /যে যা বলে বলুক পাড়ার লোকে / এবার থেকে চলব
না হয় অন্য উজান বেয়ে।”
“খুব সুন্দর, খুউব!
এত সুন্দর লেখো তুমি!” - রিনি বলে ওঠে। মনের মধ্যে যা শুরু হল, এর বেশি কিছু কথা জোগাল না তার মুখে সেই মুহূর্তে।
অতীন একটা
প্রাণখোলা হাসি হেসে রিনির চোখে সরাসরি চোখ রেখে বলল –“যা তবে এখন,
তবে মনে রাখিস, তোকে কিন্তু একটুখানি সময় দিয়েছি।“ মুখে এক যুদ্ধজয়ের হাসি ফুটে উঠল। রিনি বাকি পথটা যেন হাওয়ায় উড়তে
উড়তে বাড়ি চলে এল। সে খালি ভাবতে থাকে এ কবিতাটা না শুনলে হয়ত সে অতীনদা কে কোনদিন
চিন্তাতেও আনত না। নতুন করে চিনতেও পারত না।
এরপর অতীনের
কবিতা, রিনির ভাললাগা, অতীনের অবিমিশ্র আবেগ সব মিলেমিশে যা
দাঁড়াল তা বলে না দিলেও বোঝা যায় এক খরস্রোতা ভালবাসা জন্ম নিয়েছিল দুজনের মাঝে।
অতীনের ভাল লেগেছিল রিনির চিরশান্ত স্বভাবের বুদ্ধিমত্তা আর রিনির মন কেড়েছিল
অতীনের শৈল্পীক মন। উদাস কিন্তু উদাসীন নয়, ভালবাসতে চায়
কিন্তু ভণিতাবিহীন সে ভালবাসা, এমন ই ছিল অতীনের ভাবগতিক। একদিন অতীন
রিনিকে নিয়ে গিয়েছিল দুরের শালবনে । কত
কবিতা, কত গান শুনিয়েছিল, রিনি মুগ্ধতায় কাটিয়ে দিয়েছিল সে
সময়টুকু, অথচ প্রেমের প্রাবল্য কোনমতেই রিনিকে কোনরকম অস্বস্তিতে ফেলে নি।
অতীনের বক্তব্য ছিল সে তার মনের ভালবাসাকে কোনও চটজলদি খেলা বলে বিশ্বাস করে না।
“তোমাকে
ভালবাসার কথা জানাবার জন্য আমার মনের কথারা সব উন্মুখ হয়ে আছে , আমার ভাবনায় যে শব্দরা ভিড় করে তার স্পর্শ অনেক গভীর, যদি নিতে পার। আমি তোমার খোলা চুলে খানিক হাত বুলিয়ে দেব, দেখবে সেখানেও আমার কবিতা কেমন খেলা করে যাবে।” রিনি ভাবে তার এতদিনের অতীনদা কিভাবে ক্রমেই তার মনের মানুষ অতীন হয়ে
উঠছে। মনের মাঝেএক অসম্ভব ভাললাগা ভালবাসার মিষ্টি সুর অহরহ শুনতে পায় সে। সারাটা দিন সে মশগুল থাকে এই উত্তরণের খুশিতে।
####
আজ আবার এত
দিনের ব্যবধানে,
বিধাতার কোন খেয়ালে দেখা হয়ে গেল দুজনার। বয়সের
ছাপ দুজনের মধ্যেই স্পষ্ট, তবে অতীনের মুখে শুধু বয়সের ছাপ ই নয়, রিনি লক্ষ্য করল কোথায় যেন এক অষ্ফুট নির্বাসন যন্ত্রনা ছড়িয়ে রয়েছে।
রিনির হাতে এখন কিছুটা বাড়তি সময়, সংসারে ছেলে মেয়ে তারা আর ছোট নেই, নিজেদের কাজে-কর্মে ব্যস্ত। বিশ্ব আজ তার কোম্পানীতে একজন ভীষণ ব্যস্ত বিগ সট্।
রিনি জানে সে এতদিন সংসারের খুঁটিনাটি সবদিকে নজর দিতে দিতে পরিবারের সবাই আজ তাদের
