থিম
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
রজতকে পেয়ে
ভীষণ খুশি শোভন।
- অনেকদিন পর
তোর দেখা মিলল ভাই।
শোভন বলল, পুজোয়
কটা দিন আছিস নিশ্চয়।
তোকে আমাদের এখানের
পুজো দেখাব।
- সে উপায় কি
আমার আছে? রজত
বলল,
একটা জরুরি কাজে
আমার কোলকাতায় আসা।
- ও যত জরুরিই
হোক না কেন, শুনছি
না। বলে কতদিন – প্রায়
বছর তিনেক তো
বটেই, পর তোর সঙ্গে
দেখা। তোকে আমি ছাড়ছি
না।
রজত বলল, হ্যাঁরে
শুনেছি তোদের কলকাতায়
খুব ভাল পুজো হয়।
অনেক টাকা নাকি সব
বাজেট। পাঁচ, সাত, দশ
লাখ টাকা পর্যন্ত ?
- শুধু সাত দশ
কেন,
শোভন বলল, বিশ
পঁচিশ কি তারও বেশি।
- কী হয় রে
এত টাকা? আমি
তো থাকি সেই একেবারে
অজ পাড়াগাঁয়ে। সবচেয়ে
কাছের শহরে যেতে গেলেও
বাসে অন্তত চার
পাঁচ ঘন্টার পথ।
- ও তুই বুঝবি
না।
- খুব নাকি ফ্যাশান
ট্যাশান-
শোভন হো
হো করে হেসে উঠে
বলল,
ফ্যাশানের যুগ চলে গেছে
ভাই। অন্ততঃ সেই
কুড়ি বছর আগে। এখন
এসেছে থিম। থিমের যুগ
চলছে। বইমেলা, চর্মমেলা,
হস্তশিল্পমেলা সব কিছুতেই এখন
থিম। বাজার একেবারে
মাতিয়ে রেখেছে থিম।
রজত বলল, ও
রকম একটা কথা আমাদের
গাঁয়েগঞ্জেও চালু আছে বটে।
খবরের থিম
কাগজ গিয়ে
এখন এসেছে টিভির
যুগ। ঘরে ঘরে পৌছে
গেছে কেবল টিভি। তার
কল্যাণে কথাগুলো সকলের
কানে পৌছে গেছে। আর
শুধু কানে কেন চোখেও
তো বটে।
ট্রানজিস্টার তো
আর নয়, এ
তো চোখেও দেখা
যায়। কিন্তু মানেগুলো
সব বোঝা হয়নি ভাল
করে।
- মানেগুলো? শোভন
হাসল, আরে ওগুলো জানানোর
জন্যেই তো পুজোর ক’টা দিন
আমার এখানে থাকার
অনুরোধ নাকি? কি
থাকবি তো? তুই
তো আবার ঘোড়ায় জিন
দিয়েই আসিস প্রতিবার।
- সরি ভাই, রজত
হাসল, ভীষণ দরকারি কাজ
তাই আসা। অবশ্য – আমার
কাজগুলো সারতে দিন
দুয়েক লাগবে। সে
কটা দিন থাকতে পারি।
- ও থ্যাংকস গড।
বন্ধুকে আনন্দে জড়িয়ে
ধরল শোভন।
ক’দিন ধরে
রাস্তায় কিংবা দোকানে
দোকানে কী সব যেন
কিনে কিনে ব্যাগ ভরল
রজত, তা দেখেনি শোভন।
অন্যের ব্যাপারে তার
কৌতূহল খুব কম। অন্যের
ব্যক্তিগত সীমার মধ্যে
নাক গলাতেও সে
একেবারেই ভালবাসে না।
পঞ্চমীর সকালে
এসেছে রজত। সপ্তমীর সকালে
চলে যাবে। পঞ্চমীর দুপুরেই
বেরিয়ে পড়ল দুজনে। নানান
রকম সাজসজ্জা পরে
রাস্তায় নেমে পড়েছে সবাই।
কত রকমের সাজ
মানুষের। কত রকমের ভঙ্গি
আর উচ্ছ্বাস।
লোকগুলোকে কৌতূহলের
সঙ্গে দেখতে দেখতে
রজত প্রশ্ন করল, এখানে
সবাই খুব ফ্যাশান করে
তাই নয় রে?
রজতের প্রশ্নে
তার দিকে খানিক তাকিয়ে
নিল শোভন। তারপর বলল, ফ্যাশান
আজকাল কোথায় নেই
বল?
সারা বিশ্বই তো
আজ একটা ফ্ল্যাটবাড়ি হয়ে
গেছে।
একই গেট
দিয়ে ঢোকা আর বেরোন।
একই সিঁড়ির পাশে
দুই পরিবার। গুজরাটের
এক পরিবারের পাশেই
চেন্নাইয়ের এক পরিবার। দিল্লির
এক পরিবারের পাশেই
হয়ত আসামের এক
পরিবার। এও তো একটা
মস্ত ফ্যাশান নাকি?
রজত তখন কতকটা নিজের
মনে মনে বিড়বিড় করছে, বিভেদের মাঝে
মিলন মহান –
এ তো
আমাদের সনাতন ভারতবর্ষেরও
একটা ফ্যাশান নাকি?
এই ফ্যাশান দেখেই
কিন্তু সারা জগত আজ
একসঙ্গে চলার পণ করেছে।
না হলে সারা বিশ্বে বহু
দেশে কত বর্ণ-বিদ্বেষী, ধর্ম-বিদ্বেষী,
জাত-বিদ্বেষী
থাকলেও আজ সারা বিশ্ব
এক হয়ে রয়েছে কী
করে?
বন্ধুর কথায়
অত গা না দিয়ে
আর একবার বন্ধুর
দিকে তাকাল শোভন,
কেন তোদের গাঁয়ে
গঞ্জে কি এসব নেই? ফ্ল্যাট-ট্যাট
না হোক অন্তত সাজের
দিক থেকে ফ্যাশান। সিনেমা-টিনেমা
তো গ্রামে গঞ্জে
লোকে দেখে রে ভাই
নাকি?
রজত কিছু
বলার সুযোগ পেল
না। তার আগেই তারা
এসে পড়েছে একটা
প্যান্ডেলের খুব কাছে। ঢাকের
শব্দে শোভনের সব
কথা ঢাকা পড়ে গেল।
- আজ ঢাকিদের সব
বায়না করে নিয়ে যাচ্ছে।
কাল থেকে বাজাবে চুটিয়ে।
খুশির হাসি হেসে রজতের
দিকে তাকাল শোভন,
কি মিষ্টি আওয়াজ
তাই নয়?
উত্তর না
দিয়ে রজত শুধু হাসল।
রাস্তায় লোক ক্রমশ বাড়ছে।
বাড়ছে গাড়িঘোড়ার সংখ্যাও।
- তোদের এখানে
এর মধ্যেই বাড়ি
থেকে সব বেরিয়ে পড়েছে
মনে হচ্ছে।
শোভন বন্ধুর
অজ্ঞতায় বেশ খুশি হল।
ওকে এখানে রেখে
নিজের দাম একটু বাড়াতে
পেরেছে যেন। বলল, এখন
আর কি দেখছিস। বেলা
যত গড়াবে তুই
নিজে দেখতে পাবি আসল
ছবিটা। রাস্তাগুলো দেখবি
সব যেন নদীর মত।
জনজোয়ারের ঠেলা কাকে বলে
টের পাবি। সন্ধ্যে যতই
হতে থাকবে দেখবি
ছবিটা কেমন পাল্টে পাল্টে
যাচ্ছে। রাত হলে দেখবি
রাস্তাটা আর নদীও নেই,
হয়েছে বিরাট বড়
এক সমুদ্র। জনসমুদ্র।
আর আলোর বন্যা বয়ে
যাবে চারিদিকে। লাইট
হাউসের মত পুজোপ্যান্ডেলগুলো ডাকতে
থাকবে তোকে।
কথা না
বলে রজত হঠাৎ দাঁড়িয়ে
পড়ে কী দেখছে।
- কিরে থেমে পড়লি?
- এটা কি কোনও
প্যান্ডেল? দাঁড়িয়ে পড়ে মুগ্ধ
হয়ে দেখছে রজত।
- হ্যাঁ বটেই
তো। শোভন হাসে, তুই
কি ভাবলি?
- ভাবলাম সত্যি
বুঝি গুজরাটের সোমনাথ
মন্দিরের সামনেই এসে
পড়লাম। আশ্চর্য!
মিরাকুলাস! ভাবতে
অবাক লাগে মানুষ সৃষ্টি
করেছে এটাকে।
ক্রমশঃ
ক্রমশঃ
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন