(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমার না বলা
কথা
নারায়ণ রায়
১৯৭২-এর আমি
যে সময়ে কর্পোরেশনের চাকরিতে যোগদান করি তখনও রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন। বাংলাদেশ
তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে তখনো অনেক শরনার্থী নিজ দেশে ফিরে যায়নি। কলকাতা
কর্পোরেশনেও তখন বোর্ড ভেঙ্গে দিয়ে একজন আই এ এস এডমিনিস্ট্রেটর বসানো হয়েছে, তাঁর নাম ছিল শিব প্রসাদ সমাদ্দার পরে তিনি
ভারত সরকারের ইস্পাত দফতরের সচিব হয়ে অবসর গ্রহণ করেন। সন্ধ্যার পর কোথাও বেরোতে ভয় লাগতো। শিয়ালদা ধমর্তলা
আর কলেজ স্কোয়ার, এর বাইরে কোথাও
একা যাওয়ার কথা ভাবতেই পারতাম না। আর সব চেয়ে বেশী ভয় পেতাম কোন গলির ভিতর কোন
কারণে যাওয়ার দরকার হলে। তবে শহরের কেন্দ্রস্থলগুলোতে দিনের বেলায় কিছুই বুঝতে
পারতাম না।
সপ্তাহখানেক
অফিস করার পর একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম যে আমাদের যে কাজের জন্য নেয়া হয়েছে সেই
কাজ শুরু হতে এখনও অনেক দেরী। আমাদের কাজের চাপ খুবই কম। আমার অফিসাররা সবাই খুব
ভালো মানুষ। সামান্য যা কাজ দেন সঙ্গে সঙ্গে করে দেই তারপর অফুরন্ত সময়, নতুন কুড়ি জনকে কলকাতা শহরের বিভিন্ন যায়গায় ছড়িয়ে কাউকে হাতিবাগান,
কাউকে ভবানীপুর, কাউকে কলেজ স্ট্রিট এই ভাবে
পোস্টিং দেয়া হয়েছে, হেড অফিসে মাত্র ৩/৪ জন আর পাশেই হগ
বিল্ডিং এ আমরা তিনজন, ইতিমধ্যেই এইসব সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে
বেশ ঘনিষ্টতা হয়ে গেছে এখন আমরা পরস্পরকে তুই বলে সম্বোধন করি। আমার বন্ধুদের বাকি দুজন স্থানীয় ছেলে, এক জনের বাড়ি বাঁশদ্রোনী আরেক জনের বাড়ি বেহালা, তারা
এক সপ্তাহের মধ্যেই অফিসের হাওয়া বুঝে গেছে এবং ৪ টে বাজলেই গুটি গুটি পা পা করে
বাড়ির দিকে পা বাড়ায়, কারণ তাদের পাড়ায় ক্লাব আছে আড্ডা আছে। আর তখন কিন্তু বাসে
ট্রামে এখনকার চেয়ে অনেক বেশীই ভিড় হত। মিনিবাস ছিলনা, অটো ছিলনা, মেট্রো
ছিলনা, শহরের ভিতর এত প্রাইভেট বাসের রুট ছিল না। তাই তাড়াতাডিবাড়ি ফেরার এটাও একটা কারণ ছিল। কিন্তু আমি আর কোথায় যাব? আমাকে তো এখন ঐ তিনতলার ছাদের ঐ
অ্যাসবেসটসের ঘরে গিয়ে সেদ্ধ হতে হবে।
তাই একা একা
বোকার মত ধর্মতলা এলাকাটায় ঘুরে বেড়াতাম। ঐ এলাকায় তখনও “অনাদির মোঘলাই” এর
দোকানটা এমনই রমরমা ছিল, কোন কোন দিন ওখানে ঢুকে এক টাকা দিয়ে
একটা মোঘলাই খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত চলে যেতাম, কখনো বা একেবারে রবীন্দ্রসদন পর্যন্ত চলে যেতাম। এখন যে বাইশ তলা চ্যাটার্জ্জী ইন্টারন্যাশনাল বাড়িটি, সেটি তখনও তৈরি হয়নি, “নন্দন” তার অনেক পরে তৈরী হয়েছে। আকাদেমি অফ ফাইন
আর্টস কিম্বা রবীন্দ্রসদনে কোন নাটক বা কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে দেখলে কখনো কখনো একটা টিকিট কেটে ঢুকে পড়তাম। ওই সময়
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত,
রুদ্রপ্রসাদের বিখ্যাত কয়েকটা নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। ধর্মতলা
এলাকায় অনেকগুলো বিখ্যাত সিনেমা হল ছিল (তার মধ্যে আজও কয়েকটা আছে), তখন টিভি ছিল না সিনেমা হল গুলোতে অসম্ভব
ভীড় হ’ত, তেমন কোন ভাল ছবি হলে ২টাকা
দশ পয়সার টিকিট দশ বারো টাকায় পযর্ন্ত ব্ল্যাক হ’ত সেই সময় আমি গ্লোব, মেট্রো, নিউ এম্পায়ার, লাইট
হাউস এই সব হল গুলোতে ষাট সত্তরের দশকের বিখ্যাত সব হলিউডের সিনেমাগুলো দেখে
নিয়েছিলাম। যেমন, গানস অফ নাভারন, হাটারি,
বর্ন ফ্রী, সামার অফ ফরটিটু, কিংস সলোমনস মাইন আর সে যুগের হলিউড কাপাঁনো সুন্দরী মেরিলীন মনরোর ‘সেভেন ইয়ার ইচ’ ইত্যাদি।
তখন ওই সব
হলে বছরে একটা দুটো করে হিন্দি কিম্বা বাংলা ছবিও দেখানো হোত। আমি মেট্রো হলে
ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কো ও
গপ্পো’ দেখেছিলাম, ছবিটিতে দেবব্রত
বিশ্বাসের গলায় “কেন চেয়ে আছো গো মা......” গানটির প্রয়োগ অসাধারণ। আর গ্লোবে মুক্তি পেয়েছিল মিঠুনের প্রথম ছবি “মৃগয়া”, মৃনাল সেনের অসাধারন এই ছবিটিতে মিঠুনের
অভিনয় দেখেই বুঝেছিলাম যে মিঠুন চক্রবর্তী চলচিত্র জগতে স্থায়ী ভাবে থাকবার জন্যই
এসেছে। অনাদির মোঘলাই-এর উলটো দিকে এখন যেখানে একটা বিগ বাজার না কি যেন হয়েছে
ঐখানে তখন ছিল ‘ইউ এস আই এস’ বা
আমেরিকান লাইব্রেরী, সন্ধ্যে বেলায় সময় কাটানোর জন্য আমি
ওখানকার মেম্বার হয়ে গেলাম। ঠান্ডা ঘরে বসে বিনা পয়সায় আমেরিকার খবরের কাগজ,
পত্র পত্রিকা এসব তো পড়তামই উলটে একটা করে বই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এক
সপ্তাহ রাখা যেত। মেট্রো রেলের কাজের তখন সবে মাপ যোগ শুরু হয়েছে। মেট্রো সিনেমার উল্টো দিকে আমাদের মত জুনিয়র ইঞ্জিনিয়াররা থিয়ডোলাইট ও লেভেলিং যন্ত্র দিয়ে মাপ যোগ করে রেল পথের অ্যালাইনমেন্ট দিতেন...। আর জায়গায় জায়গায় মাটি পরীক্ষার কাজ চলছিল।
তবে চৌরঙ্গী
এলাকায় আমাদের সময় কাটানোর পক্ষে সবচেয়ে ভালো জায়গা ছিল ভারতীয় জাদুঘর। জাদুঘরে ঢুকতে তখন টিকিট কাটতে হ’ত না আর তখন তো সিক্যুরিটি চেকের কোন
ব্যাপারই ছিল না। আমরা সটান ভিতরে ঢুকে সামনের লনটায় বসে গল্প করতাম। ঐ শুখনো
হাড়গোড় প্রতিদিন আর কত দেখবো ? তার চেয়ে পাশের আর্ট কলেজের
ছাত্র ছাত্রীরা ওইখানে বসে ছবি আঁকতো আর আমরা তাদের ছবি আঁকার পদ্ধতি দেখতাম,
একবার আমাকে মডেল করে একটি মেয়ে আমার একটা সুন্দর পেন্সিল স্কেচ করে
দিয়েছিল, কালের স্রোতে সেটা কোথায় হারিয়ে গেছে। আমার আসে
পাশে এত সুন্দর দেখতে লোক থাকা সত্ত্বেও আমাকে কেন মডেল বাছা হয়েছিল আকারে ইঙ্গিতে
সেটাও জেনেছিলাম সেদিন। অল্প বয়সে আমি বেশ রোগা ছিলাম, এবং
ভরাট গোলগাল নিটোল মুখের চেয়ে এই ধরনের শীর্ণ বলিরেখা সমন্বিত মুখের স্কেচ নাকি
ভালো হয়। যাক এই পৃথিবীতে কোন কোন জায়গায় অন্তত কুশ্রী দেখতে লোকেদেরও কদর আছে এই কথা ভেবে সেদিন বেশ ভালো লেগেছিল। পরবর্তিকালে একটা ফটোগ্রাফি স্টুডিওতে
একটা সুন্দর পোস্টার দেখেছিলাম, “”THERE IS
NO BODY UGLY IN THIS BEAUTIFUL WORLD””
এই কর্পোরেশান-এ চাকরি করার সময়
খুব কাছ থেকে কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিকে দেখার সুযোগ হয়েছিল, একদিন শুনলাম পৃথিবী বিখ্যাত গোল কিপার লেভ
ইয়াসিন কলকাতায় এসেছেন, কর্পোরেশান থেকে ওনাকে সংবর্ধনা
দেওয়া হবে। কর্পোরেশান এর ভিতরে লনে ডায়াস বাধা হয়েছে। যথাসময় লেভ ইয়াসিন এলেন
তিনি রাশিয়ান ভাষায় কি সব বললেন, আর একজন সেটার বাংলা তরজমা
করে দিলেন, আমরা খুব কাছ থেকে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলাম। তবে
কর্পোরেশান এমন একটা জায়গা যে সবাইকে তাদের বাড়ি ঘরের টাক্স, বা হেয়ারিং-এর জন্য আসতে হ’ত। সেই কারনে অনেক ফুটবলার বা চলচিত্র শিল্পী-কে মাঝে মাঝেই
দেখতে পেতাম। কিন্তু প্রায় এক মাস চাকরি করার পর একদিন আমি আর আমার ওই বাঁশদ্রোনীর বন্ধু সজল সিড়ি দিয়ে নামছি ঠিক সেই সময় একজন বেশ
সুপুরুষ চেহারার ব্যাক ব্রাশ করা চুল, সাদা ধুতি ও সাদা হাফ শার্ট পরা কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরা এক ভদ্রলোক
আমাদের উপর তলা থেকে আমাদের পাশ দিয়ে নেমে চলে গেলেন।
সজল আমাকে কনুই দিয়ে খোচা দিয়ে
ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলো, “কে নেমে গেল
বলতো?” আমি বললাম,”হাঁ, চেনা চেনা মনে হচ্ছে।” সজল বললো, “দূর বোকা, চিনতে পারলি না? উনি
বিখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সাগর সেন।” সেই দিনই প্রথম
জেনেছিলাম যে সাগর সেন ঐ একই বিল্ডিং এ তিন তলায় এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে চাকরি
করেন। এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলি, তখন হগ বিল্ডিং আর মেন
বিল্ডিং ফ্লাই ওভার দিয়ে জোড়া ছিলনা, একদিন একটা কাজে আমি
আমাদের হগ বিল্ডিং থেকে মেন বিল্ডিং এ যাচ্ছি, এমন সময় দেখি
সে যুগের বিখ্যাত আভিনেতা হরিধন মুখার্জি, টিপিক্যাল সিনেমাতে
যেমন ওনাকে দেখা যায় ঠিক সেই রকমই একটি অতি সাধারণ খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবী, পায়ে চটি এবং বগলে সেই বাঁশের বাটের ছাতা, গেট দিয়ে
বেরিয়ে যাচ্ছেন, আমি আগেই শুনেছিলাম যে উনি কর্পোরেশান এ
চাকরি করেন, তবে আমি যখন ওনাকে দেখেছিলাম তখন বোধ হয় উনি
সদ্য অবসর নিয়েছেন। শহরের হাজারও ভিড়ের মধ্যে দিয়ে উনি একা হেঁটে চলেছেন কেউ ফিরেও
তাকাচ্ছে না, অথচ আমার মনে হল আমি আজ ঈস্বর দর্শন করলাম।
আজকাল দেখি পাড়ায় পাড়ায় দামী গাড়ি
চেপে দুর্গা ঠাকুর উদ্বোধনে আসা সিরিয়াল-এর এক শ্রেনীর বস্তা পচা নায়ক নায়িকা দের
নিয়ে কত হ্যাংলামী করা হয়, তাদের নামের আগে
কত বিশেষণ যোগ করা হয়। অথচ একবার ভেবে
দেখুন তো দেখি সত্যজিৎ থেকে শুরু করে সেই সময়ের সমস্ত পরিচালক দের অসংখ্য ছবিতে
দাপিয়ে অভিনয় করা হরিধন বাবুরা কোন দিন তাদের প্রতিভার সামান্য মূল্য টুকুও পাননি, একবার মনে করুন তো ফুলেশ্বরী ছবির সেই
দৃশ্যটা...। নিজের গলায় গাইছেন.... “আমি তোমায় বড়
ভালোবাসি......তোমায় বড় ভালো বাসি...।” আমি ঢিপ করে ওনার
পায়ে হাত দিয়ে একটা প্রনাম করে উঠে দাড়াতেই উনি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে
জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কে বাবা ?” আমি
আমার পরিচয় দিতেই তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “সেই জন্যই তুমি
আমাকে প্রনাম করলে, আসলে কলকাতার জল এখনো সেভাবে তোমার পেটে
পড়েনিতো? তুমি ভালো থাকো বাবা, সুখী হও”,
এ কথা বলে তিনি সোজা মতি শীল স্ট্রিট ধরে ধর্মতলা স্ট্রিট এর দিকে চলে গেলেন। তখন ও
ধর্মতলা স্ট্রিট লেনিন সরণী হয়নি। আর আমি এক দৃষ্টিতে ওনার
যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম যে একটা মানুষের মনের ভিতরে কতটা ক্ষোভ জমে থাকলে
তবে এই কথা বলেন? এখন তো সিরিয়াল
বা সিনেমাতে শ্রেষ্ঠ জেঠামশাই, শ্রেষ্ঠ পিসেমসাই, শ্রেষ্ঠ ড্রাইভার শ্রেষ্ঠ ননদ রাও পুরস্কার পাচ্ছেন, ট্রফি আর লক্ষ লক্ষ টাকা। অথচ হরিধনবাবুরা
কোন দিন সামান্য একটা পাড়ার ক্লাব থেকেও সংবর্ধনা পান নি।
শিয়ালদার হোটেল থেকে আমার অফিসে
যাওয়ার সময় বাসেই যেতাম, কিন্তু ফেরার সময়
প্রতিদিনই ধমর্তলা স্ট্রিট কিম্বা এস এন ব্যনার্জ্জী রোড দিয়ে একা একা হাঁটতে
হাঁটতে ফিরতাম। শিয়ালদা থেকে ধমর্তলা পর্যন্ত বাসের ভাড়া ছিল ১০ পয়সা, ওটাই ছিল তখন বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া।
ধমর্তলা থেকে ওয়েলিংটন পর্যন্ত বেশ দোকান বাজার অফিস পাড়ার মত, কিন্তু ওয়েলিংটনের পরেই তালতলা এলাকাটা ছিল
কেমন যেন উত্তর কলকাতার রক কালচারের মত এলাকা। এক টাও দোকান বাজার নেই, দোতলা তিনতলা পুরানো দিনের বাঙ্গালীদের বাড়ী, মাছ
ভাজার গন্ধ, একটু গলিতে ঢুকলেই রকে বসে বাঙ্গালীদের উত্তম
কুমার কিম্বা মোহনবাগান চর্চ্চা। ওয়েলিংটনে তখন একটা কুস্তির আখড়া ছিল, ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কত দিন কুস্তি দেখেছি। ওয়েলিংটনের ঠিক আগে একটা চার্চের
সামনে ফুটপাথে দু-তিনটে পুরানো গ্রামফোন রেকর্ডের দোকান ছিল, আর তার কিছুটা আগে এখন যেখানে পিয়ারলেস মারকেট হয়েছে সেখানে কমলালয় নামে
একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল।
ওই এলাকাটায় এলেই আমার অনেক
পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে যেত। তখন আমি বেশ ছোট, আমরা থাকতাম বসিরহাট থেকেও কিছুটা দূরে
তেতুলিয়া বলে একটা গ্রামে। ইছামতীর ধারে সেই ছোট্ট আমাদের গ্রাম, আমাদের কোয়ার্টারটা ছিল ভারী সুন্দর। বৃটিশ আমলে তৈরী, ভিতরে সেই যুগের সকল সুযোগ সুবিধা সহ পাকা বাড়ি কিন্তু, উপরের চালটা ছিল খড়ের। শুনেছি বৃটিশরা এই গরমের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার
জন্য গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের মোটা খড়ের চালের বাড়ি নির্মাণ করতেন। আর বাড়ির দুইদিকে জল। একদিনে কল্লোলিনী ইছামতি, আর একদিকে ঐ নদী থেকে বেরিয়ে সেচ বিভাগের
একটি ক্যানাল কয়েক মাইল দূরে বিলবল্লীর বিলে গিয়ে পড়েছে। নদী থেকে বেরোনর মুখেই
একটা লক গেট ছিল, সেই গেট খোলা-বন্ধের মাধ্যমে নদী থেকে কতটা
জল বিলে ঢোকানো হবে তা নিয়ন্ত্রণ করা হত। ওই নদী আর খালের সংযোগ স্থলে ওই দারুণ সুন্দর
বাড়িটিতে থাকতাম আমরা। আমার প্রথম স্কুলে যাওয়াও ওই গ্রামে থাকার সময়।
আমাদের প্রাইমারী স্কুলটার সেই
অর্থে বাড়ি বলে কিছু ছিল না। একটা মাটির মেঝের উপর কয়েকটা বাঁশের খুটি আর তার উপর
একটা খড়ের চালা। প্রতিদিন সকালে আমরা পালা করে স্কুল ঝাঁট দেয়া জলের কলশিতে জল ভরে রাখা এসব কাজ করতাম। ক্লাশ চলাকালীন
পড়া না পারলে আমাদের শাস্তি ছিল মাস্টার মশাইকে হাত পাখা দিয়ে যতক্ষণ তিনি থামতে না বলবেন ততক্ষণ হাওয়া করে যেতে হবে। অবশ্য
মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতেন পা ব্যাথা করছে কিনা, তা হলে বসে বসেই হাওয়া করার পারমিশন ছিল। সেই ৭/৮ বছর বয়সে আমার অনেক
সমবয়সি বন্ধু হয়েছিল আর সারাদিন আনন্দ করে খেলা ধুলো করে হৈ হৈ করে বেশ সময় কেটে
যেত। আমাদের পাশের বাড়িতে আমার বাবার এক সহকর্মী ছিলেন তাঁর অনেকগুলি সন্তান ছিল ,
ওই বাড়ির ১০/১২ টি ভাই বোনের মধ্যে ছোট ২/৩ টি ভাই বোন আমার সব চেয়ে
কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। হটাৎ ধর্মতলা থেকে এই অজ পাড়া গায়ে এলাম কেন সেটা এবার
বলি।
এই গ্রামে থাকা কালীন বাবা একদিন অফিসের
কাজে কলকাতায় এসে বাড়ি ফেরার সময় ধর্মতলা স্ট্রীটের ওই কমলালয় স্টোর্স থেকে ৯৯
টাকা দিয়ে একাটা গ্রামোফোন (তখন আমরা গ্রামের লোকেরা বলতাম কলের গান) কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন আর সঙ্গে সেই সময়ের ৭৮ আর পি এমের
কিছু রেকর্ড। দুপুর বেলায় সংসারের সব কাজ সারা হলে আমার মা একটি গল্পের বই নিয়ে খাটে
এমন ভাবে শুতেন যে তাঁর আজানুলম্বিত কেশ ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ত। আমার মায়ের গায়ের
রং ছিল পাকা কামরাঙ্গা ফলের ন্যায়, আর সদ্য ভাত খেয়ে উঠে তার ঐ তাম্বুল চর্চিত লাল ওষ্ঠদ্বয়
সমন্বিত মা কে ঠিক যেন মা দুর্গার ন্যায় লাগতো। তখন আমার ডিউটি ছিল ওই দম দেওয়া
কলের গান চালিয়ে মায়ের ফরমাস মত মাকে গান শোনানো। মাত্র গুটিকয় রেকর্ড, কে সি দে ও কমলা ঝরিয়ার কীর্ত্তন, নবদ্বীপ হালদারের
কমিক, আর সুরাইয়া, লতা, সামসেদ বেগম এদের গাওয়া কয়েকটি হিন্দি গান, আর পঙ্কজ
মল্লিকের কয়েকটি রবীন্দ্র সংগীত। সেই যুগে ওই রকম একটা গ্রামে গ্রামোফোন তো দূর অস্ত কারো বাড়িতে
একটা রেডিও ও ছিল না। তাই সন্ধ্যার দিকে অনেকে আমাদের বাড়িতে এসে গান শোনার জন্য
অনেকে বায়না করতেন এবং বেশিরভাগ সময়েই তাদের সেই অনুরোধ রক্ষিত হত।
(ক্রমশঃ)