অভীষ্ট লক্ষ্যকে ছুঁয়ে ফেলেছে বা ছুঁতে চলেছে। এই অবসরটুকু তার নিজস্ব। সে নিজেকে
এক এন.জি.ও র সঙ্গে যুক্ত করেছে। তারা বরিষ্ঠ নাগরিকদের সুখ-সুবিধার দিকে নজর দেওয়া, প্রয়োজনে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো এই সব
কাজে ব্যস্ত থাকে। রিনির মনমত এ কাজ। নানান বৃদ্ধাশ্রম, হেল্পেজ হোম ঘুরে বেড়ায় সে এই দলের সঙ্গে।
সেদিন ছিল
শনিবার। রিনি গিয়েছিল বরানগরে ‘শান্তিনীড়’ বৃদ্ধাশ্রমে।আবাসিকদের সঙ্গে রোজকার মত প্রীতি বিনিময় চলছিল, হঠাৎ বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার একজন নতুন আবাসিকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে
দেবার সময় রিনি তার দিকে চেয়ে চমকে ওঠে। “অতীন তুমি এখানে?” – এতদিন পরে দেখেও রিনির একটুও ভুল
হয়নি। ম্যানেজার ভদ্রলোক খানিক বিস্ময়ের সুরে বললেন –“ম্যাডাম,
আপনি এনাকে চেনেন, উনি সপ্তাহখানেক হল এখানে এসেছেন।” রিনি অতীনের দিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই কেবল সম্মতিসুচক ঘাড় নাড়ল। অতীন
অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য ম্যানেজারকে বলল –“হ্যাঁ,
উনি আমার খুবই পরিচিত।”
অতীনকে আসছি
বলে অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে চলে গেল রিনি তাদের কাজে।
অতীন আবার কাগজখানা মুখের কাছে তুলে ধরল।
দলের কাজ সারা
হল। অন্যান্য মহিলা সহকর্মীরা ফিরে যেতে রিনি আবার এসে বসল অতীনের কাছে। অতীন
রিনির দিকে মুখ তুলে বলে – “কতদিন হ’ল তুমি এ সমাজসেবা শুরু করেছ? সংসার করেও সময়
পাও?”
- “পাই বলেই তো
করি। আমার কথা পরে শুনো,
আগে বল তুমি এখানে কেন? তোমার নিজের সংসার বলে কিছু নেই?”
-“হ্যাঁ, ছিল। সে এখন চুকেবুকে গেছে। ছেলেটা সাত-সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে তার নিজের সংসার, কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। তার মা মানে আমার স্ত্রী বেশ কয়েক বছর হল পাড়ি
দিয়েছে পরলোকে।”
- “ও তাই তুমি নিজেকে তুলে দিয়েছ এই বৃদ্ধাশ্রমের হাতে। ভালই হল তোমার সাথে যোগাযোগ হল আবার, আর আমি তো এখানে কাজে আসিই। এবার থেকে...”
- “ও তাই তুমি নিজেকে তুলে দিয়েছ এই বৃদ্ধাশ্রমের হাতে। ভালই হল তোমার সাথে যোগাযোগ হল আবার, আর আমি তো এখানে কাজে আসিই। এবার থেকে...”
“এবার থেকে কি?” – রিনিকে থামিয়ে দিয়ে অতীন বলে ওঠে, “এবার থেকে কি আমার দেখভাল করবে নাকি তুমি?” আবার সেই প্রাণখোলা হাসি। তবে দমকে খানিক কমজোরি।
####
এখন মাঝে মাঝেই
রিনি আসে শান্তিনীড়ে। কেবল এন.জি.ও –র কাজে নয়,
সে নিজেই আসে অতীনের কাছে। কত গল্প করে, কত পুরোনো স্মৃতিকে সামনে নিয়ে আসে। অতীনেরও সময় কেটে যায় এই স্মৃতিকথা
সাহচর্যে।
“দেখ আমাদের ঘর
বাঁধা হয়ে ওঠেনি,
তা নিয়ে আর পুরোনো কাসুন্দি আমি ঘাটতে চাই না। তবে মনে মনে
তোমাকে আগলে রেখেছিলাম আমি, বোধহয় ঠিক এমন এক বর্তমানের দেখা পাব
বলে।”– অতীন একদিন বলে রিনিকে।
“তোমার কথার
মায়াবী বুনোট এখনও তেমন ই আছে দেখছি। তা তোমার স্ত্রী মারা গেছেন, কতদিন হল?
ছেলের নাম কি?” - রিনির স্বাভাবিক একটা কৌতুহলের ছোঁয়া অতীনের কানে এসে পৌঁছায়।
“বছর দশেক হল সে
আমাদের ছেড়ে গেছে। অতনু আমার ছেলের নাম” –অতীন বেশ
উদাসীন ভাবে জবাব দেয়,
“তোমার দুটো প্রশ্নের উওর আমি দিলাম বটে, তবে আমি চাইব তোমার আমার সংসার নিয়ে আমরা আর কেউ কিছু জানতে চাইব না”।
-“তা কেন? আমারও তো সংসার আছে... আমার স্বামী, ছেলে-মেয়ে তাদের সম্বন্ধে আমি তোমায় বলব...”
-“ না রিনি আমাদের
এই পূনর্মিলন বলতে পার আবার এক সুন্দর সময়কে সামনে এনে দিয়েছে। এর ভিতর তোমার আমার
সংসার কাহিনী যদি ভিড় করে, তাহলে জানবে আমাদের নিজস্ব যে
অতীতটাকে অকালে হারিয়ে এসেছি, তা কিন্তু অতটা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান
নাও হতে পারে!”
-“বেশ, তোমার যদি ভাল না লাগে, আমি আর বলব না। এখন বল, কবিতা কি তুমি এখনও লেখ আগের মত?”
- “না তোমার আমার
বিয়ের পর, ওসব পাট চুকিয়ে দিয়েছি। মনে কোরো না যেন তাই বলে আমি ঘোর সংসারী হয়ে
কাটিয়ে দিয়েছি আমার সময়। তবে কবিতার ভাষা আর আমাকে তেমন উৎসাহিত করে নি, হয়ত উৎস হারিয়ে গিয়েছিল বলেই।”
অতীনের এই কথার
ইঙ্গিত বুঝতে রিনির এতটুকু অসুবিধা হল না। তবু সে বলে – “কেন তোমার ভালবাসা তো শুধু আমাকে ঘিরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তুমি তো জীবন কে ভালবেসে লিখেছিলে অনেক অনেক কবিতা! সে উৎস হারাল কেন তবে?”
অতীন এবার কোনও
প্রত্যুত্তর না করে শুধু বলে – “তোমার যদি সময় থাকে, তবে চল একটু বেড়িয়ে আসি। এখান থেকে গঙ্গা খুব কাছে।” রিনি ও অতীন বেড়িয়ে পড়ে সেখান থেকে।
গঙ্গার ঘাটে
বাঁধানো রাস্তাটায় তখন বিকাল ভ্রমনের ভিড়, তাকে ছাড়িয়ে
পশ্চিমকোনায় একটা ভাঙ্গা পাড়ের দিকে চলে এল তারা।তুলনামূলকভাবে বেশ ফাঁকা এ জায়গায় তাই
ঝালমুড়ি-আইসক্রীমের ফেরীওয়ালারাও এদিকে ভিড় করে না। সেখানে ভাঙ্গাচোরা ঘাটের ই
এককোনা বেছে নিয়ে বসল দুজনে।
রিনি যেন মনে
মনে পৌঁছে গেল তিরিশ বছর আগেকার জীবনে। গঙ্গার জল উথাল-পাথাল আর সে আওয়াজ তার মনের অতলে শুনতে পাচ্ছে যেন। সে নিজেও জানে না
এতদিন পরে অতীনকে সে কিভাবে নিজের পাশে পাবে! অতীন কিন্তু সে তুলনায় অনেক বেশি স্বাভাবিক। বাস্তব, অবাস্তব,
পরাবাস্তব এ সম্বন্ধে তার এক স্বচ্ছ ধারণাই তাকে
এমন সহজ করে রেখেছে এমন এক মনোরম মুহূর্তেও।
অতীন ই শুরু
করে –“দেখো ছেলেবেলায় কত ছেলেই তো মাঠে ফুটবল খেলে, তাদের মধ্যে বেশ কিছু থাকে, যারা সত্যিই ভাল খেলতে পারে। তেমন গান, আঁকা,
আরও কত কি পারে বাচ্চারা তাদের ছেলেবেলায়।
কিন্তু বাস্তবে তারা কজন বলোতাদের জীবনে বড় খেলোয়ার, বড় শিল্পী হয়েওঠে?“
-“এসব কেন বলছ, অতীন?
আমাদের ঐ অত সুন্দর ছন্দময় সম্পর্ক টা বাস্তবে
সম্ভব হল না বলে?”
-“ঠিক তাই। নাঃ
তুমি ঠিক আগের মতই বুদ্ধিমতী আছ দেখছি!”
-“সে হয়ত তোমার
সংস্পর্শে এসে আবার।”
-“না গো না, এ তোমার সহজাত ক্ষমতা। তবে প্রয়োগের অনভ্যাসে এরা সময়ে সময়ে ভোঁতা হয়ে
যায় বৈ কি!”
-“এবার তোমার কাঠ-কাঠ দার্শনিক বাক্যালাপ বন্ধ করবে, কবিতা শোনাও...”
-“সে কোথায় পাব, তারা তো আজ মহেঞ্জোদারো। হা হা হা!”
-“সে কোথায় পাব, তারা তো আজ মহেঞ্জোদারো। হা হা হা!”
-“কেন সিন্ধুনদী
তো তোমার কাছে আবার এসে ধরা দিয়েছে, তুমি পারবে না আবার কবিতা লিখতে আমায়
নিয়ে?”
-“খুশি হলাম
রিনি। তোমার এই অনুরোধে। হয়ত পারব, হয়ত বা হবে না আর কবিতা লেখা আমার
দ্বারা কোনদিন!”
-“আলবত্ হবে! আমি যদি এতদিন তোমার দেওয়া ভালবাসা বাঁচিয়ে রেখে বেঁচে থাকতে পারি, তবে তোমার সে ভালবাসা গেল কোথায়, চাপা পড়ে গেলেও
তারা মরে নি আমি জানি। তুমি অস্বীকার করতে পারবে না সে কথা।“
-“এত জোর দিয়ে
তুমি, একমাত্র তুমিই বলতে পার একথা। আমার আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমার যে নিজের ই
সন্দেহ হয় মাঝে মাঝে। তোমার ছবি আমার মনে স্থায়ী হলেও সামনে তোমায় আগের মত দেখতে
পাই কোথায়?”
-“কেন এখন তো আমি
সশরীরে বিদ্যমান তোমার চোখের সামনে, তোমার অনুভুতির একদম কাছাকাছি। তবে
কেন পারবে না?
আর যদি আজ না পার, সেদিন কেন কবিতা দিয়ে আমায় এত আপন করে নিয়েছিলে? শুরু কর,
শুরু কর। একটু পরেই সন্ধ্যে নামবে, ফিরে যাব আমি।”
অতীন রিনির
মুখের দিকে এক হারিয়ে যাওয়া তেপান্তরের দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। রিনি
নিজের বিহ্বল অবস্থা কাটাতে অতীনকে তাড়া দেয়। সে যেন বুঝতে চায় অতীন এখনো ফুরিয়ে
যায় নি। তার কাব্যিক মন আজ ঠিক জেগে উঠবে আবার সেদিনের মত...
“এসেছ গো কাছে, পরম পূণ্যআমার/অস্তাচলে সূর্য নামে ওই/বৃষ্টি পেয়ে মনের শুখা খামার/উচ্চারে সে
মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ!
“দুজনের সেই
হঠাৎ নির্বাসন
/ অপূর্ণমন বাউন্ডুলে একা একা /হারিয়ে যাওয়া খুশির পুনর্বাসন /বিধির বিধানে
আবার দুজনে দেখা।
“হবার যা তা, হয়েছিল ঠিক /
হারানোর ব্যাথা, স্মৃতির সন্তরণ /তোমার আমার হারিয়ে গেল দিক / বেঁচে ছিল শুধু ভালবাসা রসায়ন।
“আজ দেখো এই
অস্তাচলের বুকে /
এলাম আমি তোমার
সরণীতে / সাঁঝের আলো এ কোন প্রাপ্তিসুখে / ভাসায় আবার
জীর্ন তরনীটি-কে!”
“অতীন, আমি ঠিক জানতাম তুমি ফুরিয়ে যাও নি, আমি যে আমার মধ্যে তোমার জীবন-কাঠি বাঁচিয়ে
রেখেছি এখনও। আমি আছি অতীন তুমি আমার মনকে সম্বল করে আরও গভীরভাবে বেঁচে থাকো।” – রিনি বাঁধভাঙা উচ্ছাসে কথাগুলো বলল।
অতীন আবার
বাস্তবের মাটিতে ফিরে এল যেন, বলল –“ভাল লাগল,
যা মনে এল বলে গেলাম তোমায়, কোথাও তো লেখা ছিল না! তবে রিনি আমি বেশ বুঝতে পারছি একজন
নারীই পারে ভালবাসার এমন নির্ঝরকে জাগিয়ে তুলতে।”
-“আর অতীন তুমি
তো জানো, সে আর কেউ নয়,
সে শুধু আমি। তোমার মনে পড়ে অতীন তুমি আমাকে
বলতে ‘তুমি তোমার নামের ওপিঠে এক জ্বাজ্বল্যমান ‘নারী’,
তাই বোধহয় তুমি অনায়াসে ভালবাসার এত ভাষা খুঁজে
পেতে, আমাকে জানাবার।”
-“হ্যাঁ, তোমার কলেজের নাম ছিল রীনা, আমি তাই শেষ থেকে শুরু করে তোমার
মধ্যে নারী খুঁজে পেতাম। আমার ভালবাসা, আমার কবিতা, আমার জীবনের অনুভুতি সবই ওই একটা শব্দে লুকানো ছিল চিরকাল।”
“ মনে রেখো, আমার জীবন অন্যখাতে বয়ে গেলেও, তোমাকে যে ভালবাসা
দিয়েছিলাম, যা পেয়েছিলাম সবই অক্ষয়, অব্যয় হয়ে আজো বেঁচে আমার মনের মাঝে।
তুমি আজ একা, ঘটনা প্রবাহের চোরা স্রোতে দেখা যখন হয়েই গেল, মনে রাখবে আর তুমি একা নও। আমার সংসারটুকু সৎভাবে রক্ষা করেও, সবার প্রয়োজন মিটিয়েও, আমি আমার মনের জমানো ভালবাসা তোমাকে
দিয়ে যাব এসে। মনটা বাঁচিয়ে রাখো অতীন। এ ছোঁয়ায় তুমি আবার কবি হয়ে ওঠো, শিল্পী হয়ে ওঠো – ব্যাস্ আর কিছু চাইনা আমি।” রিনির কথায়
অতীনের চোখের কোণ চিকচিক্ করে উঠল যেন। অতীন এক গভীর অনুভুতির ছোঁয়া মাখানো তার
দু-হাত বাড়িয়ে দিল। রিনি নিজের হাত সে হাতে রেখে এক নান্দনিক প্রতিশ্রুতির
জন্ম দিল সেদিনের অস্তগামী সূর্যের রঙ মাখা গঙ্গার ঘাটে।
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন