যূথিকা রায় : তাঁর গান ও সেই সময়
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে কলকাতার মানুষ যখন দক্ষিণ কলকাতার রামকৃষ্ণ সেবাপ্রতিষ্ঠান হাসপাতাল চত্বরে হামলে পড়েছে অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের শারীরিক অবস্থা জানার জন্য, তখনই ঐ হাসপাতালের কোন একটি ওয়ার্ডে সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘ঢুলি’ ছায়াছবির এক নেপথ্য সঙ্গীত শিল্পী, ৯৩ বছরের এক বৃদ্ধা মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে শায়িত ছিলেন সকলের আগ্রহের অন্তরালে ।
সুচিত্রা সেনের মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পরে তিনি মারা গেলেন ৬ই ফেব্রুয়ারি রাত্রি এগারোটায় । চলে গেলেন আধুনিক ‘মীরা বাঈ’ যূথিকা রায় । না, ‘ছায়াছবির নেপথ্য গায়িকা’ এটা কোন পরিচয়ই নয় যূথিকা রায়ের । বাঙালি যখন সবে গান শুনতে শুরু করেছে রেডিও বা কলের গানে, যূথিকা রায় সেই সময়ের সঙ্গীত শিল্পী । বলা সঙ্গত যে, বাংলা গানের যথার্থ আধুনিক হয়ে ওঠা বা বাংলা গানে পরিশীলিত সাঙ্গীতিক রুচি তথা আধুনিকতার নির্মাণ যাঁদের হাতে হয়েছিল তাদেরই একজন ছিলেন যূথিকা রায় ।
১৯৫০/৫২এ আট কি দশ বছর বয়সে তখনও গান শোনার কান তৈরী হয়নি । একটা চারচৌকো কাঠের বাক্স যাকে রেডিও বলা হ’ত, তাতে যখন মীরার ভজন ভেসে আসতো ‘মায়নে চাকর রাখো জী’ কিংবা ‘মেরে তো গিরিধারি গোপাল’ তখন কে মীরা বাঈ এসব জানার কথা নয় আমার । এবং বলতে লজ্জা নেই এইসব গান যিনি গাইতেন তাঁকেই ‘মীরাবাঈ’ বলে জানতাম । অনেক পরে চিতোর বেড়াতে গিয়ে গাইড যখন একটা ছোট ঘরের ভগ্নাবশেষ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল ঐ ঘরে বসেই নাকি মীরা তাঁর গিরিধারী নাগরের ভজনা করতেন, তখন যূথিকা রায়ের কথা আর তাঁর কন্ঠস্বর সামনে ভেসে আসতো । একেই বোধহয় ‘লিজেন্ড’ হয়ে যাওয়া বলে ! কিন্তু মীরার ভজন দিয়ে শুরু হয়নি তাঁর সাঙ্গীতিক জীবন, শুরু হয়েছিল আধুনিক বাংলা গান দিয়ে ।
যূথিকা রায়ের জন্ম ১৯২০র ১৬ই এপ্রিল হাওড়া জেলার আমতায় । ঐ একই বছরে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা গানের দুই প্রবাদপ্রতীম সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর মান্না দে । মাত্র সাত বছর বয়সে বাবার হাত ধরে কলকাতায় এসেছিলেন বেতারে গান গাইতে । কলকাতা বেতারের তখন নিতান্ত শৈশব কাল । মাত্র একবছর আগে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিক প্রমুখের ব্যক্তিগত উদ্যোগে কলকাতা রেডিওর পত্তন হয়েছে ১৯২৭এর ১৬ই অগস্ট । ঐ বছরেই বৃটিশ ভারতে প্রথম রেডিও সম্প্রচার শুরু হয় বোম্বাই বেতার কেন্দ্র থেকে ২৩শে জুলাই । তখনও প্রায় কারো ঘরেই রেডিও সেট পৌঁছায়নি । কানে হেডফোন লাগিয়ে বেতারের সম্প্রচারিত কথা শোনা যেতো । কিছু সম্ভ্রান্ত ঘরে রেডিও সেট ঢুকলো আরো কিছুদিন পরে । তখন বিনোদন মূলক বাংলা গান বলতে গ্রামফোন রেকর্ডে লালচাঁদ বড়াল, কৃষ্ণ ভামিনী, ইন্দুবালা, হরিমতী, কমলা ঝরিয়ার প্রেম ও ছলনামূলক ও দেহতত্বের গান, কৃষ্ণ চন্দ্র দের কীর্তনাঙ্গের গান, আর ক্বচ্চিত ‘রবিবাবুর গান’ লেবেলে দু একটি রবীন্দ্রনাথের লেখা গান । তখনও বাংলা গানের পরিশীলিত গায়ন-রুচি তৈরী হয় নি । বাংলা রেকর্ডের গানের বয়সই তখন মাত্র ছাব্বিশ বছর । ১৯০২ সালে কলের গানের প্রথম রেকর্ড চালু হওয়ার পর পরিশীলিত গায়ন-রুচি তৈরী হতে লেগে গিয়েছিল আরো কুড়ি পঁচিশটা বছর ।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে যূথিকা রায় প্রথম গ্রামফোন রেকর্ডে গান গাইলেন ১৯৩৪এ কাজী নজরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে । নজরুল তখন কাব্যভুবন থেকে চলে এসে গ্রামোফোন কোম্পানির মাস মাইনের সঙ্গীত পরিচালক । গ্রামোফোন কোম্পানির সর্বময় কর্তা । বস্তুত বাংলা গানের স্বর্নযুগের সূচনা হয়েছিল নজরুলের হাতেই । কুকুর-মার্কা এইচ এম ভি’র লেবেলে যুথিকা দুটি গান রেকর্ড করলেন প্রণব রায়ের কথা ও কমল দাশগুপ্তের সুরে, ‘আমি ভোরের যূথিকা’ এবং ‘সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে’ । যূথিকা রায়ের সেই প্রথম রেকর্ডের গান প্রসঙ্গে বাংলা গানের জীবন্ত তথ্যকোষ প্রয়াত বিমান মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ উদ্ধৃত করি,
“যূথিকা রায়ের নামে বাজারে রেকর্ড বেরুল - আমি ভোরের যূথিকা আর ওই বিখ্যাত সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে - যে গানটাকে এখনকার গবেষক বিশেষজ্ঞরাও অনেকে, আধুনিক বাংলা গান সরণীটির প্রথম মাইলফলক বলে চিহ্নিত করেছেন। কারুর কাছে এটা হয়ত প্রশ্নাতীত নাও হতে পারে, তবু এ গান যে ইতিহাসের উপাদান হয়ে গেছে - তাতে কিন্তু কোনরকম দ্বিমত নেই। সেই বোধহয় রেকর্ডের বাংলা গানে, প্রথম অর্কেস্ট্রা তৈরি হল।... তা, রেকর্ডখানা বাজারে বেরুল। আর মাত্র তিন মাসের মধ্যে যূথিকাদির এই রেকর্ডখানা ষাট হাজার কপি বিক্রী হয়ে গিয়ে বাজারে রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিল। রাতারাতি যূথিকাদি হয়ে গেলো আর্টিস্ট, স্টার।’’ (‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে” : শীতাংশুশেখর ঘোষ, পৃ ১৫৪-৫৫)।
তিরিশের দশক বাংলা গানের সুবর্নযুগের সূচনাকাল । ১৯৩২এ শচীন দেববর্মণ প্রথম বেতার ও গ্রামফোনের গানে প্রবেশ করলেন, ১৯৩২এই বাংলা চলচ্চিত্র নির্বাক যুগ পেরিয়ে সবাক হ’ল, ১৯৩৭এ ‘মুক্তি’ ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ কুমার মল্লিক ছায়াছবিতে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রয়োগ ঘটালেন । শচীন দেববর্মণ ও সুরসাগর হিমাংশু দত্তের যুগলবন্দির সুরবৈচিত্রে বাংলা গান যথার্থ অর্থেই আধুনিক হয়ে উঠলো। বাংলা গানের কথায় কাব্যের লাবণ্য এল এই সময়ের গানে । এই পর্বেই যূথিকা রায় আধুনিক বাংলা গানের সুবর্ন যুগের নির্মাণে অবিসংবাদী ভূমিকা রেখে গেলেন তাঁর স্বকীয় গায়নশৈলী ও কন্ঠ মাধুর্যের গুনে । ১৪বছর বয়সে প্রথম রেকর্ডের অভূতপূর্ব সাফল্যের পর গ্রামফোন কোম্পানি একের পর এক কমল দাশগুপ্তর সুরে আধুনিক বাংলা গানের রেকর্ড করাতে লাগলেন । সুরকার কমল দাশগুপ্তর প্রতিষ্ঠার পেছনে যূথিকা রায়েরও অবদান বড় কম ছিলনা । কারণ যূথিকা রায়ের প্রায় সব গানের সুরকার ছিলেন তিনি । যূথিকা রায়ের সংগীতজীবনের প্রায় সবটাই জুড়ে ছিলেন কমল দাশগুপ্ত । নজরুল ইসলাম তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন আর পরবর্তীতে শুধুই কমল দাশগুপ্ত । প্রথম রেকর্ড করেছিলেন নজরুল ইসলামের লেখা ও সুরে কিন্তু যে কোন কারণে সেই রেকর্ড প্রকাশিত হয়নি । হয়তো স্বয়ং নজরুলেরই তা পছন্দ হয়নি । তিনিই তখন কমল দাশগুপ্ত কে সুর করতে বলেন । ১৯৩৯এ নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়লেন । তারপর তো বাক-শক্তিই হারালেন ।
যূথিকা রায় নজরুলের অনেকগুলি গান রেকর্ডে গেয়েছিলেন । তাঁর গাওয়া নজরুলের গানের মধ্যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল ‘ওরে নীল যমুনার জল’ এবং ‘তোমার কালো রূপে যাক না ডুবে সকল কালো মম, হে কৃষ্ণ প্রিয়তম’ । দুটি গানেরই সুর করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত ।
এই সময় থেকে যূথিকা আধুনিক বাংলা গান থেকে ভক্তিমূলক – প্রধানতঃ ভজন গানে চলে এলেন । যুথিকা স্মৃতিচারণ করেছেন “এরপর প্রথমে কমল দাশগুপ্ত আমাকে একটা মীরার ভজন শেখালেন, সেই মীরার ভজন যখন দাঁড়িয়ে গেল, পপুলার হলো, ফার্স্ট যখন ‘মীরা কে প্রভু সাঁচী দাসী বানাও’ - এই গানটা বেরিয়ে পপুলার হলো, তখন ওই গ্রামোফোন কোম্পানির থেকে বলা হলো, যতগুলো মীরার ভজন আছে সব যূথিকাকে দিয়ে গাওয়ানো হবে ।
চল্লিশের দশক –বাংলা গানের ভুবন যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে । হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, সত্য চৌধুরী, সুধীরলাল চক্রবর্তী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, বেচু দত্ত প্রমুখ অনেক শিল্পী, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, মোহিনী চৌধুরী, অজয় ভট্টাচার্যর মত গানের কথাকার, দুর্গা সেন, অনুপম ঘটক, নচিকেতা ঘোষ, সলিল চৌধুরীর মত সুরকার সেই সময়ের ফসল ।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পনেরো বছর বয়সে প্রথম বেতারে গান গাইলেন ১৯৩৫এ, ১৯৩৭ এ তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বেরিয়ে গেল ‘কথা কয়োনাকো, শুধু শোন’ ও ‘জানিতে যদিগো তুমি’ । বাংলা গানের ভুবনে অনেক শিল্পীর আবির্ভাব সত্বেও আধুনিক বাংলা গানের বাইরে যে অন্য ধারার গান সেখানে গায়নশৈলীর স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হয়ে রইলেন যূথিকা রায় ।
তাঁর সঙ্গীত জীবনের প্রথম পর্বের গানগুলিতে রোমান্টিকতার সঙ্গে পাওয়া যায় একটা বিষাদ বিষন্নতার ছবি, আর ভজন গানে তাঁর গায়কীতে বিভোর, তন্ময় আত্মনিবেদন । একের পর এক মীরার ভজন গাইতে গাইতে ‘আধুনিক মীরা বাঈ’এর পরিচিতি পেয়ে গেলেন যূথিকা রায় । প্রায় তাঁর সমকালেই পন্ডিত ডিভি পালুশকর কিংবা অনেক পরে অনুপ জলোটা এবং আরো অনেক শিল্পী ভারতজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন কিন্তু মীরার ভজন গানে যূথিকা রায়ের যে শ্রদ্ধার আসন তাকে স্পর্শ করতে পারেননি কেউ । এই ‘আধুনিক মীরা’ হয়ে ওঠা তাকে বিরল সম্মান এনে দিয়েছিল । সেসব কথা যুথিকা নিজেই লিখে গেছেন তার স্মৃতিচারণ মূলক বই “আজও মনে পড়ে”তে এবং নানান সাক্ষাৎকারে ।
১৯৪৭এর পনেরোই অগষ্ট । সেদিন রেডিওতে যুথিকার গানের সিটিং ছিল । ঘটনাক্রমে সেদিন লালকেল্লায় স্বাধীন ভারতে প্রথম জাতীয় পতাকা তুলবেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু । যুথিকার পনেরো মিনিটের রেডিও সিটিং শেষ হয়েছে, ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত । তখনই টেলিফোনে সংবাদ এলো, প্রধান মন্ত্রী নেহেরু চাইছেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পুরো সময়টা রেডিওতে যেন যুথিকা রায় গান গাইতে থাকেন । নেহেরু তখন তিনমূর্তি ভবন থেকে লালকেল্লার পথে রওনা দিয়েছেন । যূথিকা আবার বসলেন গান গাইতে । গান্ধীজীর প্রিয় রামধুন ভজন ও দেশভক্তিমূলক সহ সাত/আটটি গান গেয়েছিলেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় । যূথিকার এমনই প্রবল জনপ্রিয়তা ছিল । নেহেরু নিশ্চয়ই জানতেন গান্ধীজী তাঁর দৈনিক প্রার্থনার আগে যূথিকার ভজন শুনতেন ।
১৯৪৬এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় গান্ধীজী কলকাতায় এসেছিলেন সত্যাগ্রহে । মঞ্চে ডেকে নিয়েছিলেন যূথিকাকে, তাঁর ভাষণের আগে গান গেয়েছিলেন যূথিকা রায় ।
তখন ছায়াছবিতে গান গাওয়া যে কোন শিল্পীর খুব কাঙ্খিত ছিল, শিল্পীর জনপ্রিয়তার একটা মাপকাঠি ছিল ছায়াছবিতে গান করা । কিন্তু ছায়াছবিতে গান করা যূথিকাকে টানেনি একদম । তিনি যে তন্ময়তায় ভজন গাইতেন তেমন পরিবেশ তখনকার সিনেমায় থাকতো না বলেই মনে করতেন যূথিকা । এ ব্যাপারে তাঁর মায়ের রক্ষণশীলতাও তাঁর সিনেমায় গান না করার একটা কারণ ছিল । তবু দুটি ছায়াছবিতে তিনি নেপথ্য সঙ্গীতে ছিলেন । তখনকার প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক দেবকী কুমার বসুর হিন্দি ছবি ‘রত্নদীপ’ ছবিতে, মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫১তে এবং পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীতপ্রধান ছবি ‘ঢুলি’, ১৯৫৪ তে । তাঁর দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে আর কোন বাংলা বা হিন্দি ছায়াছবিতে তিনি গান করেননি ।
বস্তুত পঞ্চাশ দশকের শেষ থেকেই তিনি অনুষ্ঠানে গান করা ছাড়া রেকর্ডের গান করা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন । তাঁর প্রায় সব গানের সুরকার কমল দাশগুপ্তের সৃষ্টিশীলতাও কমে যায় । অসুস্থতার কারণে রেকর্ডে সুর করা বন্ধ করে দিলেন । যূথিকাও গানের নতুন গান রেকর্ড করা বন্ধ করে দিলেন । এই সময় শ্যামল গুপ্তর লেখা কয়েকটি গানে নিজে সুরও দিয়েছিলেন যূথিকা । আর অন্যকোন সুরকারের সুরে যূথিকাতো গানই করেনইনি । কমল দাশগুপ্ত রেকর্ডের গানে সুর করা বন্ধ করে দেওয়ার পর গ্রামফোন কোম্পানী তাঁর ইচ্ছামত যে কোন ট্রেনারের সঙ্গে গান করার অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু যূথিকা অন্য কোন ট্রেনারের প্রশিক্ষণে গান করায় সম্মত হননি যদিও তখনও তাঁর কন্ঠে গান ছিল আর তাঁর গানের জনপ্রিয়তা ও চাহিদা ছিল । তখন তিনি রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদের গানে চলে এলেন । এইসময় বাংলা ও হিন্দি ছাড়া উর্দু ও তামিল ভাষাতেও ভক্তিমূলক গান করেছিলেন তিনি । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান করেননি । অবশ্য যূথিকা রায়ের সঙ্গীত জীবনের শীর্ষ সময়ে রবীন্দ্রনাথের গান বাঙ্গালির কাছে এখনকার মত সর্বগ্রাসী ছিলই না বরং বলা ভালো ১৯৬১তে তাঁর শতবার্ষিকীর আগে বাঙ্গালির রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার কানই তৈরী হয়নি । অথচ মজার কথা সাত বছর বয়সে বেতারে যূথিকার প্রথম গানটিই ছিল রবীন্দ্র নাথের ‘আর রেখোনা আঁধারে, আমায় দেখতে দাও’ ।
জন্ম হাওড়া জেলার আমতা, পরিবারের আদিবাড়ি খুলনা জেলার সেনেটি গ্রাম । শৈশবশিক্ষা, গানকে ভালোবাসার শুরু সেখানেই, তারপর ১৯৩০ থেকে কলকাতায় পাকাপাকি বাস । আর গানেরতো কোন দেশ কাল হয় না । বয়সও হয়না । বিস্ময় লাগে, এই সেদিন, ২০১৩র পূজোর ঠিক আগে, ৯৩বছর বয়সে মুম্বাইতে গানের অনুষ্ঠান করলেন । সেটাই তাঁর শেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান । রেকর্ডে গান করা ছেড়ে দেবার অনেকদিন পরে বিশেষ অনুরোধে একটি সাঁইবাবার ভজন রেকর্ড করেন ১৯৭৬এ এবং এটি তাঁর শেষ রেকর্ডের গান ।
সময়ের স্রোত হয়তো আমাদের অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয়, তার মধ্যে অস্বাভাবিকতাও নেই কিছুমাত্র, তবু শিল্পীর সৃষ্টি বেঁচে থাকে । যতদিন গানশোনা মানুষ ‘মীরার ভজন’ শুনতে চাইবেন, তাঁকে বোধকরি ‘আধুনিক মীরা’ যূথিকা রায়ের গানের কাছে যেতে হবে ।
সুচিত্রা সেনের মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পরে তিনি মারা গেলেন ৬ই ফেব্রুয়ারি রাত্রি এগারোটায় । চলে গেলেন আধুনিক ‘মীরা বাঈ’ যূথিকা রায় । না, ‘ছায়াছবির নেপথ্য গায়িকা’ এটা কোন পরিচয়ই নয় যূথিকা রায়ের । বাঙালি যখন সবে গান শুনতে শুরু করেছে রেডিও বা কলের গানে, যূথিকা রায় সেই সময়ের সঙ্গীত শিল্পী । বলা সঙ্গত যে, বাংলা গানের যথার্থ আধুনিক হয়ে ওঠা বা বাংলা গানে পরিশীলিত সাঙ্গীতিক রুচি তথা আধুনিকতার নির্মাণ যাঁদের হাতে হয়েছিল তাদেরই একজন ছিলেন যূথিকা রায় ।
১৯৫০/৫২এ আট কি দশ বছর বয়সে তখনও গান শোনার কান তৈরী হয়নি । একটা চারচৌকো কাঠের বাক্স যাকে রেডিও বলা হ’ত, তাতে যখন মীরার ভজন ভেসে আসতো ‘মায়নে চাকর রাখো জী’ কিংবা ‘মেরে তো গিরিধারি গোপাল’ তখন কে মীরা বাঈ এসব জানার কথা নয় আমার । এবং বলতে লজ্জা নেই এইসব গান যিনি গাইতেন তাঁকেই ‘মীরাবাঈ’ বলে জানতাম । অনেক পরে চিতোর বেড়াতে গিয়ে গাইড যখন একটা ছোট ঘরের ভগ্নাবশেষ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল ঐ ঘরে বসেই নাকি মীরা তাঁর গিরিধারী নাগরের ভজনা করতেন, তখন যূথিকা রায়ের কথা আর তাঁর কন্ঠস্বর সামনে ভেসে আসতো । একেই বোধহয় ‘লিজেন্ড’ হয়ে যাওয়া বলে ! কিন্তু মীরার ভজন দিয়ে শুরু হয়নি তাঁর সাঙ্গীতিক জীবন, শুরু হয়েছিল আধুনিক বাংলা গান দিয়ে ।
যূথিকা রায়ের জন্ম ১৯২০র ১৬ই এপ্রিল হাওড়া জেলার আমতায় । ঐ একই বছরে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা গানের দুই প্রবাদপ্রতীম সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর মান্না দে । মাত্র সাত বছর বয়সে বাবার হাত ধরে কলকাতায় এসেছিলেন বেতারে গান গাইতে । কলকাতা বেতারের তখন নিতান্ত শৈশব কাল । মাত্র একবছর আগে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিক প্রমুখের ব্যক্তিগত উদ্যোগে কলকাতা রেডিওর পত্তন হয়েছে ১৯২৭এর ১৬ই অগস্ট । ঐ বছরেই বৃটিশ ভারতে প্রথম রেডিও সম্প্রচার শুরু হয় বোম্বাই বেতার কেন্দ্র থেকে ২৩শে জুলাই । তখনও প্রায় কারো ঘরেই রেডিও সেট পৌঁছায়নি । কানে হেডফোন লাগিয়ে বেতারের সম্প্রচারিত কথা শোনা যেতো । কিছু সম্ভ্রান্ত ঘরে রেডিও সেট ঢুকলো আরো কিছুদিন পরে । তখন বিনোদন মূলক বাংলা গান বলতে গ্রামফোন রেকর্ডে লালচাঁদ বড়াল, কৃষ্ণ ভামিনী, ইন্দুবালা, হরিমতী, কমলা ঝরিয়ার প্রেম ও ছলনামূলক ও দেহতত্বের গান, কৃষ্ণ চন্দ্র দের কীর্তনাঙ্গের গান, আর ক্বচ্চিত ‘রবিবাবুর গান’ লেবেলে দু একটি রবীন্দ্রনাথের লেখা গান । তখনও বাংলা গানের পরিশীলিত গায়ন-রুচি তৈরী হয় নি । বাংলা রেকর্ডের গানের বয়সই তখন মাত্র ছাব্বিশ বছর । ১৯০২ সালে কলের গানের প্রথম রেকর্ড চালু হওয়ার পর পরিশীলিত গায়ন-রুচি তৈরী হতে লেগে গিয়েছিল আরো কুড়ি পঁচিশটা বছর ।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে যূথিকা রায় প্রথম গ্রামফোন রেকর্ডে গান গাইলেন ১৯৩৪এ কাজী নজরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে । নজরুল তখন কাব্যভুবন থেকে চলে এসে গ্রামোফোন কোম্পানির মাস মাইনের সঙ্গীত পরিচালক । গ্রামোফোন কোম্পানির সর্বময় কর্তা । বস্তুত বাংলা গানের স্বর্নযুগের সূচনা হয়েছিল নজরুলের হাতেই । কুকুর-মার্কা এইচ এম ভি’র লেবেলে যুথিকা দুটি গান রেকর্ড করলেন প্রণব রায়ের কথা ও কমল দাশগুপ্তের সুরে, ‘আমি ভোরের যূথিকা’ এবং ‘সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে’ । যূথিকা রায়ের সেই প্রথম রেকর্ডের গান প্রসঙ্গে বাংলা গানের জীবন্ত তথ্যকোষ প্রয়াত বিমান মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ উদ্ধৃত করি,
“যূথিকা রায়ের নামে বাজারে রেকর্ড বেরুল - আমি ভোরের যূথিকা আর ওই বিখ্যাত সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে - যে গানটাকে এখনকার গবেষক বিশেষজ্ঞরাও অনেকে, আধুনিক বাংলা গান সরণীটির প্রথম মাইলফলক বলে চিহ্নিত করেছেন। কারুর কাছে এটা হয়ত প্রশ্নাতীত নাও হতে পারে, তবু এ গান যে ইতিহাসের উপাদান হয়ে গেছে - তাতে কিন্তু কোনরকম দ্বিমত নেই। সেই বোধহয় রেকর্ডের বাংলা গানে, প্রথম অর্কেস্ট্রা তৈরি হল।... তা, রেকর্ডখানা বাজারে বেরুল। আর মাত্র তিন মাসের মধ্যে যূথিকাদির এই রেকর্ডখানা ষাট হাজার কপি বিক্রী হয়ে গিয়ে বাজারে রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিল। রাতারাতি যূথিকাদি হয়ে গেলো আর্টিস্ট, স্টার।’’ (‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে” : শীতাংশুশেখর ঘোষ, পৃ ১৫৪-৫৫)।
তিরিশের দশক বাংলা গানের সুবর্নযুগের সূচনাকাল । ১৯৩২এ শচীন দেববর্মণ প্রথম বেতার ও গ্রামফোনের গানে প্রবেশ করলেন, ১৯৩২এই বাংলা চলচ্চিত্র নির্বাক যুগ পেরিয়ে সবাক হ’ল, ১৯৩৭এ ‘মুক্তি’ ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ কুমার মল্লিক ছায়াছবিতে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রয়োগ ঘটালেন । শচীন দেববর্মণ ও সুরসাগর হিমাংশু দত্তের যুগলবন্দির সুরবৈচিত্রে বাংলা গান যথার্থ অর্থেই আধুনিক হয়ে উঠলো। বাংলা গানের কথায় কাব্যের লাবণ্য এল এই সময়ের গানে । এই পর্বেই যূথিকা রায় আধুনিক বাংলা গানের সুবর্ন যুগের নির্মাণে অবিসংবাদী ভূমিকা রেখে গেলেন তাঁর স্বকীয় গায়নশৈলী ও কন্ঠ মাধুর্যের গুনে । ১৪বছর বয়সে প্রথম রেকর্ডের অভূতপূর্ব সাফল্যের পর গ্রামফোন কোম্পানি একের পর এক কমল দাশগুপ্তর সুরে আধুনিক বাংলা গানের রেকর্ড করাতে লাগলেন । সুরকার কমল দাশগুপ্তর প্রতিষ্ঠার পেছনে যূথিকা রায়েরও অবদান বড় কম ছিলনা । কারণ যূথিকা রায়ের প্রায় সব গানের সুরকার ছিলেন তিনি । যূথিকা রায়ের সংগীতজীবনের প্রায় সবটাই জুড়ে ছিলেন কমল দাশগুপ্ত । নজরুল ইসলাম তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন আর পরবর্তীতে শুধুই কমল দাশগুপ্ত । প্রথম রেকর্ড করেছিলেন নজরুল ইসলামের লেখা ও সুরে কিন্তু যে কোন কারণে সেই রেকর্ড প্রকাশিত হয়নি । হয়তো স্বয়ং নজরুলেরই তা পছন্দ হয়নি । তিনিই তখন কমল দাশগুপ্ত কে সুর করতে বলেন । ১৯৩৯এ নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়লেন । তারপর তো বাক-শক্তিই হারালেন ।
যূথিকা রায় নজরুলের অনেকগুলি গান রেকর্ডে গেয়েছিলেন । তাঁর গাওয়া নজরুলের গানের মধ্যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল ‘ওরে নীল যমুনার জল’ এবং ‘তোমার কালো রূপে যাক না ডুবে সকল কালো মম, হে কৃষ্ণ প্রিয়তম’ । দুটি গানেরই সুর করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত ।
এই সময় থেকে যূথিকা আধুনিক বাংলা গান থেকে ভক্তিমূলক – প্রধানতঃ ভজন গানে চলে এলেন । যুথিকা স্মৃতিচারণ করেছেন “এরপর প্রথমে কমল দাশগুপ্ত আমাকে একটা মীরার ভজন শেখালেন, সেই মীরার ভজন যখন দাঁড়িয়ে গেল, পপুলার হলো, ফার্স্ট যখন ‘মীরা কে প্রভু সাঁচী দাসী বানাও’ - এই গানটা বেরিয়ে পপুলার হলো, তখন ওই গ্রামোফোন কোম্পানির থেকে বলা হলো, যতগুলো মীরার ভজন আছে সব যূথিকাকে দিয়ে গাওয়ানো হবে ।
চল্লিশের দশক –বাংলা গানের ভুবন যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে । হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, সত্য চৌধুরী, সুধীরলাল চক্রবর্তী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, বেচু দত্ত প্রমুখ অনেক শিল্পী, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, মোহিনী চৌধুরী, অজয় ভট্টাচার্যর মত গানের কথাকার, দুর্গা সেন, অনুপম ঘটক, নচিকেতা ঘোষ, সলিল চৌধুরীর মত সুরকার সেই সময়ের ফসল ।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পনেরো বছর বয়সে প্রথম বেতারে গান গাইলেন ১৯৩৫এ, ১৯৩৭ এ তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বেরিয়ে গেল ‘কথা কয়োনাকো, শুধু শোন’ ও ‘জানিতে যদিগো তুমি’ । বাংলা গানের ভুবনে অনেক শিল্পীর আবির্ভাব সত্বেও আধুনিক বাংলা গানের বাইরে যে অন্য ধারার গান সেখানে গায়নশৈলীর স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হয়ে রইলেন যূথিকা রায় ।
তাঁর সঙ্গীত জীবনের প্রথম পর্বের গানগুলিতে রোমান্টিকতার সঙ্গে পাওয়া যায় একটা বিষাদ বিষন্নতার ছবি, আর ভজন গানে তাঁর গায়কীতে বিভোর, তন্ময় আত্মনিবেদন । একের পর এক মীরার ভজন গাইতে গাইতে ‘আধুনিক মীরা বাঈ’এর পরিচিতি পেয়ে গেলেন যূথিকা রায় । প্রায় তাঁর সমকালেই পন্ডিত ডিভি পালুশকর কিংবা অনেক পরে অনুপ জলোটা এবং আরো অনেক শিল্পী ভারতজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন কিন্তু মীরার ভজন গানে যূথিকা রায়ের যে শ্রদ্ধার আসন তাকে স্পর্শ করতে পারেননি কেউ । এই ‘আধুনিক মীরা’ হয়ে ওঠা তাকে বিরল সম্মান এনে দিয়েছিল । সেসব কথা যুথিকা নিজেই লিখে গেছেন তার স্মৃতিচারণ মূলক বই “আজও মনে পড়ে”তে এবং নানান সাক্ষাৎকারে ।
১৯৪৭এর পনেরোই অগষ্ট । সেদিন রেডিওতে যুথিকার গানের সিটিং ছিল । ঘটনাক্রমে সেদিন লালকেল্লায় স্বাধীন ভারতে প্রথম জাতীয় পতাকা তুলবেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু । যুথিকার পনেরো মিনিটের রেডিও সিটিং শেষ হয়েছে, ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত । তখনই টেলিফোনে সংবাদ এলো, প্রধান মন্ত্রী নেহেরু চাইছেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পুরো সময়টা রেডিওতে যেন যুথিকা রায় গান গাইতে থাকেন । নেহেরু তখন তিনমূর্তি ভবন থেকে লালকেল্লার পথে রওনা দিয়েছেন । যূথিকা আবার বসলেন গান গাইতে । গান্ধীজীর প্রিয় রামধুন ভজন ও দেশভক্তিমূলক সহ সাত/আটটি গান গেয়েছিলেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় । যূথিকার এমনই প্রবল জনপ্রিয়তা ছিল । নেহেরু নিশ্চয়ই জানতেন গান্ধীজী তাঁর দৈনিক প্রার্থনার আগে যূথিকার ভজন শুনতেন ।
১৯৪৬এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় গান্ধীজী কলকাতায় এসেছিলেন সত্যাগ্রহে । মঞ্চে ডেকে নিয়েছিলেন যূথিকাকে, তাঁর ভাষণের আগে গান গেয়েছিলেন যূথিকা রায় ।
তখন ছায়াছবিতে গান গাওয়া যে কোন শিল্পীর খুব কাঙ্খিত ছিল, শিল্পীর জনপ্রিয়তার একটা মাপকাঠি ছিল ছায়াছবিতে গান করা । কিন্তু ছায়াছবিতে গান করা যূথিকাকে টানেনি একদম । তিনি যে তন্ময়তায় ভজন গাইতেন তেমন পরিবেশ তখনকার সিনেমায় থাকতো না বলেই মনে করতেন যূথিকা । এ ব্যাপারে তাঁর মায়ের রক্ষণশীলতাও তাঁর সিনেমায় গান না করার একটা কারণ ছিল । তবু দুটি ছায়াছবিতে তিনি নেপথ্য সঙ্গীতে ছিলেন । তখনকার প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক দেবকী কুমার বসুর হিন্দি ছবি ‘রত্নদীপ’ ছবিতে, মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫১তে এবং পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীতপ্রধান ছবি ‘ঢুলি’, ১৯৫৪ তে । তাঁর দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে আর কোন বাংলা বা হিন্দি ছায়াছবিতে তিনি গান করেননি ।
বস্তুত পঞ্চাশ দশকের শেষ থেকেই তিনি অনুষ্ঠানে গান করা ছাড়া রেকর্ডের গান করা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন । তাঁর প্রায় সব গানের সুরকার কমল দাশগুপ্তের সৃষ্টিশীলতাও কমে যায় । অসুস্থতার কারণে রেকর্ডে সুর করা বন্ধ করে দিলেন । যূথিকাও গানের নতুন গান রেকর্ড করা বন্ধ করে দিলেন । এই সময় শ্যামল গুপ্তর লেখা কয়েকটি গানে নিজে সুরও দিয়েছিলেন যূথিকা । আর অন্যকোন সুরকারের সুরে যূথিকাতো গানই করেনইনি । কমল দাশগুপ্ত রেকর্ডের গানে সুর করা বন্ধ করে দেওয়ার পর গ্রামফোন কোম্পানী তাঁর ইচ্ছামত যে কোন ট্রেনারের সঙ্গে গান করার অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু যূথিকা অন্য কোন ট্রেনারের প্রশিক্ষণে গান করায় সম্মত হননি যদিও তখনও তাঁর কন্ঠে গান ছিল আর তাঁর গানের জনপ্রিয়তা ও চাহিদা ছিল । তখন তিনি রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদের গানে চলে এলেন । এইসময় বাংলা ও হিন্দি ছাড়া উর্দু ও তামিল ভাষাতেও ভক্তিমূলক গান করেছিলেন তিনি । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান করেননি । অবশ্য যূথিকা রায়ের সঙ্গীত জীবনের শীর্ষ সময়ে রবীন্দ্রনাথের গান বাঙ্গালির কাছে এখনকার মত সর্বগ্রাসী ছিলই না বরং বলা ভালো ১৯৬১তে তাঁর শতবার্ষিকীর আগে বাঙ্গালির রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার কানই তৈরী হয়নি । অথচ মজার কথা সাত বছর বয়সে বেতারে যূথিকার প্রথম গানটিই ছিল রবীন্দ্র নাথের ‘আর রেখোনা আঁধারে, আমায় দেখতে দাও’ ।
জন্ম হাওড়া জেলার আমতা, পরিবারের আদিবাড়ি খুলনা জেলার সেনেটি গ্রাম । শৈশবশিক্ষা, গানকে ভালোবাসার শুরু সেখানেই, তারপর ১৯৩০ থেকে কলকাতায় পাকাপাকি বাস । আর গানেরতো কোন দেশ কাল হয় না । বয়সও হয়না । বিস্ময় লাগে, এই সেদিন, ২০১৩র পূজোর ঠিক আগে, ৯৩বছর বয়সে মুম্বাইতে গানের অনুষ্ঠান করলেন । সেটাই তাঁর শেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান । রেকর্ডে গান করা ছেড়ে দেবার অনেকদিন পরে বিশেষ অনুরোধে একটি সাঁইবাবার ভজন রেকর্ড করেন ১৯৭৬এ এবং এটি তাঁর শেষ রেকর্ডের গান ।
সময়ের স্রোত হয়তো আমাদের অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয়, তার মধ্যে অস্বাভাবিকতাও নেই কিছুমাত্র, তবু শিল্পীর সৃষ্টি বেঁচে থাকে । যতদিন গানশোনা মানুষ ‘মীরার ভজন’ শুনতে চাইবেন, তাঁকে বোধকরি ‘আধুনিক মীরা’ যূথিকা রায়ের গানের কাছে যেতে হবে ।
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন